উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

উৎসর্গ 

আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে সপ্তাহে একবার যাদের মুখ না দেখলে মনে হয়সপ্তাহটা ঠিকমতাে পার হলাে নাকিছু যেন বাদ পড়ে গেল। 

শফিকউলকরিম 

আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠলকাকে দেখা যাচ্ছে আয়নায় ? এটা কি তার নিজেরই ছায়া ? নাকি এক চোখা দৈত্যসাইক্লপ!

উড়ালপঙ্খি

যাকে দেখা যাচ্ছে তার বাঁ চোখ বন্ধ হয়ে আছেখুব চেষ্টা করলে চোখের সাদা অংশ দেখা যায়, কালাে মণি দেখা যায় নাগালের হনু উচু হয়ে আছেথুতনির কাছে খোচা খোচা দাড়িগালের হনু তাে আগে উঁচু ছিল নাবেছে বেছে আজই উঁচু হয়ে গেল ? সারা মুখে কেমন চিমশে ভাব চলে এসেছেরাতে 

ঘুমুলে এরকম হয় কিন্তু গত রাতে তার ঘুম খুব ভালাে হয়েছেঘুমের মধ্যে সে ইন্টারেস্টিং একটা স্বপ্নও দেখেছেস্বপ্নটা এখন মনে পড়ছে নাদুপুরের দিকে মনে পড়বেমুহিবের স্বপ্ন মনে পড়ে দুপুরের পর। 

এই চেহারা দুরুস্ত করা যাবে কীভাবে? শেভ করে থুতনির দাড়ি ফেলে দেয়া যাবেক্রিম ঘষে মুখের চিমশে ভাব হয়তাে বা কিছুটা কাটান দেয়া যাবেকিন্তু বা চোখের গতি কী হবে ? এই চোখ নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতেযাওয়া যায়, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায় নাআজ সকাল এগারােটায় দ্যা এরনসনামের একটা কোম্পানির সঙ্গে তার ইন্টারভিউতারা দ্বিতীয় দফায় ডেকেছেদ্বিতীয়বার যখন ডাকছে তখন নিশ্চয়ই কোনাে ঘটনা আছেচোখের এই অবস্থা দেখলে কি ইন্টারভিউ বাের্ডের কর্তারা সেই বিশেষ ঘটনা ঘটাবেন ? এখন বাজছে আটটাহাতে আরাে তিন ঘণ্টা সময় আছেএই তিন ঘণ্টায় চোখের কোনাে গতি করা যাবে কি

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

জলচিকিৎসা শুরু করলে কেমন হয় ? যেকোনাে রােগের প্রথম চিকিৎসা হলাে জলচিকিৎসাকিছু কিছু রােগের শুধু যে প্রথম চিকিৎসা তানা, শেষ চিকিৎসাওকথাগুলাে মুহিবের বড় চাচা তৌফিকুর রহমান সাহেবেরপেনশন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে তিনি বাড়িতে বসে আছেনঅবসর কাটাচ্ছেন নানাবিধ চিকিত্সা পদ্ধতি নিয়ে পড়াশােনা করেউনার কর্মকাণ্ড পড়াশােনায় সীমাবদ্ধথাকলে ভালাে হতােতা নেই, তিনি বাড়িতে কিছু ভেষজ ওষুধও বানাতে শুরু করেছেনতাঁর প্রথম প্রচেষ্টা Olive leaf extract. হামানদিস্তায় জলপাই 

গাছের কচিপাতা পেষা হচ্ছেতার সঙ্গে আগারআগার মিশিয়ে ডালের বড়ির মতাে বড়ি বানিয়ে রােদে শুকানাে হচ্ছেশুকানাের পর এই ঘাের কৃষ্ণবর্ণ বস্তুটাকে দেখাচ্ছে ছাগলের লাদির মতােএই ছাগলের লাদি দৈনিক একটা করে খেলে নবযৌবনকার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার কিছুই থাকবে নাছাগলের লাদি শরীরের সমস্ত দষিত পদার্থ ব্লটিং পেপারের মতাে শুষে নিয়ে নিবেশরীরে চলে আসবে কমনীয় কান্তি। 

মুহিব গত চারদিনে চারটা ট্যাবলেট খেয়েছেআজ যদি খায় তাহলে শরীরে পঞ্চম ডােজ পড়বেচোখে প্রবল বেগে পানির ঝাপ্টা দিতে হতে তার মনে হলাে কোনাে কারণ ছাড়াই এই যে তার চোখ ফুলে গেল, চেহারায়চিমশে ভাব চলে এসেছে, এইসব ছাগলের লাদির সাইড এফেক্ট না তাে ? যে ওষুধে নবযৌবন নিয়ে আসবে তার কিছু সাইড অ্যাফেক্ট তাে থাকারই কথা নবযৌবন নিয়ে আসবে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে নবযৌবন প্রাপ্ত মানুষটার একটা চোখ বসিয়ে দিয়ে যাবে। 

দরজায় টোকা পড়ছেমুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, যে দরজায় টোকা দিচ্ছে সে কোনাে একটা কাজ নিয়ে এসেছেকাজ ছাড়া ভােরবেলায় কেউ বেকার যুবকের কাছে আসে নাহয়তাে সকালের নাস্তার ময়দা নেইমােড়ের দোকান থেকে ময়দা আনতে হবেকিংবা চিঠি নিয়ে এক্ষুণি কারাের বাসায় যেতে হবেসেই লােক অফিসে চলে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

যিনি দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন তিনি এখন স্বগলায় জানান দিলেনবিরক্ত গলামুহিব! মুহিব! | মুহিবের বড়ভাবি ইয়াসমিনের গলাএই মহিলা অনেক পরিশ্রম করে তার লায় স্থায়ী বিরক্তি নিয়ে এসেছেনস্বাভাবিক গল্পগুজবের সময়ও তার গলায় রাজ্যের বিরক্তি ঝরে পড়েভুরু কুঁচকে থাকে, চোখ সরু হয়ে যায়। মুহিব পানির কল বন্ধ করল জলচিকিৎসার এইখানেই ইতি। 

এতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি, ব্যাপার কী? বাথরুমে ছিলাম ভাবি, শুনতে পাই নি। 

তােমার কি এখন কোনাে জরুরি কাজ আছে ? মুহিব হাসি মুখে বলল, আমার জরুরি কাজ থাকবে কী জন্যে

ইয়াসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দেবে নাকাজ আছেকি নেই সেটা বলল। 

কাজ নেই। 

মাঝারি সাইজের দুটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এনে দিয়ে যাবেপদ্মার ইলিশ আনবেবার্মিজ ইলিশ পাওয়া যায় ভুলেও বার্মিজটা আনবে না| বার্মিজ ইলিশ পদ্মার ইলিশ চিনব কীভাবে

মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করবেপদ্মার ইলিশ গােলগাল হয়বার্মিজটা হয় লম্বা টাইপেরমুখ বোচাআধাকেজি সরিষা আনবেপুরনাে সরিষা আনবে 

পুরনােটা তিতা হয়আধাকেজি নতুন রাই সরিষাকাগজি লেবুকাঁচামরিচদুইশ গ্রাম জিরা। মনে থাকবে

অবশ্যই মনে থাকবেমনে থাকবে নাভুলে যাবে, কাগজে লিখে নাওভাবি, মনে থাকবেআমার স্মৃতিশক্তি ভালােকী কী আনতে হবে বলাে তাে শুনি

দুটা পদ্মার ইলিশআধাকেজি নতুন রাই সরিষা, কাগজি লেবু, কাঁচামরিচ, দুইশ গ্রাম জিরা হয়েছে না ? দশে দশ পেয়েছি কিনা বলাে। 

 তুমি আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছডিমওয়ালা ইলিশতােমার ভাই ইলিশ মাছ খাবে নাইলিশ মাছের ডিমের ঝােল খাবেএক হাজার টাকা রাখযা বাচে ফেরত দেবে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

অবশ্যই ফেরত দেব| তােমার ভাইয়ের এক মহিলা কলিগ আছেন, নায়লা নামউনার মনে হয় কোনাে কাজকর্ম নাইপ্রতিদিন একটা রান্নার রেসিপি বলেনতােমার ভাই সেটা মাথায় করে বাসায় নিয়ে আসে। 

মুহিব গলা নামিয়ে বলল, প্রেমট্রেম হয়ে যায় নি তাে ভাবি ? আমার সঙ্গে রসিকতা করবে নাআমার রসিকতা ভালাে লাগে নাসরি। 

বড়চাচা তােমাকে ডাকছেনউনিও কী যেন আনাবেনতার সঙ্গে দেখা করে যেওআর দয়া করে এক্ষুণি একটা কাগজে লিখে নাও কী কী আনতে হবে। 

মুহিব আবারাে বাথরুমে ঢুকলজলচিকিৎসায় চোখের কিছু হয় নিশেভ করে মােটামুটি ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করা দরকারতার চোখের এই অবস্থাটা ভাবি লক্ষ করেন নিএটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনামনে হচ্ছে এই বাড়ির কেউ এখন তার দিকে ভালাে করে তাকায় নাতাকালেও কিছু দেখে নাবােধহয় সে H. G. Wellsএর অদৃশ্য মানব হয়ে যাচ্ছেএকটা পরীক্ষা করা যেতে 

পারেসবার সামনে কিছুক্ষণ ঘােরাঘুরি করবেঅকারণেই কিছু কথাবার্তাও বলা হবেদেখতে হবে যাদের সামনে ঘােরাঘুরি করা হলাে তাদের মধ্যে কতজন বলে— 

আরে, চোখে কী হয়েছে? কেউ বলবে এরকম মনে হচ্ছে না। 

তৌফিকুর রহমান দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে আছেনতাঁর পায়ের পাতা রােদে, তিনি ছায়াতেপায়ের পাতায় ওলিভ ওয়েল মাখানােওলিভ ওয়েল সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়ােলেট রশ্মি থেকে পাকে রক্ষা করবে, আবার সূর্যের উপকারী রশ্মি যা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করবে তাকে বাধাগ্রস্ত করবে নাতৌফিকুর রহমানের হাতে বিজ্ঞানের একটা বইলেখকের নাম মিশিও কাকুবইটার নাম হাইপার স্পেসভােরবেলায় তিনি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বই পড়েনরাতে পড়েন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ক বই

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

তৌফিকুর রহমান সাহেবের বয়স ষাটের উপরেচিরকুমার থাকার কারণে কিংবা নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নিযুবক বয়সে তিনি যে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তা এখনাে বােঝা যায়নিজের পােশাক আশাক নিয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতনএই ভােরবেলাতেও তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরেছেননীল পাড়ের ধবধবে সাদা লুঙ্গিকোলের উপর ঘিয়া রঙের পাতলা মটকার চাদর ফেলে রাখাএখন আষাঢ় মাসচাদরের প্রয়ােজন নেইএই চাদরটা তাঁর সাজসজ্জার অংশ। 

মুহিব বড়চাচার পাশে এসে দাড়ালতৌফিকুর রহমান বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, গুড মর্নিংতাের খবর কী?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *