সে ও নর্তকী পর্ব – ৩ হুমায়ূন আহমেদ

সে ও নর্তকী পর্ব – ৩

বড় চাচা সম্পর্কে দাদিজানের এই কথাগুলো লিলির সত্যি মনে হয়। বড় চাচার কারণে লিলিরা দ্রুত পথে বসতে বসেছে। এই সত্য স্বীকার করা ছাড়া এখন আর পথ নেই। বিষয়-সম্পত্তি সব দেখার দায়িত্ব তার। তাকেই পাওয়ার অব এ্যাটর্নি করে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি একে-একে সব বিক্রি করছেন। অন্য দুই ভাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

সংসার ঠিকমতো চলছে, খাওয়া-দাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কাজেই অসুবিধা কী? অসুবিধা হোক, তারপর দেখা যাবে। তা ছাড়া মুনশি ইরফানুদ্দিন খাঁ মৃত্যুর সময় বলে গেছেন ভাইয়ে ভাইয়ে মিল-মহব্বত রাখবা। পিতৃ আজ্ঞার অন্যথা হয় নি। ভাইয়ে ভাইয়ে মিল মহব্বত আছে। ভালোই আছে।

এই বাড়ি হলো অসুবিধাহীন বাড়ি। এ বাড়িতে কারও অসুবিধা হয় না। সবাই ভালো থাকে। সুখে থাকে। কারও অসুখ হলে ডাক্তার চলে আসে। বাসায় এসে রোগী দেখে যায়। ডাক্তার হলো বড় চাচার বন্ধু সামছুদ্দিন তালুকদার হোমিওপ্যাথ। এক সপ্তাহ তার চিকিৎসা চলে। এক সপ্তাহে কিছু না হলে অন্য ডাক্তার রমজান আলী, এলোপ্যাথ।

লিলির বড় চাচার নিয়মে হোমিওপ্যাথির জন্য এক সপ্তাহ দিতে হবে। এক সপ্তাহে রোগ যত প্রবলই হোক অন্য চিকিৎসা হবে না। সাত দিন সময় না দিলে বুঝা যাবে কেন ওষুধ কাজ করছে না। এলোপ্যাথি হলো বিষ-চিকিৎসা। যত কম করানো যায়।তবে আজাহার উদ্দিন খাঁ অবিবেচক নন। পরিবারের সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা তিনি দেখেন।

লিলির দিকে তাকিয়ে তিনি গাড়ি কিনলেন। সেই গাড়ি কেনার ইতিহাস হচ্ছে–লিলি একবার রিকশা করে আসার সময় রিকশা উল্টে পড়ে গেল। হাত কেটে রক্তারক্তি। হাসপাতাল থেকে সেলাই করিয়ে আনার পর আজহার উদ্দিন খ বললেন, রিকশা নিরাপদ না। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের যাতায়াতের জন্য গাড়ি দরকার। টু ডোর কার, যাতে পেছনের দরজা হঠাৎ খুলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে।

আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো, একটা টু ডোর কার এবং একজন বুড়ো ড্রাইভার। স্ত্রী যেমন যত বুড়ি হয় তত ভালো হয়, ড্রাইভারও তেমন। যত বুড়ো ততই অভিজ্ঞ।এক সপ্তাহের মধ্যে লিলিদের গাড়ি চলে এলো। ফোক্সওয়াগন। রাস্তার সঙ্গে মিশে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলে। গাড়িতে ঢুকতেও হয় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। গাড়ির ড্রাইভারও দর্শনীয়, জহির-বুড়ো।

এক চোখে ছানি পড়া, অন্য চোখেও ঝাপসা দেখে। সামনে কিছু পড়লে হর্ন দেয় না। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অতি ভদ্র এবং অতিশালীন ভাষায় গালি দেয়–ঐ রিকশা। গাড়ি আসতেছে শব্দ শুনো না? নড়ো না কেন? গজব পরবো। বুঝলা, গজব! লিলি যদি বলে, আপনি হর্ন দেন না কেন ড্রাইভার চাচা? হর্ন দিতে অসুবিধা আছে?

ড্রাইভার উদাস গলায় বলে, অসুবিধা আছে গো মা। ব্যাটারির যে অবস্থা হর্ন দিলে ব্যাটারি বসে যাবে। গাড়ি চলবে না। ব্যাটারির কারেন্টের বারো আনাই চলে যায় হর্নে। মানবজাতির দিকে তাকিয়ে দেখো মা, যে যত কথা বলে তত আগে তার মৃত্যু। কথা বলে বলে কারেন্ট শেষ করে ফেলে।দার্শনিক ধরনের উক্তি। লিলির বলতে ইচ্ছে করে আপনি যে হারে কথা বলেন তাতে আপনার কারেন্ট ছেলেবেলাতেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। শেষ তো হয় নি। যত বুড়ো হচ্ছেন কারেন্ট তত বাড়ছে।

কঠিন কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলেও লিলি শেষ পর্যন্ত কিছুই বলে না। তার কাউকে কিছু বলতে ভালো লাগে না। তাদের এই বিচিত্র সংসারে বড় হয়ে আজ তার এই সমস্যা হয়েছে। সব সময় মনে হয় হোক যা ইচ্ছা, ড্রাইভার সারাক্ষণ কথা বলে বলুক। কারেন্ট খরচ করুক।লিলি কিছুক্ষণ দোতলার টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেল। আজ কী বার মনে করতে পারল না। আজ কি তার ইউনিভার্সিটি আছে?

সে কি কোনো বিশেষ কারণে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে? হঠাৎ মনে হলো মাস্টার সাহেব রুমু ঝুমুকে সকালে পড়াতে এসেছেন, কাজেই আজ শুক্রবার। একমাত্র শুক্রবারই তিনি সকালে আসেন। ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাস নেই। লাইব্রেরিতে গিয়ে নোট করার কথাও নেই। আজ কোথাও যাওয়া যাবে না।লিলি আবার একতলায় নেমে এলো। কোথাও তার যেতে ইচ্ছে করছে। কোথায় যাওয়া যায়?

টেবিলে নাশতা সাজানো হচ্ছে। গাদাখানিক রুটি ভাজি। বড় এক বাটি পেঁপের হালুয়া। দিনের পর দিন একটাই নাশতা। এই নিয়েও কারও বিকার নেই। একদিন একটু অন্য কিছু করলে হয়। লিলি ভাজি মুখে না দিয়েই বলে ভাজিতে লবণ বেশি হয়েছে। মতির মা বুয়া লবণ বেশি না দিয়ে ভাজি করতে পারে না। লবণ বেশি দেবে, বকা খাবে। মতির মা ধরেই নিয়েছে ভাজি নিয়ে বকাঝকা দিন শুরুর অংশ।

লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান লিলিকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলল, হারামজাদার নাকে এক ঘুসি দিয়েছি, গলগল করে ব্লাড বের হয়ে এসেছে।কার নাকে ঘুসি দিলে? দুধওয়ালার নাকে। আমার সঙ্গে তর্ক করে। অন্যায় করেছ ক্ষমা চাও। ক্ষমা করে দেব। ক্ষমা মানবধর্ম। তা না, তর্ক। হারামজাদার সাহস কত। রগে রগে সাহস। সাহস বের করে দিয়েছি।সত্যি সত্যি মেরেছ? অবশ্যই মেরেছি। গদাম করে ঘুসি। হারামজাদা, তুমি মানুষ চেনো না। রোজ তেলাপোকা খাওয়াও…।

দুধওয়ালার নাক ভেঙে দিয়ে জাহেদুর রহমানকে অত্যন্ত উৎফুল্ল লাগছে। জাহেদুর রহমানের বয়স পঁয়ত্রিশের উপর কিন্তু চলাফেরা হাবভাব আঠারো উনিশ বছরের তরুণের মতো। সব সময় সেজেগুজে থাকে। প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করা। চকচকে জুতা। রঙচঙে শার্টের কলারের নিচে সোনার চেন ঝকঝক করে। জাহেদুর রহমান গত সাত বছর ধরে ইমিগ্রেশন নিয়ে আমেরিকা যাবার চেষ্টা করছে। তার অধ্যবসায় দেখার মতো।

লিলির ধারণা তার ছোট চাচা যদি আমেরিকা যাবার জন্য এখন পর্যন্ত কি কি করেছে তার একটা তালিকা করে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে পাঠায় তাহলে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তাকে সিটিজেনশিপ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে আমেরিকা নিয়ে যাবেন।লিলি বলল, ছোট চাচা তুমি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে? জাহেদুর রহমান পা নাচাতে নাচাতে বলল, ফর গুড দিতে পারব না। ধার হিসেবে দিতে পারি।

ধার হিসেবেই দাও।

কত?

পাঁচ শ।

এত টাকা দিয়ে করবি কী? পাঁচ শ তো অনেক টাকা। প্রায় পনেরো ডলার। পনেরো ডলার দিয়ে তুই করবি? রিকশায় করে শহরে চক্কর দেব। ঘুরব। একদিনের জন্য হিমু হয়ে যাব। মহিলা হিমু।হিমুটা কে? তুমি চিনবে না। দিতে পারবে পাঁচ শ টাকা? তিন শ দিতে পারব। বাকি দুশ অন্যখান থেকে ম্যানেজ কর। ভাইজানকে গিয়ে বল ইউনিভার্সিটিতে পিকনিক হচ্ছে, দুশ টাকা চাঁদা।মিথ্যা কথা বলতে পারব না।

মিথ্যা কথাটা তুই এত ছোট করে দেখিস কেন লিলি। মিথ্যা আছে বলেই জগতসংসার এত সুন্দর। গাদা-গাদা গল্প উপন্যাস যে পড়িস সবই তো মিথ্যা। লেখকেরা সত্যি কথা লেখা শুরু করলে বই আর পড়তে হতো না। মিথ্যা কথা বলা না শিখলে লাইফ হেল হয়ে যাবে।লিলি হেসে ফেলল। জাহেদুর রহমান গম্ভীর গলায় বলল, হাসিস না। আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। সত্যি কথা হলো ডিস্টিল ওয়াটারের মতো টেস্টলেস। আয় আমার সঙ্গে, টাকা নিয়ে যা।কত দেবে, তিন শ?

পাঁচ শ দেব। তোকে খুব পছন্দ করি। এইজন্যই দিচ্ছি। তুই হচ্ছিস অনেস্ট একটা মেয়ে।লিলি হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে আমাকে পছন্দ করো তার কারণ হলো আমি সব সময় সত্যি কথা বলি। আমি যদি তোমার মতো মিথ্যা বলতাম তাহলে পছন্দ করতে না। কাজেই সত্যি বলার কিছু এ্যাডভানটেজ আছে।জাহেদুর রহমান চিলেকোঠায় থাকে। তার ঘর ছবির মতো সাজানো। খাটে টানটান করে চাদর বিছানো। টেবিলের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো।

কোথাও এক কণা ধুলা নেই। জুতা বা স্যান্ডেল পরে তার ঘরে ঢোকা যাবে না। বাইরে খুলে ঢুকতে হবে। লিলি বলল, ঘরে ঢুকব না ছোট চাচা। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি তুমি দিয়ে দাও।আয়, একটু বসে যা।লিলি স্যান্ডেল খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার কিছু হয়েছে? নতুন একটা লাইন ধরেছি। ভালো লাইন। হয়ে যেতে পারে।কী লাইন?

আমেরিকান এক মরমন পাদ্রির সঙ্গে খাতির জমিয়েছি। প্রতি রোববারে যাই। এমন ভাব করি যেন যিশুখ্রিস্টের অমর বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। তাকে পটাচ্ছি। সে ভাবছে সে আমাকে পটাচ্ছে।তাকে পটিয়ে লাভ কী? এক স্টেজে খ্রিস্টান হয়ে যাব। তারপর তাকে বলব–আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা এখন আমাকে মেরে ফেলার জন্য ঘুরছে। আমাকে বাঁচাও। আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও। পলিটিক্যাল এসাইলেমের ব্যবস্থা করো। বুদ্ধিটা তোর কাছে কেমন লাগছে?

লিলি জবাব দিল না। জাহেদুর রহমান ড্রয়ার থেকে টাকা বের করতে করতে বলল, অনেক চিন্তাভাবনা করে এগুচ্ছি। এইবার একটা-কিছু হবেই।যদি না হয় কী করবে? আরও দুবছর দেখব। এই দুবছরে না হলে, আশা ছেড়ে দিয়ে বিয়ে-শাদি করব। ফেইথফুলি সংসার করব। টু বাংলাদেশী হয়ে যাব। পয়েলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যাব। গব-গব করে পান্তাভাত খাব।আমেরিকা যাবে এই জন্যই বিয়ে করছ না?

অবশ্যই। একজনেরই ব্যবস্থা হয় না দুজনের কীভাবে হবে? আমি ভিসা পেয়ে চলে গেলাম তোর চাচি দেশে পড়ে রইল, চোখের জল নাকের জল ক্রমাগত মিক্স করে যাচ্ছে। তখন অবস্থাটা কি হবে? নে, টাকা গুনে নে।পাঁচ শ টাকার নোট গুনে নেব কি?

ভুলে দুটি চলে গেল কিনা দেখ। আর শোন লিলি, এই টাকা তোকে ফেরত দিতে হবে না। টাকাটা তোকে আমি উপহার হিসেবে দিলাম।কেন?”

এমনি দিলাম। তুই হচ্ছিস একজন সত্যবাদী মহিলা…

আজ সকাল থেকেই লিলির মন খারাপ হয়েছিল। এখন মন ভালো হতে শুরু করল। ছোট চাচার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তার মন ভালো হয়।

জাহেদুর রহমান একটু ঝুঁকে এসে বলল, টাকাটা তোকে যে শুধু শুধু দিয়ে * দিয়েছি তা না। এর বদলে তোকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

আমার যেন কিছু ব্যবস্থা হয় সেই দোয়া করবি। সত্যবাদী মহিলার দোয়া আল্লাহ শুনবেন।আচ্ছা যাও, দোয়া করব।আল্লাহকে বলবি এই যে খ্রিস্টান হচ্ছি এটা আমার একটা ট্রিকস। উনি যেন এটাকে আবার সিরিয়াসলি না নেন।লিলি হাসছে। শব্দ করে হাসছে।জাহেদুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, গুড গার্ল। চল, নাশতা খেয়ে আসি।নাশতার টেবিলে দারুণ হইচই হচ্ছে। নেয়ামত সাহেব ভাজির বাটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ভেঙেছেন। এখন বিকট চিৎকার করছেন। ঐ বেটির মুখে এক পোয়া লবণ ঢুকিয়ে দাও। তাহলে যদি শিক্ষা হয়।

মতির মা ভাঙা বাটির টুকরা কুড়াচ্ছে। ফরিদা নতুন করে ভাজি বসিয়েছেন।লিলি রান্নাঘরে মার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, বাবা এ-রকম বিশ্রী করে চেঁচাচ্ছে কেন মা? ফরিদা বললেন, পুরুষ মানুষ একটু চেঁচামেচি তো করবেই। পুরুষদের সবকিছু ধরতে নেই। লবণটা একটু দেখ তো মা। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভয়ের চোটে দুবার লবণ দিয়ে ফেলেছি।

লিলি সামান্য ভাজি মুখে নিয়ে বলল, দুবার না মা, তুমি তিনবার লবণ দিয়েছ।–বলতে বলতে লিলি হাসল। লিলির হাসি দেখে ফরিদা হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তুই তো দারুণ সুন্দর হয়েছিস লিলি। কী আশ্চর্য কাণ্ড! আমি তো লক্ষই করি নি। তুই কি সকালে গোসল করেছিস?

হা।তোর বয়েসী মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায় গোসলের পরপর। এত সকালে গোসল করলি কেন? জানি না কেন। আচ্ছা মা শোনো, আজ আমার কোথাও বেড়াতে যেতে করছে।কোথায়? বিশেষ কোথাও না–এই ধরো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাম। নিউমার্কেটের দোকানগুলো দেখলাম।যাই করিস তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে করব।সমস্যা তো এইখানেই।রুমু রান্নাঘরে ঢুকল। তার হাতে একটা সে লিলির হাতে দিয়ে যেভাবে চুপিচুপি এসেছিল সেভাবেই বের হয়ে গেল। ফরিদা বললেন, কার চিঠি?

স্বাতীর চিঠি।

যাক, বাঁচা গেল। আমি ভাবলাম রুমু ঝুমুর মাস্টার বুঝি প্রেমপত্র লিখে ফলেছে। ওর তাকানো ভালো না। শকুনের মতো কেমন করে যেন তাকায়। স্বাতী ঠাৎ চিঠি লিখল কেন? আজ ওর জন্মদিন। যেতে বলেছে। মা, যাব? তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।বাবা যেতে দেবে না।দিতেও পারে। তোকে পছন্দ করে। নরম গলায়, কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে দেখ।এখন বলব?

না, এখন না। খবরের কাগজটা আসুক। খবরের কাগজ হাতে পড়লে মেজাজ একটু ভালো থাকে। তখন এক কাপ চা নিয়ে যাবি তারপর বলবি।নেয়ামত সাহেব খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সামনে এসট্রে আছে। ছাই এসট্রেতে ফেলছেন না, চারপাশে ফেলছেন। লিলি চায়ের কাপ তাঁর সামনে রাখতে রাখতে বলল, বাবা আমার এক বান্ধবী যে আছে স্বাতী, আজ ওর জন্মদিন।নেয়ামত সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। লিলি বলল, আমাকে খুব করে যেতে লিখেছে। এক ঘণ্টার জন্য।তোর বান্ধবীর জন্মদিন?

জি।বুড়ো ধাড়ি মেয়ের আবার জন্মদিন কি? এসব আমার পছন্দ না। ছুটির দিন বাসায় থাকবি। বাইরে বাইরে ঘুরবি কেন? যা, মাকে সাহায্য কর। একা মানুষ চারদিক সামলাচ্ছে, তাকে দেখে একটু মায়াও হয় না।নেয়ামত সাহেব আবার কাগজ পড়তে শুরু করলেন। লিলি চায়ের কাপ নামিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

স্বাতী ভেবে রেখেছিল সে তার জন্মদিনে লিলিকে ব্যাপারটা বলবে। ভয়ঙ্কর অন্যায় যে সে করেছে সেই ব্যাপারটা। লিলি আতঙ্কে শাদা হয়ে যাবে। পরপর কয়েক বার বলবে, এখন কী হবে রে? এখন কী হবে? তখন স্বাতী তার পরিকল্পনার কথা বলবে। সেটা শুনে লিলি আরও আতঙ্কগ্রস্ত হবে।

নিজের আতঙ্ক অন্যের ভেতর দেখলে নিজের আতঙ্ক খানিকটা কমে। স্বাতী খানিকটা স্বস্তি পাবে। এবং কিছুটা সাহসও পাবে। সেই সাহসটা পাবার পর স্বাতী ব্যাপারটা তার মাকে বলতে পারবে। মাকে কিভাবে বলবে তা সে ঠিক করে রেখেছে। ভয়ঙ্কর অন্যায়ের ব্যাপারটা মাকে বলা হবে সবার শেষে। চেষ্টা করবে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা না বলতে। তবে তিনি জানতে চাইলে বলতেই হবে।

সে শুরু করবে এই ভাবে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে মার ঘরে গিয়ে বলবে, মা… আজ জন্মদিন উপলক্ষে আমি তোমার সঙ্গে তোমার ঘরে ঘুমুব। বাবাকে গেস্ট রুমে ঘুমুতে বলো।মা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে বলবে–ঠিক আছে, ঘুমুবি।সে বলবে ছোটবেলায় যেভাবে ঘুমুতাম ঠিক সেইভাবে ঘুমুব। তুমি তোমার চুল খোলা রেখে শুয়ে থাকবে। আমি তোমার চুল শরীরে ফেলে ঘুমুব।মা আরও খুশি হবে। হাসিমুখে বলবে, সেই লম্বা চুল কী আছে রে মা?

স্বাতীর ছোটবেলার ঘুমের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মায়ের চুল তার সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতে হতো। এই ঘুমের বিশেষ একটা নাম ছিল—–চুল ঘুম। মায়ের চুল ভেজা হলে এই চুল ঘুম দেয়া যেত না। স্বাতী কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলত।অনেকদিন পর চুল-ঘুমের ব্যবস্থা করে স্বাতী বলবে–মা শোনো, আমি যদি পছন্দের কোনো ছেলেকে বিয়ে করি তাহলে তুমি কি আপত্তি করবে? মা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক চমকে উঠে বলবে, ছেলেটা কে?

স্বাতী বলবে, ছেলেটা কে সেই প্রশ্ন পরে আসছে। আগে বলো, আমার নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে দিতে তোমার আপত্তি আছে কি-না।মা নিতান্ত অনিচ্ছায় প্রায় ফিসফিস করে বলবেন না।তখন স্বাতী বলবে, ভালো ছেলে বলতেই বাবা-মার চোখে যে ছবি ভাসে ঐ ছেলে সে রকম না।

কী করে সে?

সে একজন কবি।

কী সর্বনাশ!

কী সর্বনাশ–বলে লাফ দিয়ে ওঠার কিছু নেই মা। কবিরা ভয়ঙ্কর কোনো প্রাণী না।করে কী? বললাম না, কবি। কবিতা লেখে। আর করবে কি? সংসার চালায় কীভাবে? কবিতা লিখে কি সংসার চলে? সেটা একটা কথা। কবিতা লিখে সংসার চলে না। তবে সে কবিতা ছাড়া আর কিছু লিখতেও পারে না।আমার মনে হচ্ছে তুই মিথ্যা কথা বলছিস। তুই ঠিকঠাক করে বল ছেলে করে কী?

মা ও একজন পেইন্টার।পেইন্টার মানে কী? গাড়িতে যে রঙ করে সেও তো পেইন্টায়।ও গাড়িতে রঙ করে না মা। কাগজে ছবি আঁকে। অপূর্ব ছবি। ছবি দেখলে তোমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। দেখতেও খুব হ্যান্ডসাম। শুধু বয়স সামান্য বেশি।সামান্য বেশি মানে কত বেশি? কত বেশি তা তো বলতে পারব না। জিজ্ঞেস করি নি কখনও। কপালের কাছের কিছু চুল পাকা দেখে মনে হয় বয়স হয়েছে মধ্যবয়স্ক।পরিচয় হলো কীভাবে?

 

Read more

সে ও নর্তকী পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *