উৎসর্গ
আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে সপ্তাহে একবার যাদের মুখ না দেখলে মনে হয়। সপ্তাহটা ঠিকমতাে পার হলাে না। কিছু যেন বাদ পড়ে গেল।
শফিক–উল–করিম
আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠল। কাকে দেখা যাচ্ছে আয়নায় ? এটা কি তার নিজেরই ছায়া ? না–কি এক চোখা দৈত্য– সাইক্লপ!
যাকে দেখা যাচ্ছে তার বাঁ চোখ বন্ধ হয়ে আছে। খুব চেষ্টা করলে চোখের সাদা অংশ দেখা যায়, কালাে মণি দেখা যায় না। গালের হনু উচু হয়ে আছে। থুতনির কাছে খোচা খোচা দাড়ি। গালের হনু তাে আগে উঁচু ছিল না। বেছে বেছে আজই উঁচু হয়ে গেল ? সারা মুখে কেমন চিমশে ভাব চলে এসেছে। রাতে
ঘুমুলে এরকম হয় । কিন্তু গত রাতে তার ঘুম খুব ভালাে হয়েছে। ঘুমের মধ্যে সে ইন্টারেস্টিং একটা স্বপ্নও দেখেছে। স্বপ্নটা এখন মনে পড়ছে না। দুপুরের দিকে মনে পড়বে। মুহিবের স্বপ্ন মনে পড়ে দুপুরের পর।
এই চেহারা দুরুস্ত করা যাবে কীভাবে? শেভ করে থুতনির দাড়ি ফেলে দেয়া যাবে। ক্রিম ঘষে মুখের চিমশে ভাব হয়তাে বা কিছুটা কাটান দেয়া যাবে। কিন্তু বা চোখের গতি কী হবে ? এই চোখ নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে। যাওয়া যায়, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায় না। আজ সকাল এগারােটায় ‘দ্যা এরনস‘ নামের একটা কোম্পানির সঙ্গে তার ইন্টারভিউ। তারা দ্বিতীয় দফায় ডেকেছে। দ্বিতীয়বার যখন ডাকছে তখন নিশ্চয়ই কোনাে ঘটনা আছে। চোখের এই অবস্থা দেখলে কি ইন্টারভিউ বাের্ডের কর্তারা সেই বিশেষ ঘটনা ঘটাবেন ? এখন বাজছে আটটা। হাতে আরাে তিন ঘণ্টা সময় আছে। এই তিন ঘণ্টায় চোখের কোনাে গতি করা যাবে কি ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
জল–চিকিৎসা শুরু করলে কেমন হয় ? যে–কোনাে রােগের প্রথম চিকিৎসা হলাে জল–চিকিৎসা। কিছু কিছু রােগের শুধু যে প্রথম চিকিৎসা তা–না, শেষ চিকিৎসাও। কথাগুলাে মুহিবের বড় চাচা তৌফিকুর রহমান সাহেবের। পেনশন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে তিনি বাড়িতে বসে আছেন। অবসর কাটাচ্ছেন নানাবিধ চিকিত্সা পদ্ধতি নিয়ে পড়াশােনা করে। উনার কর্মকাণ্ড পড়াশােনায় সীমাবদ্ধ। থাকলে ভালাে হতাে। তা নেই, তিনি বাড়িতে কিছু ভেষজ ওষুধও বানাতে শুরু করেছেন। তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা Olive leaf extract. হামানদিস্তায় জলপাই
গাছের কচিপাতা পেষা হচ্ছে। তার সঙ্গে আগার–আগার মিশিয়ে ডালের বড়ির মতাে বড়ি বানিয়ে রােদে শুকানাে হচ্ছে। শুকানাের পর এই ঘাের কৃষ্ণবর্ণ বস্তুটাকে দেখাচ্ছে ছাগলের লাদির মতাে। এই ছাগলের লাদি দৈনিক একটা করে খেলে নবযৌবন। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার কিছুই থাকবে না। ছাগলের লাদি শরীরের সমস্ত দষিত পদার্থ ব্লটিং পেপারের মতাে শুষে নিয়ে নিবে। শরীরে চলে আসবে কমনীয় কান্তি।
মুহিব গত চারদিনে চারটা ট্যাবলেট খেয়েছে। আজ যদি খায় তাহলে শরীরে পঞ্চম ডােজ পড়বে। চোখে প্রবল বেগে পানির ঝাপ্টা দিতে হতে তার মনে হলাে কোনাে কারণ ছাড়াই এই যে তার চোখ ফুলে গেল, চেহারায়। চিমশে ভাব চলে এসেছে, এইসব ছাগলের লাদির সাইড এফেক্ট না তাে ? যে ওষুধে নবযৌবন নিয়ে আসবে তার কিছু সাইড অ্যাফেক্ট তাে থাকারই কথা । নবযৌবন নিয়ে আসবে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে নবযৌবন প্রাপ্ত মানুষটার একটা চোখ বসিয়ে দিয়ে যাবে।
দরজায় টোকা পড়ছে। মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, যে দরজায় টোকা দিচ্ছে সে কোনাে একটা কাজ নিয়ে এসেছে। কাজ ছাড়া ভােরবেলায় কেউ বেকার যুবকের কাছে আসে না। হয়তাে সকালের নাস্তার ময়দা নেই। মােড়ের দোকান থেকে ময়দা আনতে হবে। কিংবা চিঠি নিয়ে এক্ষুণি কারাের বাসায় যেতে হবে। সেই লােক অফিসে চলে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
যিনি দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন তিনি এখন স্ব–গলায় জানান দিলেন। বিরক্ত গলা— মুহিব! মুহিব! | মুহিবের বড়ভাবি ইয়াসমিনের গলা। এই মহিলা অনেক পরিশ্রম করে তার লায় স্থায়ী বিরক্তি নিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক গল্পগুজবের সময়ও তার গলায় রাজ্যের বিরক্তি ঝরে পড়ে। ভুরু কুঁচকে থাকে, চোখ সরু হয়ে যায়। মুহিব পানির কল বন্ধ করল । জল–চিকিৎসার এইখানেই ইতি।
এতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি, ব্যাপার কী? বাথরুমে ছিলাম ভাবি, শুনতে পাই নি।
তােমার কি এখন কোনাে জরুরি কাজ আছে ? মুহিব হাসি মুখে বলল, আমার জরুরি কাজ থাকবে কী জন্যে ?
ইয়াসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দেবে না। কাজ আছে। কি নেই সেটা বলল।
কাজ নেই।
মাঝারি সাইজের দুটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এনে দিয়ে যাবে। পদ্মার ইলিশ আনবে। বার্মিজ ইলিশ পাওয়া যায় । ভুলেও বার্মিজটা আনবে না। | বার্মিজ ইলিশ পদ্মার ইলিশ চিনব কীভাবে?
মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করবে। পদ্মার ইলিশ গােলগাল হয়। বার্মিজটা হয় লম্বা টাইপের। মুখ বোচা। আধাকেজি সরিষা আনবে। পুরনাে সরিষা আনবে
পুরনােটা তিতা হয়। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা। কাগজি লেবু। কাঁচামরিচ। দুইশ গ্রাম জিরা। মনে থাকবে?
অবশ্যই মনে থাকবে। মনে থাকবে না। ভুলে যাবে, কাগজে লিখে নাও। ভাবি, মনে থাকবে। আমার স্মৃতিশক্তি ভালাে। কী কী আনতে হবে বলাে তাে শুনি?
দু’টা পদ্মার ইলিশ। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা, কাগজি লেবু, কাঁচামরিচ, দুইশ গ্রাম জিরা । হয়েছে না ? দশে দশ পেয়েছি কি–না বলাে।
তুমি আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছ। ডিমওয়ালা ইলিশ। তােমার ভাই ইলিশ মাছ খাবে না। ইলিশ মাছের ডিমের ঝােল খাবে। এক হাজার টাকা রাখ। যা বাচে ফেরত দেবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
অবশ্যই ফেরত দেব। | তােমার ভাইয়ের এক মহিলা কলিগ আছেন, নায়লা নাম। উনার মনে হয় কোনাে কাজকর্ম নাই। প্রতিদিন একটা রান্নার রেসিপি বলেন। তােমার ভাই সেটা মাথায় করে বাসায় নিয়ে আসে।
মুহিব গলা নামিয়ে বলল, প্রেম–ট্রেম হয়ে যায় নি তাে ভাবি ? আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। আমার রসিকতা ভালাে লাগে না। সরি।
বড়চাচা তােমাকে ডাকছেন। উনিও কী যেন আনাবেন। তার সঙ্গে দেখা করে যেও। আর দয়া করে এক্ষুণি একটা কাগজে লিখে নাও কী কী আনতে হবে।
মুহিব আবারাে বাথরুমে ঢুকল। জল–চিকিৎসায় চোখের কিছু হয় নি। শেভ করে মােটামুটি ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করা দরকার। তার চোখের এই অবস্থাটা ভাবি লক্ষ করেন নি। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। মনে হচ্ছে এই বাড়ির কেউ এখন তার দিকে ভালাে করে তাকায় না। তাকালেও কিছু দেখে না। বােধহয় সে H. G. Wells–এর অদৃশ্য মানব হয়ে যাচ্ছে। একটা পরীক্ষা করা যেতে
পারে। সবার সামনে কিছুক্ষণ ঘােরাঘুরি করবে। অকারণেই কিছু কথাবার্তাও বলা হবে। দেখতে হবে যাদের সামনে ঘােরাঘুরি করা হলাে তাদের মধ্যে কতজন বলে—
আরে, চোখে কী হয়েছে? কেউ বলবে এরকম মনে হচ্ছে না।
তৌফিকুর রহমান দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে আছেন। তাঁর পায়ের পাতা রােদে, তিনি ছায়াতে। পায়ের পাতায় ওলিভ ওয়েল মাখানাে। ওলিভ ওয়েল সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়ােলেট রশ্মি থেকে পা–কে রক্ষা করবে, আবার সূর্যের উপকারী রশ্মি যা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করবে তাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। তৌফিকুর রহমানের হাতে বিজ্ঞানের একটা বই। লেখকের নাম মিশিও কাকু। বইটার নাম ‘হাইপার স্পেস‘। ভােরবেলায় তিনি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বই পড়েন। রাতে পড়েন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ক বই।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
তৌফিকুর রহমান সাহেবের বয়স ষাটের উপরে। চিরকুমার থাকার কারণে কিংবা নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। যুবক বয়সে তিনি যে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তা এখনাে বােঝা যায়। নিজের পােশাক আশাক নিয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন। এই ভােরবেলাতেও তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরেছেন। নীল পাড়ের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। কোলের উপর ঘিয়া রঙের পাতলা মটকার চাদর ফেলে রাখা। এখন আষাঢ় মাস। চাদরের প্রয়ােজন নেই। এই চাদরটা তাঁর সাজসজ্জার অংশ।
মুহিব বড়চাচার পাশে এসে দাড়াল। তৌফিকুর রহমান বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, গুড মর্নিং। তাের খবর কী?