আমরা থাকতাম পুরনাে ঢাকার একটা বাড়িতে। সেই বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়িও উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। আমাদের পড়াশােনার জন্যে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই দিকে কারাে কোনাে নজর ছিল বলে মনে হয় না। বাবা ব্যস্ত তাঁর ব্যবসা নিয়ে।
আজ ঢাকা, কাল নারায়ণগঞ্জ, পরশু খুলনা এই অবস্থা। মা বিছানায়। বাড়ি ভর্তি কাজের লােক। এরা পান খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘােরাফেরা ছাড়া কিছু করে না। সন্ধ্যার পর দু’জন প্রাইভেট টিউটর আসেন। তারা চা পানি খান। বেত নিয়ে হাম্বিতম্বি করেন। সপ্তাহে তিন দিন আসেন একজন মওলানা। তার বিরাট দাড়ি, চোখে সুরমা। তিনি আমাদের কোরান শরীফ পাঠ করা শেখান। বিরাট বিশৃঙ্খলার ভেতরে আমরা বড় হচ্ছি। তবে বিশৃঙ্খলারও নিজস্ব ছন্দ আছে। কোথাও ছন্দ পতন হচ্ছে না। একদিন হলাে— আমার বড় বােন মারা গেল, ভালাে মানুষ সারাদিন কাজকর্ম করেছে। মওলানা সাহেবের কাছে সিপারা পড়েছে। রাতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে গিয়েছে, সেই ঘুম আর ভাঙল না।।
বাবা তখন চিটাগাং–এ। তিনি খবর পেয়ে কাজকর্ম ফেলে চলে এলেন। তাকে কন্যা শোকে অধীর বলে মনে হলাে না, তিনি শুধু বারান্দার এ মাথা
থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলেন আর বারবার বলতে লাগলেন— সমস্যাটা কী ? ঘটনাটা কী ?
বড় বােনের মৃত্যুর পেছনে কোনাে সমস্যা বা ঘটনা হয়তাে ছিল আমি নিতান্তই শিশু বলে বুঝতে পারি নি। আমার বড় বােনের নাম মীরু তার তখন আঠারাে উনিশ বছর। সমস্যারই সময়। আমার ধারণা ভালাে কোনাে সমস্যাই ছিল।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ
বড় বােনের মৃত্যুর ঠিক ছ‘মাসের মাথায় মারা গেল আমার মেজো ভাই। তার নাম ইজাজত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রিকশার ধাক্কা খেয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। বাসায় এসে কয়েকবার বমি করে চোখ উল্টে দিল। বাবা শােকে যে অভিভূত হলেন তা–না চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, সমস্যাটা কী ? ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় এটা ঠিক আছে। কিন্তু রিকশার নিচে পড়ে মৃত্যু এটা কেমন কথা? আর কিছু না অভিশাপ লেগে গেছে। মহাঅভিশাপ লেগে গেছে। এই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না।
সেই বছরের শেষ দিকে আমার সবচে‘ ছােট বােনটা মারা গেল। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলা চলে। ডিপথেরিয়ায় মৃত্যু। ছােটবােনের মৃত্যুর পর বাবা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ঠিক হলাে ঢাকায় নতুন কোনাে বড় বাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকব। অভিশাপ লাগা বাড়িতে ফিরে যাব না। গ্রামের বাড়িতে আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দেবার জন্যে সার্বক্ষণিক একজন শিক্ষক রাখা হলাে তার নাম ইরিশ। মুহম্মদ ইদরিশ মাস্টার। বাবা তাঁকে ডেকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেন— শিশুদের শাসনে রাখতে হবে। কঠিন শাসন।
পড়াশােনা না করলে, বেয়াদবি করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। কোনাে অসুবিধা নেই। শিশুদের দুইটাই অষুধ। একটা কৃমির অষুধ, আরেকটা মার । | মুহম্মদ ইদরিশ অত্যন্ত উৎসাহে তার কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। প্রতিদিনই তিনি নির্যাতনের নানান কৌশল বের করতে লাগলেন। দুই হাতে ইট নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা দিয়ে শুরুটা করলেন। হাতের ইট তাঁর পায়ে ফেলে দিয়ে তাকে প্রায় খোড়া করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম বলেই হয়ত আমার শাস্তির ব্যাপারে তিনি বিশেষ যত্নবান হলেন। এমন সব শাস্তি যা অনেক চিন্তা ভাবনা, গবেষণা করে বের করতে হয়। চট করে মাথায় আসে না।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আমাকে তিনি এক বিকালে বিশেষ এক ধরনের শাস্তি দেবার জন্যে মন্দিরে নিয়ে ঢুকলেন। গা থেকে শার্ট খুলে খালি গা করলেন। দড়ি দিয়ে দুই হাত পেছন মােড়া করে বাধলেন। তারপর দুটা প্রকাণ্ড বড় বড় মাকড়সা সুতা দিয়ে।
বেঁধে আমার গলায় মালার মতাে পরিয়ে দিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।
আমার মাকড়সা ভীতি আছে। এই নিরীহ প্রাণী মানুষের কোনােই ক্ষতি করে না কিন্তু যারা একে ভয় পায় তাদের কাছে এরা রাজ্যের বিভীষিকা নিয়ে উপস্থিত হয়। যে কারণে মাকড়সা ভীতির আলাদা নাম পর্যন্ত আছে।
প্রথম কিছুক্ষণ আমার মনে হলাে আমি বােধহয় এক্ষুণি মারা যাব। সুতা দিয়ে বাঁধা মাকড়সা দু’টা সারা গায়ে কিলবিল করছে। গলা বেয়ে মুখের দিকে উঠতে চেষ্টা করছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি গলা দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে দরজার আছড়ে পড়ি। সেটা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ আমার হাত–পা জমে গিয়েছিল। ঘর অন্ধকার। আমি চোখে কিছুই দেখছি না, কিন্তু অদ্ভুত কারণে মাকড়সা দু’টাকে দেখতে পাচ্ছি।
মনে হচ্ছে তাদের গা থেকে হালকা সবুজ আলাে বের হচ্ছে। এই সময় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল— চোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি যুবতী মেয়ে। তার গায়ে কোনাে কাপড় নেই তার জন্যে কোনাে লজ্জাও নেই। তার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা চুল। সেই চুল মুখের উপর পড়ে আছে বলে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা বলল, মাকড়সা তাে সামান্য পােকা। তুই ভয়ে দেখি মরে যাচ্ছিস?
আমি বললাম, আপনি মাকড়সা দু’টা ফেলে দিন। আপনার পায়ে পড়ি।
নারী মূর্তি বলল, পায়ে পড়ে লাভ হবে না। আমি মাকড়সা হাত দিয়ে হেঁব না। স্নান করে এসেছি। হাত নােংরা হবে। তুই মাকড়সার দিকে না। তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল। তাহলে ভয় কমবে।
আমি বললাম, আপনি কে?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ
নারী মূর্তি চাপা গলায় বলল, আমি গৌর কালী । কী আশ্চর্য তুই তাে দেখি মাকড়সার ভয়ে মরেই যাচ্ছিস! পেচ্ছাব করে মন্দিরও অপবিত্র করে ফেলেছিস। তুই কেমন ছেলে বল দেখি। মাকড়সার ভয়ে কেউ পেচ্ছাব করে? ছিঃ!
আমি বললাম, আপনি একটা কাঠি দিয়ে মাকড়সা দু’টা ফেলে দিন। নারী মূর্তি চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল— পাগলের মতাে কথা বলবি । আমি এখন কাঠি পাব কোথায় ? কাঠি খুঁজতে হলে মন্দিরের বাইরে যেতে হবে। কুয়ার পাড়ে তাের মাস্টার বসে আছে। আমি নেংটো হয়ে তার সামনে যাব না–কি ? তােকে একটা বুদ্ধি দেই শােন— এই মাস্টার তােকে আরাে অনেক যন্ত্রণা দেবে। যন্ত্রণা দেবার আগেই ব্যবস্থা করে ফেল।
কী ব্যবস্থা ?