তুমি না দেখে বলতে চেষ্টা করবে।‘
রানু অবাক হয়ে বলল, না দেখে বলব কীভাবে?
‘চেষ্টা করে দেখ । পারতেও তাে পার । বল দেখি এই কার্ডটিতে কী আঁকা আছে?”
কী আশ্চর্য, কী করে বলব? ‘আন্দাজ কর। যা মনে আসে তা–ই বল।
একটা ক্রস চিহ্ন আছে। ঠিক হয়েছে? ‘তা বলব না। এবার বল এটিতে কী আছে? ‘খুব ছােট–ছােট সার্কেল। ‘ক’টি, বলতে পারবে?
মনে হচ্ছে তিনটি। চারটিও হতে পারে।‘ মিসির সাহেব কার্ডগুলাে ড্রয়ারে রেখে সিগারেট ধরালেন। তাঁকে কেমন যেন
চিন্তিত মনে হতে লাগল। আনিস বলল, “ও কি বলতে পেরেছে? মিসির সাহেব তার জবাব না–দিয়ে বললেন, রানু, এবার তুমি বল, প্রথম ভয়টা তুমি কীভাবে পেলে। সবকিছু বলবে, কিছুই বাদ দেবে না। আমি তােমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি।‘
রানু চুপ করে রইল।
তুমি নিশ্চয়ই চাও, তােমার অসুখটা সেরে যাক। চাও না?” ‘চাই।
তাহলে বল। কোনােকিছু বাদ দেবে না। রানু তাকাল আনিসের দিকে। মিসির আলি বললেন, আনিস সাহেব, আপনি হয় পাশের ঘরে গিয়ে বসেন। ঐ ঘরে অনেক বইপত্র আছে, বসে–বসে পড়তে থাকুন। নাশনাল জিওগ্রাফির কারেন্ট ইস্যুটা আছে, গতকালই এসেছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
রানু বলতে শুরু করল। মিসির আলি শুনতে লাগলেন চোখ বন্ধ করে। একটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। মাঝখানে এক বার শুধু বললেন, ‘পানি খাবে? তৃষ্ণা পেয়েছে? রানু মাথা নাড়ল। তিনি পানির জগ এবং গ্লাস নিয়ে এলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চোখে-মুখে পানি দিয়ে নাও, ভালাে লাগবে।‘ রানু সে সব কিছুই করল।
শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। কথা বলতে লাগল স্পষ্ট স্বরে।
রানুর প্রথম গল্প। আমার বয়স তখন এগার–বার বৎসর। আমি মধুপুরে আমার এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গেছি। চাচাতাে বােনের বিয়েতে । চাচাতাে বােনটির নাম হচ্ছে অনুফা । খুবই ভালাে মেয়ে, কিন্তু চাচা বিয়ে ঠিক করেছেন একটা বাজে ছেলের সঙ্গে। ছেলের প্রচুর জায়গাটায়গা আছে, কিন্তু কিছুই করে না। দেখতেও বাজে, দাঁত উঁচু, মুখে বসন্তের দাগ। দারুণ বেঁটে। অনুফা আপার এই নিয়ে খুব মন–খারাপ। প্রায়ই এই নিয়ে কাঁদে। আমি তাকে সান্ত্বনাটান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি নিজে একটি বাচ্চা মেয়ে, তাকে কী সান্ত্বনা দেব? তবে আমার সঙ্গে অনুফা আপার খুব ভাব ছিল। আমাকে অনেক গােপন কথাটথা বলত।
যাই হােক, গায়ে–হলুদের দিন খুব রঙ খেলা হলাে। আমাদের ওদিকে রঙ খেলা হচ্ছে—উঠোনে কাদা ফেলে তাতে গড়াগড়ি খাওয়া। সারা দিন রঙ খেলে কাদা মেখে সবাই ভূত হয়ে গেছি। ঠিক করা হলাে সবাই মিলে নদীতে গোসল সেরে আসবে। চাচা অবশ্যি আপত্তি করলেন—মেয়েছেলেরা নদীতে যাবে কী?
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
চাচার আপত্তি অবশ্যি টিকল না। আমরা মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে গােসল করতে গেলাম। বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরেই নদী। আমরা প্রায় ত্রিশ
চল্লিশ জন মেয়ে, খুব হৈচৈ হচ্ছে। সবাই মিলে মহানন্দে পানিতে ঝাপাঝাপি করছি। সেখানেও খুব কাদা ছোড়াছুঁড়ি শুরু হলাে। ঠিক তখন একটা কাণ্ড হলাে, মনে হলাে একজন কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। নির্ঘাত কেউ তামাশা করছে। আমি হাসতে–হাসতে বললাম—এ্যাই, ভালাে হবে না। ছাড় বলছি, ছাড়। কিন্তু যে পা ধরেছে সে ছাড়ল না, হঠাৎ মনে হলাে সে টেনে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলতে চেষ্টা করছে। তখন আমি চিৎকার দিলাম।সবাই মনে করল কোনাে–একটা তামাশা হচ্ছে। কেউ কাছে এল না, কিন্তু ততক্ষণে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলেছে আর, আর....।
এই সময় মিসির সাহেব বললেন, বুঝতে পারছি তারপর কী হলাে।‘
সবার প্রথম অনুফা আপা ছুটে এসে আমাকে ধরলেন, তারপর অন্যরা ছুটে এল। যে আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে লাগল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
জ্ঞান হবার পর শুনেছি ওরা আমাকে বহু কষ্টে টেনে পাড়ে তুলেছে এবং দেখেছে একটা মরা মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ঐ মরা মানুষটাকে গ্রামের লােকেরা নদীর পাড়ে মাটি চাপা দিয়েছিল। সেইসব কিছুই অবশ্যি আমি দেখি নি, শুনেছি। কারণ আমার কোনাে জ্ঞান ছিল না। চাচা আমার চিকিৎসার জন্যে আমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল আমি বাঁচব না, কিন্তু বেঁচে গেলাম। এইটুকু আমার প্রথম ভয়ের গল্প।
রানু গল্প শেষ করে পুরাে এক গ্লাস পানি খেল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘ঐ লােককে তুমি দেখ নি?
‘জ্বি–না।‘
গ্রামের অন্যরা তাে দেখেছে, কী রকম ছিল দেখতে?” ‘আমি জানি না, কাউকে জিজ্ঞেস করি নি। কেউ আমাকে কিছু বলে নি।
এর পর কি তুমি কখনাে তােমার চাচার বাড়ি গিয়েছিলে?” “জ্বি–না, কখনাে যাই নি।
আরেকটা কথা তুমি বলছিলে। ঐ লােকটি তােমার পায়জামা টেনে খুলে ফেলতে চেষ্টা করছিল। তােমাকে যখন টেনে তােলা হলাে তখন কি পায়জামা পরনে ছিল?
“জ্বি–না, ছিল না।‘
মিসির আলি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে নিচু গলায় বললেন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনাে একটি জিনিস তুমি আমাকে বল নি। কিছু–একটা বাদ দিয়ে গেছ।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
রানু জবাব দিল না। ‘যে জিনিসটা বাদ দিয়েছ, সেটা আমার শােনা দরকার। সেটা কী, বলবে?
অন্য আরেক দিন বলব। “ঠিক আছে, অন্য এক দিন শুনব। তােমাকে আসতে হবে না, আমি গিয়ে শুনে আসব।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে হঠাৎ বললেন, যখন তুমি একা থাক, তখন কি কেউ তােমার সঙ্গে কথা বলে?”
হ্যা। মিসির আলি খুব উৎসাহ বােধ করলেন।
ব্যাপারটা গুছিয়ে বল।‘ মাঝে–মাঝে কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকে।‘ ‘পুরুষদের গলায়? “জ্বি–না। মেয়েদের গলায়। ‘শুধু ডাকে, অন্য কিছু বলে না?‘ ‘জ্বি–না।‘ ‘এবং যে ডাকে তাকে কখনাে দেখা যায় না?” “জ্বি–না।
‘এটা প্রথম কখন হয়? অর্থাৎ প্রথম কখন শুনলে? নদীর ব্যাপারটা ঘটার আগেই?‘
কত দিন আগে? আমার ঠিক মনে নেই।’ আচ্ছা ঠিক আছে, আজ এই পর্যন্তই।