ছেলেটা লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। গায়ে খয়েরী রঙের চাদর। গলায় টকটকে লাল রঙের মাফলার। চোখে সানগ্লাস থাকলে ষােলকলা পূর্ণ হত। বুক পকেটে আছে নিশ্চয়ই।
এদের আর কিছু থাকুক না থাকুক – সানগ্লাস থাকে।
জাফর সাহেবের অনুমান মিথ্যা হল না। সে পা ছুঁয়ে সালাম করবার জন্য নিচু হতেই বুক পকেট থেকে একগাদা ভাংতি পয়সা, চাবীর রিং এবং একটা সানগ্লাস পড়ে গেল। জাফর সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তুমি কে?
‘আমার নাম জামান। নুরুজ্জামান। ‘ভাল কথা। ব্যাপারটা কি? মুরগি তুমি এনেছ?‘
‘জি। আমার বাড়ি অতিথপুর, ঢাকায় একটা কাজে আসছি – আপনার আব্বা মুরগী দিয়ে দিলেন। বললেন, নিয়ে যাও।
নুরুজ্জামান দাঁত বের করে হাসছে। পান খাওয়া লাল দাত। জাফর সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে ধমক দিয়ে ছােকড়ার হাসি বন্ধ করেন।
এত দূর থেকে মুরগি আনার দরকার কি? ঢাকায় কি মুরগি পাওয়া যায় না।? ‘উনি আপনাকে একটা চিঠিও দিয়েছেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
দেখি চিঠি।
জাফর সাহেব চিঠি নিলেন। তাঁর মেজাজ আরাে খারাপ হল। চিঠি একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। খামে বন্ধ করে যার চিঠি তাঁর কাছে দিতে হয়। এই সামান্য ব্যাপারও তাঁর বাবার মাথায় এখন ঢুকছে না। কারণটা কি? মস্তিষ্ক বিকৃতি শুরু হল নকি ? জাফর সাহেব ভুরু কুঁচকে অতি দ্রুত চিঠির উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে
গেলেন –
বাবা জাফর, দোয়া নিও। নুরুজ্জামানের সঙ্গে কয়েকটা মুরগি এবং কিছু ডিম পাঠালাম। ঢাকায় নুরুজ্জামানের কিছু কাজ আছে। তাকে সাহায্য করবে। সে কয়েকদিন থাকবে। তােমার বাসাতেই রাখার ব্যবস্থা কর। দরিদ্র ছেলে, ঢাকায় আত্মীয়স্বজনও নেই।
বৌমার চিঠিতে জানলাম তােমার প্রেসারের সমস্যা হয়েছে। আধুনিক জীবনযাপনের এই হল ফল। পাখির মত আহার করবে, গাড়ি করে আফিসে গিয়ে কিছু কাগজপত্র সই করে ফিরে আসবে। খানিকক্ষণ টিভি দেখে ব্লপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে প্রেসার তাে হবেই। আমার এত বয়স হল, এখনাে তো এ জাতীয় কোন সমস্যা হয়নি। শুনলাম, আজকাল তুমি অল্পতেই হৈচৈ চেঁচামেচি কর, এটাও
তে ভাল কথা না!... চিঠি আর পড়তে ইচ্ছা করছে না। চিঠি মানে উপদেশ। পাঁচপঞ্চাশ বছরের ছেলেকে এত উপদেশ দেয়া যায় না, এটা উনাকে কে বুঝিয়ে দেবে? জাফর সাহেব
নুরুজ্জামানের দিকে তাকালেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
সে এখনাে দাঁড়িয়ে আছে। ধপ করে সােফায় বসে পড়েনি। যাক এইটুকু ভদ্রতা তাহলে আছে! নুরুজ্জামান হড়বড় করে বলল, ১৮টা ডিম দিয়েছিলেন এখন। সতেরোটা আছে। একটা ভেঙ্গে গেছে।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন সােফার এক কোনায় ডিমের পুটলি। ভাঙ্গা ডিম থেকে হলুদ রস বের হয়ে সােফায় নিশ্চয়ই লেগেছে।
‘ঢাকায় কত দিন থাকবে?
কিছুদিন থাকতে হবে, স্যার। ‘কিছুদিন মানে কত দিন? বি স্পেসিফিক। ‘চার পাঁচ দিন। ‘এটা হচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়ি। আমার স্ত্রী বর্তমানে বাসায় নেই, কাজের লােকও নেই – এখানে থাকলে তােমার সমস্যা হবে ...।
নুরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, আমার কোন অসুবিধা হবে না। প্রয়ােজনে কার্পেটে শুয়ে থাকব। নরম কাপেট।
‘এই কার্পেট শােয়ার জন্যে না। ভাল কথা — জুতা পরে এই কার্পেটে উঠবে না। তুমি কর কি ?
আমি অতিথপুর গার্লস হাইস্কুলের হেড মাস্টার।
জাফর সাহেব বিস্মিত হলেন – একুশ–বাইশের মত বয়স বলে মনে হচ্ছে – এই ছেলে হেড মাস্টার। তার মানে কি? তিনি বললেন, অতিথপুরে মেয়েদের হাইস্কুল আছে নাকি?
‘এখনো স্কুল হয় নাই। শুধু জমি পাওয়া গেছে। মেয়েদের স্কুলের জন্যে একজন পঞ্চাশ ডেসিমেল জমি দান করেছে। সবাই আমাকে ধরল – তুমি জোগাড়যন্ত্র করে স্কুল দাড়া করায়ে দাও ... এই জন্যেই ঢাকায় আসছি।
‘বুঝলাম না। ঢাকায় এসে কি হবে?
‘স্কুলের স্যাংশান লাগবে। স্কুল ঘর তােলার জন্যে সাহায্য যদি কিছু পাওয়া যায়। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একটু দেখা করব।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
জাফর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি যে ভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয় শিক্ষামন্ত্রী তােমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন।
‘আপনি একটু চেষ্টা চরিত্র করলে ....।। ‘আমি চেষ্টা করলেও কিছু হবে না। শিক্ষামন্ত্রী কোন বাড়ির কাছের ব্যাপার না। মন্ত্রীদের কোন দায় পড়েনি অতিথপুরের নুরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার। তাদের
আরাে কাজ আছে। বুঝতে পেরেছ?
“জ্বি স্যার।
‘আমার মনে হয় তােমার যা করা উচিত তা হল স্থানীয় এম.পি.–র সঙ্গে যােগাযোগ করা। মন্ত্রী অনেক বড় ব্যাপার।‘
‘তবু আসলাম যখন একটু চেষ্টা করে দেখি।
জাফর সাহেব বললেন, তােমার পড়াশােনা কতদূর? ‘বি.এ. পাশ করেছি। গৌরীপুর কলেজ। এম.এ. পাশ করার ইচ্ছা ছিল, টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলাম না। মানুষের সব ইচ্ছা তো আর ... নুরুজ্জামান কথা শেষ করল না। সােফায় বসে জুতা খুলতে লাগল। জুতা জোড়া রেখে এল কার্পেটের বাইরে। অর্থাৎ এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে সে এখানে কিছুদিন থাকবে। টকটকে লাল রঙের মােজা দেখা যাচ্ছে। কোন সুস্থ মাথার লােক এরকম মোজা পরে ? নতুন মােজা। এক কোনায় এখনো লেবেল লাগানাে। লেবেল খুলেনি। কিংবা কে জানে এরা হয়ত লেবেল খুলে না।
সে এখন হ্যান্ডব্যাগের চেইন খুলছে। জাফর সাহেব মনে মনে বললেন, গাধা! বসার ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। গাধাটা এখন নিশ্চয় লুঙ্গি বের করে পরে ফেলবে। সােফার টেবিলে পা তুলে নখ কাটবে। পকেটের ভাংতি পয়সার সঙ্গে একটা নেল কাটারও কার্পেটে পড়েছে। এই জাতীয় লােকজন কোন কাজকর্ম না থাকলে বসে বসে নখ কাটে। সেই কাটা নখ এসট্রেতে জমা করে রাখে।
তিথি বলল, কি হল বাবা? মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে। ভদ্রলােক কিছুদিন এখানে থাকবেন তাই না?
গেষ্ট রুম দেখিয়ে দেব?” “দেখিয়ে দে।”
রাতে ভাত খাবে ? ‘খাবে তো বটেই। ‘দু‘জনের মত ভাত আছে। আবার চড়াতে হবে।