হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১০

একটা আবার হুইল বড়শি। হুইল বড়শি কী করে টানতে হয় শো জানে না। সাধারণ বড়শি টানার নিয়ম জানে না। শুধু এইটুকু জানে ফাংলা পানির নিচে তলিয়ে গেলে যাচকা টান দিতে হয়। শেফা ঠিক করে রেখেছে। যদি হুইলের বড়শির কান উবে যায় তাহলে সে বাবা বলে বিকট চিৎকার দেবে। বাকি যা করার বাবা করবেন। দেলােয়ার ভাই থাকলে হত, তিনি মারা আপার সঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছেন। শেফার তাদের সঙ্গে যাবার ইস্যু করছিল। ইচ্ছাটা সে প্রকাশ করেনি, কারণ ইচ্ছে করলে লাভ নেই। মীরা আপা তাকে নেবে না। 

মীরার গ্রামের বাড়ি

আজহার সাহেব মেয়ের বঁড়শি ফেলা দেখতে এলেন। তার খুবই মজা লাগছে। বােঝা যাচ্ছে তার ছােট্ট মেয়েটা গ্রাম পছন্দ করতে শুরু করেছে। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছেন মেয়েটার হিপে একটা মাছ ধরুক। ধরবে বলে মনে হয় না, প্রাচীন পুকুরের বুড়ো মাছগুলি ধুলার প্রকতির হয়—এরা সহজে ধরা দেয় না। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, তাের পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তাের কি খুব অসুবিধা হবে। 

শেফা বলল, অসুবিধা হবে না। শুধু নাক ডাকতে পারবে না। তোমার নাক ঢাকার শব্দে মাছ পালিয়ে যেতে পারে। 

নাক ডাকব না, শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব। মাছ ধরার একটা মন্ত্র আছে মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিতে হয়।’ 

‘আমি ভুলে গেছি। দেলােয়ার জানতে পারে। ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে 

মনােয়ারা নাশতা নিয়ে এলেন। তিনি আজহার সাহেবের জন্যে আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছেন। 

আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনােয়ারা বললেন, এই শােনাে মীরার ঢাকায় একটা টেলিফোন করা দরকার। ওদের পরীক্ষা নিয়ে কি জানি ঝামেলা আছে। সেই সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। দেলোয়ারকে বলে দেই সঙ্গে |

আজহার সাহেব নিজেই বালিশ নিয়ে এলেন। বালিশে মাথা রেখে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন। 

তাঁর হাতে কয়েকটা পেপারব্যাক। ছুটি কাটাবার সময় তিনি সঙ্গে বেশকিছু বই নিয়ে আসেন। তবে দুটির মধ্যে আরাম করে বই পড়া যাবে। কখনোই পড়া হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার হল যখন বাস্তুত থাকে চরমে তখনই বই পড়া 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১০

চেষ্টা করেননি কেন ? ‘যা আছি তাে ভালােই আছি। মাস শেষে চাচাজী এক হাজার টাকা দেন। আমি একা মানুষ। আমি চলে গেলে চাচাজীর বিষয়সম্পত্তি দেখবে কে । বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া যায় না। 

‘আপনি কি খুব বিশ্বাসী মানুষ ? 

হয়। অবসর সময় কখনােই পড়া হয় না। বই পড়তে গেলেই হাই উঠে ঘুম পায়। এখনাে তাই হচ্ছে হাই উঠছে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও খােলা রাখা যাচ্ছে না। আজহার সাহেব বইয়ের লেখার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন – লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারছেন না। 

বইটা খুবই হাসির হবার কথা, একটুও হাসি আসছে না—কার “There Were Four of us Gorge, and William Samuel Harris, arid Myself, and montmoremcy. We were sitting in my room, smoking, and talking about how bad we were bad from a medical point of view I mean, of 

course.... 

আজাহার সাহেব হাই তুলতে তুলতে ভাবছেন। বাক্যগুলি এত লম্বা কেন ? বাক্যের শেষের দিকে এলে শুরুটা মনে থাকে না। লোকজন হাসবে কখন ? 

‘আপনি বাবার বিষয়সম্পত্তি দেখাশােনার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন ? 

দেলােয়ার উত্তর দিল না। এই মেয়েটা কথাবার্তা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। এই ধরনের বুদ্ধিমতী | মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবধানে বলতে হয় । 

দেলােয়ার সাহেব। 

দেলােয়ারের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করেছে। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মীরা! বাচ্চা একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, কোনােরকম ভুল করছে না। গাড়ি চালাতে চালাতে আবার তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, প্রয়ােজনমতাে হর্ন দিচ্ছে কী আশ্চর্য! শুধু যে দেলােয়ার বিস্মিত হচ্ছে তা না, যে দেখছে সে-ই অভিভূত হয়ে দাড়িয়ে পড়ছে। বিড়বিড় করে কী সব বলছে। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১০

দেলােয়ার সাহেব। 

নেত্রকোনায় কি রেডিমেড প্যান্টের দোকান আছে ? জি আছে।’ “অাপনি দয়া করে নেত্রকোনায় পৌঁছেই একটা প্যান্ট কিনে নেবেন।’ 

সঙ্গে টাকা আনি নাই।। ‘টাকা আমি দেব। আপনি লুঙ্গিটার উপর কোট পরেছেন, আপনাকে সার্কাসের ক্লাউলের মতো লাগছে।’ 

‘আপামণি লুঙ্গি বদলায়ে পায়জামা পরেছি। চাচিত্রী লুঙ্গি বদলাতে বললেন, এইজন্যে বদলেছি। আপনি বােধহয় লক্ষ্য করেন নাই।” ৮. পায়জামার উপর কোট আরাে জঘন্য। আপনি অবশ্যই একটা রেডিমেড় প্যান্ট কিনবেন এবং শুনুন, একজোড়া জুতাও কিনবেন। আমি টাকা দেব। 

“জি আচ্ছা।’ 

আমার কথায় আশা করি কষ্ট পাচ্ছেন না ? 

‘লােকজন কী অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে লক্ষ্য করেছেন? 

‘একটা শিম্পাঞ্জি গাড়ি চালিয়ে গেলে লােকজন যেভাবে তাকে দেখত— আমাকে সেইভাবেই দেখছে। নিজেকে শিম্পাঞ্জি শিম্পাঞ্জি মনে হচ্ছে। আর আপনাকে মনে হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ট্রেইনার। ট্রেইনার শব্দের মানে জানেন তাে ? 

“জি জানি, শিক্ষক। 

সরি, ট্রেইনার শব্দের মানে তো আপনি জানবেনই। আপনি যে বি. এ. পশি এই তথ্য মনে থাকে না। বি. এ.-তে আপনার রেজাল্ট কী ছিল ? 

থার্ড ক্লাস। 

থার্ড ক্লাসের জন্যেই বােধহয় কোথাও কোনাে চাকরিটাকরি পাচ্ছেন না, তাই না ?” 

‘জি না। চেষ্টা করি নাই।

 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *