বােধহয় লােকটা ভূত–শুদ্ধসত্ত্ব বসু

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প

তখন আমি রেলে কাজ করি। দক্ষিণপূর্ব রেলের নাম তখন ছিল বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে, সংক্ষেপে যাকে বলা হতাে বি এন আর। আমাকে প্রায়ই লাইনে বেরতে হত, হিসাব তদারকির কাজে এ অফিস সে অফিস ছুটতে হতে, কখনো বা বড় বড় স্টেশনেও হাজির থাকতে হত। | রাত নেই, দিন নেই – খবর এলেই হলাে, হুট করে বেরিয়ে পড়াে, ট্রেন যদি সে সময় না থাকে মালগাড়ীর শেষে গার্ডের কামরায় চেপে চলাে, সে অধিকার আমাদের ছিল। 

ব্রাঞ্চ লাইনে প্যাসেঞ্জার গাড়ী কম, সেখানে লাইনের যে কোন চলন্ত গাড়ীতে সে শুধু খালি ইঞ্জিন হােক, বা মালগাড়ী কিম্বা ব্যালাস্ট ট্রেন হােক আমাদের তাতে ওঠার অনুমতি পত্র সঙ্গে থাকতাে। | এই রকমের কর্ম জীবনের কিছু বৈচিত্র্য আছে, বিবিধ ধরণের বিস্ময়কর ঘটনা চাকরির একঘেয়েমিতে ভারি মিষ্টি একটা প্রলেপ বুলিয়ে দিত। আমি এখানে তােমাদের কাছে আজ ছােট্ট একটা ঘটনার উল্লেখ করবাে। 

আমাকে যেতে হবে বিলাসপুরে, যাচ্ছি চক্রধর থেকে বােম্বে মেলে, হাওড়া থেকে যে বােষে মেল সন্ধ্যার দিকে ছাড়ে, সেটা চক্রধরপুরে যায় ~ ধরাে রাত বারটোর পর, মাঝে থামে শুধু খড়গপুর আর টাটানগরে। চক্রধরপুরে মিনিট দশেক দাঁড়িয়েই ফের ছুট দেয়, দাঁড়ায় গিয়ে একশাে কিলােমিটারের পর রাউরকেল্লা স্টেশনে। তারপর গােটা তিনেক স্টেশনে থেমে ভােরবেলা যায় বিলাসপুরে। 

বােধহয় লােকটা ভূত–শুদ্ধসত্ত্ব বসু

যখনকার কথা বলছি – তখন ছিল শীতকাল। জানুয়ারী মাসের গােড়ার দিকে ঐসব অঞ্চলে শীত পড়ে। মনে হচ্ছে সেই সালটা ছিল ১৯৪৩ ~~ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে ভারতের সর্বত্র সৈন্য চলাচলের শেষ হয়নি, লাইনে লাইনে প্যাসেঞ্জার গাড়ী কমিয়ে শুধু মিলিটারি স্পেশাল চালানাে হচ্ছে। হাওড়া থেকে নাগপুর পর্যন্ত যেতে তখন মাত্র দুটো গাড়ী, বােম্বে মেল আর নাগপুর প্যাসেঞ্জার। মেলেও যেমন ভিড় কারণ মেলের অর্ধেকটা মিলিটারির বড়বাবুদের জন্যে রিজার্ভ থাকতাে, আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনেও তেমনি ঠাসাঠাসি — তিলধারণের জায়গা থাকতাে না। সে একটা সময় গেছে বটে! ঐ রকম দুর্যোগের মধ্যেও অত ভিড় ঠেলেও পাড়ি জমাতে হতাে।

কথায় বলে না, চাকরী জিঙ্গিটা খুব সুখের নয়, মর্মে মর্মে তা অনুভব করতাম। | তবে আমাদের একটা সুবিধে ছিল, আমরা ট্রায়ালভ্যানে করে যাতায়াত করতে পারতাম। অবশ্য এটা বেআইনী ব্যাপার। কিন্তু ভিড়ের বেলায় আইনের প্রতি আনুগত্য অতখানি ছিল না। কারখানা থেকে রেলের বগি তৈরী হলেই যে তাতে লােক চড়ে বসতে পারবে এমন কোন কথা নেই। সেই বগিকে একটা একটা করে বড় বড় মেল বা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের পেছনে জুড়ে দেয় – এক নাগাড়ে তারা কেমন চলে তা দেখার জন্য।

চাকা থেকে আগুন লাগে কিনা তাও দেখতে হয়। ঐ কামরার দরজা থাকে তালা বন্ধ, জানলাগুলােও ভেতর থেকে আটকানাে, ইলেকট্রিক বা অন্য কোন রকম সংযােগ থাকে না মূল গাড়ীটার সঙ্গে। শুধু গার্ডের কামরার শেষে একটা বা দুটো বগি জুড়ে দেয় চার পাঁচশশা কিলােমিটার চলার জন্য। এইরকম বগিকে ট্রায়ালভ্যান বলে। বার দশেক এই পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তা যাত্রীদের বহন করার উপযুক্ত বলে গণ্য হতাে। 

বােধহয় লােকটা ভূত–শুদ্ধসত্ত্ব বসু

আমরা রেলের কর্মীরা ভিড়ের ট্রেনে না উঠে ট্রায়াল বগিতে ওঠার চেষ্টা করতাম। আগে থেকে স্টেশন মাষ্টারের কাছে থেকে খোঁজ নিয়ে জেনে নিতাম ঐ ট্রেনে কোন ট্রায়াল বগি জুড়ে দেওয়া হবে কিনা। 

যে রাতের কথা বলছি, সেটা একে শীতের রাত — তার ওপর যুদ্ধের সময়কার জরুরী অবস্থা। ফলে, বােম্বে মেলে যে উঠতে পারবাে চক্রধরপুর থেকে এমন নিশ্চয়তা নেই। গার্ডের গাড়িতেই হয়তাে যেতে হবে। মােটা ব্যাগ মুড়ি দিয়ে ছােট একটা হােন্ডল নিয়ে স্টেশনে এসে শুনি – বােম্বে মেল দু ঘন্টা লেট; অর্থাৎ রাত্রি দুটোর আগে আর আসছে না। শীতে হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত জমে যাচ্ছে। প্লাটফর্মে বসে থাকা বা স্টেশন মাষ্টারের ঘরে গিয়ে আড্ডা মারা চলে না। পাহাড়ে জায়গা চক্রধরপুর, ছােট্ট পাহাড়ে ঘেরা, তাই সাংঘাতিক ঠান্ডা। শীতের রাত যে কি রকম যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে তার ধারণা আমার এই প্রথম। 

স্টেশনে এসে শুনলাম এই বােম্বে মেলের সঙ্গে একটা ট্রায়াল বগি জুড়ে দেওয়া হবে। নতুন বগি, সবে লাইনে বেরিয়েছে, দুদিন হলাে খড়গপুরের রেল কারখানা থেকে ছাড়া পেয়ে চক্রধরপুর সাইডিংয়ে রয়েছে। ভাগ্য ভাল বলতে হবে। তাড়াতাড়ি একটা কুলিকে ডেকে নিয়ে সাইডিংয়ে গিয়ে ট্রায়াল বগিতে উঠলাম কষ্ট করে, স্টেশন মাষ্টারের কাছ থেকে রেল কামরার দরজার চাবি আনিয়ে দরজা খােলা হলাে। ছােট্ট একটা সিঁড়ির ব্যবস্থা করে বগিতে উঠে লম্বা একটা বেঞ্চে হােন্ডল খুলে বিছানা করে দিলাম। দরজা লক করে চাবিটা ফেরত দিলাম কুলির হাতে। শীতের মধ্যে চারিদিক বন্ধ সেই বগিতে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম, বােম্বে মেল এলে তার পেছনে সাটল ইঞ্জিন এই বগিটাকে টেনে নিয়ে জুড়ে দেবে – এই রকমই হয়।

বগিটা ছিল থার্ড ক্লাসের সাধারণ কামরা, লম্বা ধরণের, দুপাশে বেঞ্চ আর মাঝখানেও আর একসারি বেঞ্চ। গাড়ীটায় এখনাে তেল রঙের গন্ধ ঘােচেনি। আলাে নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীত আর অন্ধকার যেন একত্রে জমাট বেঁধেছে সেখানে। নিরালােক কয়লাখনিও এমন অন্ধকার নয়। এলার্ম চেনও নেই, আলােও নেই, দরজা-জানালা খােলা নেই। 

বােধহয় লােকটা ভূত–শুদ্ধসত্ত্ব বসু

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বলতে পারি না – যখন ঘুম ভাঙলাে, বুঝলাম বগিটা চলতে শুরু করেছে। খটাং খটাং আওয়াজ হচ্ছে, বােম্বে মেলের পেছনে বগিটাকে জোড়া হলাে, সাইল ইঞ্জিনটা খুলে চলেও গেল। নিশ্চিত হলাম সকালে বিলাসপুরে গিয়ে নামাও যাবে, অফিসের কাজ সারতে আর দেরী হবে না। 

চক্রধরপুর থেকে গাড়ীটা ছাড়তে না ছাড়তেই দেখি আমার সামনে বেঞ্চে আর একজন কে বসে ; আমার পা দুটো যেদিকে — সেদিকেই সে বসে রয়েছে। কিন্তু লােকটা উঠলাে কখন? 

আপাদমস্তক লম্বা গরম কোর্টে মােড়া, মাথায় টুপি, হাতে-পায়ে মােজা পরা হবে। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা, অন্ধকারেও তার বিশাল বপুটা মালুম হচ্ছে। আমি ভদ্রতার খাতিরে ঘুরে শুলাম, অর্থাৎ যেদিকে আমার পা দুটো ছিল, এবার সেদিকেই মাথা রাখলাম। আমার মতাে এই লােকটাও যে রেলকর্মী, সে-বিষয়ে সন্দেহ হলাে না, লাইনে কোন কাজে যাচ্ছে। রেলকর্মী ছাড়া এখানে আর উঠবে কে! যখন আমি ঘুমােচ্ছিলাম, তখন উঠে থাকবে।

এইসব ভাবতে ভাবতে ফের একটা ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। গাড়ী তখন চক্রধরপুর স্টেশন ছেড়ে বেশ জোরে চলতে শুরু করেছে। ঘন্টা দুয়েকের আগে আর কোথাও থামবে না। | লোকটা হঠাৎ ধরা গলায় আমাকে ইংরেজীতে যে প্রশ্ন করলাে তার বাংলা মানে হচ্ছে — আচ্ছা আপনি ভূত বিশ্বাস করেন? 

ভূত? 

হ্যা ভূত। ভূত বিশ্বাস করেন? হতচকিত হয়ে আমি জবাব দিই না, করি না। কিন্তু আমি করি। ~~~ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই লােকটা উঠে গেল কামরা থেকে, কিছুতেই তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। ট্রেন ছুটছে, দু’ঘন্টার আগে আর কোথাও দাঁড়াবে না, ট্রায়াল বগিতে আলাে নেই, এলার্ম চেন নেই। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *