আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

আমরা থাকতাম পুরনাে ঢাকার একটা বাড়িতেসেই বাড়িটিও বিশালসেই বাড়িও উঁচু পাঁচিলে ঘেরাআমাদের পড়াশােনার জন্যে ঢাকায় এনে রাখা হয়েছিলকিন্তু সেই দিকে কারাে কোনাে নজর ছিল বলে মনে হয় নাবাবা ব্যস্ত তাঁর ব্যবসা নিয়ে

আমিই মিসির আলিআজ ঢাকা, কাল নারায়ণগঞ্জ, পরশু খুলনা এই অবস্থামা বিছানায়বাড়ি ভর্তি কাজের লােকএরা পান খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘােরাফেরা ছাড়া কিছু করে না। সন্ধ্যার পর দুজন প্রাইভেট টিউটর আসেনতারা চা পানি খানবেত নিয়ে হাম্বিতম্বি করেন। সপ্তাহে তিন দিন আসেন একজন মওলানাতার বিরাট দাড়ি, চোখে সুরমাতিনি আমাদের কোরান শরীফ পাঠ করা শেখানবিরাট বিশৃঙ্খলার ভেতরে আমরা বড় হচ্ছিতবে বিশৃঙ্খলারও নিজস্ব ছন্দ আছেকোথাও ছন্দ পতন হচ্ছে নাএকদিন হলােআমার বড় বােন মারা গেল, ভালাে মানুষ সারাদিন কাজকর্ম করেছেমওলানা সাহেবের কাছে সিপারা পড়েছেরাতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমুতে গিয়েছে, সেই ঘুম আর ভাঙল না। 

বাবা তখন চিটাগাংতিনি খবর পেয়ে কাজকর্ম ফেলে চলে এলেনতাকে কন্যা শোকে অধীর বলে মনে হলাে না, তিনি শুধু বারান্দার মাথা 

থেকে মাথা পর্যন্ত হাঁটতে লাগলেন আর বারবার বলতে লাগলেনসমস্যাটা কী ? ঘটনাটা কী

বড় বােনের মৃত্যুর পেছনে কোনাে সমস্যা বা ঘটনা হয়তাে ছিল আমি নিতান্তই শিশু বলে বুঝতে পারি নিআমার বড় বােনের নাম মীরু তার তখন আঠারাে উনিশ বছরসমস্যারই সময়। আমার ধারণা ভালাে কোনাে সমস্যাই ছিল। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ

বড় বােনের মৃত্যুর ঠিক মাসের মাথায় মারা গেল আমার মেজো ভাইতার নাম ইজাজতস্কুল থেকে ফেরার পথে রিকশার ধাক্কা খেয়ে নর্দমায় পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেলবাসায় এসে কয়েকবার বমি করে চোখ উল্টে দিলবাবা শােকে যে অভিভূত হলেন তানা চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, সমস্যাটা কী ? ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যায় এটা ঠিক আছেকিন্তু রিকশার নিচে পড়ে মৃত্যু এটা কেমন কথা? আর কিছু না অভিশাপ লেগে গেছেমহাঅভিশাপ লেগে গেছেএই বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না। 

সেই বছরের শেষ দিকে আমার সবচেছােট বােনটা মারা গেল। তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলা চলেডিপথেরিয়ায় মৃত্যুছােটবােনের মৃত্যুর পর বাবা সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেনঠিক হলাে ঢাকায় নতুন কোনাে বড় বাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গ্রামে থাকবঅভিশাপ লাগা বাড়িতে ফিরে যাব নাগ্রামের বাড়িতে আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দেবার জন্যে সার্বক্ষণিক একজন শিক্ষক রাখা হলাে তার নাম ইরিশমুহম্মদ ইদরিশ মাস্টারবাবা তাঁকে ডেকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে দিলেনশিশুদের শাসনে রাখতে হবেকঠিন শাসন

পড়াশােনা না করলে, বেয়াদবি করলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেকোনাে অসুবিধা নেইশিশুদের দুইটাই অষুধ। একটা কৃমির অষুধ, আরেকটা মার | মুহম্মদ ইদরিশ অত্যন্ত উৎসাহে তার কর্মকাণ্ড শুরু করলেনপ্রতিদিনই তিনি নির্যাতনের নানান কৌশল বের করতে লাগলেন। দুই হাতে ইট নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা দিয়ে শুরুটা করলেনহাতের ইট তাঁর পায়ে ফেলে দিয়ে তাকে প্রায় খোড়া করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম বলেই হয়ত আমার শাস্তির ব্যাপারে তিনি বিশেষ যত্নবান হলেনএমন সব শাস্তি যা অনেক চিন্তা ভাবনা, গবেষণা করে বের করতে হয়চট করে মাথায় আসে না। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ

আমাকে তিনি এক বিকালে বিশেষ এক ধরনের শাস্তি দেবার জন্যে মন্দিরে নিয়ে ঢুকলেন। গা থেকে শার্ট খুলে খালি গা করলেন। দড়ি দিয়ে দুই হাত পেছন মােড়া করে বাধলেনতারপর দুটা প্রকাণ্ড বড় বড় মাকড়সা সুতা দিয়ে। 

বেঁধে আমার গলায় মালার মতাে পরিয়ে দিয়ে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন। 

আমার মাকড়সা ভীতি আছেএই নিরীহ প্রাণী মানুষের কোনােই ক্ষতি করে না কিন্তু যারা একে ভয় পায় তাদের কাছে এরা রাজ্যের বিভীষিকা নিয়ে উপস্থিত হয়যে কারণে মাকড়সা ভীতির আলাদা নাম পর্যন্ত আছে। 

প্রথম কিছুক্ষণ আমার মনে হলাে আমি বােধহয় এক্ষুণি মারা যাব। সুতা দিয়ে বাঁধা মাকড়সা দুটা সারা গায়ে কিলবিল করছেগলা বেয়ে মুখের দিকে উঠতে চেষ্টা করছেআমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি গলা দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হচ্ছে নাআমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে দরজার আছড়ে পড়িসেটা সম্ভব হচ্ছিল না, কারণ আমার হাতপা জমে গিয়েছিলঘর অন্ধকারআমি চোখে কিছুই দেখছি না, কিন্তু অদ্ভুত কারণে মাকড়সা দুটাকে দেখতে পাচ্ছি

মনে হচ্ছে তাদের গা থেকে হালকা সবুজ আলাে বের হচ্ছেএই সময় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলচোখের সামনে দেখলাম একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছেতার মুখ হাসি হাসি যুবতী মেয়েতার গায়ে কোনাে কাপড় নেই তার জন্যে কোনাে লজ্জাও নেইতার মাথা ভর্তি লম্বা লম্বা চুলসেই চুল মুখের উপর পড়ে আছে বলে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নামেয়েটা বলল, মাকড়সা তাে সামান্য পােকাতুই ভয়ে দেখি মরে যাচ্ছিস

আমি বললাম, আপনি মাকড়সা দুটা ফেলে দিনআপনার পায়ে পড়ি। 

নারী মূর্তি বলল, পায়ে পড়ে লাভ হবে নাআমি মাকড়সা হাত দিয়ে হেঁব নাস্নান করে এসেছিহাত নােংরা হবেতুই মাকড়সার দিকে নাতাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতাহলে ভয় কমবে। 

আমি বললাম, আপনি কে

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২৫)-হুমায়ূন আহমেদ

নারী মূর্তি চাপা গলায় বলল, আমি গৌর কালী কী আশ্চর্য তুই তাে দেখি মাকড়সার ভয়ে মরেই যাচ্ছিস! পেচ্ছাব করে মন্দিরও অপবিত্র করে ফেলেছিসতুই কেমন ছেলে বল দেখিমাকড়সার ভয়ে কেউ পেচ্ছাব করে? ছিঃ

আমি বললাম, আপনি একটা কাঠি দিয়ে মাকড়সা দুটা ফেলে দিননারী মূর্তি চাপা হাসি হাসতে হাসতে বললপাগলের মতাে কথা বলবি আমি এখন কাঠি পাব কোথায় ? কাঠি খুঁজতে হলে মন্দিরের বাইরে যেতে হবেকুয়ার পাড়ে তাের মাস্টার বসে আছেআমি নেংটো হয়ে তার সামনে যাব নাকি ? তােকে একটা বুদ্ধি দেই শােনএই মাস্টার তােকে আরাে অনেক যন্ত্রণা দেবেযন্ত্রণা দেবার আগেই ব্যবস্থা করে ফেল। 

কী ব্যবস্থা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *