সাতকাহন পর্ব-(৯)-সমরেশ মজুমদার

সাতকাহন

কি জানি ‘ ঠোঁট উল্টালাে তিরি, হাতে ব্যাগ ছিল । তুমি নেই শুনেও দাঁড়িয়েছিল। আমি দরজা খুলিনি। তখন বলল ঘুরে আসছে। | ‘তিরি সঠিক কাজই করেছে । অজানা উটকো লােককে ঘরে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ ছিল। হাতমুখ ধুয়ে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, ‘কুয়ােয জল জমেছিল ? | ‘। পাঁচ বালতি তুলে রেখেছি।’ তিরি জিজ্ঞাসা করল, ‘চা খাবে তাে এখন ? আমি জল গরম করেই রেখেছি ! ‘খাব। আচ্ছা, লােকটাকে দেখতে কেমন রে ? 

লম্বা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা চেহারা।’ তিরি চলে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভেবে কোন কূল পেল না দীপাবলী ।। 

শমিত কেন এখানে এল ? ওর তাে এখানে, তার কাছে আসার কথা নয়। বুকের ভেতর একটা উত্তেজনা শিবিদ্ধ শুয়ােরের মত ছটফট করতে লাগল । সে নিজেকে বােঝাতে চাইল। অসম্ভব, শমিত তার কাছে আসতে পারে না । ওর আত্মমর্যাদা আছে। না, অসম্ভব। 

তিরি চা নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে তােমার ? মাথা নাড়ল দীপাবলী, ‘চা রেখে যা। ‘কিন্তু তুমি ঘামছ? ‘বললাম তাে চা রেখে যা। গলা ওপরে উঠল দীপাবলীর । 

খাটের পাশে টেবিলের ওপর কাপ রেখে তিরি চলে গেল ।

সময় লাগল নিজেকে শান্ত করতে।

প্রায় অসাড়েই চায়ের কাপ টেনে নিয়ে চুমুক দিল সে।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ঠোঁট জিভ যেন পুড়ে গেল।

চটপট কাপ নামিয়ে রেখে মুখে শব্দ করল দীপাবলী ।

চা যে গরম।

থাকবে সেটুকুও মনে ছিল না। 

সাতকাহন পর্ব-(৯)

দুটো বছর একা মানুষের জীবনে কতখানি তা ফেলে আসার অনেক পরে যেভাবে টের পাওয়া যায় তা যদি আগে বােঝা যেত ? কোন এক পণ্ডিত বলেছিলেন, পৃথিবীতে একটি মানুষের জীবনে ধরত্ন সম্পত্তির থেকেও মূল্যবান হল সময়। অথচ ঈশ্বর মানুষকে এমন মুখ করে রেখে দেন যে সে সেটা চলে যাওয়ার আগে বুঝতেই পারে না কি হারাচ্ছে ।এখন মাঝে মাঝে মনে হয় একটা জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেও মানুষ বুঝতে পারে না ঠিক কতটা সময় অপচয় করল সে। 

কিন্তু বেঁচে থাকা মানেই যদি অভিজ্ঞ হওয়া তাহলে অপচয়েরও নিশ্চয়ই একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণে জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করলে আর কোন আফসােস থাকে । ওয়ার্কিং গার্লস হােস্টেলের জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সেই দুটো বছর তার খুব খারাপ কাটেনি। অন্তত অভিজ্ঞ হয়েছে । 

পরীক্ষা পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটেনি যা দীপাবলীকে বিচলিত করতে পারত। জলপাইগুড়ির সম্পত্তির ব্যাপারে অমলকুমার সেখানকার বিখ্যাত উকিল, জীবনগতি বায়মহাশয়ের সঙ্গে থেকে সুরাহা করে দিয়েছিল যা দুটি বিখ্যাত সেবাপ্রতিষ্ঠানের নামে লিখে দিয়ে সমস্ত দায় থেকে মুক্ত হয়েছিল দীপাবলী । এবং এই ঘটনাটির জন্যে যাবতীয় আত্মীয়স্বজনের বিরাগভাজন হওয়াটাকে সে একটুও আমল দেয়নি। পরীক্ষার পর দীপাবলী একই সঙ্গে আই এ এস এবং ড বি সি এস পরীক্ষায় বসেছিল। আই এ এস পরীক্ষা দিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল তার পক্ষে কৃতকার্য হওয়া সম্ভব নয়। পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছিল। কিন্তু উরু বি সি এস পরীক্ষার দিন আচমকা সর্দিজ্বরে পড়ে গিয়েছিল। জ্বর গায়েই পরীক্ষা দেয় কিন্তু মনে হয়েছিল ফল খুব খারাপ হবে না। 

সাতকাহন পর্ব-(৯)

পরীক্ষার পর অখণ্ড অবসর। মায়ার সঙ্গে যােগাযােগ ছিলই। সে মায়াকে বলেছিল শমিতকে খবর দিতে দেখা করার জন্যে। তখন শমিত আসত কালেভদ্রে। তার প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় বসা শমিতের একদম পছন্দ ছিল না। শমিত দেখা হলেই জোর করত নাটকের দলে যােগ দিতে। তার ধারণা নাটকে অভিনয় করলে দীপাবলী অনেক ওপরে পৌছাতে পারবে । যে মেয়ে অল্প রিহার্সাল দিয়ে জীবনে নাটক সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও অত ভাল অভিনয় করতে পারে তার একমাত্র কাজের জায়গা এখানেই হওয়া উচিত। দীপাবলী একমত হয়নি কখনও। সে ইচ্ছে করেই ওর নাটকের দলে যেত না। একধরনের অস্বস্তি হত। | মায়াকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও শমিত দেখা করতে এল না। এমনটা সাধারণত হয় না।

বেশ কিছুদিন আগে শমিত দীপাবলীকে বলেছিল সে যদি ইচ্ছে করে তবে তার স্কুলে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে কাজ করতে পারে। পরে তার মনে হয়েছিল শমিত আলাপের সময় বলেছিল সে নিজেই ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে আছে। হয়তাে স্কুলের নিয়মিত শিক্ষক হওয়ায় কর্তৃত্ব তৈরি হয়নি বলে পরে এ নিয়ে আর কথা বলেনি। চাকরি বাকরি পাওয়ার আগে যদি স্কুলে সাময়িক পড়ানাের কাজ পাওয়া যায় মন্দ কি। টিউশনি এবং ব্যাঙ্কের সামান্য সুদে তার মােটামুটি চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে চারটের বেশি ভাল শাড়ি নেই তার। আটপৌরে ধরলে বড়জোর দশটা হবে। দুটোর রঙ উঠে গেছে অনেকটা। শাড়ির ওপর তার কখই আকর্ষণ ছিল না, নেইও, কিন্তু একজন মহিলাকে বাইরে বের হতে গেলে রুচিসম্পন্ন পােশাক দরকার হয়ই। 

সাতকাহন পর্ব-(৯)

এক রবিবার দুপরে খাওয়াদাওয়ার পর হােস্টেল থেকে বের হল সে। মায়ার কাছ থেকে শমিতের ঠিকানা পেয়েছিল ক’দিন আগে। শ্যামবাজারের মােড়ে গিয়ে বাস ধরে যখন সে শমিতের পাড়ায় গিয়ে পৌঁছাল তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা, রােদুর কড়কড়ে। জায়গাটা দেখলে কলকাতা বলে মনেই হয় না। একটা মুদির দোকান খােলা ছিল। সেখানে জিজ্ঞাসা করে শমিতের বাড়িতে পৌঁছাল সে। একতলা সাদামাটা বাড়ি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। হঠাৎ মনে হল এমন না ভেবে চলে আসা ঠিক হয়নি। শমিতের বাড়ির লােকজন কিছু মনে 

করতেও পারে। কিন্তু চলে আসার পর ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় নাসে দরজায় শব্দ করল। 

ভেতর থেকে শমিতের গলা ভেসে এল, কে ? 

দীপাবলী চুপ করে রইলকয়েক সেকেন্ড বাদে দরজা খুলল শমিততার চোখ বিস্ফারিত । “আরে, তুমি ? কি আশ্চর্য ঘটনা। কি ব্যাপার ? 

দীপাবলী হাসলবাইরে দাঁড়িয়ে উত্তর দেব ? ‘না, নাসরি। এসাে, ভেতরে এসাে

দীপাবলী ঘরে ঢুকল। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর। দেওয়ালে দুটো ছবি টাঙাননা। একটি উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের। অন্য ছবিটি সে কখনও দ্যাখেনিসেটা লক্ষ্য করে শমিত বলল, “উনি শিশিরকুমার ভাদুড়ি। আধুনিক বাংলা নাটকের জনক

 

Read more

সাতকাহন পর্ব-(১০)-সমরেশ মজুমদার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *