পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ঘুম ভাঙার পর ঘড়ি দেখতে চায়। কখন ঘুম ভাঙল এটা জানা যেন খুবই জরুরি। যারা কাজের মানুষ তারা যেমন ঘড়ি দেখে অকাজের মানুষরাও দেখে।শুভ্র সম্ভবত এই দুই দলের কোনোটাতেই পড়ে না। তার ঘরে কোনো দেয়ালঘড়ি নেই। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় হাতঘড়িটাও সে বালিশের নিচে রাখে। না। অথচ ঘুম ভাঙার পর তারই সবচে বেশি সময় জানতে ইচ্ছা করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘড়ি না দেখে সময় আন্দাজ করার নানান কায়দাকানুন তার আছে।
জানালা দিয়ে আসা রোদ যদি খাটের বা দিকের পায়াতে ঝলমল করতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখনো আটটা বাজে নি। আটটার পর খাটের বা পায়ে কোনো রোদ থাকে না।সিলিং-এর মাঝামাঝি জায়গায় চারকোণা (ম্যাচ বাক্সের সাইজ) রোদ থাকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। সিলিং-এ রোদ না থাকলে বুঝতে হবে সাতটার বেশি বাজে। চারকোণা এই রোদ কোন ফাঁক দিয়ে আসে শুভ্ৰ এখনো বের করতে পারে নি। এই ব্যবস্থা অবশ্যি গরমকালের। শীতের দিনে সকাল নটা পর্যন্ত ঘরে কোনো রোদই আসে না।
শুভ্রর বয়স যখন দশ এগারো তখন সময় জানার তার খুব একটা ভালো ব্যবস্থা ছিল। ঠিক সাতটায় তার জানালার পাশে একটা কাক এসে বসত। ঘাড় বঁকিয়ে রাগী রাগী চোখে শুভ্রর দিকে তাকাত। কা কা করে দুবার ডেকেই ঝিম মেরে যেত।কাকটার সঙ্গে শুভ্রর এক সময় বন্ধুত্বের মতো হয়ে যায়। সে দিব্যি ঘরে চুকত। নাশতা খাবার সময় সে শুভ্রর হাত থেকে পাউরুটি খেত। শুভ্ৰ কাকটার একটা নামও দিয়েছিল— কিংকর।শুভ্রর বাবা মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, কিংকর আবার কেমন নাম? তুই এর নাম দে Old faithful. কাটায় কাটায় সাতটার সময় সে যখন আসে তার এই নামই হওয়া উচিত।
মোতাহার হোসেন সাহেব কাকটার সময়ানুবর্তিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিংকর সত্যি সত্যি সকাল সাতটায় আসে কি-না তা দেখার জন্যে তিনি অনেকবার সাতটা বাজার আগে ঘড়ি হাতে ছেলের ঘরে বসেছেন। এবং প্রতিবারই মুগ্ধ গলায় বলেছেন— ভেরি ইন্টারেস্টিং, কাকটা তো ঘড়ি দেখেই আসে! কোনো একজন পক্ষী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে হবে।শুভ্রর মা কাকের ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেন নি। অলুক্ষ্মণে পাখি রোজ ছেলের ঘরে এসে ঢুকবে কেন? কোনো কাক কখনোই মানুয্যের কাছে আসে না। এটা কাক না, অন্য কিছু।মোতাহার হোসেন বললেন, অন্য কিছু মানে কী? কাকের বেশ ধরে অন্য কিছু আসছে। খারাপ জিনিস। কাকটা আসা শুরু করার পর থেকে শুভ্ৰ কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে লক্ষ করছ না?
মোতাহার হোসেন বললেন, আমি তো কিছু লক্ষ করছি না।কী আশ্চর্য! শুভ্রর চোখের নিচে কালি পড়েছে, তুমি দেখছ না? এই বদকাক যেন না আসে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।শেষপর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। কাকটা প্ৰায় এক বৎসর রোজ এসে হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করল।এখন শুভ্রর বয়স চব্বিশ। প্রায় বার-তের বছর আগের ব্যাপার, অথচ শুভ্রর মনে হয়- তার বয়স বাড়ে নি। সময় আটকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিংকর এসে জানালায় বসে গম্ভীর গলায় দুবার কা কা করেই চুপ করে যাবে। এই কাকটা মাত্র দুবার ডাকে, তারপর আর ডাকে না।
শুভ্রর ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। সে বিছানায় শুয়ে আছে। সময় কত হয়েছে সে ধরতে পারছে না। আষাঢ় মাস। সূর্য মেঘে ঢাকা পড়ে আছে। খাটের নকশা করা পায়াতে আলো এসে পড়ে নি। সময়টা জানার জন্যে সে নিজের ভেতর এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করছে। যেন তাকে আজ কোনো কাজে যেতে হবে। খুবই জরুরি কোনো কাজ। অথচ তার কোনো কােজ নেই। শুভ্র দিনের প্রথম চায়ের জন্যে অপেক্ষা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকিনা নামের এই বাড়ির কাজের মেয়েটা চা নিয়ে আসবে। শুভ্রর ঘুম ভাঙলেই এই মেয়ে কীভাবে যেন টের পায়। চায়ের কাপ হাতে জানালার বাইরে এসে ক্ষীণ গলায় বলে— ভাইজান, চা এনেছি। শুভ্ৰ যে জেগেছে মেয়েটা টের পায় কী করে? কোনো একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। সেই কোনো একদিন যে আজই হতে হবে তা-না।ভাইজান, চা এনেছি।
শুভ্ৰ কিছু বলল না। বিছানায় উঠে বসল। সকিনা ঘরে ঢুকল। শুভ্রকে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতে হলো না। তার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে।চায়ের কাপ হাতে দিয়েই সকিনা চলে যায় না, কাপে চুমুক না দেয়া পর্যন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্রর ধারণা চায়ের কাপে চুমুক দিতে সে যদি পনের মিনিট দেরি করে তাহলে এই মেয়েটা পনের মিনিট মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোনো একদিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে দশ পনেরো মিনিট বসে থাকবে। দেখার জন্যে মেয়েটা সত্যি দাঁড়িয়ে থাকে কি-না। আজই যে করতে হবে তার কোনো মানে নেই। Some other day.
শুভ্ৰ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিছানা থেকে নামল। এখন তার কাজ কম্পিউটার চালু করে কয়েক লাইন লেখা। এই অভ্যাস আগে ছিল না, নতুন হয়েছে। মানুষ যে-কোনো অভ্যাসে দ্রুত অভ্যস্থ হয়ে যায়।শুভ্র কী-বোর্ডে অতি দ্রুত হাত চালাচ্ছে। স্ক্রিনে লেখা উঠছে, এই সঙ্গে একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে। সাউন্ডবক্স থেকে পিয়ানো বাজানোর মতো শব্দ হচ্ছে। এটা শুভ্রর নতুন কর্মকাণ্ড। সে একটা সফটওয়্যার তৈরি করেছে। প্রতিটি অক্ষরের জন্যে পিয়ানোর একটা রিডের শব্দ। ব্যাপারটা এরকম যেন শব্দ শুনে সে বলে দিতে পারে কী লেখা হচ্ছে।
সে লিখছে—
আজ আকাশ মেঘলা। কয়েক দিন থেকেই আকাশ মেঘলা যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। আজ হবে কি-না কে জানে। রাতে আমি একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে আমি একটা ক্লাসরুমে বক্তৃতা দিচ্ছি। আমার হাতে চক। পেছনে বিশাল ব্লাকবোর্ড। ব্লাকবোর্ডের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত জটিল একটা সমীকরণ লেখা। কী সমীকরণ তা এখন মনে পড়ছে। না। তবে আমার ধারণা টাইম ডিপেনডেন্ট শ্রোডিঞ্জার ইকোয়েশন। স্বপ্নটা মজার এই জন্যে যে ক্লাসে কোনো ছাত্র নেই। প্রতিটি চেয়ার খালি। অথচ আমি বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্নটা আরেকটা কারণে মজার, সেটা হচ্ছে স্বপ্ন ছিল রঙিন।
বইপত্রে পড়েছি স্বপ্ন সাদাকালো। অথচ আমার বেশিরভাগ স্বপ্নই রঙিন। কাল রাতের স্বপ্ন যে রঙিন ছিল এতে আমার মনে কোনোরকম সন্দেহ নেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে ক্লাসরুমের চেয়ারগুলি ছিল হলুদ রঙের। আমার গায়ে একটা সুয়েটার ছিল। সুয়েটারের রঙ লাল। আমার স্বপ্নগুলি রঙিন কেন এই বিষয়ে একজন স্বপ্নবিশারদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। স্বপ্ন বিষয়ে আমার খুব কৌতূহল আছে।
জন্মান্ধরা স্বপ্ন দেখে কি দেখে না। এই নিয়ে আমি খুব ভাবতাম। তারপর নিজেই ভেবে ভেবে বের করলাম তাদের স্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই। দৃশ্যমান জগতের কোনো স্মৃতি তাদের নেই। স্বপ্ন তারা কীভাবে দেখবে? অনেক পরে বইপত্র পড়ে জেনেছি। আমি যা ভেবেছি তাই ঠিক। জন্মান্ধরাও স্বপ্ন দেখে, তবে সেই স্বপ্ন শব্দের স্বপ্ন। তাদের স্বপ্লে কখনো ছবি থাকে না, থাকে শব্দ।এই পর্যন্ত লিখে শুভ্র থামল। যুক্তাক্ষরে পিয়ানোর যে শব্দ আসছে তা কানে লাগছে। সফটওয়্যারে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। যুক্তাক্ষর যাই হোক একটা মাত্র নোট বাজবে। এই নোটটির যুক্তাক্ষর ছাড়া অন্য ব্যবহার থাকবে না।শুভ্র আবার লিখতে শুরু করল—
স্বপ্ন ব্যাপারটা আমি খুব ভালোমতো জানতে চাই। কারণ আমি অতি দ্রুত অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। তখন আমার জগৎ হবে শুধুই শব্দময়। দৃশ্যমান জগৎ তখন দেখা দেবে স্বপ্নে। আমি যেহেতু জন্মান্ধ না, আমি অবশ্যই স্বপ্ন দেখব। আমার এখন উচিত চমৎকার সব দৃশ্য দেখে দেখে সেইসব স্মৃতি মাথায় ঢুকিয়ে রাখা।আমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। অপটিক নাৰ্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো ডাক্তারই সেটা বন্ধ করতে পারছেন না।আমার বাবা অতি ক্ষমতাধর মানুষদের একজন। তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি। চেষ্টায় কাজ হচ্ছে না। আমার শেষ চিকিৎসা করলেন একজন জার্মান ডাক্তার। তার নাম বার্নড ব্রোসার্ড। তিনি জার্মান ভাষায় যা বললেন তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে— যুবক, আমি দুঃখিত। আমরা অগ্রসরমান বিপদ রোধ করতে পারছি না। ঘটনা ঘটবেই।
আমি বললাম, কখন ঘটবে? ভদ্ৰলোক বললেন, সেটা বলতে পারছি না। সেটা কালও ৩৫৩ পারে; আবার এক বছর, পাঁচ বছর, দশ বছরও লাগতে পারে।আমি বললাম, বাহ ইন্টারেস্টিং তো!ডাক্তার সাহেব বললেন, ইন্টারেস্টিং কোন অর্থে? আমি বললাম, প্রতিদিন ঘুম ভাঙার সময় আমি প্রবল এক উত্তেজনা অনুভব করব। চোখ মেলার পর কী হবে? আমি কি দেখতে পাব? না-কি দেখতে পাব না? আমার জন্যে প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। সেই অর্থে ইন্টারেস্টিং।
শুভ্র কম্পিউটার ছেড়ে চেয়ারে এসে বসল। ঘরের আলো আরো কমে এসেছে। মনে হয় আকাশ ভর্তি হয়ে গেছে। কালো মেঘে। আষাঢ় মাসের এই আকাশটা দেখে রাখা উচিত। স্বপ্ন দেখার সময় কাজে লাগবে। সমস্যা হচ্ছে ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছা করছে না। অন্য আরেকদিন দেখা যাবে। Some other day. জাহানারা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র এরকম করছে কেন? কেমন কুজো হয়ে চেয়ারে বসে আছে। তার হাতে বই। বই পড়তে পড়তে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে। মাদ্রাসার তালেবুল এলেমরা কোরান শরীফ পড়ার সময় এইভাবে মাথা দোলায়। শুভ্ৰ নিশ্চয় কোরান শরীফ পড়ছে না।
জাহানারার ইচ্ছা করছে ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন— এই তুই এরকম করছিস কেন? তিনি অনেক কষ্টে ইচ্ছাটা চাপা দিলেন। গতকাল রাতে শোবার সময় জাহানারা ঠিক করেছেন। আগামী বাহাত্তর ঘণ্টা তিনি ছেলের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। মাতা-পুত্রের অভিমান জাতীয় কোনো ব্যাপার না। জাহানারা ছোট্ট একটা পরীক্ষা করছেন। তিনি দেখতে চান তার কথা বলা বন্ধ করে দেয়াটা শুভ্র ধরতে পারছে কি-না। ধরতে অবশ্যই পারবে, কিন্তু কত ঘণ্টা পরে পারবে সেটাই জাহানারার পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে মাত্র সাড়ে এগারো ঘণ্টা পার হয়েছে। এখনো শুভ্ৰ কিছু বুঝতে পারছে না।
জাহানারা আরো কিছুক্ষণ শুভ্রর ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। শুভ্র তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কারণ সে বসেছে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে। বসার ভঙ্গি কুৎসিত। প্রাইমারি স্কুলের বুড়ো হেডমাস্টার সাহেবদের মতো চেয়ারে পা তুলে বসেছে। তার গায়ের পাঞ্জাবিটা কুচকানো। তার মানে রাতে যে পাঞ্জাবি পরা ছিল এখনো সেই বাসি পাঞ্জাবি গায়ে আছে। কোনো মানো হয়? আজও সে শেভ করতে ভুলে গেছে। তিনি স্পষ্ট দেখেছেন গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। জাহানারা চিন্তিত ভঙ্গিতে দক্ষিণের বারান্দার দিকে রওনা হলেন।
দক্ষিণের চিক দিয়ে ঢাকা বড় বারান্দাটা শুভ্রর বাব। মোতাহার হোসেনের পত্রিকা পড়ার জায়গা। এখানে বড় একটা বেতের ইজিচেয়ার আছে। প্রতিদিন ভোরবেলায় ইজিচেয়ারের বা-দিকের হাতলে চারটি খবরের কাগজ রাখা হয়। ডান-দিকের হাতলের পাশের ছোট্ট টেবিলে থাকে মাঝারি আকৃতির একটা টিপট ভর্তি চা, এক প্যাকেট সিগারেট এবং লাইটার। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তিনি পর পর কয়েক কাপ চা খান। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। সারাদিনে তিনি চা সিগারেট কোনোটাই খান না। শুধু রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে ইজিচেয়ারে এসে বসেন। দিনের শেষ সিগারেট এবং শেষ চা খেয়ে ঘুমুতে যান। শুভ্ৰ এই জায়গাটার নাম দিয়েছে- ধোয়াঘর।
মোতাহার হোসেন বেঁটেখাটো শুকনা ধরনের মানুষ। তার চেহারাটা রাগী রাগী হলেও কারো উপর কখনো রাগ করেছেন বলে শোনা যায় না। ব্যাংকে এই ভদ্রলোকের নগদ অর্থ আছে পাঁচশ এগারো কোটি টাকা। আমেরিকার চেস ম্যানহাটন ব্যাংকেও তার প্রচুর অর্থ জমা আছে। সঠিক হিসাব তার নিজের কাছেও নেই। অতি বিত্তবানদের নানান বদনেশা এবং বদখেয়াল থাকে। এই ভদ্রলোকের সেইসব কিছু নেই। তিনি তার সমস্ত শক্তি, মেধা এবং কল্পনা অর্থ উপার্জনেই ব্যয় করছেন। ইলেকশানের সময় তিনি বিএনপি, আওয়ামী লীগ দুদলকেই এক কোটি টাকা চাঁদা দেন। দুই দলই তাকে নমিনেশন নেওয়ার জন্যে বুলবুলি করে। তিনি দুদলকেই বলেন- আরে ভাই, আমি শুটকি মাছের ব্যবসায়ী। আমি ইলেকশন কী করব! মোতাহার হোসেনের অনেক ধরনের ব্যবসা থাকলেও শুটকি মাছের কোনো ব্যবসা নেই। তারপরেও এই কথা কেন বলেন তিনিই জানেন।
জাহানারা যখন স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন তখন মোতাহার হোসেনের হাতে তৃতীয় চায়ের কাপ। তিন নম্বর সিগারেট সবে ধরিয়েছেন। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, Hello young lady! জাহানারা বললেন, রাখ তোমার young lady! শুভ্র কী করছে জানো? মোতাহার হোসেন বললেন, ভয়ঙ্কর কিছু কি করেছে?মাথা দোলাতে দোলাতে বই পড়ছে।খুব বেশি কি দোলাচ্ছে?
জাহানারা বললেন, তুমি ঠাট্টার গলায় কথা বলছি কেন? তোমার ঠাট্টার এই ভঙ্গি আমার একেবারেই পছন্দ না।মোতাহার হোসেন বললেন, অতি তুচ্ছ বিষয়ে তুমি যে টেনশান কর সেটা দেখলে ঠাট্টা ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথায় আসে না।একটা জোয়ান ছেলে পেণ্ডুলামের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে বই পড়ছে, এটা তুচ্ছ বিষয়? অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়। সে যদি পা উপরে দিয়ে মাথা নিচে রেখে শীর্ষসনের ভঙ্গিতে বই পড়ত তাহলে সামান্য টেনশান করা যেত।সামান্য?
হ্যাঁ সামান্য। শুভ্রর বয়সী ছেলেদের হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভট কিছু করতে ইচ্ছা করে। সেটাই স্বাভাবিক।তুমি তো শুভ্রর বয়সী এক সময় ছিলে। তুমি উদ্ভট কিছু করেছ? মোতাহার হোসেন আগ্রহ নিয়ে বললেন, অবশ্যই করেছি। শুনতে চাও? সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে আমরা তিন বন্ধু বটগাছে বসে ছিলাম। বটগাছটা ছিল ডিসট্রিক্ট বোর্ড সড়কের পাশে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল…।জাহানারা বিরক্ত গলায় বললেন, প্লিজ, আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি ছেলের ঘরে যাও, ঘটনা কী জেনে আস।টেনশানটা যেহেতু তোমার, তুমি যাও।আমি যাব না। তুমি যাবে। সব কিছু জেনে আসবে। কী বই পড়ছে, মাথা দোলাতে দোলাতে কেন পড়ছে। তার ঘটনা। কী?এই দুটা পয়েন্ট জানলেই হবে?
আরেকটা পয়েন্ট আছে। শুভ্র দাড়ি শেভ করে নি। আমি পুরোপুরি দেখতে পারি নি, কিন্তু মনে হচ্ছে করে নি। কারণটা কী? জিজ্ঞেস করে জানবে।আমি কারণ বলে দিচ্ছি। শুভ্রর বয়েসী ছেলেরা চেহারা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসে। হুট করে দাড়ি রেখে ফেলা, গোঁফ রেখে ফেলা, মাথা কামিয়ে ন্যাড়া হওয়া কমন ব্যাপার।শুভ্ৰ কমন ছেলে না। অন্য দশজন ছেলে যা করবে তা সে করবে না। আমি নিশ্চিত ও কিছু মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।এত নিশ্চিত হচ্ছে কীভাবে? তার মধ্যে কোনো টেনশান দেখছ? কোনো টেনশন নেই। এই যে আমি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি সে বুঝতেও পারছে না।মোতাহার হোসেন অবাক হয়ে বললেন, তুমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছ? জাহানারা বললেন, হ্যাঁ।কারণটা কী?
আমি দেখতে চাচ্ছি। শুভ্র ব্যাপারটা বুঝতে পারে কি-না। আমার অভাব অনুভব করে কি-না। তোমার সঙ্গে এত বকবক করতে পারব না। তোমাকে যা করতে বলছি দয়া করে করে।ঠিক আছে। আরেক কাপ চা খেয়ে নেই। চা-টা ভালো হয়েছে।পরে এসে চা খাও। চা পালিয়ে যাচ্ছে না।তোমার ছেলেও পালিয়ে যাচ্ছে না। আশা করা যাচ্ছে সে মাথা দোলাতেই থাকবে।প্লিজ, শুভ্রকে নিয়ে রসিকতা করবে না।মোতাহার হোসেন কাপে চা ঢাললেন। সিগারেট ধরালেন। জাহানারার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। জাহানারা অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন বলে এই হাসি দেখতে পেলেন না। জাহানারা বললেন, তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ? সিগারেট-চা হাতে নিয়েই যাচ্ছি।অবশ্যই না। তুমি আমার ছেলের ঘরে সিগারেট নিয়ে ঢুকবে না। Passive smoking অনেক বেশি ক্ষতি করে। সিগারেট শেষ করে যাও।
মোতাহার হোসেন সিগারেটে একটা টান দিয়ে চায়ের কাপে ফেলে দিলেন। কাপের পাশেই অ্যাসট্রে আছে। অ্যাসট্রেতে ফেললেন না। কাজটা করলেন স্ত্রীকে বিরক্ত করার জন্যে। স্ত্রীকে বিরক্ত করতে তার ভালো লাগে। কিন্তু আজ জাহানারা ব্যাপারটা লক্ষ্য করল না। তার মাথায় অন্য কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে।শুভ্রর ঘরে ঢুকে মোতাহার হোসেন বললেন, Hello young man! শুভ্র বাবার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, Hello old man and the Sea! মোতাহার হোসেন বললেন, তোর কাছে তিনটা বিষয় জানতে এসেছি। ঝটপট জবাব দে। নাম্বার ওয়ান— কী বই পড়ছিস?
ম্যাজিকের একটা বই পড়ছি— Amazing Magic Book। অনেক ম্যাজিক শিখে ফেলেছি।খুবই ভালো। একদিন ম্যাজিক দেখব। পয়েন্ট নাম্বার টু- ম্যাজিকের বই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছিস কেন? মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছি না-কি? Yes my son. তোর মার কাছে শুনলাম, তুই মোটামুটি পেণ্ডুলাম হয়ে গেছিস।ও আচ্ছা, বুঝতে পারছি। বইটা পড়ার সময় মাথার ভেতর একটা গান বাজছিল। মনে হয়। গানের তালে তালে মাথা নাড়ছিলাম।কী গান? কিং স্টোন ট্রায়োর গান–Where have all the flowers gone. পয়েন্ট নাম্বার থ্রি- দাড়ি শেভ করছিস না কেন?
শুভ্ৰ হাসল। মোতাহার হোসেন বললেন, দাড়ি রাখবি ঠিক করেছিস? আমার ধারণা দাড়িতে তোকে ইন্টারেস্টিং লাগবে। আরেকটু বড় না হলে অবশ্য বোঝা যাবে না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি কিছুদিন দাড়ি রেখেছিলাম। তখন আমার নাম হয়ে গেল ছাগল মোতাহার। শুধু থুতনিতে কিছু, এই জন্যেই ছাগল মোতাহার নাম।শুভ্র বলল, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।মোতাহার হোসেন বসতে বসতে বললেন, দেখি কী ম্যাজিক শিখেছিস। একটা ম্যাজিক দেখা।আমি শুধু কৌশলগুলো শিখছি, দেখাতে পারব না। জিনিসপত্র নেই।জিনিসপত্র ছাড়া ম্যাজিক হয় না?
শুভ্র বলল, একটা ম্যাজিক অবশ্য জিনিসপত্র ছাড়াই পারব। তোমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।মোতাহার হোসেন বললেন, বাইরে যেতে পারব না। আমি বরং চোখ বন্ধ করে থাকি, তুই গুছিয়ে নে।তিনি চোখ বন্ধ করলেন। ছেলের সামনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে তার ভালো লাগছে। শুভ্র তেমন কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। তারপরও তিনি ঠিক করলেন শুভ্ৰ যাই দেখাক তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হবার ভান করবেন। যদিও বিস্মিত হবার ভান করাটা বেশ কঠিন হবে বলেই তার ধারণা। সবচে সহজ হলো রেগে যাবার ভান করা। ভুরু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে শুধু তাকানো।
বাবা, চোখ খোল।মোতাহার হোসেন চোখ মেললেন। শুভ্র বলল, দেখ এই কাগজটায় দশটা ফুলের নাম লিখেছি। এখান থেকে যে-কোনো একটা ফুলের নাম বলো।মোতাহার হোসেন বললেন, টগর।শুভ্র বলল, তুমি যে টগর ফুলের নাম বলবে এটা আমি জানতাম। বলতে পার এক ধরনের মাইন্ড রিডিং। টেলিপ্যাথি। তোমার সামনে যে মগটা আছে সেটা তুলে দেখ, মগের নিচে একটা কাগজে আমি টগর লিখে রেখেছি।মোতাহার হোসেন মগ তুলে দেখলেন সত্যি সত্যি লেখা টগর। তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। শুভ্ৰ মিটি মিটি হাসছে। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! কীভাবে করলি? শুভ্র বলল, সেটা তোমাকে আমি বলব না।বলবি না কেন?
শুভ্র বলল, এই ম্যাজিকের কৌশলটা এতই সহজ যে বললেই তোমার বিস্ময় পুরো নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি যে একটু আগে বিস্মিত হচ্ছিলে সেটা ভেবেই বিরক্ত হবে। তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি তুমি খুবই অবাক হয়েছ। এই অবাক ব্যাপারটা আমি নষ্ট করতে চাই না।তোর ফুলের ম্যাজিকটা কি ইচ্ছা করলে আমি শিখতে পারব?
অবশ্যই পারবে। তবে আমি শেখাব না।শুভ্র বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার চোখ ঝিলমিল করছে।মোতাহার হোসেনের ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছা হচ্ছে। প্লিজ বাবা, আমাকে শিখিয়ে দে জাতীয় কথা বলতে মন চাইছে। ছেলের সঙ্গে কিছু ছেলেমানুষী নিশ্চয়ই করা যায়।শুভ্র বলল, আজ তুমি অফিসে যাবে না? মোতাহার হোসেন বললেন, এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হয় যাব না।সারাদিন কী করবে?
তাও ঠিক করি নি। কোনো কাজ না করাটা সবচে কঠিন কাজ। মনে হচ্ছে কঠিন কাজটাই করতে হবে।মোতাহার হোসেন উঠে দাঁড়ালেন। তার হাতে শুভ্রর লেখা টগর কাগজটার চিরকুট। এই চিরকুট তিনি কেন সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেও জানেন না। তিনি অফিসে যাবেন না- এই কথাটা শুভ্রকে কেন বললেন তাও বুঝতে পারছেন না। তার শরীর মোটামুটি সুস্থ আছে অথচ তিনি অফিসে যান নি এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি।শুভ্র বলল, টগর নামটা যে রবীন্দ্রনাথের খুব অপছন্দের নাম এটা কি তুমি জানো? মোতাহার হোসেন বললেন, না।