হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

বাদশাহ নামদার পর্ব –২০

কথা বলতে বলতেই বাবর তীক্ষ্ন চোখে তাকালেন । অনেক দূরে ধুলার ঝড়ের মতো উঠেছে । অশ্বারোহীর দল কি ছুটে আসছে ? কোনো বিদ্রোহী বাহিনী ?

হওয়ার তো কথা না । অশ্বারোহীর দল আগ্রার দিক থেকেই আসছে । এমন কি হতে পারে আগ্রার দুর্গে বন্দি গোয়ালিরের রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবারকে উদ্ধার করতে সাহায্যকারী কেউ এসেছে ।

 বাবর ইশারা করলেন । মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধোবস্থায় পরিস্থিতি তৈরি হলো । সিঙ্গা বাজানো হলো । বাদশাহের প্রিয় পিতজুচাক ঘোড়া নিয়ে একজন ছুটে এল । বাদশাহ তখ্ন রওয়ান ছেড়ে ঘোড়ার উঠলেন । দূরে ধুলার ঝড় ঘন হচ্ছে । সৈন্যসংখ্যা আন্দাজ করা যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে রোদে ঘোড়ার আরোহীদের শিরস্ত্রাণ ঝলসে উঠছে ।

বাবরের সংবাদ সরবরাহ দলের চারজন ঘোড়সওয়ার ছুটে যাচ্ছে । তাদের হাতে আয়না । তারা আয়নার আলো ফেলে বোঝার চেষ্ঠা করবে কারা এসেছে । সম্রাট বাবরের চোখমুখ শক্ত । দৃষ্টি তীক্ষ্ন । হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি সহজ হলো । তিনি শরবতের গ্রাসের দিকে হাত বাড়ালেন । সৈন্যবাহিনী নিয়ে কে আসছেন তিনি জানেন । আসছে পুত্র হুমায়ূন মীর্জা ।

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

যুদ্ধাবস্থার তাতে পরিবর্তন হলো না । সম্রাটদের পুত্র থাকে না, ভাই থাকে না । তারা সবসময়ই একা । হুমায়ূন যে সসৈন্যে তাকে আক্রমণ করতে আসছে না এর নিশ্চয়তা কোথায় ? হুমায়ূন মীর্জার অধীনে বিশাল সৈন্যবাহিনী আছে । আগ্রা দুর্গ দখল করার জন্যে পাঁচ শ’ অশ্বারোহীর একটি বিশেষ দল সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে । বাবর বিড়বিড় করে নিজের রচনা চারপদী কবিতা আবৃত্তি করলেন-

সম্রাটের বন্ধু তার সুতীক্ষ্ন  তরবারি এবং তার ছুটন্ত ঘোড়া আর তার বলিষ্ঠ দুই বাহু তার বন্ধু নিজের বিচার

এবং পঞ্জরের অস্থির নিচের কম্পবান হৃদয়

হুমায়ূন মীর্জা ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন । তিনি বাবার সামনে এসে নতজানু হয়ে দাঁড়ালেন । তার হাতে নীল রেশমি রুমালে কী যেন লুকানো । বাঁ হাতে রুমাল রেখে ডান হাতে তিনি নিজের কপাল স্পর্শ করে সেই হাতে ভূমি স্পর্শ করলেন । তিনবার এই কাজটি করে কুর্নিশ পর্ব শেষ করা হলো ।

বাবর বললেন, পুত্র তোমার হাতে কী ?  

হুমায়ূন বললেন, সামান্য উপহার ।

পিতার প্রতি পুত্রের উপহার কখনোই সামান্য না ।

হুমায়ূন বললেন, অতি মহার্ঘ উপহারও মহাপুরুষের কাছে সামান্য ।

বাবর প্রীত হলেন । কবিতার এই চরণটি তাঁর লেখা । পুত্র মনে করে রেখেছে এবং সময়মতো বলতে পেরেছে । বাবর বললেন, উপহার দেখাও ।

হুমায়ূন মীর্জা রেশমি রুমাল খুললেন । তার হাতে পায়রার ডিমের চেয়েও বড় একটা হীরা । সূর্যের আলো হীরাতে পড়েছে । মনে হচ্ছে হাতে আগুন লেগে গেছে । বাবর মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ্ !

হুমায়ূন মীর্জা বললেন, এই হীরার নাম কোহিনুর । এর ওজন আট মিস্ কাল্ । বলা হয়ে থাকে এই কোহিনূরের মূল্য সারা পৃথিবীর সকল মানুষ দু’দিন পানাহার করতে পারবে ।

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

এটা কি সেই কোহিনূর যা সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি ভারতে এনেছিলেন ?

এটি সেই কোহিনূর । আপনি হাতে নিলে আমি খুশি হব । সম্রাট বাবর হীরকখণ্ড হাতে নিলেন । মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর বললেন, পুত্র তোমার উপহার পেয়ে আমি খুশি হয়েছি । এতই খুশি হয়েছি যে এই কোহিনূর তোমাকেই আমি উপহার হিসেবে দিচ্ছি । পিতার উপহার গ্রহণ করো ।

বাবর লক্ষ করলেন হুমায়ূনের চোখ ছলছল করছে । এ-কী ! এত অল্পতে তার ছেলের চোখে পানি আসছে কেন ? একদিন সে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করবে । পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে রাজদূতরা এসে তাকে কুর্নিশ করে বলবে, বাদশাহ নামদার । তাকে হতে হবে ইস্পাতের মতো কঠিন ।

সম্রাট বাবরের ভ্রু কুঞ্চিত হলো । তিনি উঁচু গলায় বললেন, পু্ত্র শোনো । শুধু এই হীরক খণ্ড না, ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থ আমি তোমাকে উপহার দিলাম । বলো, মারহাবা ।

মারহাবা ।             

হুমায়ূন মীর্জা এর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন । সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর পিতার দিল্লীর কোষাগার দখল করে রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বাদাখশানের দিকে । আগষ্ট মাস,১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দ । এই কাজ তিনি কেন করলেন তা এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের কাছে রহস্যাবৃত ।

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

সম্রাট বাবর তাঁর স্ত্রী মাহিম বেগমের সঙ্গে খেতে বসেছেন । সম্রাট খাচ্ছেন, মাহিম বেগম একটির বাটি এগিয়ে দিচ্ছেন । সব খাবারই পরীক্ষা করা, তারপরেও স্বামীর পাত্রে খাবার দেওয়ার আগে নিজে চেখে দিচ্ছেন । বাবর বললেন, তোমার পুত্র যে আমার রাজকোষে লুট করে পালিয়ে গেছে এটা জানো ?

জানি ।

কাজটা সে কেন করেছে জানো ?

জানি না ।

তার কি শাস্তি হওয়া উচিত ?

উচিত । তবে আপনি দয়ালু পিতা । হুমায়ূন মীর্জা আপনার অতি আদরের প্রথম সন্তান ।

বাবর বললেন, সম্রাটের কোনো পুত্র থাকে না । স্ত্রী থাকে না । আত্মীয়-পরিজন থাকে না । সম্রাটের থাকে তরবারি ।

আপনার থাকে । কারণ আপনি অন্য সম্রাটদের মতো না । আপনি আলাদা ।

আমি প্রধান উজির মীর খলিফার সঙ্গে পরামর্শ করেছি । প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার পক্ষে । কঠিন শাস্তি দেওয়া হলে তার ভাইরা সাবধান হবে । অন্য রাজপুরুষরাও সাবধান হবে ।

মাহিম বেগম চুপ করে রইলেন । বাবর বললেন, প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জাকে মৃত্যুদণ্ড শাস্তির পক্ষে । হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মৃত্যু ।

মাহিম বেগম বললেন, প্রধান উজির কী বলছেন তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না । আপনি কী ভাবছেন তা গুরুত্বপূর্ণ ।

বাবর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন । অদ্ভুত এই হাসি দেখে হঠাৎ মাহিম বেগমের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ।

হুমায়ূন মীর্জা বাদাখ্ শানের পথে । এখন যাত্রাবিরতি । রাজকীয় তাঁবু ফেলা হয়েছে । তিনি গরমে অতিষ্ঠ । স্নানের বাসনা প্রকাশ করেছেন । স্নানপাত্রে পানি ঢালা হচ্ছে । আট ভাগ পানির সঙ্গে এক ভাগ গোলাপের পাপড়ি মেশানো হবে । পানিতে সামান্য কর্পূরও দেওয়া হবে । কর্পূর মেশানো পানিতে দৈত্যাকৃতি পাখা দিয়ে হাওয়া দেওয়া হবে । এই হাওয়ায় কর্পূর উড়ে গিয়ে পানি দ্রুত শীতল হবে ।

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

 হুমায়ূন মীর্জার হাতে রঙতুলি এবং চীন দেশ থেকে আনা শক্ত তুলট কাগজ । তিনি আগ্রহ নিয়ে একটা পাখির ছবি আঁকছেন । পাখির পালক ঘন নীল । ঠোঁট এবং পা লাল । পাখিটা মনের আনন্দে তাঁর তাঁবুর পাশেই ঘুরছে । জনসমাগম দেখে ভয় পাচ্ছে না । কেউ এর নাম-পরিচয় বলতে পারছে না । হুমায়ূন মীর্জার সার্বক্ষণিক সঙ্গী দু’জন চিত্রকর এবং একজন হরবোলা পাখির পরিচয় বের করার চেষ্টায় আছে । চিত্রকরদের একজন হুমায়ূন মীর্জার ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে পাখি-বিষয়ক বই নিয়ে এসে পাতা ওল্টাচ্ছেন । অন্যজন হুমায়ূন মীর্জার মতোই পাখির ছবি আঁকছেন । যেন পরে ছবি দেখে পাখির পরিচয় পাওয়া যায় । হরবোলা অপেক্ষা করছে কখন পাখি ডেকে ওঠে । একবার ডাকলেই হরবোলা বাকি জীবন এই ডাক মনে রাখবে । পাখি এখনো ডাকছে না।

 রাত অনেক হয়েছে ।

সম্রাট বাবর ঘুমাবার প্রস্তুতি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছেন । ইয়েমেন থেকে আনা হালকা সৌরভের আগরবাতি জ্বলছে । হাবশি খোজারা টানাপাখা টানছে । বড় বড় মাটির পাত্রে পানি রাখা আছে । তাদের গায়ে বাতাস পড়ায় ঘর শীতল । হিন্দুস্থানের অতি গরম আবহাওয়া বাবর এখনো হস্য করে উঠতে পারেন নি । গরমের রাতগুলিতে প্রায়ই তাকে অঘুম কাটাতে হয় ।

মাহিম বেগম ঘরে ঢুকে সম্রাটকে কুর্নিশ করলেন । সম্রাট স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না । আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি । রাজকোষে লুন্ঠনের অপরাধে তোমার পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম । তাকে ধরে আনার জন্যে আমার বিশাল সেনাবাহিনী আগামীকাল প্রত্যুষে যাত্রা করার কথা । কিছুক্ষণ আগে আমি তোমার পুত্রকে ক্ষমা করেছি ।

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

মাহিম বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, সম্রাট যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি সম্রাটের পায়ে চুম্বন করতে আগ্রহী ।

অনুমতি দিলাম ।

মাহিম বেগম সম্রাটের পায়ে মুখ ঘষতে লাগলেন । সম্রাট সামান্য চমকালেন । এই দৃশ্যের সঙ্গে কি তাঁর দুঃস্বপ্নের কোনো মিল আছে ? স্বপ্নে একটা পঙ্গু ভেড়া এই ভঙ্গিতেই তার পায়ে মুখ ঘষছিল । মাহিম বেগম তার অতি আদরের স্ত্রী । হুমায়ূন মীর্জার মাতা।

মাহিম বেগম বললেন, কাবুলের দুর্গে হুমায়ূন মীর্জার জন্ম হয় । তাকে দেখতে এসে আপনি খুশি হয়ে আমাকে এক শ’ আশরাফি উপহার দেন । তখন আমি আপনাকে কী বলেছিলাম আপনার কি মনে আছে ?

সম্রাট ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মনে আছে । তুমি বলেছিলে স্বর্ণমুদ্রার আমার প্রয়োজন নাই । আপনি শুধু পুত্রে গায়ে হাত রেখে বলবেন. আপনি তার উপর কখনো রুষ্ট হবেন না । শোনো মাহিম বেগম, আমি সেই প্রতিজ্ঞা কিন্তু করি নাই । যাই হোক অনেকক্ষণ পায়ে মাথা রেখেছে এখন মাথা তোল ।

মাহিম বেগম বললেন, আপনার কিছু বিষয় আমি বুঝি না । আপনার পরম শত্রু ইব্রাহিম লোদী পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত । এই ইব্রাহিম লোদীর লোদীর মা’কে আপনি রাজ-অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছেন । কারণ জানতে পারি ?

বাদশাহ নামদার পর্ব – ২

পার । এই মহিলা কোনো অপরাধ করেন নি । নিহত পুত্রের চেহারা দেখে শোকে অধীর হয়েছেন ।

আমি তাঁর প্রতি দয়া করব না !

আপনি অবশ্যই করবেন । আপনাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করাই আমার অন্যায় হয়েছে ।

(ইব্রাহিম লোদীর মা প্রথম সুযোগেই বাবরকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেন । তাঁর এই অপরাধও ক্ষমা করা হয় ।)

৪র্থ জিলকদ্ ৯১৩ হিজরির * মঙ্গলবার রাতে নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন মীর্জা জন্মগ্রহণ করেন ।

তিনি পিতার দিক থেকে তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের পঞ্চদশ পুরুষ ।

নাসিরুদ্দিন মোহম্মদ হুমায়ূন মীর্জা নামের আবজাদ (আরবি অক্ষর থেকে নামের সংখ্যা মান বের করা ।

অনেকটা নিউরোলজির মতো ।) সংখ্যা ৯১৩ ।

আমি বাদশাহ নামদার গ্রন্থে ৯১৩ আবজাদ সংখ্যায় সম্রাট হুমায়ূনের বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করব ।

এই কাহিনীতে ঔপনাসিকের রঙ চড়ানোর কিছু নেই । সম্রাট হুমায়ূন অতি বিচিত্র মানুষ ।

ভাগ্য বিচিত্র মানুষ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে । ভাগ্য তাঁকে নিয়ে অদ্ভুত সব খেলা খেলছে ।

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –৩

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *