দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

তুমি না দেখে বলতে চেষ্টা করবে‘ 

রানু অবাক হয়ে বলল, না দেখে বলব কীভাবে

চেষ্টা করে দেখ পারতেও তাে পার বল দেখি এই কার্ডটিতে কী আঁকা আছে?” 

কী আশ্চর্য, কী করে বলব? আন্দাজ করযা মনে আসে তাবল। 

একটা ক্রস চিহ্ন আছেঠিক হয়েছে? ‘তা বলব নাএবার বল এটিতে কী আছে? খুব ছােটছােট সার্কেলটি, বলতে পারবে

মনে হচ্ছে তিনটিচারটিও হতে পারেমিসির সাহেব কার্ডগুলাে ড্রয়ারে রেখে সিগারেট ধরালেনতাঁকে কেমন যেন 

চিন্তিত মনে হতে লাগলআনিস বলল, কি বলতে পেরেছে? মিসির সাহেব তার জবাব নাদিয়ে বললেন, রানু, এবার তুমি বল, প্রথম ভয়টা তুমি কীভাবে পেলেসবকিছু বলবে, কিছুই বাদ দেবে নাআমি তােমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি‘ 

রানু চুপ করে রইল। 

তুমি নিশ্চয়ই চাও, তােমার অসুখটা সেরে যাকচাও না?চাই। 

তাহলে বলকোনােকিছু বাদ দেবে নারানু তাকাল আনিসের দিকেমিসির আলি বললেন, আনিস সাহেব, আপনি হয় পাশের ঘরে গিয়ে বসেনঘরে অনেক বইপত্র আছে, বসেবসে পড়তে থাকুননাশনাল জিওগ্রাফির কারেন্ট ইস্যুটা আছে, গতকালই এসেছে। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

রানু বলতে শুরু করলমিসির আলি শুনতে লাগলেন চোখ বন্ধ করেএকটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন নামাঝখানে এক বার শুধু বললেন, পানি খাবে? তৃষ্ণা পেয়েছে? রানু মাথা নাড়লতিনি পানির জগ এবং গ্লাস নিয়ে এলেনশান্ত স্বরে বললেন, চোখে-মুখে পানি দিয়ে নাও, ভালাে লাগবেরানু সে সব কিছুই করল

শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইলকথা বলতে লাগল স্পষ্ট স্বরে। 

রানুর প্রথম গল্পআমার বয়স তখন এগারবার বৎসরআমি মধুপুরে আমার এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গেছিচাচাতাে বােনের বিয়েতে চাচাতাে বােনটির নাম হচ্ছে অনুফা খুবই ভালাে মেয়ে, কিন্তু চাচা বিয়ে ঠিক করেছেন একটা বাজে ছেলের সঙ্গেছেলের প্রচুর জায়গাটায়গা আছে, কিন্তু কিছুই করে নাদেখতেও বাজে, দাঁত উঁচু, মুখে বসন্তের দাগদারুণ বেঁটেঅনুফা আপার এই নিয়ে খুব মনখারাপপ্রায়ই এই নিয়ে কাঁদেআমি তাকে সান্ত্বনাটান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিকিন্তু আমি নিজে একটি বাচ্চা মেয়ে, তাকে কী সান্ত্বনা দেব? তবে আমার সঙ্গে অনুফা আপার খুব ভাব ছিলআমাকে অনেক গােপন কথাটথা বলত। 

যাই হােক, গায়েহলুদের দিন খুব রঙ খেলা হলােআমাদের ওদিকে রঙ খেলা হচ্ছেউঠোনে কাদা ফেলে তাতে গড়াগড়ি খাওয়া। সারা দিন রঙ খেলে কাদা মেখে সবাই ভূত হয়ে গেছিঠিক করা হলাে সবাই মিলে নদীতে গোসল সেরে আসবেচাচা অবশ্যি আপত্তি করলেনমেয়েছেলেরা নদীতে যাবে কী

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

চাচার আপত্তি অবশ্যি টিকল না। আমরা মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে গােসল করতে গেলামবাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরেই নদীআমরা প্রায় ত্রিশ 

চল্লিশ জন মেয়ে, খুব হৈচৈ হচ্ছেসবাই মিলে মহানন্দে পানিতে ঝাপাঝাপি করছিসেখানেও খুব কাদা ছোড়াছুঁড়ি শুরু হলােঠিক তখন একটা কাণ্ড হলাে, মনে হলাে একজন কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছেনির্ঘাত কেউ তামাশা করছেআমি হাসতেহাসতে বললামএ্যাই, ভালাে হবে নাছাড় বলছি, ছাড়কিন্তু যে পা ধরেছে সে ছাড়ল না, হঠাৎ মনে হলাে সে টেনে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলতে চেষ্টা করছেতখন আমি চিৎকার দিলামসবাই মনে করল কোনােএকটা তামাশা হচ্ছেকেউ কাছে এল না, কিন্তু ততক্ষণে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলেছে আর, আর....। 

এই সময় মিসির সাহেব বললেন, বুঝতে পারছি তারপর কী হলাে‘ 

সবার প্রথম অনুফা আপা ছুটে এসে আমাকে ধরলেন, তারপর অন্যরা ছুটে এলযে আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে লাগলতারপর আমার আর কিছু মনে নেই। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

জ্ঞান হবার পর শুনেছি ওরা আমাকে বহু কষ্টে টেনে পাড়ে তুলেছে এবং দেখেছে একটা মরা মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেমরা মানুষটাকে গ্রামের লােকেরা নদীর পাড়ে মাটি চাপা দিয়েছিলসেইসব কিছুই অবশ্যি আমি দেখি নি, শুনেছিকারণ আমার কোনাে জ্ঞান ছিল নাচাচা আমার চিকিৎসার জন্যে আমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিলেনসবাই ধরে নিয়েছিল আমি বাঁচব না, কিন্তু বেঁচে গেলামএইটুকু আমার প্রথম ভয়ের গল্প। 

রানু গল্প শেষ করে পুরাে এক গ্লাস পানি খেলমিসির আলি সাহেব বললেন, লােককে তুমি দেখ নি

জ্বিনা‘ 

গ্রামের অন্যরা তাে দেখেছে, কী রকম ছিল দেখতে?আমি জানি না, কাউকে জিজ্ঞেস করি নিকেউ আমাকে কিছু বলে নি। 

এর পর কি তুমি কখনাে তােমার চাচার বাড়ি গিয়েছিলে?জ্বিনা, কখনাে যাই নি। 

আরেকটা কথা তুমি বলছিলেলােকটি তােমার পায়জামা টেনে খুলে ফেলতে চেষ্টা করছিলতােমাকে যখন টেনে তােলা হলাে তখন কি পায়জামা পরনে ছিল

জ্বিনা, ছিল না‘ 

মিসির আলি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে নিচু গলায় বললেন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনাে একটি জিনিস তুমি আমাকে বল নিকিছুএকটা বাদ দিয়ে গেছ। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

রানু জবাব দিল না। যে জিনিসটা বাদ দিয়েছ, সেটা আমার শােনা দরকার। সেটা কী, বলবে

অন্য আরেক দিন বলবঠিক আছে, অন্য এক দিন শুনবতােমাকে আসতে হবে না, আমি গিয়ে শুনে আসব।’ 

রানু কিছু বলল নামিসির আলি সাহেব কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে হঠাৎ বললেন, যখন তুমি একা থাক, তখন কি কেউ তােমার সঙ্গে কথা বলে?” 

হ্যামিসির আলি খুব উৎসাহ বােধ করলেন। 

ব্যাপারটা গুছিয়ে বলমাঝেমাঝে কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকেপুরুষদের গলায়? জ্বিনামেয়েদের গলায়শুধু ডাকে, অন্য কিছু বলে না?জ্বিনাএবং যে ডাকে তাকে কখনাে দেখা যায় না?জ্বিনা। 

এটা প্রথম কখন হয়? অর্থাৎ প্রথম কখন শুনলে? নদীর ব্যাপারটা ঘটার আগেই?‘ 

কত দিন আগে? আমার ঠিক মনে নেই।’ আচ্ছা ঠিক আছে, আজ এই পর্যন্তই। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *