‘তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ। তােমার কারখানায় কি কোন সমস্যা হচ্ছে ? মতিন সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মনে হল তিনি শুনতে পাননি। এষা বলল, তুমি তাে ঐ লােকটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে না।
‘কোন লােকটা?” ‘ঐ যে যাকে নিয়ে এসেছ। এ্যামনেশিয়া হয়েছে। ‘ওর কোন খবর আছে নাকি?”
না। দিব্যি খাচ্ছে–দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে সে সুখে আছে। ‘কারাে সঙ্গে কথাটথা বলে না?”
‘নিজ থেকে বলে না। কেউ কিছু বললে খুশী হয়ে জবাব দেয়। আজ দুপুরে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি সে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে মিতুর সঙ্গে লুডু খেলছে।”
‘তুই কি কথা বলেছিস?” | ‘না। কথা বলতাম। কিন্তু লােকটাকে আমার কেন জানি পাগল মনে হয়। চোখের দৃষ্টি যেন কেমন।
‘আরে দূর – চোখের দৃষ্টি ঠিকই আছে। লােকটা কিছু মনে করতে পারছে এই জন্যে তুই ভয় পাচ্ছিস। তাের কাছে মনে হচ্ছে লােকটা পাগল। তুই বরং লােকটার সঙ্গে কথা বল।
‘কথা বললে বুঝতে পারবি – তার ব্যাকগ্রাউণ্ড কি? কি ধরনের ফ্যামিলি থেকে এসেছে। পড়াশােনা কি। এতে লােকটাকে ট্রেস করতে সুবিধা হবে।
তুমি তো অনেক কথা বলেছ – তােমার কি মনে হয়? মতিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি খানিকটা কনফিউজড।
“সে কি?
মতিন সাহেব আরাে একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে লক্ষ্য করলেন, লােকটা হেঁটে হেঁটে কাঠাল গাছগুলির দিকে যাচ্ছে। মতিন সাহেব বললেন, লােকটার একটা নাম দরকার। এমিতে ডাকার জন্য একটা নাম। যতদিন আসল নাম পাওয়া না গেছে ততদিন এই নামে ডাকব।
‘নাম তাে বাবা দেয়া হয়েছে। ‘কি নাম?
নাম হচ্ছে জুলাই। ‘জুলাই ?”
‘হ্যা, জুলাই। মিতু নাম রেখেছে। এখন জুলাই মাস, কাজেই তার নাম জুলাই। যখন আগস্ট মাস আসবে তখন তার নাম হয়ে যাবে আগস্ট। মিতুর খুব ইচ্ছা – লােকটা যেন সারাজীবন এই বাড়িতে থাকে, যাতে সে প্রতিমাসে একবার করে নাম বদলাতে পারে।
এষা খিল খিল করে হেসে উঠল। মতিন সাহেব বললেন, আরেক কাপ চা আন তাে মা।
‘আরেক কাপ চা এনে দিচ্ছি – কিন্তু বাবা তুমি তােমার সিগারেটের প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে দাও। এরপর তােমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে — আমার কাছে চাইবে।
মতিন সাহেব সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে দিলেন।
এষা চা বানিয়ে এনে দেখে, তার বাবা ঘুমুচ্ছেন। তন্দ্রা নয় — বেশ ভাল ঘুম। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একজন মানুষের ঘুম । এষার তাকে জাগাতে ইচ্ছা করল না। সে চায়ের কাপ নিয়ে বাগানে নেমে গেল। জুলাই নামের লােকটাকে দিয়ে আসা যাক। তার সঙ্গে কথাও হয়নি। কিছুক্ষণ কথা বলা যেতে পারে। তবে নিজের হাতে চা নিয়ে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। লােকটা লাই পেয়ে যেতে পারে ; বরং সে নিজেই নিয়ে এসে চা খাবে। চা খেতে খেতে দু‘একটা কথা বলবে। | বাগানের এই দিকটা অন্ধকার। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বা ফিউজ হয়েছে, নতুন বাল্ব লাগানাে হয়নি। তবে রাস্তার ল্যাম্প পােস্টের আলো খানিকটা এসেছে
এদিকে। সেই আলােয় অস্পষ্ট করে হলেও সবকিছু চোখে পড়ে। লােকটিকে কাঁঠাল গাছের নীচে পা তুলে বসে থাকতে দেখা গেল।
বসে থাকার ভঙ্গিটি মজার। পা তুলে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসা। শিরদাড়া সােজা করা। ধ্যান–ট্যান করছে না–কি? লােকটা বসেছে উল্টোদিকে। এষা এগুচ্ছে পেছন দিক থেকে। লােকটার মুখ দেখতে পারছে না। পেছন দিক থেকে একটা মানুষের কাছে যেতে ভাল লাগে না।
‘কেমন আছেন?
লােকটা চমকে উঠল। উঠে দাড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এষা বলল, আমি মিতুর বড় বােন। লােকটা নীচু গলায় বলল – জ্বি, আমি জানি। মিতু বলেছে।
‘আপনি বসুন, দাড়িয়ে আছেন কেন?” লােকটি বলল, আপনিও বসুন।
কথাগুলি এত সহজ এবং এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা হল যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন মানুষ কথা বলছে। এষা বসল। বসতে বসতে বলল, বাবা আপনার খোজ বের করার খুব চেষ্টা করছেন। আপনার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আপনি কি দেখেছেন?
“দেখেছি।”
‘থানায় খবর দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে আপনাকে তুলে এনেছেন সেখানেও লােক পাঠানাে হয়েছে।
‘আমি জানি। আপনার বাবা আমাকে বলেছেন। ‘আপনি কি কিছুই মনে করতে পারেন না?” ‘জি না।”
এর জন্যে আপনার মন খারাপ লাগছে না?
‘আশ্চর্য! আপনার আত্মীয়–স্বজন কারা, তারা কোথায় আছেন – এই ভেবে মন খারাপ হচ্ছে না?”
লােকটি চুপ করে রইল।
এষা বলল, আপনার আত্মীয়–স্বজনরা নিশ্চয়ই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। ছােটাছুটি করছেন।
লােকটি চুপ করেই রইল। যেন এই প্রসঙ্গে সে কোন কথা বলতে আগ্রহী নয়। এষা বলল, আপনার পড়াশােনা কতদূর?
‘জানি না।।
‘আচ্ছা আমি একটা ইংরেজী কবিতা বলি আপনি এর বাংলা কি, বলুন
Remember me when I am gone away.
Gone far away into the silent land. ‘আমি অর্থ বলতে পারছি না। ‘আপনি কি ইংরেজী জানেন না ? ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয় জানি না। ‘ও আচ্ছ। আমার মনে হচ্ছিল, আপনি ইংরেজী জানেন।” ‘আমি জানি না।‘
এষা উঠে দাঁড়াল। লােকটি বলল, চলে যাচ্ছেন?
‘হঁ্যা, আপনিও ঘরে চলে যান। বৃষ্টি নামবে। দেখুন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
লােকটি জবাব দিল না।
রাত নটার দিকে বৃষ্টি নামল। এষা নিজের ঘরে পড়ছিল। মালী এসে বলল, আপা লােকটা কঁঠাল গাছের নীচে বইয়া বৃষ্টিতে ভিজতাছে।।
‘জানি না। ঘরে যাইতে বললাম, যায় না।
না গেলে না যাবে। ভিজুক। ‘পাগল–ছাগল মানুষ বাড়িতে রাখা ঠিক না আপা। ‘তােমাকে উপদেশ দিতে হবে না। তুমি তােমার নিজের কাজ কর।”
মালী চলে গেল। এষা জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। লােকটা বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। তার মধ্যে কোন রকম বিকার নেই। যেন একটা পাথরের মূর্তি। লােকটা কি পাগল? কথাবার্তায় অবশ্যি মনে হয়নি। ইংরেজী জানে না – তার মানে মূর্খ ধরনের মানুষ।
কাজের মেয়েটি এসে বলল, আপা আপনার টেলিফোন। ‘কার টেলিফোন ?
কাজের মেয়েটি মুখ টিপে হাসল। যার মানে এই টেলিফোন জুবায়ের করেছে। জুবায়ের টেলিফোন করলেই এ বাড়িতে এক ধরনের চাপা হাসি হাসা হয়। এর কোন মানে আছে?
এষা টেলিফোন ধরল। “কে এষা ?” ‘হ্যা। “তােমাদের এদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?” ‘হ্যা। হচ্ছে। ‘অল্প–স্বল্প না ক্যাটস এণ্ড ডগস?” ‘ভালই হচ্ছে। ‘বৃষ্টিতে ভিজবে এষা ?” .