হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা বাদশাহ নামদার পর্ব –২৩

বাদশাহ নামদার পর্ব –২৩

ঘোড়সওয়ার বাহিনী দুর্গের মূল ফটকের কাছে রাখা হয়েছে। পাথরের তৈরি দুর্গ হালকা কামান দেগেও কিছু করা যাবে না।উছি বেগের সঙ্গে বৈরাম খাঁ বৈঠকে বসেছেন। উছি বেগের উদ্দেশ্য যদি ধরা যায়। উছি বেগ বারবারই বলছেন-আমি একজন বিপদগ্ৰস্ত রাজ্যহারা মানুষকে সাহায্য করছি, এর বেশি কিছু না। বৈরাম খাঁ বললেন, বিপদগ্ৰস্ত মানুষকে সাহায্য করতে দেখা যায় কিন্তু রাজ্যহারা মানুষকে কেউ সাহায্য করে না।উছি বেগ বললেন, কেউ করে না তা ঠিক না, আমি তো করছি।আপনি কি পুরস্কারের আশায় এই কাজ করছেন?

না। ভালো কাজ পুরস্কারের লোভে কেউ করে না।বৈরাম খাঁ বললেন, আপনার মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। কোনো এক শুভক্ষণে সম্রাট হুমায়ূন নিশ্চয়ই আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।আপনারা যত দিন ইচ্ছা এই দুর্গে থাকবেন। দুর্গে রসদ নেই, পানি নেই। আমি ব্যবস্থা করছি। হাম্মামখানায় কিছু পানি আছে, তাতে আজকের রাতটা চলবে। ভোর হোক, সব ব্যবস্থা হবে।আল্লাহপাক আপনার মঙ্গল করুন।হাম্মামখানায় পানি পাওয়া গেল না। হাম্মামখানার কল খোলা, সব পানি বের হয়ে গেছে। দুর্গের রসদঘর শূন্য। একদানা চাল বা গম পাওয়া গেল না।

বৈরাম খাঁ প্ৰমাদ গুনলেন। তিনি নিশ্চিত উছি বেগের উদ্দেশ্য ভাল না।ভোরবেলা রসদ বা পানি কোনোটাই এল না। পানিশূন্য অবস্থায় সারা দিন কাটল। জওহর আবিতাবিচির সংগ্রহে দুই মশক পানি আছে। হুমায়ূনের প্রয়োজন মিটবে, কিন্তু অন্যদের কী হবে? বৈরাম খাঁ উছি বেগের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করলেন। উছি বেগ দুর্গের ভেতর আসতে রাজি হলেন না।বৈঠক হবে উছি বেগের তাঁবুতে। বৈরাম খাঁ তাতেই রাজি। নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি উছি বেগের তাঁবুতে ঢুকলেন। তাদের কথোপকথন

বৈরাম খাঁ : সম্রাট-পত্নী হামিদা বানু সন্তানসম্ভবা। তিনি অসুস্থ। প্রবল জ্বরে কাতর।

উছি বেগ : শুনে দুঃখিত হলাম। আমার সঙ্গে কোনো চিকিৎসক নেই। থাকলে পাঠিয়ে দিতাম।

বৈরাম খাঁ : দুর্গে পানি নেই। খাবার নেই।

উছি বেগ ; আমি এই বিষয়ে কিছু করতে পারছি না। চেষ্টা করেও সংগ্ৰহ করতে পারি নাই। আমাদেরও খাদ্য-পানির সংকট।

বৈরাম খাঁ : বাদশাহ হুমায়ূন আপনার কাছে একটা প্রস্তাব উপস্থিত করতে আমাকে বলেছেন। তিনি নিজ পত্নীর অবস্থা দেখেই এমন একটা প্রস্তাব করছেন।

উছি বেগ : বলুন কী প্রস্তাব।

বৈরাম খী : উনার সঙ্গে একটি বহু মূল্যবান রত্ন আছে। রত্নটি আপনি উপহার হিসেবে পাবেন।

উছি বেগ : রত্নটির নাম কি কোহিনূর?

বৈরাম খাঁ : হ্যাঁ, কোহিনূর। আপনি খোঁজখবর ভালোই রাখেন। দুর্গপ্রধান না হয়ে আপনার রাজ্যপ্রধান হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, সম্রাটের একটি শর্ত আছে।

উছি বেগ : শর্ত দেওয়ার মতো অবস্থায় আপনার সম্রাট নেই, তার পরেও শুনি।

বৈরাম খাঁ : আপনি আমাদের সিন্ধুনদ পার হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। পানি এবং রসদ সরবরাহ করবেন।

উছি বেগ : কোহিনূর কখন পাব?

বৈরাম খাঁ : পানি এবং রসদ নিয়ে আপনার লোকজন ঢুকবে। তাদের সঙ্গে আপনিও দুর্গে ঢুকবেন। তখনই আপনার হাতে কোহিনূর দিয়ে দেওয়া হবে। আপনি কি রত্ন চেনেন?

উছি বেগ : না।

বৈরাম খাঁ : তাহলে কী করে বুঝবেন এটিই মহামূল্যবান কোহিনূর?

উছি বেগ : আমার এখানে একজন রত্নব্যবসায়ী আছে। সে চিনবে।

বৈরাম খাঁ : আপনি তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুত। কোহিনূরের জন্যে এই কাণ্ড করছেন?

উছি বেগ : আপনার অনুমান সঠিক। কোহিনূর আগে আমার হাতে পৌঁছতে হবে। পানি এবং রসদ, পাথর হাতে পাওয়ার পর সরবরাহ করা হবে।

বৈরাম খাঁ : পাথর আপনি নিজে নেবেন? নাকি আমাকে নিয়ে আসতে হবে?

উছি বেগ : আপনি নিয়ে আসবেন। রত্নব্যবসায়ী আপনার সঙ্গে যাবে। সে রত্ব ঠিক আছে কি না দেখে নেবে।

বৈরাম খাঁ : রত্নব্যবসায়ীকে আমার সঙ্গে দিন। আমি পাথর নিয়ে ফিরছি। আমাকে কিছু সময় দিতে হবে। কোহিনূর বিশেষ জায়গায় লুকানো। খুঁজে বের করতে সময় নেবে। এর মধ্যে আপনি পানি এবং রসদের ব্যবস্থা করুন।

উছি বেগ : বিলম্ব হলে সমস্যা নেই।

রত্নবণিকের নাম মহাবীর। সে জাতিতে জৈন, পরম অহিংস। মুখেনাকে পাতলা কাপড় পরে রাখে, যেন মশা-মাছি নাকে-মুখে ঢুকে মারা না যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটে যেন পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া মারা না যায়।রত্নবণিককে দুর্গে ঢুকিয়েই দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। বৈরাম খাঁ বললেন, আমরা যে মহাবিপদে পড়েছি তা কি বুঝতে পারছেন?

মহাবীর বলল, আমি ব্যবসায়ী মানুষ এইসব কিছু বুঝি না। কোহিনূর আমাকে দেখাবেন। আমি বলব আসল জিনিস কিংবা নকল। আমার কাজ শেষ।বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী হলো আহত ব্যাঘ। আমি আহত ব্যাঘ।খাঁ সাহেব, গেট খুলে দেন। আমি অহিংস মানুষ। পিঁপড়া পর্যন্ত মারি না।আপনাকে পিঁপড়া মারতে হবে না। খামাখা পিঁপড়া কেন মারবেন? আপনি দেখবেন আমরা কী করে মানুষ মারি।খাঁ সাহেব, গেট খুলে দেন।

এক্ষুনি গেট খুলে দেব। আমরা দুজন গেট দিয়ে বের হব। আমার হাতে থাকবে রেশমি রুমালের ভেতর সাধারণ একখণ্ড পাথর। আমি রুমাল উঁচু করে উছি বেগের তাঁবুর দিকে এগুতে থাকব। উছি বেগ তাঁবু থেকে ছুটে আসবে। আর তখনই আমার তীরন্দাজরা তাকে মারবে। উছি বেগের মৃত্যু বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমার ঘোড়সওয়ার বাহিনী বের হবে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ হবে। আপনি মানুষের মৃত্যু দেখবেন।

হতভম্ব মহাবীর বলল, আপনার লোক যখন তীর ছুঁড়বে সেই তীর তো আমার গায়েও লাগতে পারে।সম্ভাবনা আছে, তবে আমার তীরন্দাজদের হাতের নিশানা ভালো। তাদের উপর ভরসা রাখতে পারেন।পরের অংশ সংক্ষিপ্ত। উছি বেগ প্রথম তীরের আঘাতেই ধরাশায়ী হলেন। তার দলের লোকদের হতভম্ব ভোব কাটার আগেই বৈরাম খাঁ’র বাহিনী বের হয়ে এল।

ভারতবর্ষে সেনাপতির মৃত্যু মানেই যুদ্ধে পরাজয়। উছি বেগের লোকজন পালাতে শুরু করেছে। বৈরাম খাঁ’র জন্যে একটি ঘোড়া এবং তরবারি নিয়ে আসা হয়েছে। বৈরাম খাঁ লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠতেই যুদ্ধ শেষ।হুমায়ূন তাঁর বাহিনী নিয়ে নির্বিঘ্নে সিন্ধুনদ পার হলেন। উছি বেগের সৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া রসদ এবং পানির এখন আর অভাব নেই।হামিদা বানুকে নৌকায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তিনি একবার বললেন, আমরা কোথায়?

হুমায়ূন বললেন, সিন্ধুনদ পার হচ্ছি।পানি খাব।হুমায়ূন বললেন, যত ইচ্ছা পানি খাও। পানির অভাব নেই।মহাবীর তীরবিদ্ধ হয় নি। সে বৈরাম খাঁ’র সঙ্গে আলাদা নৌকায় উঠেছে। মহাবীর বৈরাম খাঁ’র দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাম মহাবীর কিন্তু আপনি সত্যি মহাবীর এবং অতি বিচক্ষণ।

বৈরাম খাঁ হাই তুলতে-তুলতে বললেন, মানুষ মারা দেখে মজা পেয়েছে? মহাবীর বলল, এইসব কী বলেন? আমরা অহিংস জাতি। পিঁপড়া পর্যন্ত মারি না।বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে জুটেছেন কী জন্যে? কোহিনূর হীরা এক নজর দেখে জীবন সার্থক করার ইচ্ছা। সুযোগ কি পাব?অবশ্যই পাবেন। তবে আগে কয়েকটা পিঁপড়া মারতে হবে। পারবেন?

মহাবীর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা পিঁপড়া মারতে রাজি আছি। এর বেশি পারব না।বৈরাম খাঁ বললেন, পিঁপড়া মারতে হবে না। পিঁপড়া মারা ছাড়াই আপনাকে কোহিনূর দেখাব। তবে কোহিনূর সামান্য পাথর ছাড়া কিছু না। জীবন্ত সঠিক মানুষ হলো আসল কোহিনূর। পেছনের নৌকার দিকে তাকান। রাজ্যহারা সম্রাট হুমায়ূন স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছেন। উনিই আসল কোহিনূর। দেখেছেন? হুঁ। আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?

শুধুমাত্র নদী জানে সে কোনদিকে যাচ্ছে। তার যাত্রা সমুদ্রের দিকে। মানুষ নদী না বলেই সে কোনদিকে যাচ্ছে তা জানে না।মহাবীর বলল, আপনার সাহস এবং বীরত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি অর্থের যোগান দেব, আপনি সৈন্য সংগ্ৰহ করবেন। সৈন্য হচ্ছে তীর্থের কাক। ভাত ছিটালেই আসে।বৈরাম খাঁ বললেন, অর্থের বিনিময়ে আপনাকে কোহিনূর দিতে হবে?

হুঁ।বৈরাম খাঁ বললেন,শুনুন মহাবীর। কোহিনূর বিক্রি হয় না। এটা উপহার হিসেবে পাওয়া যায় কিংবা তলোয়ারের সাহায্যে কেড়ে নিতে হয়। আর কথা না বলে নদীর শোভা দেখুন।প্রেতযোনির হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা আচার্য হরিশংকর করেছেন। তান্ত্রিকের কাছ থেকে ‘রাম কবচ নিয়েছেন। গলায় পরেছেন অষ্টধাতু রক্ষাকবচ। তাঁর বিছানার নিচে সরিষা দানা, দরজায় বুলিছে লোহার শিকল। প্রেতিযোনি সরিষা এবং লোহা ভয় পায়। তারা আগুনও ভয় পায়। হরিশংকরের খাটের নিচে মাটির মালশায় দিনরাতই কয়লার আগুন জ্বলে। সারাক্ষণ আগুন জ্বলিয়ে রাখার জন্যে তিনি বয়রা নামে এক কিশোরকে চাকরি দিয়েছেন।

প্রেতিযোনির হাত থেকে ব্যাপক সুরক্ষা গ্রহণের ফল। ফলেছে, হরিশংকর এখন আর খাটের উপর আকিকা বেগমকে পা বুলিয়ে বসতে দেখেন না। হরিশংকর ধর্মকর্মে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছেন। ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করেন। গঙ্গায় বুক পর্যন্ত ড়ুবিয়ে সূর্যপ্ৰণাম দিয়ে দিন শুরু করেন। মন্দিরে মন্দিরে ঘোরেন। সাধু-সন্তদের ধর্ম-উপদেশ শোনেন। দুপুরে কাকভোজন করান। কাকের রূপে আত্মারা মর্ত্যে ঘোরেন। কাকভোজন করালে আত্মাদের শান্তি হয়। পুণ্যলাভ হয়।

সন্ধ্যার পর হরিনাম শোনার পালা। হরির পবিত্র নাম শোনার মধ্যেও পুণ্য। হরিশংকরের পুণ্য সংগ্ৰহ চলতেই থাকে। তবে তিনি শারীরিকভাবে খানিকটা আচল হয়ে পড়েছেন। বা পায়ে কী-যেন হয়েছে। জায়গায় জায়গায় কালো হয়ে ফুলেছে। ব্যথা-বেদনা নেই, তবে স্পর্শানুভূতিও নেই। শুধু মাটিতে পা ফেললে যন্ত্রণায় অস্থির হন।কুণ্ঠরোগের প্রধান লক্ষণ স্পর্শানুভূতি চলে যাওয়া। তার মতো পুণ্যবান মানুষের কুণ্ঠরোগ হওয়ার কোনোই কারণ নেই।

কাশির পথে পথে কুণ্ঠরোগীরা ছালা গায়ে বসে থাকে। তাদের সামনে থাকে ভিক্ষাপাত্র। কুণ্ঠরোগীদের কারোর কারোর হাত এবং পায়ের আঙুল পচে গলে হাড় বের হয়ে পড়েছে। সেখানে মাছি ভনভন করে। এই দৃশ্য হরিশংকরের সহ্য হয় না। তিনি নিয়মিত কাকভোজন করালেও কুণ্ঠরোগীদের প্রতি কোনো দয়া দেখান না। কুণ্ঠরোগীরা অভিশপ্ত। তাদের দয়া করলে পুণ্য অর্জন হয় না।আজ শনিবার, অমাবস্যা। কালীপূজার যোগ পড়েছে। হরিশংকর সকাল সকাল ঘরে ফিরেছেন। কালীপূজার রাত শাক্তদের। অন্যরা এই সময় গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে না, এটাই বিধি।

দরজা খুলে হরিশংকর হতভম্ব। আকিকা বেগম খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আকিকা বেগমের পাশে তার বান্ধবী অম্বা। দুজনের মুখ হাসি হাসি। অম্বা পরিচিতজনের মতো করে বলল, কেমন আছেন? হরিশংকর মনে মনে রাম নাম জপ করতে লাগলেন। প্রশ্নের জবাব দিলেন না। প্রেতিযোনির প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। জবাব দিলে তারা পেয়ে বসে। অম্বা বলল, আপনার পায়ে কী হয়েছে? কুণ্ঠ?

হরিশংকর বললেন, কুষ্ঠ কেন হবে। বাত হয়েছে বাত। অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাতের ব্যথা বাড়ে। আজ অমাবস্যা। বাতের প্রকোপের এই কারণেই বৃদ্ধি।প্রেতিযোনির সঙ্গে কথাবার্তায় জড়াতে নেই—এই সত্য জেনেও হরিশংকর কথাবার্তা শুরু করেছেন। তিনি আবারও রাম নামে ফিরে গেলেন।আকিকা বেগম বলল, আমার বাবা দিল্লীর সম্রাট পাদশাহ হুমায়ূন কোথায়?আমি জানি না।আকিকা বলল, আপনি কেন জানেন না?

হরিশংকর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন।হুমায়ূন আছেন যোধপুর রাজ্যের সীমানার একটি পরিত্যক্ত গ্রামে। গ্রামের নাম ভকুর। সেইসময় মাঝে মাঝেই কিছু জনপদ পরিত্যক্ত হতো। ডাকাতের আক্রমণ, পাশের কোনো রাজ্যের রসদ সংগ্ৰহ অভিযানের কারণে এটা ঘটত। মহামারি তো আছেই। মহামারীতে জনপদের পর জনপদ উজাড় হওয়ার মতো ঘটনা নিয়মিতই ঘটত।

হামিদা বানু একটি মাটির ঘরের বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। একটু দূরে মশাল জ্বালানো হয়েছে। মশাল ঘিরে পোকা নাচানাচি করছে। তাদের কেউ কেউ সরাসরি আগুনে ঢুকে পড়ায় পট পট শব্দ হচ্ছে। হামিদা বানু পোকাদের খেলা দেখছেন।

রাতের খাবার হিসেবে লবণ দিয়ে গম সিদ্ধ করা হচ্ছে। ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন অন্য আরেকটি ঘরের বারান্দায় আফিম খাচ্ছেন। তাঁর সৈন্যদের বেশির ভাগ তাকে ছেড়ে গেছে। বৈরাম খাঁ ছাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ তাদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য হুমায়ূনের নেই। আমীরদের মধ্যে পাঁচজন এখনো আছেন।হুমায়ূন দূর থেকে লক্ষ করলেন, হামিদা বানু কী যেন খাচ্ছেন। বেশ আরাম করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া। হামিদা বানুর সঙ্গে কোনো খাবার নেই। কৌতূহলী হয়ে হুমায়ূন। এগিয়ে গেলেন।কী খাচ্ছ?

হামিদা বানু লজ্জিত গলায় বললেন, খুব বেদানা খেতে ইচ্ছা করছিল। তাই বেদানা খাচ্ছি।বেদানা কোথায় পেলে? কোথাও পাই নি। কল্পনায় খাচ্ছি।হুমায়ূন দুঃখিত হয়ে লক্ষ করলেন, হামিদা বানু কল্পনার বেদানা ভেঙে দানা মুখে দেওয়ার ভঙ্গি করছেন। দানা কিছুক্ষণ চিবানোর পর থু করে বিচি দূরে ফেলে দিচ্ছেন।

হামিদা বানু বললেন, জাহাঁপনা, বেদানা খুব মিষ্টি। কয়েকটা দানা খেয়ে দেখবেন? হুমায়ূন বললেন, এই ছেলেখেলার কোনো মানে হয়? হামিদা বানু বললেন, ছেলেখেলা ছাড়া আমাদের এখন কী আর আছে? হুমায়ূন মাথা নিচু করে স্ত্রীর সামনে থেকে বের হয়ে এলেন। তখন একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। সম্রাট হুমায়ূনের সব জীবনীকার এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। আবুল ফজলের গ্রন্থেও এর উল্লেখ আছে। ঘটনাটা এ রকম–

হুমায়ূন স্ত্রীর সামনে থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগুতেই অপরিচিত এক লোক তাঁকে কুর্নিশ করল। হুমায়ূন বললেন, আপনি কে? সে বলল, আমি দুৰ্ভাগ্যতাড়িত এক ব্যবসায়ী। ডাকাতরা আমার সর্বস্ব নিয়ে গেছে। এখানে আগুন জ্বলছে দেখে এসেছি। আমি তৃষ্ণার্তা এবং ক্ষুধার্ত।হুমায়ূন বললেন, আমি আপনার চেয়ে খুব ভালো অবস্থায় নেই। তৃষ্ণ নিবারণ করুন। খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে খাদ্য গ্ৰহণ করুন।

বণিক বলল, আমার কাছে কিছুই নেই। যা দিয়ে একজন সম্রাটকে সম্মান জানানো যায়। আমার সঙ্গে বড় একটা বেদানা আছে। যদি গ্ৰহণ করেন।বণিক থলে থেকে বিশালাকৃতির একটা বেদানা বের করল। পেকে লাল টুকটুক করছে।হামিদা বানু হাতে বেদানা পেয়ে অবাক হয়ে বললেন, বেদানা কোথায় পেলেন?হুমায়ূন বললেন, আমি হিন্দুস্থানের সম্রাট। আমার স্ত্রীর বেদানা খেতে ইচ্ছা করছে। আমি সামান্য একটা বেদানা জোগাড় করতে পারব না?

যোধপুরের রাজা মালদেবের কাছে শের শাহু-পুত্ৰ জালাল খাঁ একটি গোপন পত্র পাঠিয়েছেন। পত্রের বিষয় একসময়কার দিল্লীর সম্রাট হুমায়ূন। জালাল খাঁ লিখেছেন— যোধপুরকে আমরা আমাদের বন্ধু রাজ্য বলে গণ্য করি। বন্ধুত্ব কখনো এক পক্ষীয় বিষয় না। আপনি আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছেন তা জানা প্রয়োজন।আমাদের শক্তি সামর্থ্যের প্রমাণ আপনার চোখের সামনেই আছে। একসময়কার ক্ষমতাধর মোঘল সম্রাট আজ প্রাণভয়ে পথে-প্ৰান্তরে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমরা আশা করি, আপনি যেভাবেই হোক পলাতক হুমায়ূনকে খুঁজে বের করবেন। আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ রাজ্যে নিয়ে আসবেন। তার কাছে মহামূল্যবান হীরক কোহিনূর আছে। আপনি এই হীরকখণ্ড রেখে দেবেন। রত্নের উপর আমার পিতা বা আমার কোনো মোহ নেই। আমরা হুমায়ূনকে জীবিত অবস্থায় চাই।আপনাকে যা জানানোর আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানালাম। আপনি কী করবেন তা আপনার বিবেচ্য।আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, হুমায়ূনের সব ভাইরা আমাদের সঙ্গে আছে।

ইতি জালাল খাঁ

মীর্জা কামরানের কাছে তার বোন গুলবদন বেগম এসেছে। তার হাতে কারুকার্যময় রুপার থালায় মিষ্টান্ন। গুলবদন বলল, ভাই মিষ্টি খাও।মীর্জা কামরান বললেন, মিষ্টি খাওয়ার মতো বিশেষ কোনো ঘটনা কি ঘটেছে?গুলবদন বলল, রাজপুরুষদের মিষ্টান্ন খেতে বিশেষ কোনো ঘটনার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরেও ছোট্ট একটা উপলক্ষ আছে।উপলক্ষটা কী?

আমি ভাই হুমায়ূনের মঙ্গল কামনা করে কোরান খতম এবং দোয়ায় ইউনূস খতম দিয়েছি। এই মিষ্টান্ন আমার নিজের হাতে বানানো।মীর্জা কামরান বললেন, দোয়া দরুদে কি ভাগ্য পরিবর্তন হয়? তোমার আদরের ভাইয়ের জন্যে অনেকেই প্রার্থনা করছে। তার মধ্যে আমার নিজের মা’ও আছেন। ওনার ভাগ্য কি বদলেছে?

আল্লাহপাক যখন চাইবেন তখন ভাগ্য বদলাবে, তার আগে না। তারপরেও আমরা প্রার্থনা করি নিজেদের মনের শান্তির জন্যে।তোমার বানানো মিষ্টান্নের একটি খেলে যদি তোমার মন শান্ত হয় তাহলে আমি মিষ্টি অবশ্যই খাব।মীর্জা কামরান মিষ্টি মুখে দিতে-দিতে বললেন, তোমার আদরের ভাইয়ের বর্তমান অবস্থা জানতে চাও?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *