পনাদের সােজাসাজ বুঝতে পারিনি আসবেন কি না, অসুস্থ শুনলাম ? ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি সুধীর গুপ্তয়া, সাউথ ডিস্ট্রিক্টের এস ডি ও। আমারই ব্যাচমেট। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলােক দুহাত জোড় করে নমস্কার করলেন, আপনার কথা আগেই শুনেছিলাম। আপনার মত সুন্দরী মহিলা এই চাকরিতে আছেন ভাবাই যায় না !
‘কেন ? চাকরি বুঝি অসুন্দরী মহিলাদের জন্য ? | ‘না, না, সুন্দরীরা সাধারণত পটের বিবি হন। এত খাটাখাটুনির চাকরি তাদের সহ্য হয়।
আমি এটাই মিন করতে চেয়েছি। দীপাবলী হাসল, ‘তাহলে বলব আপনার দেখার পরিধি বেশী বড় নয়।’ | এইসময় তিনটে গাড়ি ছুটে এল। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এস ডি ওরা এগিয়ে গেলেন ব্যস্ত হয়ে। গাড়ি থেকে মন্ত্রী, ডি এম নামলেন। দীপাবলী দেখল মন্ত্রীর বয়স হয়েছে কিন্তু খাদির পাঞ্জাবি ও ধুতিতে বেশ সৌম্য দেখাচ্ছে তাঁকে। পুলিশের সুপারও ছিলেন পেছনের জিপে। অফিসাররা সবাই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন তাঁদের সারির মধ্যে দিয়ে নমস্কার করতে করতে মন্ত্রীমশাই ডি এম-কে নিয়ে সার্কিট হাউসে ঢুকে গেলেন বিনা বাক্যব্যয়ে।
মিনিট চারেকের মধ্যে মিটিং আরম্ভ হল। মন্ত্রী এবং ডি এম বসেছেন ঘরে একদিকে, এপাশে অফিসাররা। দীপাবলী দ্বিতীয় সারির এক কোণে বসে শুনছিল। ডি এম ভূমিকা করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘না, না, কথা বাড়ানাের দরকার নেই। আপনাদের সােজাসুজি কিছু কথা বলি ।
সাতকাহন পর্ব-(৫)
এই জেলায় খরা যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। বৃষ্টি হয় না তাই চাষবাসও হয় না। কৃষকরা খুব কষ্টে বেঁচে আছেন। আমরা অবশ্য তাঁদের নানারকম সাহায্য করি তা আপনারা জানেন। কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে যাতে এই এলাকায় চাষবাস হয়। এ ব্যাপারে আপনাদের আরও বেশী পরিশ্রম করতে হবে। আর চাষ ছাড়া ওদের হাতে শ্রমের বিনিময়ে যাতে কিছু পয়সা আসে, নিয়মিত রােজগার করে যেতে পারে তার জন্যে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।
মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বারংবার বলেছেন কৃষকরাই হল ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবরকম চেষ্টা করা উচিত। মন্ত্রী হাত বাড়িয়ে মাস তুলে নিয়ে দুটো চুমুক দিলেন, ‘জল। এই জেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জলের অভাব। ঈশ্বর এই জেলাকে মেরে রেখেছেন কোন বড় নদী না দিয়ে জল ছাড়া চাষবাস করা সম্ভব নয়। আমাদের ভাবতে হবে কিভাবে শুধু বছরের দু’তিন মাস নয় বরা মাস ফসল ফলানাের ব্যবস্থা এখানে করা যায়। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে অনেকরকম গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন। দুশাে বছর ধরে ইংরেজরা শুধু ভারতবর্ষের গরিব কৃষকদের শােষণ করেছে কিন্তু তাদের উন্নতির কোন চেষ্টাই করেনি।
আমরা জনগণের নির্বাচিত সরকার, তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের হাত হল আপনারা। আপনারাই পারেন গান্ধীজী, জওহরলালের স্বগের ভারতবর্ষকে বাস্তবে নিয়ে আসতে। বন্দেমাতরম। মন্ত্রী বসে পড়লেন। পকেট থেকে সাদা মাল বের করে কপাল গলা মুছে ডি এমের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালেন। | ডি এম নিচু গলায় তাঁকে কিছু বলতে তিনি বাঁ হাত উল্টে সম্মতি দিলেন। ডি এম উঠে দাঁড়ালেন, ইংরেজিতে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী মহাশয় অত্যন্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও এখানে এসে আমাদের যা বললেন তা নিশ্চয়ই স্মরণে রাখব। তবে আপনারা যারা এই জেলার সর্বত্র হয় না। কৃষকরা পরিকল্পনা নেওয়া।
সাতকাহন পর্ব-(৫)
ছড়িয়ে আছেন তাঁরা যদি কোন সমস্যার কথা বলতে চান তা লিখিতভাবে আমার কাছে পাঠালে আমি নিশ্চয়ই কলকাতায় মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়ের দপ্তরে পাঠিয়ে দেব।‘
হঠাৎ মন্ত্রী বলে উঠলেন, ‘স্পেশ্যাল কিছু সমস্যা আছে না কি?
অফিসাররা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। মন্ত্রী বললেন, “চিঠি চাপাটিতে সময় নষ্ট না করে বলে ফেলুন এখানে। আপনি বলুন ভাই ? দীপাবলী দেখল সামনের সারিতে বসা তার এস ডি ওর দিকে ইঙ্গিত করছেন মন্ত্রী। তিনি খুব নার্স ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন, স্যার, অ্যাজ সাচ তেমন কিছু প্রব্লেম নেই, শুধু গরম ছাড়া। সবাই হাে হাে করে হেসে উঠলেন। মন্ত্রীমশাইও সেই হাসিতে যােগ দিয়ে বললেন, এ ব্যাপারে সরকারের তরফে কিছু করার নেই।
ঈশ্বরের ওপর আমাদের কোন কন্ট্রোল নেই যে তাঁকে কথা শুনতে বাধ্য করব। সিট ডাউন প্লিজ। এস ডি ও বসে পড়লেন। ডি এম তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাহলে আমরা এখানেই আজকের আলােচনা শেষ করছি। মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়কে জেলার পক্ষ থেকে এখানে আসার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল দীপাবলী। তার এস ডি ওর এইরকম হাস্যকর মন্তব্য শােনার পর সে ঠিক করল উঠে দাঁড়াবে। ডি এম কথা বলতে শুরু করা মাত্র সে তার হাত উঁচুতে তুলেছিল। কথা শেষ করে ডি এম সেটা দেখতে পেলেন। আলােচনা সভা শেষ হয়েছে ভেবে সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছিল ডি এম দু‘হাত শূন্যে তুলে সবাইকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। দীপাবলী দেখল সবাই এখন তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। ডি এম বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনি কিছু বলতে চাইছেন ?
সাতকাহন পর্ব-(৫)
দীপাবলী উঠে দাঁড়াল, হ্যাঁ। ‘আপনি কোন ব্লকে আছেন ?
দীপাবলী উত্তর দিল। মন্ত্রী কিছু বলল ডি এমকে। তিনি মাথা ঝুঁকিযে সেটা শুনে হাসলেন। তারপর ইঙ্গিত করলেন দীপাবলীকে বলতে।
দীপাবলী হাতের ফাইলটা খুলল। তারপর বিনীত গলায় বলল, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়, মাননীয় ডি এম । আমি খুব অল্প দিন হল এই জেলায় বদলি হয়ে এসেছি। যে এলাকায় আমাকে কাজ করতে পাঠানাে হয়েছে তার অবস্থা দেখে আমি শিউরে উঠেছি। স্বাধীনতার পর পনের বছর হতে চলল আমরা শাসনে এসেছি কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি এখানকার মানুষদের বেঁচে থাকাব ন্যূনতম সুযােগসুবিধে আমরা দিতে পারিনি।
হঠাৎ একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। দীপাবলী অস্বস্তিতে পড়ল। মন্ত্রী মহাশয় হাত তুলে ইঙ্গিত করলেন সবাইকে চুপ কবতে। দীপাবলী একটু নাভার্স হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ জেদের বশে সে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি আন্দাজ করতে পারছিল না। তবু এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোনাে কারণ নেই। সে বলল, আমার এলাকায় বৃষ্টি হয় না বললেই ঠিক বলা হয়। বছরের একটা সময় জল এতে নিচে চলে যায় যে কুয়াে নতুন করে খোঁড়াতে হয়।
আমি নেখালি নামের একটি গ্রামের ছবি মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়ের সামনে তুলে ধরতে চাই। নেখালি গ্রামে বাহান্নটি পরিবার কোনােমতে টিকে আছে। মাটি পাথর হয়ে গিয়েছে তাই চাষ হয় না। কোনরকম গাছপালা নেই। গ্রামে কোন কুয়াে বা নলকূপ নেই। কয়েক ক্রোশ দূর থেকে জল নিয়ে আসে তৃষ্ণা মেটানাের জন্যে।
সাতকাহন পর্ব-(৫)
স্নানের কথা বছরে এক দুদিনের বেশী ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে দিনমজুরি করে এরা যে পয়সা পায় তাই দিয়েই কোন মতে বেঁচে থাকে। কেন বেঁচে আছে তা এরা নিজেরাই জানে না। নেখালির প্রায় প্রতিটি মানুষ কমবেশী অসুস্থতায় ভুগছে। তবে চর্মরােগ ওদের মধ্যে ব্যাপক। আমি এদের দিকে তাকালে কোন ভারতবর্ষকে দেখতে পাব ? আমরা এদের জন্যে আজ পর্যন্ত কি করেছি ? দীপাবলী থামতেই মন্ত্রী মশাই বললেন, আপনি কি সরকারকে অভিযুক্ত করছেন ?
সাতকাহন পর্ব-(৫)
সমস্ত ঘর মুহুর্তেই নিঃশব্দ হয়ে গেল । দীপাবলী মাথা নাড়ল, না, আমি একজন কর্মচারী হিসেবে সরকারের অঙ্গ। সত্যিকারের ছবি তুলে ধরছি।
‘কিন্তু আমি আপনার গলায় কম্যুনিস্টদের সুর পাচ্ছি।’
দীপাবলী থমকে গেল। তারপর বলল, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়, আমি রাজনীতির ধারে কাছে থাকি না। যা সত্যি তাই বলছি।
এবার ডি এম, এস ডি ওর দিকে তাকালেন, আপনার বক্তব্য কি ?
এস ডি ও বললেন, ‘মিসেস ব্যানার্জী আমাকে অবশ্য নেখালির কথা বলেছিলেন । সমস্যা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার মনে হয়েছিল মহিলারা একটু বেশী ভাবপ্রবণ হন।
Read more