মতিন সাহেবের বাড়িতে তিনি খুব ভয়ে ভয়ে এসে উঠেছেন। এখনাে মতিন সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। কয়েকটা দিন এই বাড়িতে থাকতে চান। এই প্রসঙ্গে মতিন সাহেবের সঙ্গে কিভাবে আলাপ করবেন তা অনেকবার মনে মনে ভেবে রেখেছেন।
সমস্যা হচ্ছে বয়সের কারণেই বােধ হয় ভেবে রাখা কথা তিনি কখনাে ঠিকমত বলতে পারেন না। তাছাড়া মতিন সাহেব লােকটিকেও তিনি ভয় পান। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অর্থ ও বিত্তবান সব মানুষকেই তিনি ভয় করা শুরু করেছেন।
হরিবাবু বারান্দায় বসেছিলেন।
এষা তাকে ডেকে নিয়ে গেল। বসার ঘরে মতিন সাহেব তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। হরিবাবু মনে মনে গীতার শ্লোক বলতে লাগলেন –
“তমসাে মা জ্যোতির্গময় মৃত্যেৰ্মামৃতং গময়।”
হে ঈশ্বর, আমাকে অন্ধকার থেকে আলােকে নিয়ে যাও। মৃত্যু থেকে অ-মৃত্যুতে।
মতিন সাহেব বললেন, বসুন। হরিবাবু বসলেন। ‘শুনলাম, কিছুদিন এখানে থাকতে চান ?
‘ব্যাপারটা কি?”
হরিবাবু ভেবে রাখা কথা দ্রুত মনে করার চেষ্টা করলেন। কোন কিছুই মনে পড়ল না। নিজের অভাবের কথা বলতে পারলেন না। মাথার ভেতর গীতার শ্লোক ঘুরতে লাগলাে —
“তমসাে মা জ্যোতির্গময় মৃত্যেৰ্মামৃতং গময়।”
‘কতদিন থাকতে চান ? ‘এই অল্প কটা দিন। আমার আয়ু শেষ। যাওয়ার জায়গা নাই। ‘আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই? ‘খুড়তােতাে এক ভাই থাকে পাটনায় — তার ঠিকানা জানি না।
‘আমি বরং আপনাকে কিছু অর্থ সাহায্য করি। একজন মানুষকে রাখার অনেক সমস্যা। বুঝতেই পারছেন।
হরিবাবু বিড় বিড় করে গীতার শ্লোক বললেন। মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন – এসব কি বলছেন?
‘গীতার একটা শ্লোক। বয়স হয়ে গেছে – এখন ঠিকমত কিছু ভাবতেও পারি না – বলতেও পারি না। আপনাকে আমি বেশীদিন যন্ত্রণা দেব না, কয়েকটা দিন। আমার প্রতি দয়া করুন। আমি রােজ সকালে উঠে ঈশ্বরের কাছে – মৃত্যু প্রার্থনা করি । ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমার সময় আগতপ্রায়।
“ঈশ্বর প্রার্থনা শুনেছেন তা কি করে বুঝলেন ? ‘এটা বােঝা যায়।
মতিন সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন – আচ্ছা থাকুন। ‘আপনি কি আমাকে থাকতে বললেন ?” ‘হ্যা বললাম।
মতিন সাহেব এষাকে বলেছিলেন –ঐ লােকটার ঘর হরিবাবুকে দিয়ে দে। এষা বললাে, মিস্টার জুলাই এর ঘর? সে তাে এখনাে যায় নি।
‘ঐ ঘরে আরেকটা খাট দিয়ে দে, তা হলেই তাে হল। প্রত্যেকের আলাদা ঘর লাগবে নাকি?”
হরিবাবু বললেন, আপনি আমাকে কিছু বললেন? ‘না। আপনাকে কিছু বলিনি।
হরিবাবুর জায়গা হল মিস্টার জুলাই এর সঙ্গে। প্রথম রাত আনন্দে তিনি ঘুমুতে পারলেন না।
মিতু বলল, আজ থেকে তােমার নাম মিস্টার আগস্ট। লোকটি হাসল। মিতু বলল, তােমার খুশী লাগছে না? নতুন নাম পেয়ে গেছ।
‘হা খুশী লাগছে। খুব খুশী। বৎসরে বারটা নাম ঘুরে ঘুরে আসবে। তার চেয়েও ভাল হত যদি এক দুই তিন চার এইভাবে নাম রাখা হত। যেমন যেদিন । একটা শিশুর জন্ম হল সেদিন তার নাম এক, পরের দিন তার নাম দুই, তার পরের দিন তিন। এইভাবেই চলতে থাকবে। প্রতিদিন নতুন নাম। এতে অনেক সুবিধা।
‘কি সুবিধা ?”
‘কেউ যখন তার নাম বলবে সঙ্গে সঙ্গে তুমি বুঝবে এই পৃথিবীতে সে কতদিন বাঁচল। এটা জানা থাকা খুব দরকার।
‘দরকার কেন?”
‘দরকার এই জন্যে যে নাম শােনামাত্র তুমি বুঝবে এই পৃথিবীতে সর্বমােট । কতগুলি সূর্যাস্ত তুমি দেখেছে।
মিতু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ব্যাপারটা তার ভাল লাগছে। সে নিজের নামটা বদলে ফেলবে কিনা ভাবছে। বদলে ফেললে হয়। কেউ আবার রাগ করবে
তাে?
মিস্টার আগস্ট মিটি মিটি হাসছে। মিতু বলল, আপনি হাসছেন কেন? ‘তুমি তােমার নাম বদলে ফেলতে চাচ্ছ এই জন্যে হাসছি। ‘কে বলল আপনাকে নাম বদলাতে চাচ্ছি?”
‘কে কি ভাবছে তা আমি অনুমান করতে পারি। তুমি তােমার জন্ম তারিখ বল, আমি ঠিক করে দেব তােমার নাম কি হবে।
‘আমার জন্ম ১১ মার্চ। ‘কোন সনে জন্ম সেটা বল।
মিতু বলল। লােকটা সঙ্গে সঙ্গেই বলল, তােমার নাম হল তিন হাজার ছয়শ’ চুয়াম।
‘আগামীকাল আমার নাম হবে তিন হাজার ছয়শ’ পঞ্চান্ন। ‘হ্যা।
মিতু নতুন নামের আনন্দ চোখে মুখে নিয়ে ঘর থেকে বেরুল। সবাইকে ব্যাপারটা জানানাে দরকার। বাসার সবাইকে তাে জানাবেই, স্কুলের বন্ধুদেরও জানাতে হবে। আজ ছুটির দিন হয়ে মুশকিল হয়ে গেছে। ছুটির দিন না হলে সব বন্ধুদের এক সঙ্গে বলা যেত। এখন বলতে হবে টেলিফোনে।
টেলিফোন বই আছে। সেই বই–এ সে সবার টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখেছে। অবশ্যি যাদের সঙ্গে ঝগড়া হয় তাদের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার কেটে দেয়। ঝগড়া মিটমাট হলে আবার লেখে।
মিতু তার টেলিফোনের বই নিয়ে বেশ কিছু টেলিফোন করল ‘হ্যালাে শমি – আমি মিতু। কেমন আছিস ভাই ?”
‘ভাল।”
‘আজ থেকে আমি আমার নাম বদলে ফেলেছি – এখন আমার নাম তিন হাজার ছয়শ’ চুয়ান্ন।
‘ধ্যাৎ
‘ধ্যাৎ না। সত্যি। আগামীকাল আমার বয়স হবে তিন হাজার ছয়শ‘ পঞ্চান্ন। আমার যতদিন বয়স — সেটাই আমার নাম। এতে সুবিধা কি জানিস? এতে সঙ্গে সঙ্গে বােঝা যাবে এ জীবনে আমি কটা সূর্যাস্ত দেখেছি।
‘মিতু তুই পাগলের মত কথা বলছিস কেন? তাের কি জ্বর হয়েছে?”
মিতু বলে তুই আমাকে আর ডাকবি না ভাই। আমার যা নাম তাই ডাকবি – তিন হাজার ছয়শ চুয়ান্ন। আচ্ছা ভাই রাখলাম।
মিতু সব মিলিয়ে চারটা টেলিফোন করল। পঞ্চমটা করতে যাচ্ছে, তখন মতিন সাহেব তাকে কাছে ডাকলেন। হাসিমুখে বললেন, হচ্ছে কি মিতু? মিতু লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না বাবা।
‘টেলিফোনে কি বলছিস? আমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে শুনলাম। যদিও অন্যের টেলিফোন কনভারসেশন শােনা খুবই অনুচিত। মনের ভুলে শুনে ফেলেছি। তুমি কি বলছ বন্ধুদের ?
‘এখন থেকে আমার নতুন নাম বাবা। একেকটা দিন আসবে আমার নাম বদলে যাবে।
এই বুদ্ধি কার ? ‘মিস্টার আগস্ট আমাকে বলেছেন।
মতিন সাহেবের মুখ একটু যেন গম্ভীর হল। মুখের গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে বললেন – আচ্ছা ঠিক আছে। এষাকে বল আমাকে চা বানিয়ে দিতে। মিতু চায়ের কথা বলতে গেল। মতিন সাহেব খবরের কাগজ হাতে লােকটার খোজে গেলেন। সে ঘরে নেই। কাঁঠাল গাছের নীচে বসে আছে। মতিন সাহেব মন্টুর ঘরে উঁকি দিলেন। সকাল এগারােটা বাজে। মন্টুর ঘুম ভেঙ্গেছে। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাঁত ব্রাশ করছে। কেউ বিছানায় শুয়ে ব্রাশ করতে পারে তা তার ধারণার বাইরে ছিল। মন্টু দুলাভাইকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
‘দুলাভাই কিছু বলবেন?” ‘। তুমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাঁত মাজ এটা জানতাম না।
‘এটা নতুন শুরু করেছি দুলা ভাই। রাতে শােবার আগে টুথপেস্ট লাগিয়ে মাথার কাছে রেখে দেই। দাঁত–টাত মেজে একেবারে ফ্রেশ হয়ে বিছানা থেকে। নামি।
‘ভাল। ‘কি বলতে এসেছেন দুলাভাই ??
‘তুমি ঐ লােকটাকে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে পারবে? কোন খোজ তাে পাওয়া যাচ্ছে না – আর কতদিন রাখব। সে যে নিজ থেকে চলে যাবে তারও লক্ষণ দেখছি না।
‘আমি বরং এক কাজ করি। লােকটাকে কড়া করে বলি, গেট আউট। মামদোবাজি শুরু করেছ? পরের বাড়িতে খাচ্ছ–দাচ্ছ ঘুমুচ্ছ। স্টপ ইট, বিদায়
হও।
‘এসব বলার কোন দরকার নেই। লােকটাকে যেখান থেকে তুলে এনেছিলাম। সেখানে রেখে এসাে। গাড়ি নিয়ে যাও। আরেকটা কথা – লােকটাকে না জানানাে ভাল যে, তুমি তাকে রেখে আসতে যাচ্ছ।
‘জানলে অসুবিধা কি?” ‘লােকটার আজ যে এই অবস্থা তার জন্যে আমি নিজেকে দায়ী মনে করছি। আমার মধ্যে অপরাধবােধ আছে।”
“আপনি যা বলবেন তাই করব দুলাভাই। বিড়ালের বাচ্চা যেমন ছেড়ে দিয়ে আসে — ঠিক তেমনি ছেড়ে দিয়ে আসব। ব্যাটা আবার গন্ধ শুকে চলে না আসে।
মতিন সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, যা করবে চুপচাপ করবে। বাসার কাউকে কিছু জানানাের দরকার নেই। বিশেষ করে মিতু যেন কিছু না জানে।
‘কেউ কিছু জানবে না দুলাভাই। আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। রাতের অন্ধকারে মাল পাচার করে দেব।