ডায়াবেটিস কি ? ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়

diabetes

বর্তমানে আমাদের সবার কাছে পরিচিত এক শব্দ হলো ডায়াবেটিস । ডায়াবেটিসের রোগী নেই এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস একটি মহামারী রোগ । 

ডায়াবেটিস কি  ?

ডায়াবেটিস কী এমন প্রশ্নের জবাবে আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সরে না। কিন্তুু এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় । ডায়াবেটিস মেলাইটাস একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা ।

যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন মানুষের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে । হিসাব অণুযায়ী প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৬ জন ই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত । আমরা যখন কার্বোহাইড্রেট বা সাধারণ শর্করাজাতীয় খাবার যেমন, ভাত, আলু, পাউরুটি, চাপাটি, মিষ্টি আলু কাঁচাকলা, চিনি ও অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় খাবার খাই তখন তা ভেঙ্গে গ্লুকোজ পরিণত হয় ।

ডায়াবেটিসের পিছনে মূল ফ্যাক্ট হচ্ছে, শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে না পারা । ইনসুলিন হলো একটি হরমোন, যেটি মানবদেহের অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহান্টসের বিটা কোষ থেকে নিঃসৃত হয় । এর কাজ হলো গ্লুকোজকে , মানুষের দেহের কোষগুলোয় পৌঁছে দেওয়া । শরীরের কোষগুলো এই গ্লুকোজ ব্যবহার করে শক্তি উওপাদন করে । 

মানুষের শরীরের কোষে যখন গ্লুকোজ পৌঁছায় না তখন স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয় । যখন কারও ডায়াবেটিস হয় তখন ঐ মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায় । তখন কোষে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারেনা । ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় । সাধারণত প্রশ্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায় ।

এজন্য ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রস্রার হয় । তৃষ্ণা বেশি লাগে । প্রচুর গ্লুকোজ বের হয়ে যায় বলে রোগী দূর্বল হয়ে পড়েন । ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহন না করলে, রক্তনালি, স্নায়ু, কিডনি, চোখ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ নান ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় । 

ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহঃ 

ডায়াবেটিসের সাধারণ কতগুলো লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখে সহজেই চিহিৃত করা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে কিনা । লক্ষণগুলো হলোঃ

১. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া 

২. তৃষ্ণা বেশি লাগা 

৩. ঘন ঘন খিদে লাগা  

৪. প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করা

৫. বিশেষত রাতে টয়লেটে  বেশি যাওয়া 

৬. জননাঙ্গে চুলকানি 

৭. চোখে ঝাপসা দেখা 

৮. খাওয়া সত্ত্বেও  ওজন কমে যাওয়া 

৯. শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া বা ক্ষত সহজে না সাড়া । 

১০. হাত-পায়ে ব্যাথা বা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাওয়া । 

১১. প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া । 

ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ 

ডায়াবেটিস মূলত দুই ধরনের । 

১. টাইপ- 1

২. টাইপ- 2

টাইপ-1ঃ শরীর কোন ইনসুলিন উৎপাদন না করতে পারলে টাইপ-1 ডায়াবেটিস দেখা দেয় । যখন অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায় তখন এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা দেয় । টাইপ-1 ডায়াবেটিস অনেকসময় বংশ পরস্পরায় চলে, যা জিনগত প্রভাবের ইঙ্গিত করে । টাইপ-1 ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত অল্পবয়স্ক মানুষ যেমন ৪০ বছরের আগে দেখা যায় । ইনসুলিন ইনজেকশন, খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে এর চিকিৎসা নেয়া যায় । 

টাইপ-2ঃ ডায়াবেটিস থাকা প্রতি দশজনের নয় জন ব্যাক্তির টাইপ-2 ডায়াবেটিস আছে । এই ধরনের ডায়াবেটিসকে ‘‘পরিপক্কতার সূচনার’’ ডায়াবেটিস বলা হতো । মধ্যবয়সী বা বয়স্ক মানুষের মধ্য এ ধরনের ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায় । বর্তমান সময়ে অল্পবয়সী ব্যাক্তিদের মধ্যেও এ ধরনের ডায়াবেটিস বিস্তার লাভ করছে । টাইপ-2 ধরনের ডায়াবেটিস হলে শরীর তখনও কিছুটা ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে । কিন্তু তার পরিমান যথেষ্ট হয় না বা ইনসুলিন যথাযথভাবে কাজ করতে পারেনা । যাদের ওজন খুব বেশি তাদের টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায় । দক্ষিন এশীয়, আফ্রিকান ক্যারিবিয়ান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সাধারণত বেশি দেখা যায় । এর ধারা বংশগতভাবে চলতে থাকে । সেখানে সাধারণত ২৫ বছরের বেশি বয়সের মধ্যেই টাইপ-2 ডায়াবেটিস দেখা যায় । খাদ্যাভ্যাস , শরীরচর্চা, ট্যাবলেট, ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে টাইপ-2 ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়।  

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়ঃ

১. শস্য দানাঃ  প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শস্য দানা রাখা উচিত। কেননা শস্য দানা মানুষের শরীরের রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্তনে রাখে । ফলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে । এক্ষেত্রে ব্রাউন রাইস কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । 

২. গ্রিন-টিঃ  ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গ্রিন-টি ইনসুলিন মত কাজ করে । তাই ভালো মানের গ্রিন টি বেছে নেওয়া উচিত । 

৩. বাদামঃ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ২১ শত্যাংশ কমায় চীনাবাদাম , গবেষনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে । খাদ্য তালিকায় তাই আখরোট বা কাজুবাদাম রাখা দরকার । নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে ।

 ৪. লেবুঃ  লেবু ও লেবু জাতীয় ফল ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে । ভিটামিন ‘‘সি’’ এর অভাবে ডায়াবেটিসর ঝুঁকি রয়েছে । ভিটামিন সি এর অভাব পূরণে লেবু, কমলা, জাম্বুরা, মৌসম্বি খাওয়া যেতে পারে । এগুলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ইনসুলিনের মত কাজ করে । 

৫. সবুজ শাক সবজিঃ সবুজ শাক সবজি যেমন, পালংশাক, বাঁধাকপি, শালগম, ফুলকপি, লেটুস পাতা ইত্যাদি খাবারে ক্যালরি এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম । এসব খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে । 

৬. ডিমঃ উচ্চ মানের প্রোটিন সম্মত পেশি গঠনকারী খাদ্য হলো ডিম । ডিমের সাদা অংশে উচ্চমানের চর্বিহীন প্রোটিন এবং কমমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট রয়েছে যা দুই ধরণের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে । 

৭. মাছঃ মাছে রয়েছে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড । যা ইনসুলিনের সংবেদনশীলতাকে উন্নত করতে সাহায্য করে । গ্লুকোজের ঘনত্ব কমিয়ে ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে । 

ডায়াবেটিসে একবার আক্রান্ত হলে, এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া মোটেও সহজ নয় । প্রথম প্রথম খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রনে রাখা যায় । 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে যা  করতে হবেঃ 

ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং জীবন যাপনের স্টাইলের উপর নির্ভরশীল তারপরও চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব । খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে । 

১. প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে । মসূন সাদা আটার  রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভূষিওয়ালা আটার রুটি । 

২. চিনি জাতীয় পানীয়, ফিজি ড্রিংকস, মিষ্টি, হোয়াইট পাস্তা , প্যষ্ট্রি ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে । 

৩. এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে কয়েক ঘন্টা বিরতি দিয়ে অল্প অল্প করে খাওয়া দরকার । 

৪. শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করতে হবে ।চিকিৎসকরা বলেন, সপ্তাহে আড়হি ঘন্টা ব্যায়াম করা দরকার । দ্রুত হেঁটে , সিড়ে বেয়ে উপরে ওঠে ব্যায়াম করা যেতে পারে । 

৫. ধূমপান পরিহার করাও জরুরি । কোলেস্টেরলে মাত্রা নিয়ন্ত্রনে না রাখলে হৃদ রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায় । 

৬. ডায়াবেটিসের ঔষধপত্র প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রত্যেকদিন যথাসময়ে গ্রহন করতে হবে ।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *