হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৩

 আজহার সাহেব বললেন, অনেকক্ষণ থাকবরে মা। সাধ মিটিয়ে নৌকা। ভ্রমণ। তাের ভালাে লাগছে না ? মীরার গ্রামের বাড়ি

শেফা শুকনাে গলায় বলল, ভালাে লাগছে। “তােরা শহরবাসী হয়ে গাছপালা ভুলে গেছিস। বল্ দেখি ঐটা কী গাছ?’ 

জানি না বাবা। ‘মীরা তুই বলতে পারবি ? 

বই যে পড়ছিস সেতাে দেখতেই পাচ্ছি। গল্পের বই ? IELT না, জোকস-এর একটা বই। “এত ঝামেলা করে নৌকা নিয়ে বের হয়েছি কি জোকস-এর বই পড়ার জন্যে? 

‘মনােয়ারা তুমি পারবে ? ‘শ্যাএা গাছ। ‘রাইট— এটাই হল বিখ্যাত শ্যাওর গাছ। শেফা বলল, বিখ্যাত কেন ? 

আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, বিখ্যাত কারণ গ্রামের মানুষদের ধারণা শ্যাওরা গাছে ভূত থাকে। এই গাছগুলি লােকালয়ে হয়ও না। জংলামতাে জাগা ছাড়া শ্যাওরা গাছ হয় না। গাছের পাতালি ও খুব ঘন। বাকি। আঁকড়া। চাদের আলাে যখন পড়ে তখন পাতার কারণে মনে হয় ভূত-প্রেত বলে আছে। 

শেফা উঠে দাড়াল। বাবার জ্ঞানীকথা শুরু হয়ে গেছে। তার অসহ্য লাগছে। বাথরুমের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্ঞানীকথা শুনতে ভালাে লাগে না। অনেকক্ষণ নৌকায় থাকতে হবে শুনে তার বাথরুম আরাে বেশি লাগছে। কিছু একটা করা দরকার। চুপিচুপি মাকে বলা যায় না। না, মাকে বললে হবে না। বলতে হবে আপাকে। আপা একটা ব্যবস্থা করবেই। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৩

আজহারউদ্দিন বললেন, শেফা যাচ্ছিস কোথায় ? 

মা-র কাছে যাচ্ছি বাবা। 

‘আমি সকাল থেকে লক্ষ্য করছি তুই মুখ ভোঁতা করে বসে আছিস। কারণটা কী? 

মীরা কিছু বলার আগেই মনােয়ারা শঙ্কিত গলায় বললেন, ওর শরীর ভালো না। জুম । 

জুরটর কিছু না, ও ইচ্ছা করে এ-রকম করছে। আমি গত দুদিন ধরে ওকে লক্ষ্য করছি। এ-রকম একটা ভাব করছে যেন নির্বাসনে এসেছে। হােয়াই। বেড়াতে যেতে হলে নেপালে যেতে হবে? সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে নিজের দেশে বেড়ানাে যায় না? মীরা, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকা আমার দিকে। 

মীরা বাবার দিকে তাকাল । “জোকস-এর বইটা নদীতে ফেলে দে। ফেল বললাম । দ্যাটস এন অর্ডার।’ 

শীরা বইটা দীতে ফেলে দিল। বই টুপ করে ডুবল না। ভেসে রইল । দেলােয়ার দুঃখিত চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে আছে । মাজহারউদি ন গরি গলায় ডাকলেন, দেলােয়ার। 

দেলােয়ার ভীত গলায় বলল, জ্বি চাচাজী। | ‘নৌকা ঘুরাতে বল । আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়িতে ফিরে যাই। মেয়েরা জোকের বই পড়ুক।’ 

| দেলােয়ারকে কিছু বলতে হল না। মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে ফেলল। শেফী খুব খুশি। সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভালাে দিক আছে । বাবা আপার ওপর রাগ করল বলেই তারা এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারছে, নয়তাে দুপুর পর্যন্ত বাথরুম চেপে নদীতে নদীতে ঘুরতে হত। শেফা মনে মনে বলল, আপা থ্যাংকস । আপার জন্যে শেফার বেশ মন খারাপ লাগছে। এতগুলি মানুষের সামনে বেচারি বকা খেল। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৩

মায়ার পরিস্থিতি সামালাবার জন্য আজাহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, এই তুমি চা খাবে? ক্লাঙ্কে করে চা এনেছিলাম। 

আজহার সাহেব বললেন, না।। 

মনােয়ারা মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবি? খেয়ে দেখ ঠাণ্ডার মধ্যে চা খেতে ভালাে লাগবে। কাপে ঢেলে দেই? 

মা বলল, মা তুমি একটু অলর সে তা, আমি বাম করব। বলতে বলতেই সে হড় হড় করে বমি করল। মনােয়ারা মেয়েকে ধরতে এগিয়ে এলেন। মীরা বলল, না প্লিজ কাছে এসাে না। 

– শেফার এখন বাবার জন্যে খারাপ লাগছে। সে পরিকার বুঝতে পারছে আপাকে বমি করতে দেখে বাবার মন খারাপ হয়েছে। অকারণে অসুস্থ মেয়েকে এতলি মানুষের সামনে বকা দেয়া হল। শেফার ধারণা বাবার খুব ইচ্ছা করছে বড় মেয়ের কাছে যেতে । চক্ষুলজ্জার জন্যে পারছেন না। শেফা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, আহা চক্ষুলজ্জার মজা অতি সামান্য কারণে মানুষ কত ভালাে কাজ করতে পারে না। সে নিজেও পারে না। একবার স্কুল ছুটির পর শেফা গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিল। শাহবাগের মােড়ে সিগন্যালে গাড়ি থামল। বুড়াে এক ভিক্ষুক তার জানালার সামনে মাথা নিচু করে খুবই মিষ্টি গলায় বলল, সুন্দর আফা, একটা টেকা দিবেন ? চা খামু।

তার কথা বলার ধরন, তার হলি, শেফার এত ভালো লাগল, কিন্তু চক্ষুলজ্জার জন্যে টাকাটা বের করতে পারল না। উল্টা কসিন গলায় বলল, যাও মাফ কর। মাফ কর” বললে যে-কোনাে ভিখিরি রাগ করে । এই বুড়াে রাগ না করে ঠিক আগের মতাে মিষ্টি করে হাসল। তার পরই চলে গেল অন্য গাড়ির কাছে। শেফার খুবই ইচ্ছা করছিল ভিখিরিটাকে ভাক দিয়ে আনে। ড্রাইভার চাচাকে প্রায় বলেই ফেলছিল, একে ডাক দিন তাে। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলা হল না । এই বুড়ার কথা শেফার মাঝে মাঝেই মনে হয়। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৩

পারে। মনােয়ারা এসে সাবধানে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। ঘুমন্ত মানুষের গায়ে চাদর ট্রানালে তারা হঠাৎ যেমন কিছু নড়াচড়া করে সেও তাই করল । এবং নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হল। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। ঘরে হারিকেন দেয়া হয়েছে। হারিকেনের আলােয় ঘরটা আরাে অন্ধকার লাগছে। এই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে। পল্লী বিদ্যুত। পল্লী বিদ্যুতের নিয়ম হল রাত দশটার পর কারেন্ট আসে। বাকি রাতটা মিটিমিটি করে বাতি জ্বলে । সকালবেলায় আর কারেন্ট নেই। মানুষজন এতেই খুশি। গ্রামে ইলেকট্রিসিটি আছে এই আনন্দই তাদের রাখার জায়গা নেই। দেলােয়ার তাকে বলছিল, বুঝছেন আপামণি শহর বন্দরে যেমন ঘনঘন কারেন্ট যায়, আমাদের এইখানে যায় না। দশটা- এপাত্রোটার সময় বিদ্যুত আসে। একবার মাসলে আর যাওয়া যাওয়ি নাই। সক্কালবেলায় যাবে । তাও বেলা উঠলে ।

মীরা বলল, আপনাদের তাে খুবই সুবিধা। 

দেলােয়ার সবক’টা দাঁত বের করে বলল, বিদ্যুতের সুবিধা আমাদের আছে এইটা অস্বীকার যাবে না।

 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৪

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *