সাতকাহন পর্ব-(৩)-সমরেশ মজুমদার

সাতকাহন

‘আমার কিছু প্রয়ােজন হলে আপনাকে খবর দেব ভাবছেন কেন ? 

‘মেমসাহেব । আপনি কি এদের জন্যে কাজ করতে চান না আপনার আগের লােকদের মত চোখ বন্ধ করে থাকবেন ? যদি কাজের ইচ্ছে থাকে তাহলে এই শমা আপনার উপকার করতে পারবে। বি ডি ও সাহেব তাে বটেই, ডি এমের কাছে কোন ফাইল আটকে থাকলে আমাকে বলবেন এক দিনেই কাজ হয়ে যাবে। আচ্ছা, অনেক বিরক্ত করলাম, এবার আপনি আরাম করুন, আমি চলি। দবজার দিকে কথা শেষ করেই এগিয়ে গেল আচমকা অৰ্জুন। হঠাৎ কি মনে হল দীপাবলী ডাকল, ‘শুনুন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। কাল নাকি নেখালি গ্রামে খুব গণ্ডগােল হয়েছে, কি ব্যাপার আপনি কি কিছু জানেন ? 

চোখ বড় করল অর্জুন ঘুরে দাঁড়িয়ে, কিছু না, আমি বলেছি ছেলেদের আর কাজে লাগাবাে না। ফাঁকি মারে কাজ কম হয়। এবার থেকে মেয়েদরেই কাজ দেব, তাই! ও হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলতে একদম ভুলে গিযেছি। একটা নয়, দুটো। প্রথমটা, আপনার এস ডি ও সাহেবের সঙ্গে আজ সকালে দেখা হয়েছিল। তাঁর পেট খারাপ, আসতে পারবেন না আজ । আর দ্বিতীয়টা হল,পােস্ট অফিসের পিওন আসছিল আপনার টেলিগ্রাম নিয়ে। আমি আসছি বলে বেচাবাকে কষ্ট দিলাম না, নিন। 

টেলিগ্রামটা দীপাবলীর হাতে ধবিয়ে দিয়ে অর্জুন মাথা ঝুকিয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই তার গাড়ির শব্দ হল। দীপাবলীর ঘাের কাটতে সে টেলিগ্রামটার দিকে তাকাল। 

সাতকাহন পর্ব-(৩)

টেলিগ্রামটা ছিড়ল দীপাবলী। এর আগে কখনও তাব নামে কেউ টেলিগ্রাম পাঠায়নি। কৌতুহল ছিল তাই। শমিতের নামটা দেখে সে ভূ কোঁচকালাে। শমিত লিখেছে সে আসছে। কেন আসছে, কি জন্যে এবং কতদিন থাকবে তার বিশদ লেখার প্রয়ােজন বােধ করেনি অথবা পয়সা বাঁচিয়েছে। সে যে এখানে আছে তা একমাত্র অমলকুমার ছাড়া কাউকে ও জানায়নি। তাহলে শমিত কি করে ঠিকানাটা পেল ! টেলিগ্রামে ওর আসার দিনও উল্লেখ করা নেই। 

দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এল দীপাবলী। তিরি কাছেপিঠে নেই। বাড়ির প্রতিটি জানলা বন্ধ। বাইরে এখন সূর্যের কড়াই থেকে যেন লাভা ঝরছে। শরীরে জামাকাপড় রাখতে ইচ্ছে করে না। শাড়ি পর্যন্ত তেতে উঠেছে। বাঁচোয়া এই যে তেমন ঘাম হয় না। গলা তুলে দীপাবলী ডাকল, “তিরি, এক গ্লাস জল দে। | তিরি এল মিনিট দেড়েকের মধ্যেই। জল দিয়ে হাসল। সেটা গলায় ঢেলে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, আজ জল তুলে রেখেছিস ? 

‘আজ কেন তুলব ? কাল তুলেছি। ঘােলা জল ছিল হেঁকে ফুটিয়ে কপূর দিয়ে রেখেছি। কেন, কপূরের গন্ধ পেলে না ? 

‘পেয়েছি। তুই এমন চমৎকার বাংলা শিখলি কোখেকে ? ‘শিখে গিয়েছি। 

“আচ্ছা, যদি একদিন দেখি বুয়ােতে এক ফোঁটা জল উঠছে না তাে কি করবি? 

‘তুমি ছুটি নেবে আর আমি তােমার সঙ্গে এখান থেকে চলে যাব।

হাসল তিরি, না দিদি, এই কুয়াের জল কখনও শুকোয় না।

সাতকাহন পর্ব-(৩)

‘তাহলে ওরা নিতে এলে আপত্তি করেছিলি কেন ? দু’জনের জল দুশাে জন নিলে থাকবে ! দিদি, ও তােমাকে কি বলল ? দীপাবলীর মনে পড়ল, হ্যাঁ, তুই অর্জুন নায়েককে দেখে আমাকে বাইরে বেরুতে মানা করছিলি কেন ? ব্যাপারটা কি ? 

মাথা নাড়ল তিরি, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি মেমসাহেব।’ ‘তার মানে ? ‘মেমসাহেব বলে ও তােমাকে কিছু বলল না। ‘খুলে বল তাে, হেঁয়ালি করিস ন। ‘আগে পাশের যত গ্রাম আছে ভাল মেয়ে দেখলেই ও কাজ দেবার নাম করে বদমায়েসি করে। সবাই জানে কিন্তু কেই কিছু বলতে পারে না। 

দীপাবলীর চোয়াল শক্ত হল। অর্জুন নায়েকের কিলবিলে হাসিটা মনে পড়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা কবল, তােকে কিছু বলেছিল ? 

‘সেইটাই তাে আসল ব্যাপার। মাথা নাড়ল তিরি, ‘দাঁড়াও, আসছি রান্নাঘর থেকে। 

দীপাবলী হতাশ হল । সে খাটে শরীর এলিয়ে দিল।

মেয়েটাকে কোন প্রশ্ন করলে সরাসরি জবাব পাওয়া যায় না। ওয়ার্কিং গার্লস হােস্টেলে বনানীদির স্বভাবের কিছুটা পেয়েছে ও।

বিকেলে বনানীদি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বললেন, ‘উঃ, আজ যা কাও হয়েছে তােকে কি বলব ? প্রথমদিকে দীপাবলী ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞাসা করত, কি হয়েছে ? 

সাতকাহন পর্ব-(৩)

‘আর বলিস না। সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর দেখি মাথা ধরেছে। চা খেলাম অ কমল না। খবরের কাগজ পড়লাম। সুজাতা বলল মাথা ধরার ট্যাবলেট খেতে। আমি আবাব ওসব খেতে পারি না। সাততাড়াতাড়ি স্নান করে খেয়েদেয়ে খুলে গেলাম। গিয়ে শুনি আমাদের এক কলিগ স্বপ্নার কাল রাত্রে বাচ্চা হয়েছে। খুব শখ ছিল ছেলের, হল মেয়ে। ওর কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। তবে স্বপ্ন এত রােগা যে ভালয় ভালয় হয়েছে এই ঢের। 

‘কি কাণ্ড হয়েছে বলছিলেন না ? ‘হ্যাঁ বলছি। দুপুরে হেড মিসট্রেসের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। আমাদের স্কুলে আবার মেটানিটি লিভ নেই। পুজোর ছুটি গরমের ছুটি তার ওপর নাকি মেটার্নিাট লিভ দেবেন 

বললেন এমনভাবে প্ল্যান করুন যেন ছুটির সময় বাচ্চা হয়। বােঝ। দীপাবলী হেসে ফেলল, তারপর ? ‘তুই হাসছিস ? কিরকম কাণ্ডজ্ঞান দ্যাখ! ছুটির পর ভাবলাম আমার এক মাসতুতাে বােনের বিয়ে হয়েছে গড়পাড়ে, ঘুরে আসব। গেলাম। ও তাে খুব খুশি। ওর বরের নাকি নিউ মার্কেটে দোকান আছে। যাবি একদিন ওখানে ? 

‘যেতে আপত্তি কি। কিন্তু কাটা। ‘হ্যাঁ, তা ওখানেই বােনের ভাশুরের সঙ্গে আলাপ হল। তার বউ মারা গিয়েছে বিয়ের পরের বছর। মাথায় বিশাল টাকা পয়তানিশ বছর বয়স। পেটের গােলমালে ভােগে। অনেক খরচ করেছে কমেনি। তা আমি বললাম গ্রে স্ত্রী একজন হােমিওপ্যাথ আছেন আমাদের মণিকার পেটের অসুখ সারিয়েছিলেন। তাই শুনে এমন ধরল যে ওকে নিয়ে 

যেতে হল সেই ডাক্তারের কাছে । আমি তাে মণিকার সঙ্গে কয়েকবার গিয়েছিলাম । ওষুধ-টষুধ নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল আমাকে হােস্টেলে। 

সাতকাহন পর্ব-(৩)

‘এইটে তােমার কাণ্ড ? ‘দূর ! তা কেন হবে ? ‘তাহলে ? ‘ভদ্রলােকের স্ত্রী, যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি নাকি আমাদের হেড মিসট্রেসের বােন, ব্যাপারটা ভাব । সেই বােন যদি বেঁচে থাকত তাহলে মানুষটার অবস্থা কি হত? 

দীপাবলী কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি। বনানীদি যদি শ্যামবাজারের কথা বলতে আসতেন তাহলে বালিগঞ্জ থেকে শুরু করতেন।

এবং যে-কোন বিষয়েই কথা বলতে গেলে একবার না একবার হেডমিসট্রেস চলে আসতেনই। 

খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে দীপাবলী ডাকল, “তিরি! 

তিরি দূর থেকে সাড়া দিল। তারপর তার পায়ের আওয়াজ ঘরে এল। দীপাবলী বলল, ‘শােন, তােকে আমি যখন যা প্রশ্ন করব তখনই তার উত্তর দিবি । ফেনাবি না।’ 

‘আমি তাে উত্তর দিই! সরল গলায় বলল তিরি।। ‘তােকে অর্জুন নায়েক কি বলেছিল ? ‘ও, ওই কথা ! না, শুনলে তুমি রাগ করবে।’ ‘আবার ? ‘মানে, আমার যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন চার চারটে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল। নেখালি থেকে না। যেসব গ্রামে বৃষ্টি হয়, চাষবাস কবা যায় সেইসব গ্রাম থেকে। বাবার তাে পয়সা ছিল না যে বিয়ে দেবে। তারা সবাই বলল অর্জুনবাবুকে গিয়ে ধর।

একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে । বাবা গেল। অর্জুনবাবু বলল, “আগে তােমার মেয়েকে চোখে দেখি তারপর বিয়ের খরচ দেব ? তাই শুনে মা কিছুতেই রাজি নয়। এগ্রামের মেয়েদের চেহারা ভাল না বলে ডাক পড়ে না। কিন্তু অন্য গ্রামের মেয়েরা নাকি হপ্তায় একদিন অর্জুনের কাছে কাজের নামে গিয়ে থাকে। একজনের পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, অর্জুনবাবু নেখালির একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা নেখালিতে আসার পরের রাতেই গলায় দড়ি দেয়। তাই মা আমাকে পাঠাল না।

 

Read more

সাতকাহন পর্ব-(৪)-সমরেশ মজুমদার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *