সমুদ্রের পানি রূপার মতো চকচক করছে, আর তোমরা …..
আমরা কী ?
থাক । সবটা বললে রহস্য শেষ হয়ে যাবে ।
আপনি একজন অসাধারণ মানুষ হিমুভাই! অসাধারণ!
আমি এবং বাদল ওদের এগারোটার ট্রেনে তুলে দিতে এলাম । ফুপা-ফুপু এলেন না । ফুপার শরীর খারাপ করেছে ।
ট্রেন ছাড়বার আগ-মুহূর্তেৃ রিনকি বলল, হিমুভাই, আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে ।
কিসের ভয় ?
এত আনন্দ লাগছে । আনন্দের পরই তো কষ্ট আসে । যদি খুব কষ্ট আসে । কষ্ট আসবে না । তোদের জীবন হবে আনন্দময় । তোদেরকে আমি আমার ময়ূরাক্ষী নদী ব্যবহার করতে দিয়েছি । এই নদী যারা ব্যবহার করে তাদের জীবনে কষ্ট আসে না ।
তুমি কী যে পাগলের মতো কথা মাঝে মাঝে বল! কিসের নদী ?
আছে একটা নদী । আমি আমার অতিপ্রিয় মানুষদের শুধু সেই নদী ব্যবহার করতে দেই। অন্য কাউকে দেই না । তুই আমার অতিপ্রিয় একজন । যদিও খানিকটা বোকা, তবু প্রিয় ।
তুমি একটা পাগল । তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার ।
ট্রেন নড়ে উঠল । আমি জানালার সঙ্গে সঙ্গে এগুতে লাগলাম । রিনকির আনন্দময় মুখ দেখতে এত ভালো লাগছে! রিনকির চোখে এখন জল । সে কাঁদছে । আমি মনে মনে বললাম, হে ঈশ্বর, এই কান্নাই রিনকি নামের মেয়েটির জীবনের শেষ কর হোক ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড- ১৬
প্রায় দশদিন পর আস্তানায় ফিরলাম ।
আস্তানা মানে মজিদের মেস – দ্য নিউ বোর্ডিং হাউস ।
মজিদ ঐ বোর্ডিং হাউসে দীর্ঘদিন ধরে আছে ।কলেজে যখন পড়তে আসে তখন এই অন্ধ গহবর খুঁজে বের করে । নামমাত্র ভাড়ায় একটা ঘর । সেই ঘরে একটা চৌকি, একটা টেবিল । চেয়ারের ব্যবস্থা নেই কারণ চেয়ার পাতার জায়গা নেই । মজিদের চৌকিতে একটা শীতল পাটি শীত গ্রীষ্ম সবসময় পাতা থাকে । মশারিও খাটানো থাকে । প্রতিদিন মশারি তোলা এবং মশারি ফেলার সময় মজিদের নেই । তাকে সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত নানান ধান্ধায় ঘুরতে হয়, প্রতিমাসে তিনটি মনিঅর্ডার করতে হয়। একটা দেশের বাড়িতে, একটা তার বিধবা বড়বোনের কাছে এবং তৃতীয়টি আবু কামাল বলে এক ভদ্রলোককে । এই ভদ্রলোক মজিদের কোনো আত্মীয় নন । তাকে প্রতিমাসে কেন টাকা পাঠাতে হয় তা মজিদ কখনো বলেনি ।
জিজ্ঞেস করলে হাসে । এইসব রহস্যের কারণেই মজিদকে আমার বেশ পছন্দ । আমাকে মজিদের পছন্দ কিনা আমি জানি না । সে মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অনগ্রহ নিয়ে মেশে । কোনো কিছুতেই অবাক বা বিস্ময় প্রকাশ করে না । সম্ভবত শৈশবেই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে । ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় তাকে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম । ডাচ এক যাদুকর জার্মান কালচারাল সেন্টারে যাদু দেখাচ্ছেন । বিস্ময়কর কাণ্ডকারখানা একের-পর-এক-ঘটে যাচ্ছে । একসময় তিনি তার সুন্দরী স্ত্রীকে করাত দিয়ে কেটে দু-টুকরা করে ফেললেন । ভয়াবহ ব্যাপার ।
ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড- ১৬
মহিলা দর্শকরা ভয়ে উ উ জাতীয় শব্দ করছে । তাকিয়ে দেখি মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে । ক্ষীণ নাক ডাকার শব্দও আসছে । আমি চিমটি কেটে তার ঘুম ভাঙালাম । সে বলল, কী হয়েছে ?
আমি বললাম, করাত দিয়ে মানুষ কাটা হচ্ছে ।
মজিদ হাই তুলে বলল, ও আচ্ছা ।
সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল । অথচ আমি অনেক ঝামেলা করে দুটা টিকিট জোগাড় করেছি যাতে একবার অন্তত সে বিস্মিত হয় । আমার ধারণা, তাজমহলের সামনেও তাকে যদি নিয়ে যাওয়া হয় সে হাই চাপতে চাপতে বলবে, ও আচ্ছা, এটাই তাজমহল! ভালোই তো মন্দ কী ।
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ময়ূরাক্ষী উপন্যাসের খন্ড- ১৭