আমিই মিসির আলি-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

এই সাইকিয়াট্রিস্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায় মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খােলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেনতার উপর গবেষণা করছেন

আমিই মিসির আলিমনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেনবাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকারবাইরের কোন শব্দও সেখানে যাবার কোন উপায় নেইপরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানাে হয় নাসে কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢােকেতারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছেআস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকেভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়ডাকাডাকি করতে শুরু করেবাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকেকোন উত্তর পায় নাএদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসেসে প্রাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙ্গুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়পানি বাড়তেই থাকে

পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে আলাে ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়যে জগতের আলাে পৃথিবীর আলাের মতাে নাসেই আলাের বর্ণ সােনালিসেই জগতের বৃক্ষরাজি পৃথিবীর বৃক্ষরাজির মতাে নাসেই জগত অদ্ভুত অবাস্তব এক জগতযেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শােনা যায়শতকরা দশভাগ ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন অন্ধকার ধূম্রময় এক জগতেসেই জগৎ আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগতবাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে নাতারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি জেমস সাহেবের বইটি পড়ে মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে শৈশবে মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টার না জেনেই ধরনের একটি পরীক্ষা আমার উপর করেছিলভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে স্ফটিক দরজা খােলার ব্যবস্থা করেছিলআমি আমার পাঠ্য বিষয় গণিতশাস্ত্রের চেয়ে প্যারাসাইকলজির বিষয়ে বেশি আগ্রহ বােধ করতে থাকিধরনের বইপত্র যেখানে যা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করিএটা করতে গিয়ে অনেক ভালাে বই যেমন পড়েছি অনেক মন্দ বইও পড়েছিউদাহরণ ভালাে বই পড়ার উদাহরণ হিসেবে 

বলিমৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মানসিক জগত নিয়ে লেখা পেরিনের অসাধারণ বই Death call, পেরিন দেখিয়েছেন মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষদের মানসিক রূপান্তর একই ধারায় হয়মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে আসার পর হঠাৎ মনে হয় মানুষগুলি আর জগতে বাস করছে নাতারা অন্য কোন জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেযে জগতটির সঙ্গে পৃথিবীর জগতের কোনই মিল নেইতাদের কাছে সেই জগতটি সত্য বলে মনে হয়। 

পেরিনের লেখা আরেকটি বইও আমাকে আলােড়িত করেছিলএই বইটি ক্যানসারে আক্রান্ত রুগীদের নিয়ে লেখারুগীরা জানেন তাদের মরণ ব্যাধিতে ধরেছেবাঁচার কোনাে আশা নেইতারপরেও মনের গভীর গােপনে বেঁচে থাকার আশা পােষণ করেনতাঁরা ভাবেন একটা কিছু অলৌকিক ব্যাপার তাঁদের জীবনে ঘটবেঈশ্বর প্রার্থনা শুনবেন তাদের আরােগ্য করবেনক্যানসারের কোনাে অষুধ বের হয়ে যাবেসেই অষুধে রােগমুক্তি ঘটবেআশায় আশায় বাচতে থাকেনএক সময় হঠাৎ করেই বুঝতে পারেনকোনাে আশা নেইনিশ্চিত মৃত্যু সামনেই অপেক্ষা করছেতখন তারা অন্য রকম হয়ে যানআত্মা তাদের ত্যাগ করেআশা ত্যাগ করার পরও দুএক দিন তারা বাঁচেনসেই বাঁচা ভয়াবহ বাঁচামানুষটা বেঁচে আছে, কথা বলছে, খাচ্ছে ঘুমুচ্ছে কিন্তু মানুষটার আত্মা নেই| আমার মায়ের বেলায় ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিলআত্মা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলসে এক ভয়াবহ ব্যাপার

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ

বিলেতে পড়াশােনার সময়ই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলি সুযােগ এবং সুবিধামত আমি প্যারাসাইকলজির উপর কিছু কাজ করবসেই সুযােগের জন্যে আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। 

মিসির আলি খাতার উপর থেকে চোখ তুললেনসুলতান এসে পাশে দাঁড়িয়েছেসে এসেছে নিঃশব্দেমিসির আলি সুলতানের ঘরে ঢােকার শব্দ পান নিসে যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই বুঝতে পেরেছেন। 

সুলতান খাটে বসতে বসতে বলল, সন্ধ্যাবেলা পড়াশােনার জন্যে ভাল না। মিসির আলি কিছু বললেন নাসুলতান বলল, আপনি গভীর মনােযােগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন দেখে ভাল লাগলঘটনাগুলি আমি মােটামুটি ভালােই গুছিয়ে লিখেছি। 

মিসির আলি বললেন, আমি যখন কিছু পড়ি মন দিয়েই পড়িতুমি 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *