দৌড়ানাের জুতাে, পুরােনাে শর্ট সবই ওয়ার্ডরােব থেকে বেরােলাে। দ্রুত পােশাক পরে নেয় পরাগ। তারপর বেরিয়ে পড়ে।। | এই ভােররাতে ও আমেরিকার হাইওয়েতে গাড়ির ভীড় কিছু কম নয়। আমেরিকায় হাইওয়েতে চব্বিশ ঘন্টাই গাড়ির স্রোত বয়ে যায় । আজ উইক এন্ডের ভােরে সেটা মিছিলের চেহারা নিয়েছে ।
মােবাইল হাউস, বােটিং বা মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে গাড়ির পর গাড়ি বেরিয়ে পড়ছে নানা দিকে হবে বলে । সমুদ্র, লেক, পাহাড়, অরণ্য কোনওটাতেই মার্কিনদের অরুচি নেই। তবে নিউইয়র্কের দিকে গাড়ির সংখ্যা বেশী নয় । রাস্তাটা ফাঁকাই গেল পরাগ ! আশি নব্বই মাইল গতি তুলে দিল গাড়িতে। এত ভােরে পুলিশ বােধহয় খুব তৎপর নেই। থাকলেও বয়েই গেছে পরাগের। টিকেট খাবে তাে! বহােৎ আচ্ছা।লিঙ্কন টানেন ধরে হাডসন নদী পেরিয়ে থার্ড নাইন স্ট্রিট। তারপর পার্ক অ্যাভেনিউ। সােজা নাক বরাবর উত্তরে এগিয়ে যেতে রাগল পরাগ। নাইনটি সিক্সথ স্ট্রিটে বাঁয়ে মোড় নিল। ঢুকে পড়ল সেন্ট্রাল পার্কের উত্তরাংশে। সেই অতিকায় অরণ্যভূমি, সবুজ, ঘাসের মাঠ, সেই অনবদ্য প্রকৃতির। ছোঁয়া, সব আছে। আজ উইক এন্ডে স্বাস্থ্যান্বেষী মানুষের কিছু অভাব। তা সত্বেও জগার আছে, আছে ভবঘুরে নির্যরা।
গাড়ি পার্ক করে পরাগ নেমে পড়ল । এখন আর দৌড়ানাের দম নেই তার। হাতে গায়ে সেই জোর নেই বুকে উৎসাহ নেই । নিধুম চোখ। কচকচ করছে জ্বালায়। বহুদিন ভাল করে খায়নি বলে শরীর দুর্বল।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
সেই অনবদ্য ভাের । আলাে ফুটছে, পাখি জমছে, ঘাস মাটির গন্ধ আসছে। একটি শর্টস পর। যুবতি মেয়ে কহ ঘেঁষে দৌড়ে বেরিয়ে গেল । দীঘল সতেজ চেহারা, লম্বা বিনুনি দুলছে পিঠের
ওপর।
ওই মেয়েটাকে আমি ধরে ফেলতে পারবাে কি? একটু ইতস্তত করল সে। তারপর দুর্বল পায়ে হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। হাঁটু ভেঙ্গে এল কয়েক কদম যেতে না যেতেই । বুক ব্যধিয়ে উঠল । দম আটকে আসতে থাকল গলায়। মাথা টলমল! চোখের দৃষ্টি হঠাৎ আবছা হয়ে এল। তবু পরাগ ধপ ধপ করে পা ফেলে নিতান্ত সদ্য-হাঁটতে-শেখা শিশুর মতাে দৌড়ােতে থাকল। কিংবা সেটা আদৌ দৌড়ই নয়। দৌড়ের ক্যারিকেচার।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
মানুষ ছােতে কোনও লক্ষের পিছনে। আজ সকালে পরাগ ছুটছে দামাল, দক্ষ দৌড়বাজ ওই মেয়েটার সঙ্গে পাল্লা টানতে। এর কোনও মানেই হয় না। কিছুতেই পরাগ ওকে ধরতে পারবে
ইতিমধ্যেই ও একশাে গজ এগিয়ে গেছে। এবং পার্কের ঘনায়মান কুয়াশা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সামনেই একটা বাঁক । মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যাবে।
প্রাণপণে পরাগ ছুটতে লাগল। মেয়েটা বাকের মুখে মিলিয়ে গেল বটে, কিন্তু পরাগ জানে বাঁকের পর একটা সােজা স্ট্রিপ আছে। বাঁক ঘুরলেই মেয়েটাকে।
আবার দেখতে পাবে পরাগ। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, হেপ! ওঃ গড!
কে। পরাগ থমকে দাঁড়াল। সে নিজেই কি? না, এ তাে মেয়ের গলা! বিভ্রান্ত পরাগ ছুটে বাঁকটা অতিক্রম করল। না, সােজা স্ট্রিপটায় মেয়েটা নেই। কোথায় গেল তবে?
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
তার উদ্ভ্রান্ত মাথা কিছুক্ষণ কাজ করল না। তারপর করল। কাছেই ইস্ট হারলেম । কৃষ্ণাঙ্গ কিছু পাজি লােক সেন্ট্রাল পার্কটাকে তাদের কজায় রেখেছে অনেকদিন। মাঝে মাঝে ঘটনা ঘটে।
পরাগ রাস্তা ছেড়ে ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে ঘাসের ওপর নেমে গেল । নিউ ইয়র্কররা এসব ঘটনা চোখ বুজে এড়িয়ে যায়। যা হচ্ছে হােক । চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ যা খুশি হােক, নিউ ইয়র্কের লােকেরা গা জ্ববে না। আপনি বাঁচলে বুড়াের নাম ।
মন্ত স্ট্রবেরির একটা ঝােপের পিছনে চারজন কালাে যুবক ধরেছে মেয়েটাকে। গায়ের কামিজ উড়ে গেছে, শর্টস ধরে টানছে । আর দুজন পিছন থেকে ধরে মুখ চেপে রেখেছে মেয়েটার।
স্টপ! স্টপ! ইউ রাসকেল! বলে পরাগ দৌড়ে গিয়ে প্রথমে যে যুবকটিকে পেল তাকেই একখানা লাথি কষাল । দ্বিতীয় জনকে একখানা ঘুষি ।
এত আচমকা অপ্রত্যাশিত হামলায় চারজনই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। লাথি বা ঘুষিতে তাদের কিছুই হয় নি। কিন্তু বিস্ময় হয়েছে।
মেয়েটাকে ছেড়ে তারা চারজনই ফিরে পঁাড়ল পয়াগের দিকে।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
স্কাউড্রেলস! বলে চারজনের দিকে নিজেকে নিক্ষেপ করে পরাগ।এ এম আত্মহত্যাই। মরতে তাে হতই পরাগকে। এভাবেই না হয় মরল।
আশ্চর্যের বিষয়, ছেলেগুলাে নয়, পরাগই আগে মারল । তার ঘূষিটা আটকানাের কোনও চেষ্টাই করল না অগ্রগামী প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা ছেলেটি। হারলেমের রাস্তায় রাস্তায় তারা নিত্য মারপিট করে, খুন-খারাপি করে, চুরি, ছিনতাই করে, সাবওয়েতে নিত্য যাত্রীরা তাদের ভয়ে তটস্থ। সুতরাং পরাগের ঝুঁষি আটকানাের চেষ্টা করা তাদের কাছে হাস্যকর। ছেলেটা প্যান্টের দু পকেটে হাত ভরে রেখেছিল । হাত বের করল না, শুধু পা তুলে পরাগের পজিন্নায় একটি লাথি মারল ।
হৃদয়বৃত্তান্ত-শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়
মড়াৎ করে একটা শব্দ হয়ে থাকবে। পরাগ প্রায় শুন্যে উঠে ছিটকে গেল অনেকটা দূর। ঘাসের ওপর পড়ে ঝি হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ড। না, আহত হওয়া তার চলবে না। তাকে মরতে হবে। হামাগুড়ি দিয়ে ফের উঠে দাঁড়াল পরাগ । এবং আবার নিক্ষেপ করল নিজেকে। এ লড়াই জেতার লড়াই নয়, হারার লড়াইও নয় এ হল তার মরার লড়াই।
তার একটা খুঁষি হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু দ্বিতীয়টা লাগল। কোথায় লাগল, কার লাগল তা বুঝতে পারল না পরাগ। তার দরকারও নেই। এই খুনিদের ক্ষেপিয়ে দেওয়াটাই তার কা। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম তার প্রত্যেকটা ঘূষিই লাগতে লাগল। তার তিনটে লাথিও বৃথা গেল না। তারপর আর হিসেব করল না পরাগ ।