এই সাইকিয়াট্রিস্ট মনে করেন যে কৃত্রিম উপায় মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করে অদৃশ্য দরজা খােলা যেতে পারে। তিনি একটি কৃত্রিম উপায় বেরও করেছেন। তার উপর গবেষণা করছেন।
মনের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টির জন্যে তিনি উৎসাহী ভলেন্টিয়ারকে একটি সাত ফুট বাই সাত ফুট এয়ার টাইট ধাতব বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে দেন। বাক্সের ভেতরটা ভয়ংকর অন্ধকার। বাইরের কোন শব্দও সেখানে যাবার কোন উপায় নেই। পরীক্ষাটা কী, কেমন ভাবে হবে তার কিছুই ভলেন্টিয়ারকে জানানাে হয় না। সে কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই বাক্সের ভেতর ঢােকে। তারপর হঠাৎ লক্ষ করে বাক্সের ভেতর পানি জমতে শুরু করছে। আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। ভলেন্টিয়ার বাক্সের ভেতর দাঁড়ায়। ডাকাডাকি করতে শুরু করে। বাক্সের ডালায় ধাক্কা দিতে থাকে। কোন উত্তর পায় না। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে তার গলা পর্যন্ত চলে আসে। সে প্রাণে বাঁচার জন্যে পায়ের আঙ্গুলে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। পানি বাড়তেই থাকে।
পানি নাক পর্যন্ত যাবার পর পরীক্ষাটা বন্ধ হয়। তীব্র ভয়ে ভলেন্টিয়ার দিশাহারা হয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ত্রিশভাগ ভলেন্টিয়ার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ নিজেকে বাক্সের বাইরে আলাে ঝলমল একটা জগতে দেখতে পায়। যে জগতের আলাে পৃথিবীর আলাের মতাে না। সেই আলাের বর্ণ সােনালি। সেই জগতের বৃক্ষরাজি পৃথিবীর বৃক্ষরাজির মতাে না। সেই জগত অদ্ভুত অবাস্তব এক জগত। যেখানে অস্পষ্ট কিন্তু মধুর সঙ্গীত শােনা যায়। শতকরা দশভাগ ভলেন্টিয়ার নিজেদের আবিষ্কার করেন অন্ধকার ধূম্রময় এক জগতে। সেই জগৎ আতঙ্ক এবং কোলাহলের জগত। বাকি ষাট ভাগ কিছুই দেখে না। তারা আতঙ্কময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাক্স থেকে বের হয়ে আসে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি জেমস সাহেবের বইটি পড়ে মােটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে শৈশবে মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টার না জেনেই এ ধরনের একটি পরীক্ষা আমার উপর করেছিল। ভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে স্ফটিক দরজা খােলার ব্যবস্থা করেছিল। আমি আমার পাঠ্য বিষয় গণিতশাস্ত্রের চেয়ে প্যারাসাইকলজির বিষয়ে বেশি আগ্রহ বােধ করতে থাকি। এ ধরনের বইপত্র যেখানে যা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। এটা করতে গিয়ে অনেক ভালাে বই যেমন পড়েছি অনেক মন্দ বইও পড়েছি। উদাহরণ ভালাে বই পড়ার উদাহরণ হিসেবে
বলি— মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মানসিক জগত নিয়ে লেখা পেরিনের অসাধারণ বই Death call, পেরিন দেখিয়েছেন মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষদের মানসিক রূপান্তর একই ধারায় হয়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে আসার পর হঠাৎ মনে হয় মানুষগুলি আর এ জগতে বাস করছে না। তারা অন্য কোন জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। যে জগতটির সঙ্গে পৃথিবীর জগতের কোনই মিল নেই। তাদের কাছে সেই জগতটি সত্য বলে মনে হয়।
পেরিনের লেখা আরেকটি বইও আমাকে আলােড়িত করেছিল। এই বইটি ক্যানসারে আক্রান্ত রুগীদের নিয়ে লেখা। রুগীরা জানেন তাদের মরণ ব্যাধিতে ধরেছে। বাঁচার কোনাে আশা নেই। তারপরেও মনের গভীর গােপনে বেঁচে থাকার আশা পােষণ করেন। তাঁরা ভাবেন একটা কিছু অলৌকিক ব্যাপার তাঁদের জীবনে ঘটবে। ঈশ্বর প্রার্থনা শুনবেন তাদের আরােগ্য করবেন। ক্যানসারের কোনাে অষুধ বের হয়ে যাবে। সেই অষুধে রােগমুক্তি ঘটবে। আশায় আশায় বাচতে থাকেন। এক সময় হঠাৎ করেই বুঝতে পারেন— কোনাে আশা নেই। নিশ্চিত মৃত্যু সামনেই অপেক্ষা করছে। তখন তারা অন্য রকম হয়ে যান। আত্মা তাদের ত্যাগ করে। আশা ত্যাগ করার পরও দু‘এক দিন তারা বাঁচেন। সেই বাঁচা ভয়াবহ বাঁচা। মানুষটা বেঁচে আছে, কথা বলছে, খাচ্ছে ঘুমুচ্ছে কিন্তু মানুষটার আত্মা নেই। | আমার মায়ের বেলায় ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল। আত্মা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার!
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ
বিলেতে পড়াশােনার সময়ই আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলি সুযােগ এবং সুবিধামত আমি প্যারাসাইকলজির উপর কিছু কাজ করব। সেই সুযােগের জন্যে আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়।
মিসির আলি খাতার উপর থেকে চোখ তুললেন। সুলতান এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। সে এসেছে নিঃশব্দে। মিসির আলি সুলতানের ঘরে ঢােকার শব্দ পান নি। সে যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই বুঝতে পেরেছেন।
সুলতান খাটে বসতে বসতে বলল, সন্ধ্যাবেলা পড়াশােনার জন্যে ভাল না। মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি গভীর মনােযােগ দিয়ে আমার লেখা পড়ছেন দেখে ভাল লাগল। ঘটনাগুলি আমি মােটামুটি ভালােই গুছিয়ে লিখেছি।
মিসির আলি বললেন, আমি যখন কিছু পড়ি মন দিয়েই পড়ি। তুমি