প্রিয়তমেষু পর্ব:০১ হুমায়ূন আহমেদ

প্রিয়তমেষু পর্ব:০১

কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।নিশাত কী-হোলে চোখ রাখল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ দরজায় ধাক্কা পড়ছে। নিশাত বলল, কে? কোনো উত্তর নেই। চাপা হাসির মত শব্দ। নিশাত দরজা খুলল। আশ্চর্য কাণ্ড। এইটুকু একটা বাচ্চা। সবে দাঁড়াতে শিখেছে। তাও নিজে নিজে নয়। কিছু একটা ধরে দাঁড়াতে হয়। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কেমন দুলছে।খোকন, তোমার কি নাম?

খোন বিশাল একটা হাসি দিল। নিচের মাটীর একটিমাত্র দাঁত। সেই দাঁত হাসির আভায় ঝিকঝিক করছে। নিশাত উচু গলায় জহিরকে ডাকল, এই, কাণ্ড দেখে যাও।কি কাণ্ড? না দেখলে বুঝবে না। বিরাট এক অতিথি এসেছে।জহির গলায় টাই বাধছিল। আয়নার সামনে থেকে নড়া উচিত নয়, তবু নড়ল। নিম্প্রণ গলায় বলল, এ কে? পাশের বাসার। কী রকম অসাবধান মা দেখেছ? বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়েছে। যদি সিঁড়ির দিকে যেত।জহির আয়নার সামনে চলে গেল। টাইয়ের নটে গোলমাল হয়ে গেছে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সে নট ঠিক করতে করতে বলল, নিশাত, বাচ্চাটাকে ঘরে ঢুকি না।ঢেকাব না কেন?

বাচ্চাদের একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, সাজানোগোছাননা ঘর দেখলেই এরা প্রাকৃতিক কর্মটি করে ফেলে। ও এক্ষুণি তা করে ফেলবে।ফেলুক। এই খোকন, ভেতরে আসবে? টুটু টুটু।নতুন কেনা কাৰ্পেট, খেয়াল রেখো।নিশাত বলল, মা-টা কেমন দেখলে? একদম নেংটোবাবা করে রেখে দিয়েছে। একটা প্যান্ট পরাবে না? আয়নায় নিশাতের ছায়া পড়েছে। জহির অবাক হয়ে দেখল, নিশাত বাচ্চাটার পেটে নাক ঘষছে। জহির হালকা গলায় বলল, আদরটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে না? আদর কখননা বাড়াবাড়ি হয় না। বাড়াবাড়ি হয় ভালবাসায়।যার বাচ্চা তাকে দিয়ে এস। দেখ কেমন গা মোচড়াচ্ছে—এটা হচ্ছে বড় কিছু করবার প্রস্তুতি।আচ্ছা, এর হাতে একটা ক্র্যাকার দেব? গলায় বেঁধে যাবে না তো আবার?

ক্রাকারফ্যাকার দিও না। লোভে পড়ে যাবে। রোজ আসবে।আহা আসুক না। এই খোকন, ক্র্যাকার খাবে? টুটু টুটু।খোকন জবাব দেবার আগেই খোকনের মার ভয়-কাতর মুখ দেখা গেল। নিশাত লক্ষ করল বেচারি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে,কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। নিশাত সহজভাবে বলল, এত ছোট বাচ্চাকে একা ছাড়তে আছে? যদি সিড়ির দিকে যেত? ও ঘুমাচ্ছিল। কখন যে জেগেছে বুঝতেও পারি নি।বাচ্চার কি নাম? ওর নাম পল্টু।পল্টু আবার কী রকম নাম? বড় হলে ওর বন্ধুরা ওকে বন্টু বলে খেপাবে। ওর একটা ভালো নাম রাখুন।

মেয়েটি হেসে ফেলল। নিশাত বলল, আসুন না, ভেতরে আসুন। মেয়েটি লাজুক দৃষ্টিতে জহিরের দিকে তাকাচ্ছে। নিশাত বলল, ও এক্ষুণি অফিসে চলে যাবে। আপনি বসুন, আপনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হোক। আমরা পাশাপাশি থাকি অথচ আলাপ নেই।ঘর খোলা রেখে এসেছি। তালা দিয়ে আসি? বলেই মেয়েটি উত্তরের অপেক্ষা করল না। ছুটে চলে গেল।জহির হ্যান্ডব্যাগে অফিসের ফাইল ভরতে-ভরতে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, ভদ্রমহিলা বেশ অসাবধান। ব্লাউজের বোতাম খোলা ছিল, তুমি লক্ষ করেছ? এত কিছু থাকতে তোমার চোখ গিয়ে পড়ল ঐখানে! আয়নার ভেতর দিয়ে এত সব দেখে ফেললে? তোমার কি ধারণা আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি?

নিশাত জবাব দিল না। তার একটু মন-খারাপ হয়েছে। জহির রাউজের এই প্রসঙ্গ না তুললেও পারত। শালীনতার একটা ব্যাপার আছে। জহিরের কি তা মনে থাকে না।রাগ করলে নাকি নিশাত? না। এত চট করে রাগ করলে চলে না। আজও কি তোমার ফিরতে দেরি হবে, না সকাল-সকাল ফিরবে? রাত আটটার মধ্যে ফিরব। পজেটিভ।পল্টু সাহেব তার কাজটি এখন সারছেন। কার্পেটের উপর তীর বেগে ঝর্নার ধারা পড়ছে। পল্টুর মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। নিশাত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকাল জহিরের দিকে। জহির কিছু বলল না। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল। তার আজকের বিদায় অন্য দিনের মত হল না। অন্য দিন নিশাত তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সিড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে দু-একটা টুকটাক কথা হয়। আশেপাশে কেউ না-থাকলে জহির অতি দ্রুত তার ঠোঁট এগিয়ে আনে। সেই সুযোগ সে খুব বেশি পায় না।

পর মা ফিরে এসেছে। এর মধ্যেই সে বেশভুষার কিছু পরিবর্তন করেছে। প্রথম যে-জিনিসটা নিশাতের চোখে পড়ল, তা হচ্ছে ব্লাউজের বোতাম লাগান। চুল খোঁপা করা। পরনে অন্য একটা শাড়ি।আপা আসব? আসুন আসুন।উনি অফিসে চলে গেছেন, তাই না? হ্যাঁ।আপনি তো আজ ওঁকে এগিয়ে দিলেন না? রোজ দেন।নিশাত একটু যেন হকচকিয়ে গেল। অবশ্যি তার বিস্ময়ের ভাব তেমন প্রকাশ পেল না। এই মেয়েটি যদি অফিসে এগিয়ে দেবার ব্যাপারটা লক্ষ করে তা হলে আরো কিছু হয়তো লক্ষ করেছে। নিশাত সহজ গলায় বলল, আপনি চা খাবেন? চাকরি আপনার জন্যে? জ্বি আচ্ছা। আর আপা, আমাকে আপনি-আপনি করে বলবেন না। আমার বয়স কিন্তু খুব কম।তাই নাকি?

জ্বি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাঝখানে আমার বিয়ে হল। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে শুনি আমার বিয়ে। কয়েক জন লোক ডেকে এনে বিয়ে। সেই রাতেই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম।বাকি পরীক্ষাগুলো নিশ্চয়ই দাও নি? জ্বি-না। আমার শ্বশুরসাহেব বললেন, মেয়েদের আসল পরীক্ষা হল সংসার। ঐ পরীক্ষায় পাস করতে পারলে সব পাস।ঐ পরীক্ষায় কি পাস করেছ? সে হেসে ফেলল। নিশাত বলল, তুমি বস এখানে। বাচ্চার সঙ্গে খেলা কর, আমি চা বানিয়ে আনছি। খোকনের হাতে কি আমি একটা ক্র্যাকার দেব? দিন না। যা দেবেন ও তাই খাবে। গলায় আটকাবে না তো আবার?

উঁহু। আটকাবে কেন? এক দিন ও তার বাবার একটা সিগারেট গিলে ফেলেছিল। প্যাকেট থেকে বের করে টপ করে মুখে দিয়ে ফেলল। তারপর সে কী বমি।নিশাত চায়ের পানি চড়িয়েছে। সকালের কিছু কাজকর্ম তার এখনো বাকি। নাশতার প্লেট পরিষ্কার করা হয় নি। লরি ছেলেটা আসবে কাপড় নিতে। টেলিফোন অফিসে যেতে হবে। সাত শ টাকা বিল এসেছে। অথচ টেলিফোন বলতে গেলে করাই হয় নি। কমপ্লেইন করতে হবে। কলাবাগানে মার কাছে যাওয়া দরকার। গত সপ্তাহে যাওয়া হয় নি। মা নিশ্চয়ই রেগে আছেন।আপা আসব?

রান্নাঘরের দরজা ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।এস।বাবু ঘুমাচ্ছে।বিছানায় শুইয়ে দাও।বিছানা লাগবে না, ও আরাম করে কার্পেটে ঘুমাচ্ছে। আপা, আপনার রান্নাঘরটা কী সুন্দর।তোমার পছন্দ হচ্ছে? খুব পছন্দ হচ্ছে। খুব সুন্দর। ছবির মতন।তোমার রান্নাঘরও তুমি এরকম করে সাজিয়ে নাও। রানাঘর তো একই রকম।আপনি কি ভেবেছেন আমরা পাশের ফ্ল্যাটটায় ভাড়া থাকি? মোটেই না। ও বেতনই পায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। তাও বাড়ি ভাড়া মেডিকেল সব মিলিয়ে। এর মধ্যে দু শ টাকা কেটে নেয়। আর ফ্ল্যাটের ভাড়াই পাঁচ হাজার। ওর এক দূর সম্পর্কের চাচা ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলেন। তিন মাসের অ্যাডভান্স দিলেন। উঠলেন। না। ইরান না ইরাক কোথায় নাকি যাচ্ছেন।

বাড়িওয়ালা অ্যাডভান্সের টাকাও ফেরত দেবে না। চাচা বললেন, ঠিক আছে, তোরা থাক এই ক দিন।ভালই তো হল, তিন মাস থাকা গেল।দুই মাস তো আপা চলেই গেল। ওর যা কষ্ট! অফিসের পর রোজ বাসা খুঁজতে যায়। ফিরতে-ফিরতে রাত নটার মতো বাজে। এক দিন ফিরল রাত এগারটায়। বাসাবো না কোথায় নাকি গিয়েছিল।নাও, চা নাও। চিনি হয়েছে কি না দেখ তো! চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু খাবে? টোস্টে জেলি মাখিয়ে দিই? দিন।নিশাত টোস্টের টিন বের করল। ফুীজ খুলে জেলির কৌটা বের করল। একটা পিরিচে পটেটো চিপস ঢালল।আপা, আমি যে হুট করে রান্নাঘরে চলে এসেছি, আপনি কি রাগ করেছেন? রাগ করব কেন?

তুমি আসায় বেশ সুন্দর গল্প করতে পারছি। যখন ইচ্ছা হয় আসবে। আমি একাই থাকি।আপা, আমার নাম পুষ্প।বাহ্, খুব সুন্দরপুষ্প বনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে। কে লিখেছে জান? জ্বি-না।বইটই তেমন পড় না বোধহয়? আগে পড়তাম, এখন সময়ই পাই না। কোনো কাজের লোক নেই। সবকিছু নিজের করতে হয়।কাজের লোক আমারও নেই। অবশ্যি আমরা দুজনমাত্ৰ মানুষ—আমাদের দরকারও হয় না।একটা বাচ্চা হোক, তখন দেখবেন কত কাজ! নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাবেন না। আপা, আমি এখন যাই? আচ্ছা, আবার এসো। পট্ সাহেবকে এখন আর ঘুম ভাঙিয়ে নেবার দরকার নেই। কাঁদবে হয়ত। জেগে উঠলে আমিই দিয়ে আসব।পুষ্প চলে গেল। পল্টু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এক হাতে একটা ক্রাকার। তা এখনো হাতে ধরা আছে। নিশাত খুব সাবধানে পল্টুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। এ তার মায়ের রূপ পেয়েছে।

নিশাতের মনে হল সে ছোট্ট একটা ভুল করেছে। পুষ্পকে বলা দরকার ছিল, পুষ্প, তুমি খুবই সুন্দরী একটি মেয়ে। মেয়েটা খুশি হত। মেয়েটিকে দেখেই মনে হয় এ অল্পতে খুশি হওয়া মেয়ে। এই ধরনের মেয়েরাই প্ৰকৃত সুখী হয়।স্বামী হয়তো শোবার আগে মিষ্টি করে একটা কথা বলবে, এতেই আনন্দে এমেয়ের চোখ ভিজে উঠবে। সমস্ত দিনের গ্লানি ও বঞ্চনার কথা মনে থাকবে না। শুধু মনে হবে তার চেয়ে সুখী এ-পৃথিবীতে কেউ নেই।বাচ্চা ছেলেটা ঘুমের মধ্যেই হাসছে। কী অপূর্ব দৃশ্য। ঠোঁটের কোণে বিসকিটের গুঁড়ো লেগে আছে। যেন কেউ চন্দন মাখিয়ে দিয়েছে। আর হাসছে কী মিষ্টি করে। অপূর্ব কোনো স্বপ্ন দেখছে হয়তো। শিশুদের স্বপ্ন কেমন হয় কে জানে।

এই সুন্দর হাসির একটা স্কেচ করে রাখলে কেমন হয়? পেনসিল আছে না ফুরিয়ে গেছে নিশাত মনে করতে পারছে না। আজকাল ছবি আঁকাই হয় না। কোন জিনিসটি আছে কোনটি নেই কে জানে! বেশ কিছু চারকোল ব্লক এক বার ব্যাংকক থেকে নিয়ে এসেছিল। ইচ্ছা ছিল প্রচুর চারকোল ড্রইং করবে। একটিও করা হয় নি। ছবি আঁকার ইচ্ছা হয়েছে, আঁকা হয় নি। কোনো ইচ্ছাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটাও হবে না। কাগজ এবং পেনসিল নিয়ে বসবার পর হয়তো আর আঁকতে ইচ্ছা করবে না। অদ্ভুত একধরনের আলস্য বোধ হবে। বাচ্চা ছেলেটি এখনো ঠোঁট বাঁকিয়ে আছে। কী বিশ্রী একটা নাম! এই যুগের ছেলেদের কত সুন্দর-সুন্দর নাম রাখা হচ্ছে—অয়ন, মৌলী, নাবিল, তা না—পল্টু। ছিঃ! পুষ্পকে বলতে হবে নামটা বদলে দিতে। দরকার হলে সে নিজে সুন্দর একটা নাম খুঁজে দেবে। টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। বাচ্চাটার আবার ঘুম না ভেঙে যায়। নিশাত ছুটে গিয়ে টেলিফোন ধরল। কলাবাগান থেকে মা টেলিফোন করেছেন।

নিশাত কথা বলছিস? হ্যাঁ মা।তুই আজ সন্ধ্যায় আসতে পারবি? আমি তো ভাবছিলাম এখুনি আসব।চলে আয়। গাড়ি পাঠাতে পারব না, তোর বাবা নিয়ে গেছেন।গাড়ি লাগবে না মা।তোর গলাটা এমন ভারি-ভারি শোনাচ্ছে কেন? জানি না মা।তোর কি কোনো ব্যাপারে মন খারাপ? হুঁ।কি হয়েছে? জহিরের সঙ্গে ঝগড়া? না, ওর সঙ্গে আমার কখনন ঝগড়া হয় না। তোমাকে বলেছিলাম না, বিয়ের সময় আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কখন ঝগড়া করব না? স্ট্যাম্পের উপর সই করে প্রতিজ্ঞা।তা হলে মন খারাপ কেন? তা তো মা জানি না। মাঝে-মাঝে আমার এরকম হয়। সন্ধ্যাবেলা আসতে বছ। কেন? কি ব্যাপার? তোর বাবার কাণ্ড! বিরাট এক পাঙ্গাশ মাছ কিনে এনেছে। খুব নাকি ফ্রেশ মাছ। সবাইকে নিয়ে খাবে।বাবা এমন খাই-খাই করে কেন বল তো মা?

জানি না। একেক বার এমন বিরক্ত লাগে। কিছুক্ষণ আগে ঐ মাছের ছবি তোলা হল।মা শোন, কয়েকটা সুন্দর দেখে ছেলের নাম দিও তো! কেন রে? আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের দেবশিশুর মত একটা ছেলের নাম রেখেছে পল্টু। নামটা পাল্টাব।তুই এখনো পাগলী হয়েই রইলি।নিশাতের মা খুব হাসতে লাগলেন। নিশাতও হাসছে। বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে গেছে। প্রথমে সে কাঁদবার উপক্রম করেছিল, এখন মত পাল্টে হাসিতে যোগ দিয়েছে। খুব হাসছে।রাত আটটা বাজতেই পুষ্পর ঘুম পেয়ে যায়। নটার দিকে সেই ঘুম এমন হয় যে, সে চোখ মেলে রাখতে পারে না। ঘুম কাটানোর কত চেষ্টা সে করে। কোনোটাই তার বেলায় কাজ করে না। অথচ রকিব রোজ ফিরতে দেরি করে। আজও করছে।এখন বাজছে নটা তেত্রিশ। আজ বোধহয় দশটাই বাজাবে। পুষ্প চোখে পানি দিয়ে। এল। জিভে লবণ ছোঁয়াল। জিভে লবণ ছোঁয়ালে নাকি ঘুম কাটে। তার কাটছে না। আরো যেন বাড়ছে।

রকিব ফিরল দশটায়। বিরক্ত মুখে বলল, কী যে তোমার ঘুম, আধঘন্টা ধরে বেল টিপছি। তাড়াতাড়ি গোসলের পানি দাও। পুষ্প ঘুম-ঘুম চোখে রান্নাঘরে ছুটে গেল। প্ৰচণ্ড গরমেও রকিবের গোসলের পানিতে এক কেতলি ফুটন্ত পানি ঢালতে হয়। একটু ঠাণ্ডা পানি গায়ে লেগেছে কি লাগে নি, লোকটির ঠাণ্ডা লেগে যায়। খুখুক কাশি, গলা ব্যাথা। কী অদ্ভুত মানুষ।রকিব বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করল না। রকিবের স্বভাব হচ্ছে গোলস করতে-করতে খানিকক্ষণ কথা বলা। বাথরুমের দরজা খোলা এই কারণেই। পুষ্পের এটা ভালো লাগে না। বলেছেও কয়েক বার।

রকিব কান দেয় নি।

পুষ্প, বাড়ি একটা পাওয়া গেছে।

তাই নাকি?

দুটো রুম। নেট দেওয়া বারান্দা। গ্যাস ইলেকট্রিসিটি দুই-ই আছে।

ভাড়া কত?

কম। খুবই কম।

কত?

আন্দাজ কর তো দেখি?

পনের শ?

রকিব মনের আনন্দে খানিকক্ষণ হাসল। যেন সে মজা পাচ্ছে।

বল না কত?

বার। ওনলি টুয়েলভ হাড্রেড।

সত্যি?

হুঁ। একটা সমস্যা আছে। সাময়িক সমস্যা। ফর দা টাইম বীইং একটু অসুবিধা হবে। ধর তিন-চার মা। তার পরই সমস্যার সমাধান।সমস্যাটা কী? পানির কানেকশন দেয় নি। মাস তিনেক লাগবে। ওয়াসার ব্যাপার।পুষ্প অবাক হয়ে বলল, পানি ছাড়া চলবে কীভাবে? সব ঠিক করে রেখেছি। একটা ড্রাম কিনে ফেলব। লোক রাখব। ঠিকা লোক। তার কাজই হবে সকালবেলা ড্রাম ভৰ্তি করে দেওয়া। এক ড্রামের বেশি পানি তো আমাদের লাগবে না।পুষ্প ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এক বার ভাবল বলবেপানি-ছাড়া বাড়িতে যাব না। বলল না, কারণ বললেই চেঁচামেচি শুরু করবে। রাতে হয়তো ভাতও খাবে না। ধীরেসুস্থে বললেই হবে। পুষ্প খাবার বাড়তে শুরু করল। খাবারের আয়োজন খুবই খারাপ। ডাল চচ্চড়ি আর ভর্তা।

পুষ্প বলল, আস্তে আস্তে খাও। আমি চট করে একটা ডিম ভেজে আনি।ডিম লাগবে না। এতেই হবে।না, হবে না।তা হলে ঐ সঙ্গে দুটো শুকনো মরিচ ভেজে আনবে।রকিবের চোখ উজ্জ্বল। বাড়ির সমস্যা মিটে গেছে, এই আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছে। সে ভাত মাখতে-মাখতে বলল; পানির এত দরকারও আমাদের নেই। মরুভূমিতে লোকজন কী করে? এক গ্রাস পানি হলে তাদের তিন দিন চলে যায়।আমরা তো আর মরুভূমিতে থাকি না।তা না থাকলাম। তাই বলে অপচয় করব?

পুষ্প এক সময় বলল, তোমার বন্ধু মিজান সাহেবকে বল না, উনি যে এক বার বলেছিলেন বাড়ি দেখে দেবেন।ওর কথা বাদ দাও। এক শ ধান্ধায় থাকে। ঝোঁকের মাথায় বলেছিল, এখন হয়তো মনেও নেই।তবু এক বার বলে দেখা আচ্ছা বলব। বাসায় চা খেতে এক দিন ডাকব। তখন মনে করিয়ে দিলেই হবে। লাভ হবে না। ঢাকা শহরে দুই হাজারের নিচে বাড়ি নেই। এটা হয়ে গেছে বড়লোকের শহর।

 

Read more

প্রিয়তমেষু পর্ব:০২ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *