‘আমি কিছুই বলব না। এইসব পাগলামি তুমি তােমার মা‘র কাছ থেকে পেয়েছ। তােমার মাকে আমি যেমন কিছু বলি না – তােমাকেও বলব না। তবে আশা করব যে, দ্রুত পাগলামি কাটিয়ে উঠবে।
সাবের মাথা নিচু করে রাখল। কিছু বলল না। মতিন সাহেব বললেন, বুঝতে পারছ কি বলছি? ‘পারছি। ‘পাগলামি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। ‘জি আচ্ছা।
পাগলামি কাটিয়ে ওঠার কোন রকম লক্ষণ সাবেরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার স্টাডি রুমে চিকিৎসা শাস্ত্রের রাজ্যের বই। সারাদিন সে বই পড়ে। যে সময়টা বই পড়ে না – বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে। এমাথা ওমাথায় যায় – ওমাথা থেকে এমাথায় আসে। যা পড়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে।
দোতলায় মা’র ঘরের পাশের ঘরে থাকে মিতু এবং এষা। মেজো মেয়ে এষা ইংরেজী সাহিত্যে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স পড়ছে। রূপবতী না হলেও স্নিগ্ধ চেহারা, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। ছেলেটির নাম জুবায়ের। লেদার টেকনােলজিতে জার্মানী থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। নিজেই ছােটখাটো ইণ্ডাস্ট্রির মত শুরু করেছে। শুরুটা করেছে চমৎকার। জুবায়ের প্রায়ই এ বাড়িতে। আসে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করে।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মতিন সাহেবের বড় মেয়ের নাম নিশা। মাত্র কিছুদিন হল তার বিয়ে হয়েছে। এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী। রূপবতীদের সাধারণ ত্রুটি – অহংকার তার মধ্যে পুরােপুরি আছে। নিশার স্বামী ফজলুর রহমান গােবেচারা ধরনের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্সের এসােসিয়েট প্রফেসর। নিশা এই বিয়েতে সুখী হয়নি বলে মনে হয়। বাবার বাড়িতে সে যখন আসে – স্বামী এবং শশুর বাড়ির বদনাম করতে আসে। মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করে।
মতিন সাহেব থাকেন এক তলায়। বলা চলে একা একাই থাকেন। এমনও দিন যায় – স্ত্রীর সঙ্গে তার কথাই হয় না। এই নিয়ে তাঁর মনে কোন ক্ষোভ আছে বলে মনে হয় না। মতিন সাহেবের পাশের ঘরে থাকে মিতুর ছােট মামা মন্টু। জগন্নাথ কলেজ থেকে দু‘বার বি.এ.পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে সে। তৃতীয়বারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন্টুর ঘরের দরজায় বড় বড় করে লেখা –
মনােয়ার আহমেদ মন্টু তার নিচে ছােট ছােট অক্ষরে লেখা – বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। মন্টুর ঘর দিন–রাতই খােলা। যার ইচ্ছা সে ঘরে ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। মতিন সাহেবের
দুই দুয়ারী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
পরিবারের এই হচ্ছে মােটামুটি পরিচয়। এরা ছাড়াও দু‘জন কাজের লােক, একজন বাবুর্চি, একজন মালী, একজন দারােয়ান, একজন ড্রাইভার এ বাড়িতেই থাকে। এদের থাকার জায়গা বাড়ির পেছনের টিন শেডে। এইসব মানুষের সঙ্গে তিনদিন আগে আরেকজন মানুষ যুক্ত হয়েছে যার কোন নাম নেই এবং যে পুরানাে কোন কথা মনে করতে পারছে না।
এক তলায় একটা ঘর তাকে দেয়া হয়েছে। নির্বিকার ভঙ্গিতেই সে সেই ঘরে আছে। খাওয়া–দাওয়া করছে, ঘুমুচ্ছে। যেন এটা তার নিজেরই ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইতেও শােনা যাচ্ছে। একটিই গান –
সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শােনাে শােনাে পিতা
কহে কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা। মতিন সাহেব লােকটির খোঁজ বের করার ভালই চেষ্টা করেছেন। থানায় ডায়েরী করিয়েছেন। দুটি দৈনিক পত্রিকায় ‘সন্ধান চাই’ বিজ্ঞাপন ছবিসহ ছাপা হয়েছে। এ্যাকসিডেন্ট যেখানে হয়েছিল সেখানেও লােক পাঠিয়েছিলেন। কেউ কোনরকম সন্ধান দিতে পারেনি। মতিন সাহেব বুঝতে পারছেন না, তার কি করণীয় আছে। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন আরাে তিন–চারদিন দেখে লােকটাকে যেখান থেকে তুলেছেন সেখানে রেখে আসবেন। কাজটা অমানবিক হলেও কিছু করার নেই। সঙ্গে কিছু টাকা–পয়সা দিয়ে দিলেই হবে। লােকটি স্মৃতিশক্তি তার কারণেই হারিয়েছে তাতাে নাও হতে পারে। হয়ত আগে থেকেই স্মৃতিশক্তি ছিল না।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
বুধবার সন্ধ্যা।
মতিন সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। এষা ট্রেতে করে চা, এক পিস কেক এবং কলা এনে সামনে রাখল। মতিন সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?
এষা হাসি মুখে বলল, ভাল আছি। তুমি কেমন আছাে বাবা? ‘আমি মন্দ আছি।
পিতা এবং কন্যা দুজনই একসঙ্গে হেসে উঠল। এষা কথা বলা শেখার পর থেকে এই জাতীয় বাক্যালাপ দুজনের মধ্যে চলছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধরনটা একটু পাল্টাচ্ছে। এষার পাঁচ বছর বয়সে কথাবার্তা হত এ রকম ঃ
মতিন সাহেব উঁচু গলায় বলতেন, কেমন আছ মা–মণি।
এষা প্রায় চিৎকার করে বলতাে, তুমি কেমন আছাে বাবা–মণি। “আমি মন্দ আছি। ‘আমিও মন্দ আছি। হি হি হি।।
আজ দু‘জনেরই বয়স বেড়েছে কিন্তু এই একটা জায়গায় যেন বয়স আটকে আছে। এষা বাবার সামনে চা রাখল। কোমল গলায় বলল, কলার খােসা ছাড়িয়ে দেব বাবা? মতিন সাহেব বললেন, তাের কথা শুনে মনে হচ্ছে কলার খােসা ছড়ানাে দারুণ কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা করে তুই আমাকে সাহায্য করতে চাস। কিছু করতে হবে না – তুই আমার সামনে বােস। বসতে বলার দরকার ছিল না – এষা নিজ থেকেই বসত। সন্ধ্যাবেলা বেশ কিছুটা সময় সে বাবার সঙ্গে বসে। মতিন সাহেব মেয়ের কাছ থেকে বাড়ির সারাদিনের খবরাখবর নেন। এষাকে এ বাড়ির গেজেট বলা চলে। কিছুই তার চোখ এড়ায় না। বলেও খুব গুছিয়ে।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মতিন সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ তাের মা আছে কেমন?
‘জানি না। ইউনিভার্সিটিতে যাবার আগে উকি দিয়েছিলাম। মা খ্যাক করে উঠেছেন – কেন ডিসটার্ব করছ?”
‘বেচারী খেটেখুটে বাসায় আসে। ডিসটার্ব না করলেই হয়। ‘ডিসটার্ব আবার কি? আমি মার সঙ্গে কথাও বলব না ? ‘যখন মন টন ভাল থাকবে তখন কথা বলবি?” ‘তার মন কখনােই ভাল থাকে না। ‘তাও ঠিক। ‘আরেকটা খবর আছে বাবা। ‘বলে ফেল। ‘হরিপ্রসন্ন স্যার এসেছেন।
মতিন সাহব বিরক্ত মুখে বললেন, কেন ?
“কিছু বলেন নি। দেখে মনে হল খুব অসুস্থ। তুমি কি তার সঙ্গে কথা বলবে? ডাকব?”
‘না এখন কথা বলব না। মনটা ভাল না। ‘মন ভাল না কেন?” তিনি উত্তর দিলেন না। সিগারেট ধরালেন। তিনি এখন পুরােদমে সিগারেট খাচ্ছেন। দিনে এক প্যাকেটের বেশী লাগে।
এষা একটু চিন্তিত বােধ করল। বাবার সিগারেট শুরু করা মানে তার ওষুধের কারখানায় বড় ধরনের কোন সমস্যা। যে সমস্যা নিয়ে তিনি কখনাে কারাে সঙ্গে কথা বলেন না।
‘সাবেরের খবর কি রে?
‘দাদা ভালই আছে। একটা নর কংকাল কিনে এনেছে। অস্থিবিদ্যা যা শিখেছিল সব ভুলে গেছে। আবার নতুন করে নাকি শিখতে হবে।
মতিন সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এষা বলল, মার সঙ্গে দাদাকেও নিয়ে। যাও। তাকেও কোন একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানাে দরকার। আরেক কাপ চা দেব বাবা?
Read more