হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৫

 পানির অনেক নিচে এরা মাটির মাছ উপর শুয়ে থাকে। এদের একেকটার বয়স দুশ তিনশ বছর । এদের হা প্রকাণ্ড । শরীর লোহার মত শক্তন । এরা প্রচণ্ড রাগী। বেশিরভাগ সময় এরা ‘ঘুমিয়ে থাকে। যে তাদের ঘুম ভাঙায় তাকে তারা কিছুতেই মা করে না।

মীরার গ্রামের বাড়ি 

সুন্দি-ফিকির এ ৱে এরা তাকে পানিতে নিয়ে যায়। তার পর খুবলে খুবলে চোখ খেয়ে ফেলে। এইসব কথা শেফাকে কেউ বলেনি। তার মনে 

মাছ ট্রোল বোয়েছে।’ মাছ টোপ খেয়েছে খুব ভালাে কথা । তুই এমন ছটফট করছিস কেন? কেমন জানি লাগছে । 

কেমন লাগালাগির কিছু নেই। মাছটা এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। সুতা ছাড়তে হবে। দেথি ছিপটা আমার হাতে ।না তােমার হাতে দেব না। তুমি আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। যা করতে বলবে তাই করব। সুতা কীভাবে ছাড়তে হয়?” 

> শেফার কথা শেষ হবার আগেই মাছ আবার সুতা টানা শুরু করল এবং প্রথমবারের মতাে তাকে দেখা গেল। সে পানি ছেড়ে শুন্যে লাফিয়ে উঠল। 

আজহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, একি! এ তাে বিরাট মাছ! এই মাছ ধরে রাখা তাের-আমার কর্ম না। এক্ষুনি সুতা ছিড়ে ফেলবে। 

শেফা বলল, তুমি বােকার মতাে দাড়িয়ে থেকো না বাবা। আমাকে কী করতে হবে বল । 

এ কী করতে হবে আমি নিজেওতাে জানি না।’ 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৫

 শেফা ছিপ ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে তাকে-সুদ্ধ টেনে পানিতে ফেলে দেবে। অ|জহার সাহেব মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এল । উ45ায় তারও শরীর কাঁপছে। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, যেভাবেই হােক মাছটাকে ষোল ড্রা প্রায় তুলতে হবে। আর তা ছাড়তে হবে। 

. শেফা বলল, আর কীভাবে সুতা ছাড়শ? 

 আজহার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আমি নিজেওতাে মা তাের মতই আনাড়ি। অবশ্যি আমার নিজেকে ওল্ড ম্যান দ্য সি’র বিকৃসারম্যানের মতাে লাগছে। ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি পড়েছিস? । | ‘এই সময় পড়াশােনার কথা বলবে নাতাে বাবা, ভালো লাগছে না।’ 

আলেশ হে ওয়ের লেখা অসাধারণ দুলাল।। এ বাবা তুমি সবসময় বিরক্ত কর কে?’ 

‘নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপন্যশি।’ 

বাবা প্লিজ।’ 

শেফা আমি এক কাজ করি। আমি বরং পুকুরে নেমে পড়ি । আমি দেখেছি ছিপে বড় মাছ ধরা পড়লে একজন পুকুরে নামে।’ 

“তাহলে তুমি নেমে পড়। কথা বলে সময় নষ্ট করহ কেন?” “তুই ছিল শক্ত করে বলে কি| 

হুইলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শেফার শরীর কাপছে । বুক ধক ধক করছে । আর কিছুক্ষণ এ-রকম চললে শেফা মনে হয় টেনশানে মরেই যাবে। এমন অবস্থায় হঠাৎ সুতা টানা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। পৃথিবী যেন হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। আশ্চর্য গাছের পাতাও পড়ছে না। | এ-রকম কীভাবে হয় । পৃথিবী এমন শব্দহীন হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনাে সমস্যা হয়েছে। ভৌতিক কিছু। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৫

শেফা কাঁদো-কাঁদো গলায় ডাকল, বাবা। 

শেফাকে ভীষণ চমকে দিয়ে শেয়ার ঠিক পেছন থেকে আইজি সাহেব বললেন, কী হয়েছে না ‘আমি ধরে আছি। 

আজহার সাহেবের গায়ে শীতের কাপড়। কাশ্মিরি কাজ-করা লাল সােয়েটার। 

তিনি সেই কাপড়েই পানিতে নেমে পড়লেন। 

মনােয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। গাড়ির সীটে আধাশােয়া হয়ে পড়ে আছেন। তার মাথায় সবসময় ঘোমটা দেয়া থাকে, এখন ঘােমটা নেই। শাড়ির আঁচল সরে গেছে। জানালা খানিকটা খােলা। শীতের বাতাসে তার মাথায় কাঁচাপাকা চুল উড়ছে। মীরার মনে হল জানালাটা বন্ধ করা দরকার। মা’র ঠাণ্ডা লেগে যেতে। পারে আবার মনে হচ্ছে এই ভালাে বন্ধ বাতাসে না- থেকে খোলা বাতাসে থাকাই ভালাে। ঘশ্ন ভালাে হবে। মা’ব্ল ঘুম দরকার। আজ রাতে মা নিশ্চয়ই দুলবে না। সারারাত জেগে থাকবে । এবং তার শরীর ভয়ংকর খারাপ করবে। 

মারা মা’র একটা ব্যাপারে মন্ত্র। সে কখনাে চিন্তাও করেনি তার মা এই ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে এবং এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে । পরিস্থিতি মানুষকে তৈরী করে। কথাটা বােধহয় ঠিক। পরিস্থিতি যখন পাল্টে যায় তখন মানুষ পাল্টে যায়। মুরগি জবে করার দৃশ্য দেখে যে মানুষ ভয়ে ভিরমি খায় সে-ই ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে। তখন তার হাত কাঁপে না। মানুষ জলের মতাে। এর সঙ্গে সঙ্গে সে তার আকার বদলায়। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৫

বাড়ির পরিস্থিতি বদলে গেছে, মা বদলে গেছেন। বাবা নতুন পরিস্থিতির খবর জানেনও না। তিনি যখন জানবেন তিনি বদলে যাবেন। শেফা বদলাবে। দেলােয়ার বদলাবে। এখন দেলোয়ার ভাত মুখে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। তার কোলে পানিভর্তি জেরিকেন। এক-একবার গাড়ি ঝাকুনি খাচ্ছে।

জেরিকেনের পানি তার গায়ে পড়ছে। সে নির্বিকার। দেলােয়ার পানি, সঙ্গে নিয়েছে যুলি যাবার পথে ও চাচীজী বমি করেন। পানির অভাবে যেন তার অসুবিধা না হয়। দলের একটু পরপর ছাড় দুলিয়ে নেয়ারাকে দেখছে। মান্নার মনে হল দেলােয়ার বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে কী যেন বলছে। জানতে ইচ্ছা করছে। পরিস্থিতি আগের মতাে থাকলে সে জিজ্ঞেস করত, দেলােয়ার সাহেব বিড়বিড় করছেন কেন? 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৫

‘আচ্ছা এই মানুষটাকে সে দেলােয়ার সাহেব ডাকে, না দেলােয়ার ভাই ডকে আশ্চর্য, মনে পড়ছে না। তার নিজের মাথাও এলােমেলাে হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মাথা এলােমেলাে হতে দেয়া যাবে না। খুব ভয়াবহ সময় তার সামনে  ভয়ংকর সম্ভবত  শাই। এই রাত পার করতে পারলে বাকি জীবন সুখে-দুঃখে কেটে যাবে। আজ রাত তার জন্যে কালরাত । সব মানুষের জীবনে একটা কালরাত থাকে । লখিন্দরকে যে রাতে সাপে কাটল সে রাতটা ছিল বেহুলার কালরাত । 

বেহুলার চেয়ে সে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বেহুলা তার কালরাতের খবর আগেভাগে জানত না। সে জানে। না, ভুল ভাবা হচ্ছে । বেহুল। জানত তার মহাবিপদের কথা । সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে লােহার সরদার করেছি। তাতে লাভ হয়নি। চুলের মতো কাল নাগিনা কোন এল, ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-২৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *