তিশকে খুৰ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সে অত্যন্ত আগ্রহ বােধ করছে। যন্ত্র মানুষের মতাে আগ্রহ বােধ করছে, খুবই অবাক হবার মতাে ব্যাপার। আর আমি মানুষ হয়ে যন্ত্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, তিশ শুনে যাও।
তিশ থমকে দাঁড়াল। আমি বললাম, “ইনাের কাছে তােমাকে যেতে হবে না। ‘কেন ?’ ‘প্রশ্ন করবে না। তােমাকে যেতে নিষেধ করছি, তুমি যাবে না। ‘তিন লাইনের কবিতাটা তাকে শোনাব না ?’
না। এখন দয়া করে বিদেয় হও।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঘর পুরােপুরি অন্ধকার নয়। হালকা আলাে আছে। এই রকম আলােয় মন বিষর্ণ হয়। হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে–আসা একটি গ্রহের কথা মনে হয়। সেই গ্রহের একজন মানবীর কথা মনে পড়ে, যার সঙ্গে এই জীবনে আর দেখা হবে না ।
হাত বাড়িয়ে মাথার বাঁ পাশের নীল একটা সুইচ টিপলাম। হালকা সংগীত বাজতে শুরু করল । মাঝে মাঝে এই সংগীত আমি শুনি। এর জন্ম পৃথিবীতে নয় । অজানা এক গৃহে । অজানা গ্রহের অচেনা উন্নত কোনাে প্রাণী এই সুর সৃষ্টি করেছে। গভীর বিষাদময় সুর ।
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
প্রচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে জেগে উঠলাম । কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি ? মনে করতে পারছি না। হয়তাে দেখেছি। দুঃস্বপ্ন প্রায় সময়ই মনে থাকে না, কিন্তু তার প্রভাব মানুষকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৩৩৬,৭২৫২, এই ঘড়ি আমার কাছে এখনাে অর্থহীন। শুধু জানি এই ঘড়ি মহাকাশযানের সময় বলছে। ৩৩৬,৭২৫২, ঘণ্টা আগে মহাকাশযান যাত্রা শুরু করেছে। যাত্রা শুরুর সময় ছিল শুন্য ঘণ্টা। এখানে আরাে দুটি ঘড়ি আছে। একটিতে দেখানাে হচ্ছে পৃথিবীর সময় । সেখানে সময় প্রসারণ বা ডাইলেশনের ব্যাপারগুলি হিসাবের মধ্যে ধরা আছে।
আমি সেই হিসাব বুঝি না। অবশ্যি বােঝবার চেষ্টাও করি না । কারণ ঘড়ির সময় বােঝা বা বােঝার চেষ্টা করা এখানে অর্থহীন। যেই মুহূর্তে হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়া হবে সেই মুহূর্তেই সময় অদ্ভুতভাবে জট পাকিয়ে যাবে। সেই জটের অর্থ উদ্ধার করা মানুষের পক্ষে এখনাে সম্ভব হয় নি। | আমি বিছানা ছেড়ে নামলাম। তৃষ্ণা পেয়েছিল কয়েক ঢােক পানি খেলাম। অস্বস্তিটা কমল না, বরং বেড়ে যেতে লাগল। যেন বিরাট কিছু হতে যাচ্ছে । ভয়ংকর কিছু। নিজেকে একটু হালকা হালকাও লাগছে। কৃত্রিম উপায়ে মহাকাশযানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তৈরি করা হয়। এখানে ওজন-শূন্যতা নেই। কিন্তু নিজেকে হালকা লাগছে কেন? আমি সুইচ টিপে তিশকে ডাকলাম। উদ্বিগ্ন গলায় বললাম, “কিছু হয়েছে নাকি তিশ?
তিশ বলল, কী হবে ? ‘আমার কী কারণে যেন খুব অস্বস্তি লাগছে।’
এরকম সবারই মাঝে মাঝে লাগে। একে বলে গতিজনিত শারীরিক বিপর্যয়। আমাদের গতিবেগ এখন ০.৪৩c, অর্থাৎ আলাের গতিবেগের প্রায় তেতাল্লিশ শতাংশ। গতিবেগ যখন ৩,৬০০ হবে বা তার চেয়ে বেশি হবে তখন শারীরিক বিপর্যয় শুরু হবে। হার্ট বিট দ্রুত কমতে থাকবে, ব্লাড প্রেশার কমবে, বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং গায়ের তাপমাত্রা প্রায় সাত ডিগ্রির মতো কমে যাবে। তবে ভয়ের কিছু নেই, ওষুধপত্রের ভালো ব্যবস্থা আছে। আমি কি তােমার জন্যে ডাক্তার রােবটকে খবর দেব?’
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
আমাদের এই ডাক্তার রােবট মনােবিশ্লেষণের ব্যাপারেও একজন বিশেষজ্ঞ। আমার মনে হয় তোমার উচিত তার সঙ্গে কথা বলা ।
“তুমি বিদেয় হও।”
তিশকে বিদেয় দিয়ে আমার অস্বস্তি আরাে দ্রুত বাড়তে লাগল। যতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এই প্রথম বার মনে হল আমৱা একটা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছি। কোনাে এক আকর্ষণী শক্তির মধ্যে পড়ে গেছি —যার শক্তি অকল্পনীয়। আমার মনে হল মহাকাশযানের প্রতিটি পরমাণুর ওপর এই শক্তির অশুভ ছায়া পড়েছে। এই শক্তি যেন নিয়তির মতো অমােঘ। এর হাত এড়াবার কোনাে উপায় নেই। অথচ মহাকাশযানের সব কিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে মনে হচ্ছে। আমার মাথার ওপর বিন্দুর মতো একটি আলাে জ্বলছে, যার মানে মহাকাশযানে কোনাে যান্ত্রিক ত্রুটি নেই।
প্রতিটি যন্ত্র ঠিকমতাে কাজ করছে। তা তাে হতে পারে না।আমি নিজের ঘর ছেড়ে বেরুল্লাম। হলঘরে মিনিটখানেক কিংবা তার চেয়েও কিছু কম সময় দাঁড়িয়ে ভাবলাম কী করা উচিত। একবার মনে হল আমার কিছুই করার নেই, যা হবার হােক । আমি বরং আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। এই ভাবনা দীর্ঘস্থায়ী হল না । আমি রওনা হলাম জন বরগের সুরের দিকে। আগে থেকে যােগাযােগ না করে তার ঘরে যাবার নিয়ম নেই, কিন্তু ততটা সময় মনে হচ্ছে আমার হাতে নেই।
আমি কি অসিতে পারি জন বরগ ? | এক মুহুর্তের জন্যে জুন বরগের চোখে বিরক্তির ছায়া পড়ল। তিনি সেই বিরক্তি মুছে ফেলে বললেন, “নিশ্চয়ই। যদিও মহাকাশ নীতিমালায় আপনি তা পারেন না। তবে সব নীতিমালা সব সময় প্রযােজ্য নয়। আপনি কেমন আছেন ?
অনন্ত নক্ষত্র বীথি-পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ভালাে।
বসুন। মহাকাশের দৃশ্য দেখুন। আমি বেশির ভাগ সময় ভিউ প্যানেলের সামনে বসে কাটাই। বাইরের ছবি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।’
“আমি একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’
বলুন।
‘আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। | ‘খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মহাকাশযানের গতিবেগ আলাের গতিবেগের চল্লিশ শতাংশেরও বেশি। সেই বেগ ক্রমেই বাড়ছে।
এই অবস্থায় শারীরিক কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। এবং তখন যা করতে হয়, তা হচ্ছে—একজন ডাক্তারের কাছে যেতে হয় । মিশন-প্রধানের কাছে নয়।
‘অাপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমার মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শক্তিধর কিছু তার দিকে আমাদের টানছে। এর শক্তি অকল্পনীয়, সীমাহীন। আমার মনে হচ্ছে একে এড়াবার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই।’ জন বরগ হেসে ফেললেন। একজন বয়স্ক লােকের মুখে শিশুদের মতাে কথা শুনলে আমরা যে রকম করে হাসি, অবিকল সে রকম প্রশ্রয়–মাখানো হাসি । জন বরগ হাসতে হাসতেই বললেন, মহাকাশযান সম্পর্কে আপনার কোনাে ধারণা নেই বলেই এ রকম উদ্ভট কথা আমাকে বলতে এসেছেন।