হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১২

জীবন নিশ্বাস নিতে পারবেন। 

নেত্রকোনা থেকে ফেরার পর মেয়েকে দেখে তার ভালো লাগল । বেশ হাসি খুশি মেয়ে। কয়েকদিন ধরে মীরার মুখে যে অন্ধকার ভৰি ছিল তা নেই। বরং খানিকটা ঝলমলে ভাব চলে এসেছে। অবশি এটা অভিনয়ও হতে পারে। তার বড় মেয়ে অভিনয় ভালাে জানে। ছােটটা একেবারেই জানে না।

মীরার গ্রামের বাড়ি 

মনােয়ারা মীরাকে বললেন, কোনাে সমস্যা হয়েছিল? মীরা হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কোনাে সমস্যা হয়নি। ‘মেয়েমানুষ গাড়ি চালাচ্ছে এটা দেখে লােকজন মজা পায়নি?” ‘খুব মজা পেয়েছে। 

ঢাকায় লাইন পেতে সমস্যা হয়নিতাে? 

উহু! প্রথম রিঙেই সাবের টেলিফোন ধরল এবং আমার গলা চিনতে পারল না। বলল আপনি কে বলছেন? 

তাহলে সাবের সঙ্গে কথা হয়েছে?’। 

‘হ্যা এটা আমার জরুরি কথা। দাদাজান কাল রাতে ঘুমিয়েছেন শেফার সঙ্গে এবং তাকে নাকি বলেছেন তিনি এক রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমাবেন, আর এক রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবেন। এইভাবে চলতে থাকবে এটা শোনার পর থেকে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। 

হাতপা ঠাক্ষ্মা হবার কা আছে? দাদী নাতনির সঙ্গে ঘুনবে না!” । | না ঘুমবে না। অবশ্যই আমার সঙ্গে না। একটা লেপের নিচে আমি আর লালীজান । উনার হাড়ি-হাছিদ্র পা উনি আমার গায়ে হল দেবেন। তার শরীর থেকে আসবে শুকনা গােবরের গন্ধ । অসহ্য । মা তুমি যেভাবেই হােক আমাকে বাটা। মনােয়ারা চিন্তিত মুখে বললেন, উনি তাের সঙ্গে ঘুমুতে চাইলে আমি না করব কীভাবে? 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১২

‘এইসব প্যাচাল বুদ্ধি তােমার খুব ভালাে আছে। তুমি একটা বুদ্ধি বের কর। বিনিময়ে আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি যদি বল আমাকে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করতে হবে তাতেও রাজি আছি । 

মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বললেন, $| জালামি ধরনের কথা বলিল না। বাবার সঙ্গে গল্প করবি না তো কার সঙ্গে গল্প করবি 

এ ভালো আছে তাে। “ভালােই আছে তবে ওর মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। গলা কেমন যেন ভারী ভারী শুনাল। কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো আমার গলা শুনেই সে তার নিজের গলা ভারী করে ফেলল।’ 

মীরা হাসতে হাসতে বলল, মা তুমি কি জানাে যে বাংলাদেশে প্রথম দশজন সেরা বিরক্তিকর গল্প-কথকদের মধ্যে বাবা আছেন? হি হি হি। 

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আজহার সাহেব তার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। মনোয়ারা চা নিয়ে ঢুকলেন। মীরা তার মাকে চোখে-চোখে বলল, মা আমাদের বাঁচাও। মনোয়ারা হাসলেন এবং তিনিও গল্প শুনতে বসলেন। ঢাকায় থাকার সময় সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করা প্রায় কখনােই হয় না। শেফা বসবে টিভির সামনে, এক্স ফাইল বা কিছু দেখবে। মীরা থাকবে তার ঘরে, তার দরজা থাকবে বন্ধ। বন্ধ-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে সিডির গানের শব্দ ভেঙে ভেঙে আসবে। তার দরজায় ধাক্কা দিলে সে বিরক্ত গলায় বলবে, পরে আলো তাে মা। এখন দরজা খুলতে পারব না। . আজহার সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত গলায় বললেন, শীতের সন্ধ্যায় আনন্দময় ব্যাপার হচ্ছে গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিলাক্স করা। শীত যত বেশি পড়বে রিলাক্সেশন তত বেশি হবে। বরফের দেশে কী হয় দেখ। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। ঘরের ভেতরে ফায়ার-প্লেসে কাঠ পুড়ছে। কাঠের গনগনে আগুন। সেই আগুনের পাশে গােটা পরিবার জড়াে হয়েছে। আগুন তাপাতে তাপাতে কফি খাচ্ছে। ২৮ শেফা বলল, কফি খাচ্ছে না বাবা, মদ খাচ্ছে। 

আজহার সাহেব বললেন, এটা মা তুমি একটা ভুল কথা বললে। ইংরেজি ছবি দেখে-দেখে তোমার এই ধারণা হয়েছে। আসলে ওরা মদ্যপান কম করে। বরং আমি দেখি বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে এটা অনেক বেশি। অর্থবিত্তের প্রমাণ হিসেবে মদ্যপানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মদ্যপান হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১২

শেফা গম্ভীর হয়ে বলল, বাবা তােমায় সাধারণ কথাও বক্তৃতার মতাে কেন? 

মনােয়ার হেসে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বললেন, এই শোনাে তুমি একটা মজার গল্প আমাদের শুনাও তো । | মজার গল্প 

HTহা মজার গল্প । তােমার মেয়েদের ধারণা তুমি মজার গল্প জানাে না।’ 

মজার গল্প মানে কি ঞ্জ গল্প?—আচ্ছ। শোনাে নেদারল্যান্ডের এবােরজিলের একটা অদ্ভুত কাস্টমের কথা বলি। নেদারল্যান্ডের এক প্রাচীন আদিবাসী গােষ্ঠী আছে, তাদের অদ্ভুত সামাজিক কিছু নিয়মকানুন আছে । 

তাদের মধ্যে একদল আছে যাদের বলা হয় Si] Eater. সিন ইটার মানে হল পাপ-খাদক। তারা অন্য মানুষদের পাপ খেয়ে ফেলে। 

মনােয়ারা বললেন, ও মাগো। কী বলছ তুমি! পাপ খাবে কীভাবে? 

মনোয়ারার এত বিস্মিত হবার কারণ নেই। তিনি এই গল্প এর আগে তিনবার শুনেছেন। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন গল্প জমিয়ে দেবার জন্যে। 

আজহার সাহেব বললেন, মনে কর কেউ মারা গেল। তখন করা হয় কি, মত ব্যক্তিকে নগ্ন করে মাটিতে শুইয়ে রাখা হবে। তার শরীরে নানান খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে রাখা হবে। তারপর খবর দেয়া হতে Sin eaterলের । SiTI eater আসবে, তার চেটেপুটে মৃতদেহের উপর থেকে খাবারদাবারগুলি খেয়ে ফেলবে। বিশ্বাস করা হয় যে তারা খাবারদাবারের সঙ্গে মতব্যক্তির সব পাপ খেয়ে ফেলবে। মৃত ব্যক্তি হয়ে যাবে পুরোপুরি নিস্পাপ এবং সে সরাসরি স্বর্গে ফলে যাবে । আর Sin eateরা যাবে অনন্ত নরকে। 

শেফা এবং মারার ভেতর গল্প শুনে কোনো ভাবান্তর হল না, কিন্তু মনােয়ারা চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। ঘেন্না-মেশানাে গলায় বললেন- তওবা আসতাগফিরুল্লা, বলে কী? 

আজহার সাহেব উৎসাহিত হয়ে দ্বিতীয় গল্প শুরু করতে যাবেন, তখন দেলােয়ার খুকে খবর দিল স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব কয়েকজন শিক্ষক লিয়ে এসেছেন। আজহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন। স্কুলের মাস্টাররা প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই এ-বাড়িতে আসহেন। মুগ্ধ হয়ে আজহার সাহেবের গল্প শুনছেন । আজহার সাহেব তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দময় কিছু সময়

 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-১৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *