এই পৃথিবীর মধ্যে ছিল। অনন্ত এক শীতলপাটি। অনেক দাঙ্গা ঝগড়াঝাটি পার হয়ে তাই ভালােবাসা জাগিয়েছিল অনেক আশা, ফুটিয়েছিল অজস্র রং খানিকটা তার গদ্যে এবং খানিকটা তার পদ্যে ছিল।
–নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
মেজাজ খারাপ করার মত পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে।
জাফর সাহেবের প্রেসারের সমস্যা আছে। মেজাজ খারাপ হলে প্রেসার দ্রুত ওঠা–নামা করে। চট করে মাথা ধরে যায়। ঘাড় ব্যথা করতে থাকে এবং মুখে থুথু জমতে থাকে – এর কোনটিই ভাল লক্ষণ নয়। পঞ্চাশ পার হবার পর লক্ষণ বিচার করে চলতে হয়। তাঁর বয়স পাঁচপঞ্চাশ। তিনি লক্ষণ বিচার করে চলার মনে প্রাণে চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন কিছুতেই যেন মেজাজ না বিগড়ে যায়। এটা প্রায় কখনােই সম্ভব হয় না।
অফিস থেকে ফেরার পর তিনটা ঘটনা ঘটল মেজাজ খারাপ করার মত। ইলেকট্রিসিটি থাকায় লিফট বন্ধ ছিল। আটতলা পর্যন্ত হেঁটে উঠার পর কারেন্ট চলে এল। লিফট ওঠা নামা শুরু করল।
পত্রিকা চেয়েছিলেন, সকাল বেলা তাড়াহুড়ায় ভালমত পড়া হয়নি। তাঁকে ভেতরের একটা পাতা দেয়া হল, বাইরের পাতাটা না-কি পাওয়া যাচ্ছে না।
এক কাপ চা চাইলেন, তিথি এক কাপ চা দিয়ে গেল। চুমুক দিতে গিয়ে দেখেন সর ভাসছে। তিনি বললেন, সর ভাসছে কেন? | তিথি বলল, সর চায়ের চেয়ে হালকা বলেই ভাসছে। যদি ভারী হত তাহলে
ডুবে যেত। বলেই সে হেসে ফেলল। জাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, রসিকতা করছিস কেন?
‘রসিকতা করছি না বাবা। একটা বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করলাম। | কঠিন ধমক দিতে গিয়েও জাফর সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। মেজাজ ঠিক রাখতে হবে। কিছুতেই মেজাজ খারাপ হতে দেয়া যাবে না। মেজাজের জন্যে শুধু তাঁর নিজেরই যে সমস্যা হচ্ছে তাই না, পারিবারিক সমস্যাও হচ্ছে। গত চারদিন ধরে এই ফ্ল্যাট বাড়িতে শুধু তিথি এবং তিনি আছেন। তাঁর স্ত্রী শায়লা ছােট দুই মেয়ে ইরা, মীরাকে নিয়ে পল্লবীতে তাঁর মায়ের বাসায় চলে গেছেন। যাবার আগে কঠিন গলায় বলেছেন, তুমি তােমার মেজাজ নিয়ে থাক। আমি চললাম।।
জাফর সাহেব বলেছেন, যেতে ইচ্ছে হলে যাবে। তবে তুমি যদি মনে কর আমি তােমাকে সাধাসাধি করে নিয়ে আসব তাহলে বিরাট ভুল করবে। এ জীবনে অনেক সাধাসাধি করেছি। আর নয়। তােমার ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি।
ছােট মেয়ে দুটিও যে মার সঙ্গে চলে যাবে তিনি ভাবেন নি। তিনি সারাজীবন শুনে এসেছেন মেয়েরা পিতৃভক্ত হয়। শুধু তাঁর বাড়িতেই উল্টো নিয়ম। দুই মেয়ে সুরসুর করে মা‘র সঙ্গে চলে গেল। তাও যদি স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়ে হত একটা কথা ছিল। একটা আই এসসি, দিয়েছে, অন্যটা আই এ পড়ে, সেকেণ্ড ইয়ার। বড় মেয়ে তিথিও হয়ত চলে যেত। নেহায়েত হিউমেনিটেরিয়ান গ্রাউড়ে যায় নি। ইরা মীরা খুব ভাল করে জানে তিনি এদের না দেখলে অস্থির বােধ করেন। সবাইকে এক সঙ্গে না নিয়ে বসলে খেতে পারেন না। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়। কাকে কখন কি বলছেন খেয়াল থাকে না। | শায়লা চলে যাবার পরদিন কাজের মেয়ে রাশেদা তার টিনের ট্রাংক এবং পুটলা–পুটলি নিয়ে বিদেয় হয়ে গেল। যাবার সময় বলল, “ভূল তুরুটি কিছু হইলে নিজ গুণে ক্ষমা দিবেন।”
জাফর সাহেব বললেন, বেতন পাওনা আছে না? বেতন নিয়ে যাও। ‘আমার বেতনের দরকার নাই।
শেষ মুহূর্তে জাফর সাহেব আপােষের সুর বের করলেন। রাশেদা চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। তিথি সামান্য এক কাপ চা পর্যন্ত ঠিকমত বানাতে পারে না। রান্নার প্রশ্নই আসে না। ঢাকা শহরে ভাল কাজের লােক পাওয়া পরশ পাথর পাবার মত। জাফর সাহেব রাশেদার দিকে তাকিয়ে প্রায় মধুর গলায় বললেন, চলে যাচ্ছি। কেন তাই তো বুঝলাম না। তােমাকে তেমন কিছু বলা হয়নি। রাশিদা বলল, আমি মিজাজের ধার ধারি না। যে বাড়িত আমারে ইংরেজি গাইল দেয় হেই বাড়িত কাম করি না।।
ইংরেজি গালির ব্যাপারটা সত্য। জাফর সাহেব রাশেদাকে স্টুপিড ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার বলেছেন। এবং তিনি মনে করেন তাঁর জায়গায় অন্য যে কেউ এরচে’ কঠিন গালি দিত। তিনি অফিস থেকে এসে স্যান্ডেল চাইলেন। রাশেদা স্যান্ডেল দিল ঠিকই, কিন্তু দুটা দু’পাটির। তিনি কিছু বললেন না। চা চাইলেন। চা এনে দিল। চুমুক দিয়ে দেখেন মিষ্টি হয়নি। তিনি বললেন, রাশেদা, চিনি লাগবে। সে রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, চিনি দেওয়া আছে, লাড়া দেন। নাড়া দিতে চামচ লাগবে। তিনি চামচ চাইলেন, রাশেদা একটা তরকারির চামচ নিয়ে উপস্থিত হল। চামচ দেখেই তাঁর মেজাজ খারাপ হল, তবু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এই চামচ চায়ের কাপে ঢুকবে?
রাশেদা চামচ উল্টে পেছনটা দিয়ে ভাল ঘোঁটার মত তাঁর চায়ের কাপ ফুঁটে দিল। শুধু তখনি তিনি বললেন, স্টুপিড, ব্রেইনলেস ক্রিয়েচার। অবশ্যি কঠিন গলায় বললেন। মিষ্টি করে কাউকে স্টুপিড বলা যায় না। সেই বলটাই কাল হয়েছে।
জাফর সাহেব মেজাজ আয়ত্তে রাখার চেষ্টা অনেকদিন থেকেই করছেন। পারছেন না। সবাই সবকিছু পারে না, চেষ্টাও করে না। তিনি চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টা কারাের চোখে পড়ছে না। দুশ তেত্রিশ টাকা দিয়ে বই কিনে এনেছেন – ‘Self control. সাতশ’ পৃষ্ঠার বই। সেখানে নেই, এমন জিনিস নেই। একটা অংশ আছে Yoga. সেই অংশে বলা হয়েছে – প্রতি রাতে শােবার আগে পাঁচ মিনিট শবাসন করলে নিজের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে।
শবাসনের নিয়ম হল শক্ত মেঝেতে খালি গায়ে গায়ে কোন রকম কাপড়ই থাকতে পারবে না, অবাসও নয়) শুয়ে থাকতে হবে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে ভাবতে হবে একজন মৃত মানুষ। তাঁর দেহটা একটা মৃত মানুষের দেহ। এই দেহের কোন অনুভূতি নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে এই দেহের কোন যোগ নেই।
পাঁচপঞ্চাশ বছর বয়সে নেংটো হয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকার কল্পনাই ভয়াবহ। তিনি এই ভয়াবহ ব্যাপারটাও করলেন। দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে রইলেন। পুরােপুরি নগ্ন হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। তিনি কোমরে একটা টাওয়েল জড়িয়ে রাখলেন। লাভের মধ্যে লাভ এই হল, তাঁর ঠাণ্ডা লেগে গেল। কাশি, সর্দি। টনসিল ফুলে একাকার। টোক গিলতে পারেন না।
মানুষের কত সমস্যা থাকে। তাঁর একটিই সমস্যা। মেজাজ সমস্যা। কেউ তা সহজভাবে নিতে পারে না। মানুষের অসংখ্য সৎগুণের কিছু কিছু তাঁরও নিশ্চয়ই আছে। সেসব কেউ দেখবে না।
শায়লা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। চারদিনে একবার টেলিফোন পর্যন্ত করেনি। মেয়ে দুটিও না। রাশেদা চলে গেছে জানার পর তার কি উচিত ছিল না বাসায় ফিরে আসা?
এই যে তিথি সরভর্তি এক কাপ চা তাঁর হাতে দিল, চাপা হাসি হাসতে হাসতে বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যাখ্যা করতে লাগল, তার কি উচিত ছিল না, বলা – বাবা, কাপটা আমার কাছে দাও। আমি আরেক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসছি। এমন না যে সে পরীক্ষার চাপে ব্যতিব্যস্ত। তার এমএসসি, ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে। রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার এই সময়টা সে তাে রান্নাবান্না শেখার চেষ্টাও করতে পারে। একদিন বিয়ে হবে, নিজের সংসার শুরু করবে। এই যুগের মেয়েরা শুধু লেখাপড়া শিখবে, রান্নাবান্না শিখবে না? সামান্য এক কাপ চা–ও বানাতে পারবে না। তা তাে হয় না। সরভর্তি চা হাতে নিয়ে জাফর সাহেব বসে রইলেন।
অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল বাজছে। রাশেদা নেই যে কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দেবে। তিথি কি করছে? সেকি তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে? তাঁর ইচ্ছা করছে কড়া গলায় ডাকেন – ‘তিথি!
ডাকার আগেই তিথি উপস্থিত হল। হাতে চায়ের কাপ। “বাবা, নাও – এবার চায়ে কোন সর নেই হেঁকে এনেছি।
জাফর সাহেব যন্ত্রের মত চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, কলিংবেল বাজছে। “দরজা খােলা হয়েছে, বাবা। ‘কে এসেছে? ‘অচেনা একজন। যে এসেছে সে ড্রয়িং রুমে বসেছে। | জাফর সাহেব চায়ের কাপ হাতে উঠতে গেলেন। তিথি হাত ধরে বাবাকে বসিয়ে দিল। নরম গলায় বলল, চা শেষ করে তারপর যাবে। তার আগে না।
‘যে এসেছে, আমার ধারণা, তাকে দেখে তােমার মেজাজ আরাে খারাপ হবে। মাঝখান থেকে তােমার চা খাওয়া হবে না। চায়ে কি চিনি হয়েছে?
‘চায়ের টেম্পারেচর ঠিক আছে? বেশি ঠাণ্ডা কিংবা বেশি গরম হয়নি তাে?” ‘না। ঠিকই আছে।
তিথি বাবার সামনে মােড়া পেতে বসল। জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, মেয়েকে কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগছে। চুল টুল কেটেছে, কিংবা কোন একটা কায়দা করেছে। রাস্তার মােড়ে মােড়ে মেয়েদের চুল কাটার দোকান হওয়ায় এই এক বিপদ হয়েছে। নাপিতের কাছে ছেলেরা যাবে। মেয়েরা কেন যাবে? কি হচ্ছে দেশটার?
জাফর সাহেব বললেন, তোকে এমন লাগছে কেন?‘ ‘কেমন লাগছে? | ‘কি রকম যেন লাগছে ! চুল কেটেছিস?”
না, কানে দুল পরেছি।‘
জাফর সাহেব মেয়ের কানের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। হাতের চুড়ির চেয়ে বড় দু‘টা রিং, মাঝারি সাইজের হাতীর কানের জন্যে মানানসই হত মানুষের কানের জন্যে না। সুস্থ মাথার কেউ এই দুল কানে পরে? এই ফ্যাশন কবে চালু হল ?
‘সুন্দর লাগছে না, বাবা?”
জাফর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এগুলির নাম কি?
‘আলাদা কোন নাম নেই। আমি নাম দিয়েছি পাংকু রিং, পাংকু মেয়েদের রিং।” ‘পাংকু মেয়ে মানে কি? ‘তুমি বুঝবে না। তােমার চা খাওয়া কি শেষ হয়েছে?”
‘তাহলে তুমি বসার ঘরে যাও। যে বসে আছে তাকে দ্রুত বিদেয় করে আস। তবে ফর গডস সেক, রাগারাগি করবে না।
রাগারাগি করব কেন?”
‘রাগারাগি করবে কারণ ভদ্রলােক কাদামাখা জুতা পায়ে কার্পেটে হাঁটাহাঁটি করছেন। তােমার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তাঁর হাতে চারটা মুরগি। মুরগিগুলি তিনি কার্পেটে শুইয়ে রেখেছেন। আমার মনে হয় তারা ইতিমধ্যে কার্পেট নােংরা করে ফেলেছে। কারণ মুরগিগুলিতাে আর জানে না আমরা নতুন কাপেট কিনেছি।”
‘ঠাট্টা করছিস?” ……‘মােটেই ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। তােমার যা মেজাজ, ঠাট্টা করে। বিপদে পড়তে চাই না। ……….সত্যি কার্পেটে মুরগি শুইয়ে রেখেছে ? …..‘তুই বলতে পারলি না যে কার্পেট মুরগির বিছানা না ?
‘আমি বলতে পারিনি, কারণ আমি অতি ভদ্র একজন তরুণী। কাউকে অপ্রস্তুত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ভদ্রলোক কেমন মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে, দেখে মায়াই লাগলাে।
জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তিথি বলল, প্লীজ বাবা, মেজাজ খারাপ করবে না। গ্রাম থেকে এসেছে, বােকাসােকা মানুষ ...।।
তিথি মিথ্যা বলেনি। সত্যি সত্যি কার্পেটের এক কোণায় চারটা মুরগি, দড়ি দিয়ে পা বাঁধা। তারা ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িং রুমের সৌন্দর্য দেখছে। ধুলোমাখা জুতাে পায়ে রােগ ধরনের একটা ছেলে বসে আছে। কার্পেট মাত্র গত সপ্তাহে কেনা হয়েছে। জুট কাপেট না কিনে তিনি প্রায় চারগুণ দাম দিয়ে সিনথেটিক শ্যাগ কাপেট কিনেছেন। সেখানে কেউ যদি কাদা মাখা জুতা পায়ে সােফায় বসে থাকে, কেমন।
লাগে ?
জাফর সাহেব রুক্ষ গলায় বললেন, কি ব্যাপার ?