হিমু মামা পর্ব – ২ হুমায়ূন আহমেদ

হিমু মামা পর্ব – ২

গাধার মতো কথা বলিস না তো টগর। মানুষ হয়ে জন্মেছিস মানুষের মতো কথা বলবি। হিমুরা কি লাভ-লোকসান হিসাব করে চলে? তারা কি বিজনেসম্যান? ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ঘুরবে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে তেলতোলে মুখে হাসবে। যা আরেক কাপ চা নিয়ে আয়। এবারেরটাও যেন আগের মতো হয়।

আর চা না খেলে হয় না? বেশি চা খাওয়া তো ভালো না।তোকে জ্ঞানীর মতো কথা বলতে হবে না। তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছি নিয়ে আয়। চা খেতে খেতে একটা রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব।কী রহস্য? আমি যে হিমু হয়ে গেছি, এটা তোর বড় চাচা কীভাবে জানল? টগর বলল, এই বাড়িতে ওনার অনেক স্পাই আছে। বাড়ি গিজগিজ করছে স্পাইয়ে।শুভ্র বলল, তাই তো দেখছি। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

যা চা নিয়ে আয়।টগর অনাগ্রহের সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বার চা চাইতে গেলেই সব ধরা পড়ে যাবে। টগরের বুক টিপটিপ করছে। এর মধ্যে নীলু আবার অতিরিক্ত রকমের হৈচৈ শুরু করেছে, আমার অঙ্ক বই, আমার অঙ্ক বই। বাড়ি মাথায় তোলার মতো চিৎকার। টগরের খুবই বিরক্তি লাগছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেই কি বই পাওয়া যাবে! যখন সময় হবে বই আপনা-আপনি চলে আসবে।

নীলুর চিৎকার শুনে বড় চাচা বের হয়ে এসেছেন। তিনি নীলুকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। বড় চাচার যে বুদ্ধি তিনি নীলুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললে বুঝে ফেলতে পারেন, অঙ্ক বই পাওয়া যাচ্ছে না। কেন। কাজেই এখন যেটা করতে হবে তা হলো, অঙ্ক বইটা এনে আগের জায়গায় রেখে দিতে হবে। বেশি দেরি করা যাবে না। টগর তা-ই করল। যেখানকার বই সেখানে।

টগর অঙ্ক বই নীলুর পড়ার টেবিলে রেখে বড় চাচার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার উদ্দেশ্য বড় চাচার সঙ্গে নীলুর কথাবার্তা যদি কিছু শোনা যায়। আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনা খুবই অন্যায়। বিরাট পাপ হয়। এই কাজটা টগরের করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আড়াল থেকে কথা শোনার পাপ কাটান দেয়ার জন্য ছোটখাটো কোনো পুণ্য করতে হবে। পাপ করলেই পুণ্য করে সব সমান সমান রাখা। সে বড় চাচার ঘরের দরজার ওপাশে দাঁড়াল।

নীলু ফোঁপাচ্ছে। ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বড় চাচা বললেন, ফোঁপানি বন্ধ করা নীলু। বই পাওয়া যাচ্ছে না, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না যে তার জন্য ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। রাজ্য ছেড়ে রাজা বনবাসী হলেও কোনো রানী এভাবে কাঁদে না।নীলু ফোঁপানি বন্ধ করল।কী বই পাওয়া যাচ্ছে না?

অঙ্ক বই। আমি অঙ্ক করছিলাম। মাঝখানে দশ মিনিটের জন্য বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি বই নেই।বই হাওয়া হয়ে গেছে? হুঁ।তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়? না।বই খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা তো তোমার ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে। কিছুদিন পর পরই তো শুনি তোমার এই বই পাওয়া যাচ্ছে না, ওই বই পাওয়া যাচ্ছে না।জি।

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দেয়। তখন আবার বই খুঁজে পাওয়া যায়।জি।রহস্যটা কী? জানি না বড় চাচা।তোমার পড়ার ঘরে যাও, দেখো বই আবার ফিরে এসেছে কি না।জি আচ্ছা। যদি বই ফিরে না আসে তাহলে ড্রাইভারকে নিউমার্কেটে পাঠাও, সে বই কিনে আনবে। বইয়ের শোকে মরাকান্না কাঁদতে হবে না। বই মারা যায়নি। বই জীবিত আছে।জি আচ্ছা।

আমার ধারণা, বই নিয়ে এই রসিকতা কে করছে তা আমি বুঝতে পারছি। তুমি টগরকে একটু আমার কাছে পাঠাও।বড় চাচার কথা শুনে টগরের বুক ধক করে উঠল। কী সর্বনাশ, কাজটা যে সে করেছে এটা কি বড় চাচা ধরে ফেলেছেন? টগর অতি দ্রুত তার গোপন জায়গায় চলে গেল। এই মুহূর্তে বড় চাচার সামনে পড়ার কোনো মানে হয় না।এ বাড়িতে টগরের একটা গোপন জায়গা আছে। গোপন জায়গার খবর এ বাড়ির কেউই জানে না। টগরের ধারণা, কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না।

গোপন জায়গাটায় ছাদের সিঁড়িঘর দিয়ে যেতে হয়। সিঁড়িঘরের সঙ্গের যে বাথরুম সেই বাথরুমের ফলস সিলিং হলো টগরের গোপন জায়গা। ফলস সিলিং বানানো হয়েছিল। টুকিটাকি জিনিস রাখার জন্য। টগর সব পরিষ্কার করেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়েছে। ছাদের মতো জায়গাটায় চাদর বিছানো আছে। বালিশ আছে। পানির বোতল, চিপস সবই আছে। অনেক গল্পের বই আছে। গুজ বামের দশটা বই, হেরি পটারের দুটো। অনেকগুলো লেগোর সেট আছে। একটা আছে মেকানো সেট। ছবি আঁকার জন্য খাতা আছে, পেনসিল আছে।

এসব ছাড়াও কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স আছে। বাক্সটার ওপরে লাল মার্কার দিয়ে লেখা :

THIEF BOX

চোরবাক্স

এই বাক্সে টগর কিছু চুরি করা জিনিস অল্প কিছু দিনের জন্য লুকিয়ে রাখে। যেমন তার বাবাকে কে যেন একটা লাইটার দিয়েছিল। বোতাম টিপলেই আগুন বের হয় এবং বাজনা বাজে। এই লাইটারটা টগর চুরি করে এনে তার থিফ বক্সে রেখে দিল। কিছু দিন লাইটার নিয়ে খেলে আবার একসময় বাবার কোটের পকেটে রেখে দিল। টগরের বাবা খুবই অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য কাণ্ড, লাইটারটা পাওয়া গেছে। কাজের বুয়া দুজনকে খামাখা সন্দেহ করেছি। ছি-ছি! আমার পকেটেই ছিল।

চোরবাক্সে কোনো জিনিসই টগর বেশি দিন রাখে না। শুধু দাদিয়ার দাঁতের পাটি এক সপ্তাহ রেখে দিয়েছিল। চারদিকে এমন হৈচৈ শুরু হলো! সবার এক কথা, দাঁত কে নেবে? দাঁত কি চুরি করার জিনিস? দাঁত কে নিল। এই বিষয়ে অনেক থিওরি বের হলো। টেগরের বাবা বললেন, ইঁদুরের কাণ্ড। ইঁদুর নিয়েছে। এই শুনে সুলতানা বললেন, এত বড় দাঁত কি ইঁদুরের মুখে লাগবে? ইঁদুর কেন নেবে।টগরের বাবা সুলতানার কথা শুনে রেগে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। প্লিজ।

সেই দাঁত এক সপ্তাহ পর টগর রেখে দিল বড় চাচার টেবিলের ড্রয়ারে। এই নিয়েও কম হৈচৈ হলো না। ড্রয়ারে দাঁত এল কোথেকে? নানা গবেষণা, নানা আলোচনা। গুজগুজ ফিসফিস মিটিং। বাড়িতে হৈচৈ হলে টেগরের ভালো লাগে। তবে সে খুব ভালো করেই জানে তার পাপ হচ্ছে। এই পাপ কাটান দেয়ার জন্য তাকে পুণ্য করতে হবে। সে তখন পুণ্য করে।

পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখার জন্য তার একটা খাতা আছে। খাতার নাম পাপ-পুণ্য খাতা। খাতায় পাপগুলো লেখা থাকে লাল মার্কারে। পুণ্যগুলো সবুজ মার্কারে।টগর জানালার শিকে পা রেখে তার গোপন জায়গায় ওঠে, সিলিংয়ের দরজা লাগিয়ে দেয়। একবার ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলে কারোর বোঝার সাধ্যও থাকে না যে এখানে কেউ আছে। জায়গাটা একটু অন্ধকার। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার চোখে সয়ে যায়।

টগর তার গোপন জায়গায় বসে আছে। তার হাতে বড় একটা খাতা। এটা ‘পাপ-পুণ্য খাতা’ না, অন্য খাতা। এই খাতায় তাদের বাড়ির প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে কিছু লেখা আছে। লেখাগুলো টগরই লিখেছে। কিছু দিন পর পর সে লেখাগুলো পড়ে। সামান্য কাটাকাটি করে। আজ খাতাটা সে নিয়েছে আরো নতুন কিছু তথ্য যোগ করার জন্য। ছোট মামা যে গত সপ্তাহে হিমু হয়ে গেছে, এই কারণে আজ তার বিচার হবে এই তথ্য খাতায় লেখা নেই। টগর খাতার লেখা পড়তে শুরু করল। সে পড়াশোনায় খুব ভালো।

সব পরীক্ষায় A পায়। বড় হয়ে সে Mad Scientist হবে।

টগর

It is me,

Standard six student.

খুব বুদ্ধিমান ছেলে। অতি ভালো। মিষ্টি স্বভাব। সে সবাইকে ভালোবাসে। তার কোনো খারাপ গুণ নেই। সপ্তাহে একদিন সে আঁ আঁ করে সবাইকে বিরক্ত করে। কারণ ঐ দিন তার গানের টিচার আসেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তাকে গান শেখান।

নীলু

My sister

Standard seven student

বুদ্ধি নেই। মন্দ। ঝগড়াটে স্বভাব। তার কোনো ভালো গুণ নেই।

দাদিয়া

My Grandma

Age: 75

Name : Fatima Begum

VERY GOOD LADY

দাদিয়া খুব ভালো। She is A+। দাদিয়া ছোটদের কখনো বকা দেন না। খুবই খারাপ। সবার ধারণা, উনি বেশি দিন বাঁচবেন না। কিন্তু আমি জানি দাদিয়া অনেক দিন বাচবেন। তবে দাদিয়া যেদিন মারা যাবেন সেদিন এই বাড়িতে মজার একটা ঘটনা ঘটবে। দাদিয়া যে লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমান সেই লেপ টুকরা টুকরা করে কেটে সবাইকে এক টুকরা করে উপহার দেয়া হবে।

ঘটনাটা খুব অদ্ভুত লাগলেও অদ্ভুত না। কারণ দাদিয়ার লেপে আছে টাকা। তিনি যখনই টাকা পেয়েছেন, লেপের ভেতর সেলাই করে রেখে দিয়েছেন। সবাই মনে করে এই লেপে কম করে হলেও এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা আছে। কাজেই লেপের একটা টুকরা পাওয়া মানে অনেকগুলো টাকা পাওয়া। আমি যে টুকরা পাব সেখান থেকে টাকা বের করে লেগো কিনব।

বড় চাচা

My uncle

Name: Chowdhury Ajmol Hossain

VERY ANGRY PERSON

আমার বড় চাচা খুবই রাগী। রাগের জন্য নোবেল প্রাইজ দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে তিনি অবশ্যই নোবেল প্রাইজ পেতেন। He is A+ in hot temper। তবে তিনি যে রাগী তা তাকে দেখে বোঝা যায় না। কারণ তিনি সব সময় হাসি হাসি মুখ করে থাকেন।

বড় চাচা বাসায় যতক্ষণ থাকেন। ততক্ষণ বই পড়েন। তিনি থাকেন এই বাড়ির দোতলায়। এ জন্য ছোটরা কেউ দোতলায় যায় না। তিনি বিয়ে করেননি। ভাগ্যিস বিয়ে করেননি। বিয়ে করলে তার ছেলেমেয়ে হতো। সেই ছেলেমেয়েরা তাকে ভয় করত। এই পৃথিবীতে ভয় পাওয়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়ে যেত।টগর এই পর্যন্ত পড়ে খাতা নামিয়ে পাপ-পুণ্য খাতাটা নিল। আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শুনে যে পাপ করা হয়েছে, সেটা লিখে ফেলা দরকার।

পাপ নং ২১৩

আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শুনেছি।

এর পাশেই সে লিখল :

পুণ্য নং ২১৩

আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শোনার পর পাপ কাটান দেয়ার জন্য এই পুণ্যটা করা হবে। এখনো করা হয়নি। তবে আজই করা হবে। বড় চাচার ঘর থেকে যে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নেয়া হয়েছে সেটা কোনো এক ফাঁকে বড় চাচার ড্রয়ারে রেখে দেয়া হবে। তিনি হারানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস পেয়ে আনন্দ পাবেন। এতে পুণ্য হবে। মানুষকে আনন্দ দেয়াতেই পুণ্য।

টগর পাপ-পুণ্যের খাতা থিফ বক্সে রেখে সাবধানে তার গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে এল। সে ভেবেছিল তার জন্য বাড়িতে খোঁজাখুঁজি পড়বে। দেখা গেল সে রকম কিছু না। কেউ তাকে খুঁজছে না। সে নীলুর ঘরে গেল। নীলু আনন্দিত গলায় বলল, এই টগর, আমি অঙ্ক বইটা পেয়েছি।টগর, বলল, কোথায় পেয়েছিস?

যেখানে হারিয়েছিলাম। সেখানেই পেয়েছি। আমার কী ধারণা জানিস? আমার ধারণা কোনো ভূতের কাণ্ড। এই বাড়িতে ভূত আছে। কাজের বুয়ারও তাই ধারণা। সে নাকি ভূত দেখেছে। আমি ঠিক করেছি একদিন প্লানচেট করে ভূত আনব।কবে? আমার পরীক্ষার পরে। ক্লাসের বন্ধুদের বলব। রাতে সবাই আমার সঙ্গে থাকবে। রাত বারোটার পর ভূত নামানো হবে। তুই থাকবি? আমি ভূত-ফুত বিশ্বাস করি না।ভূত যখন তোর কান মলে দেবে তখন বিশ্বাস করবি।টগর বলল, আজ যে ছোট মামার বিচার হবে তুই জানিস? নীলু বলল, জানি।বিচার দেখবি না?

আমার বিচার দেখার শখ নেই। তা ছাড়া ছোটরা বিচারে থাকতেও পারবে না। বিচার-ফিচার আমার ভালোও লাগে না। আমি যে বইটা ফেরত পেয়েছি এতেই আমি খুশি।নীলুকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। নীলুর আনন্দ দেখে টেগরের ভালো লাগছে। নীলু যত আনন্দিত হবে টেগরের পুণ্য হবে তত বেশি। আজ মনে হয়। পাপের চেয়ে পুণ্য বেশি হয়েছে।

সন্ধ্যার পর বিচারসভা বসার কথা।বিচারসভা বসতে বসতে আটটা বেজে গেল। খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা, টগরকে ডাকা হয়েছে বিচারসভায়। তার মতো ছোট মানুষকে বিচারসভায় কেন ডাকা হয়েছে কে জানে? টগর বসেছে বড় চাচার খাটে। ছোট মামাও একই খাটে বসেছেন। তবে অনেকখানি দূরে। তিনি এমনভাবে বসেছেন যে টগর তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

বড় চাচা আধশোয়া হয়ে তার বড় ইজিচেয়ারে বসেছেন। তার মাথার নিচে বালিশ। পায়ের ওপর পাতলা চাদর। আরাম আরাম ভাব।টগরের বাবা-মা বসেছেন। পাশাপাশি বেতের চেয়ারে। চেয়ার দুটো বড় চাচার ঘরে থাকে না। বিচারসভা যখন বসে তখন আনা হয়। টগরের বাবার মনে হয় কোনো কাজ আছে। তিনি কিছুক্ষণ পর পর হাতের ঘড়ি দেখছেন। টগরের মা সুলতানা হাই তুলছেন। সুলতানা শুধু রান্নাবান্নার সময় হাই তোলেন না।

অন্য যেকোনো সময় হাই তোলেন। সুলতানার চিন্তা-ভাবনা বিচারসভাতে নেই। তাঁর মন পড়ে আছে। মুরগির মিষ্টি কাবাবে। মিষ্টি কাবাব বানানো হয়েছে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন বিচারসভা শেষ হওয়ার পর সবাইকে সেই কাবাব খেতে দেয়া হবে। বিচারসভার শেষে কাবাব খাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকবে কি না এটা নিয়েই তিনি চিন্তিত।টগরের বাবা বললেন, ভাইজান, বড়দের মধ্যে টগর কেন? ওকে যেতে বলি?

বড় চাচা বললেন, না। ওকে আমার প্রয়োজন।এই বলেই তিনি চোখ বন্ধ করালেন। বাইরের কেউ উপস্থিত থাকলে মনে করত। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে যারা ভালোমতো চেনে তারা জানে যে এটা তার একটা স্টাইল। জটিল কোনো কথা বলার আগে ঘুম ঘুম ভাব করবেন। হালকা নাকডাকা টাইপ শব্দও করবেন। সবাইকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে হঠাৎ ইজিচেয়ারে উঠে বসবেন।

টগর, সেই বিশেষ সময়ের অপেক্ষা করছে। তার ইচ্ছা করছে ছোট মামার মুখের ভাবটা দেখতে, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না এবং তিনি একবারও টগরের দিকে তাকাচ্ছেন না। টগর যেটা করতে পারে তা হচ্ছে সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে উঠে এসে ছোট মামার পাশে বসতে পারে। কাজটা করা ঠিক হবে কি না সে বুঝতে পারছে না। বড় চাচা তাতে বিরক্ত হতে পারেন এবং বিরক্ত হয়ে বলতে পারেন, তোমার এখানে থাকার দরকার নেই।

তুমি যাও, পড়াশোনা করো। টগর মনে-প্ৰাণে বিচারসভায় থাকতে চাচ্ছে।ইজিচেয়ারে বড় চাচা হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চোখ মেললেন। সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির করলেন টগরের মুখের ওপর।গম্ভীর গলায় বললেন, টগর আছিস? টগর, বলল, জি বড় চাচা।তুই তোর ছোট মামা সম্পর্কে আমাকে গোপনে কী বলেছিস তা আবার বল, সবাই যেন শুনতে পায়।

টগর, হকচকিয়ে গেল। ছোট মামার হিমু হওয়ার সব খবর সে বড় চাচার কাছে সাপ্লাই করেছে। বড় চাচা যে এরকম মিটিং করে তার কথা ফাঁস করে দেবেন তা সে ভাবেনি। সবাই তাকাল তার দিকে। ছোট মামাও তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়।বড় চাচা বললেন, চুপ করে আছিস কেন, বল।টগর বিড়বিড় করে বলল, ছোট মামা হিমু হয়ে গেছে।কী হয়ে গেছে? হিমু।টগর লক্ষ করুল সবাই ছোট মামার দিকে তাকাচ্ছে।

শুভ্ৰ ভেবেছিল বিশ থেকে পঁচিশ পৃষ্ঠার বিরাট এক রচনা লিখবে। রচনার নাম ‘হিমু’। রচনায় অনেক পয়েন্ট থাকবে। কবিতার উদ্ধৃতি থাকবে। উপসংহার থাকবে। লিখতে গিয়ে দেখল, সব এক পৃষ্ঠায় হয়ে গেছে। অনেক চিন্তা করেও এর বেশি সে কিছু লিখতে পারছে না।চৌধুরী আজমল হোসেন শুভ্রের হাত থেকে লেখাটা নিলেন। পর পর দুবার পড়লেন। কিছুক্ষণ শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পড়লেন।হিমু।কে, কী ও কেন হিমু হলো উপন্যাসের একটি চরিত্র।কী?

সে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে। খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে।কেন? হিমু সত্যের অনুসন্ধান করে। হলুদ পাঞ্জাবি এবং খালি পা তার বাইরের ব্যাপার। ভেতরে সে সত্য-অনুসন্ধানী।শুভ্ৰ বলল, আমি যাই? বড় চাচা বললেন, আচ্ছা যাও। তুমি কি নিশ্চিত হিমু সম্পর্কে যা বলার সব বলা হয়েছে? কিছু বাদ যায়নি? একটা ব্যাপার শুধু বাদ পড়েছে।সেটা কী? হিমুদের কিছু সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতা তৈরি হয়। তারা ভবিষ্যৎ বলতে পারে।তুমি পারো?

না। কারণ আমি পুরোপুরি হিমু হতে পারিনি।পারছ না কেন? পারছি না কারণ হিমুর কর্মকাণ্ডগুলো আপনারা করতে দিচ্ছেন না। ছাদে গিয়ে জোছনা দেখতে পারছি না। কলঘরের হাউসে পানি ভর্তি করে সেই পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলেও কাজ হতো। সেটাও করা যাবে না।হাউসের পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলে তুমি ভবিষ্যৎ বলতে পারবে?

পুরোপুরি হিমু হওয়ার দিকে এগোতে পারব। হিমু হয়ে যাবার পর অবশ্যই ভবিষ্যৎ বলতে পারব। ভবিষ্যৎ বলা হিমুদের জন্য কোনো ব্যাপার না।বড় চাচা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। তারপর গলা উচিয়ে বললেন, ঠিক আছে পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকে। ছাদে গর্ত খুঁড়ে বসে থেকে জোছনা দেখতে পারো। অনুমতি দিলাম। সুপার ন্যাচারেলে ক্ষমতা তৈরি হবার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।

টগরের প্রাইভেট স্যার এসেছেন। স্যারের নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। রিটায়ার করার পর বড়লোকের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ান। তাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসতে হয় এবং দিয়ে আসতে হয়। ঘড়ি দেখে তিনি এক ঘণ্টা দশ মিনিট পড়ান। দশ মিনিট বাড়তি পড়ানোর কারণ মাঝখানে তিনি দশ মিনিটের জন্য পড়া বন্ধ রাখেন। এই দশ মিনিট তিনি খুব ঠাণ্ডা (বরফ মেশানো) লেবুর শরবত খান। একটা পান খান। পান খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকেন। এই সময় কোনোরকম শব্দ করা যাবে না।

রকিবউদ্দিন ভূইয়া অতি কঠিন শিক্ষক। যখন হেডমাষ্টার ছিলেন তখন তার নাম ছিল পিসু-হেড়ু। কারণ তার হুঙ্কার শুনলে ছোট ক্লাসের ছাত্ররা প্যান্টে পিসু করে দিত। হেডমাষ্টার থেকে প্রাইভেট মাস্টার হওয়ার পর তাকে আর কেউ ভয় পায় না। ছাত্রদের ভয় দেখানোর অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন (চোখ বড় বড় করে তোকানো, চাপা গলায় হুঙ্কার) কোনোটাতে কিছু

টগরের স্যার দশ মিনিটের ব্রেক নিয়েছেন। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তার চোখ ছাত্রের দিকে। তবে তিনি কিছু দেখছেন না। কারণ তার চোখ বন্ধ। শুধু মুখ নড়ছে। কারণ তিনি পান চিবোচ্ছেন। যদিও এই সময় তার সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। তারপরও টগর কথা বলল, স্যার, আজকে কিন্তু আমাকে আগে আগে ছেড়ে দিতে হবে।

রকিবউদ্দিন চোখ মেললেন। চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, টগর, তোমাকে না বলেছি আমার রেস্ট পিরিয়ডে কোনো কথা বলবে না? ভুলে গেছি, স্যার।কেন তুলে গেছ? স্যার, আজকে আমার মাথায় খুব টেনশন। আমার ছোট মামা হিমু হয়ে গেছেন। পানির হাউসে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন। এই জন্য আমার খুব টেনশন হচ্ছে। সব কিছু ভুলে যাচ্ছি।টেনশন বানান করো।

T-E-N-S-I-O-N। হয়েছে। এখন বলো তোমার ছোট মামা কী হয়েছেন? হিমু হয়েছেন। পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন।মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

জি না। হিমু হয়েছেন। হিমু হলে এইসব করতে হয়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে থাকতে হয়। মাটিতে গর্ত করে গর্তে বসে জোছনা দেখতে হয়।পাকা বেত দিয়ে দশটা বাড়ি দিলে ঠিক হয়ে যেত। দেশ থেকে বেত উঠে গেছে তো, এই জন্যই এত সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইংরেজিতে একটা বাগধারা আছে, স্পেয়ার দি ব্রড, স্পয়েল দি কিড়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবে বসে আছে! ফাজিল!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *