হা হয়েছি। স্ত্রীরা স্বামীদের স্বাধীনতায় হাত দিতে পছন্দ করে। শুধু শুধু নানা বায়নাক্কা মদ খেতে পারবে না, রাত জেগে পড়তে পারবে না, জুয়া খেলতে পারবে না— আরে কী মুশকিল, আমার সব কথায় কথা বল কেন ? আমি কি তােমার কোনাে ব্যাপারে মাথা গলাই ? আমি কি বলি নীল শাড়ি পরতে পারবে না, লাল শাড়ি পরতে হবে। হাইহিল পরতে পারবে না, ফ্ল্যাট স্যাণ্ডেল পরবে। বলি কখনাে ? না, বলি না। আমি ওদেরকে ওদের মতাে থাকতে বলি। আমি নিজে থাকতে চাই আমার মতাে। ওরা তা দেবে না।
‘এই যে এখন একা একা বাস করছেন, আপনি কি মনে করেন আপনি সুখী? ‘হা সুখী, মাঝে মাঝে একটু দুঃখ-দুঃখ ভাব চলে আসে, তখন মদ্যপান করি । প্রচুর পরিমাণেই করি। পুরােপুরি মাতাল হতে চেষ্টা করি । পারি না। শরীর যখন আর অ্যালকোহল অ্যাকসেপ্ট করতে পারে না তখন বমি করে ফেলে দেয় কিন্তু মাতাল হতে দেয় না। কেন দেয় না তারও একটা কারণ আছে।
কী কারণ? ‘বলব, আরেকদিন বলব। এখন বলেন কী খাবেন ? আজকের আবহাওয়াটা ব্লাডি মেরির জন্যে খুব আইডিয়াল । দেব একটা ব্লাডি মেরি বানিয়ে ? জিনিসটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালাে। প্রচুর টমেটোর রস দেয়া হয়।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার ভালােই খাতির হলাে। মাসে দুএকবার তার কাছে যাই। বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে কথা হয়। যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব, অ্যান্টিম্যাটার, লাইফ আফটার ডেথ । ভদ্রলােকের নাস্তিকতা দেখার মতাে, যা বলবেন— বলবেন। কোথাও সংশয়ের কিছু রাখবেন না। আমার মতাে আরাে অনেকেই আসে। তবে তাদের মূল আগ্রহ জলযাত্রায়।
একবার আমাদের আড্ডায় এক ভদ্রলােক একটি ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম— শ্রাবণ মাসে একবার তিনি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। বাড়ি স্টেশন থেকে অনেকখানি দূর। সন্ধ্যাবেলা ট্রেন এসে পৌছার কথা । পেঁৗছতে পৌছতে রাত নটা বেজে গেল। গ্রামদেশে রাত নটা মানে নিশুতি রাত। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। স্টেশনে একটাও লােক নেই ।
একা একাই রওনা হলাম। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ দেখি আমার আগে-আগে কে যেন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কাউকে দেখিনি। এখন এই সাইকেলে করে কে যাচ্ছে ? আমি বললাম কে কে কে ? কেউ জবাব দিল । লােকটা একবার শুধু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চিনলাম। যে সাইকেলে বসে আছে তার নাম পরমেশ। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি । বছর তিনেক আগে নিউমােনিয়া হয়ে মারা যায়…
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
গল্পের এই পর্যায়ে মােতালেব সাহেব বাজখাই গলায় বললেন স্টপ । আপনি বলতে চাচ্ছেন – আপনার এক মৃত বন্ধু সাইকেল চালিয়ে আপনার পাশে পাশে যাচ্ছিল ?
‘হ্যা।।
‘মনে হচ্ছে আপনাকে সাহস দেবার জন্যেই সে আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল।
হতে পারে।’
মােতালেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তর্কের খাতিরে স্বীকার করে নিলাম যে, আপনার বন্ধু মরে ভূত হয়েছেন। আপনাকে সাহস দেবার জন্যে আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন। এখন সমস্যা হলাে— সাইকেল। একটা সাইকেল মরে ‘সাইকেল-ভূত হবে না, যদি না হয় তা হলে আপনার ভূত-বন্ধু সাইকেল পেল কোথায় ?
যিনি গল্প করছিলেন তিনি থমকে গেলেন। মােতালেব সাহেব বললেন, স্বীকার করলাম অবশ্যই তর্কের খাতিরে যে মানুষ মরে ভূত হতে পারে, তাই বলে কাপড় মরে তাে কাপড়-ভূত’ হবে না। আমরা যদি ভূত দেখি তাদের ল্যাংটা দেখা উচিত। ওরা কাপড় পায় কোথায় ? সবসময় দেখা যায় ভূত একটা সাদা কাপড় পরে থাকে। এর মানে কী ?
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ঘাের নাস্তিক, প্রচণ্ড যুক্তিবাদী মানুষের কাছ থেকে আমি অবিশ্বাস্য একটি গল্প শুনি। যেভাবে গল্পটি শুনেছিলাম অবিকল সেইভাবে বলছি। গল্পের শেষে মােতালেব সাহেব কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অপ্রয়ােজনীয় বিধায় সেই ব্যাখ্যা আমি দিচ্ছি না। বৈশাখ মাসের এক ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় মােতালেব সাহেব গল্প শুরু করলেন। | ‘এই যে ভাই লেখক, ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা শুনবেন ? একটা কন্ডিশনে ঘটনাটা বলতে পারি । চুপ করে শুনে যাবেন। কোনাে প্রশ্ন করতে পারবেন না। এবং ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারবেন না।’
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
‘বিশ্বাস করলে অসুবিধা কী ?
‘অসুবিধা আছে। আমার মাধ্যমে কোনাে অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার প্রচার পাবে তা হয় না। তা হতে দেয়া যায় না। আপনি যদি ধরে নেন এখন যা শুনছেন তা একটা গল্প, মজার গল্প, তা হলেই আপনাকে বলতে পারি।’
‘এই গল্পটি কোথাও ব্যবহার করতে পারি ?
‘পারেন। কারণ গল্প-উপন্যাসকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। সবাই ধরে নেয় এগুলি বানানাে ব্যাপার।
তা হলে বলুন শুনি।’
ভদ্রলােক পরপর চার পেগ মদ্যপান করলেন। তার মদ্যপানের ভঙ্গিও অদ্ভুত । অষুধের মেজারিং গ্রাস ভরতি করে হুইসকি নেন। এক ফোঁটাও পানি মেশান না। ঢক করে পুরােটা মুখে ফেলে দেন কিন্তু গিলে ফেলেন । কুলকুচা করার মতাে শব্দ হয়। তারপর একসময় ঘোত করে গিলে ফেলে বলেন– কেন যে মানুষ এইসব ছাইপাশ খায়! বলেই আবার খানিকটা নেন। যা-ই হােক, ভদ্রলােকের জবানিতে মূল গল্পে যাচ্ছি
তখন আমার বয়স চব্বিশ, এম.এ. পাস করেছি। ধারণা ছিল খুব ভালাে রেজাল্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার হিসেবে এন্ট্রি পেয়ে যাব। তা হয়নি। এম.এ.-র রেজাল্ট খুবই খারাপ হলাে । কেন হলাে তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। পরীক্ষা ভালাে দিয়েছি। একটা গুজব শুনতে পাচ্ছি। জনৈক অধ্যাপক রাগ করে আমাকে খুবই কম নম্বর দিয়েছেন। এই গুজব অমূলক নাও হতে পারে। অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালাে না । দুএকজন আমাকে বেশ পছন্দ করেন, আবার কেউ-কেউ আছেন আমার ছায়াও সহ্য করতে পারেন না।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
যা বলছিলাম, রেজাল্টের পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা খুব রাগারাগি করলেন। হিন্দি ভাষায় বললেন নিকালাে। আভি নিকালাে ।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, চলে যাচ্ছি। হিন্দি বলার দরকার নেই।
এই বলেই সুটকেস গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম । আমি খুবই সচ্ছল পরিবারের ছেলে। কাজেই খালিহাতে ঘর থেকে বের হলাম না। বেশকিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। কোথায় যাচ্ছি কাউকে বলে গেলাম না। সঙ্গে একগাদা বই, বিশাল একটা খাতা। এক ডজন বলপয়েন্ট। সেই সময় আমার লেখালেখির বাতিক ছিল। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস শুরু করেছিলাম, যে-উপন্যাসে মূল ডিটেকটিভ খুন করে । ইন্টারেস্টিং গল্প ।
যা-ই হােক, বাড়ি থেকে বের হয়েও খুব একটা দূরে গেলাম না। একটা হােটেলে ঘর ভাড়া করে রইলাম। দেখি সেখানে কাজ করার খুব অসুবিধা— সারাক্ষণ হইচই। কিছু-কিছু কামরায় রাতদুপুরে মদ খেয়ে মাতলামিও করে। মেয়েছেলে নিয়ে আসে।