রাক্ষুসে পাথর
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বুড়াে মাঝি বললাে, বাবু, বেড়াতে এসেছেন, বেড়িয়ে ফিরে যান। ঐ দ্বীপে। যাবেন না। এখানে দোষ লেগেছে।
আমরা একটু অবাক হলুম। দোষ লেগেছে মানে কী? দ্বীপের আবার দোষ লাগে কী করে?
বিমান বললাে, বুড়াে কর্তা, তুমি যা টাকা চেয়েছে, তাই দিতে আমরা রাজি হয়েছি। তবু তুমি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে না কেন? ঐ দ্বীপে কি আছে? বুড়াে মাঝি তার সাদা দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বললাে, কিছুই নেই। সেই কথাই তাে বলছি। শুধু শুধু ওখানে গিয়ে কী করবেন?
বুড়াে মাঝি হাল ধরেছে, আর দাঁড় বাইছে নাতি। এই নাতির বয়স তত চোদ্দ বছর হবে, ওর নাম সুলেমাম। সে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বুড়াে মাঝি যতই না বলছে, ততই আমাদের জেদ চেপে যাচ্ছে। একটা সাধারণ দ্বীপ, সেখানে কি এমন ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে? কত জাহাজ যাচ্ছে এখান দিয়ে, সে রকম কিছু থাকলে সবাই জানতে পারত।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
হলদিয়াতে বিমানের দাদা চাকরি করে। আমি আর বিমান কয়েক দিনের জন্য এসেছি এখানে বেড়াতে। হলদিয়া জায়গাটা বেশ সুন্দর। নতুন বন্দর নতুন শহর গড়ে উঠেছে। চারদিকে সই নতুন নতুন বাড়ি আর অনেক ফাঁকা জায়গা। শহরটার একদিকে গঙ্গা আর একদিকে হলদি নদী।
সকালবেলা নদীর ধারে জেলেরা মাছ বিক্রি করতে আসে। আমরা সেই মাছ কিনতে গিয়েছিলম। ঘাটে অনেকগুলাে নৌকো বাঁধা। নৌকো দেখেই আমাদের মনে হলাে, একটা নৌকো ভাড়া করে নদীতে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়। একজন মাঝিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রাজি হয়ে গেল। তিরিশ টাকা দিলে সে যতক্ষণ ইচ্ছে আমাদের ঘুরিয়ে আনবে।
আমি আর বিমান দু’জনেই সাঁতার জানি, সুতরাং আমাদের জলের ভয় নেই। বিমান তাে সুইমিং কমপিটিশনে অনেকবার প্রাইজ পেয়েছে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমি আগেই শুনেছিলাম যে হলদিয়ার কাছে একটা দ্বীপ আছে, তার নাম আগুনমারির চর। আগে সেই চরটা মাঝে মাঝে জেগে উঠতাে। এখন আর তােবে
এখন সেখানে গাছপালা জন্মে গেছে। কোনাে মানুষজন অবশ্য সেখানে এখনাে থাকে না।
নৌকো দেখেই আমার ঐ দ্বীপটার কথা মনে এসেছিল। নতুন দ্বীপ মানেই তাে নতুন দেশ। ওখান থেকে ঘুরে এলেই একটা নতুন দেশ দেখা হয়ে যাবে। অনেকদিন বাদে, যখন ঐ দ্বীপেও অনেক ঘরবাড়ি হয়ে যাবে, কলকারখানা বসবে, তখন আমরা বলবে, জানাে, যখন আমরা আগুনমারিতে গিয়েছিলুম তখন এসব কিছুই ছিল না, শুধু গাছপালা আর …।
গাছপালা ছাড়া আর কী আছে সেই দ্বীপে। বুড়াে মাঝি ভয় পাচ্ছে কেন?
নৌকোয় চড়বার সময় মাঝিদের কক্ষনাে চটাতে নেই। সেইজন্য আমি অনুনয় করে বললুম, ও বুড়াে কর্তা, বলাে না সেখানে কী আছে? কেন আমাদের যেতে বারণ করছাে ? | বুড়াে মাঝি বললাে, কিছু নেই তাে বলছি গাে বাবু, শুধু কয়েকটা গাছ আর || বালি। আর ঐ শামুক ঝিনুক ভাঙা।
নিমান বললাে, তাহলে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে চাইছে না কেন? সেখানে কি ভয়ের কিছু আছে?
বুড়াে মাঝি বললাে, আকাশে মেঘ দ্যাখাে না বাবু, এখন আর অতদূরে যাওয়া ঠিক নয়। এই কিনারায় কিনারায় থাকা ভালাে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিমান বললাে, তুমি কি আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছাে? সামান্য মেধ, এতে কখনাে ঝড় ওঠে? তুমি আমাদের নিয়ে যেতে চাওনা তাই বলাে!
আমি বুড়াে মাঝির নাতিকে জিজ্ঞেস করলুম, সুলেমান তুমি গেছাে সেই দ্বীপে? সেখানে ভয়ের কিছু আছে? সুলেমান দাদুর দিকে তাকালাে একবার। তারপর বললাে, ভয়ের কিছু নেইকো। অন্য কিছু দেখা যায় না। তবে সেখানে গেলি মনটা কেমন কেমন করে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।
এ তাে আরও অদ্ভুত কথা, একটা দ্বীপে গেলে মন খারাপ হয়ে যাবে? আমি আর বিমান দুজনেই হেসে উঠলুম। তা হলে তাে যেতেই হবে সেখানে।
বুড়াে মাঝিকে বললাম, তুমি যদি না যেতে চাও তাে আমাদের ফেরত নিয়ে চলাে। আমরা অন্য নৌকো ভাড়া করব।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বুড়ো মাঝি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাে, আপ্লদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি সে টাকা ফেরত দেওয়া পাপ। তবে চলেন নিয়ে যাই। পরে যেন আমাকে দোষ দেবেন না। ওরে সুলেমান ভালাে করে টান। | আকাশে মেঘ আছে বটে কিন্তু জমাট কালাে নয়। সেই মেঘের ছায়া পড়েছে জলে। বােদ নেই, কেশ ছায়া ছিল। নদীতে বড় বড় ঢেউ। এখানে নদী প্রায় সমুদ্রের মত। এপার ওপার দেখাই যায় না। পাশ দিয়ে জাহাজ কিংবা স্টিমার গেলে আমাদের নৌকোটা দুলে দুলে উঠছে। | খানিকক্ষণ পরে বুড়াে মাঝি ডান দিকে হাত তুলে বললাে, ঐ যে দেখেন, আগুনমারির চর। দেখলেন তো?
আমি আর বিমান দু’জনেই ঘাড় ফেরালুম। মনে হলাে নদীর বুকেই যেন || কয়েকটা গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি দেখা যাচ্ছে না।বুড়াে মাঝি বললে, দেখা হলাে তাে? এবারে নৌকো ঘােৱাই ?
আমি আর বিমান একসঙ্গে বলে উঠলুম, সে কি আমরা কাছে যাবাে না।
কাছে গিয়ে আর কি করবেন? আর তাে দেখার কিছু নাই। বিমান এবারে বেশ রেগে গিয়ে বললাে, তােমার মতলব কি বলাে তাে, বুড়াে || কর্তা? ঐ দ্বীপে কি তােমার কোনাে জিনিষপত্তর আছে? ওখানে আমাদের যেতে
দিতে চাও না কেন? বুড়াে মাঝি আমতা আমতা করে বললাে, দেখা তাে হলােই, আরও কাছে গিয়ে লাভটা কী।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিমান বললাে, লাভ-লােকসানের কথা নয়। আমরা ঐ দ্বীপে নেমে হাঁটতে চাই। | বুড়াে মাঝি এবারে খুব জোরে হাল থােরাতেই নৌকোটা তরতরিয়ে এগিয়ে গেল। দ্বীপটার একেবারে কাছে পৌছে নৌকোটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বুড়াে বললাে, এবারে নামুন।
সেখানটায় অন্তত এক হাঁটু জন। তারপর কাদামাটি। বিমান বললাে, আর একটু এগােও, এখানে নামবাে কি করে ?
বুড়াে মাঝি এবার রাগে গড়গড়িয়ে বললাে, আপনাদের বাবু এখানেই নামতে হবে। আমার নৌকো ঐ চরের মাটি ছোঁবে না। ও মাটি অপয়া। | বিমান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি বললাম ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা এখানেই নামবাে।
জুতাে খুলে রাখলুম নৌকোয়। তারপর হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লুম জলে। ছপ ছপ করে এগিয়ে গেলুম দ্বীপটার দিকে। বুড়াে মাঝি নৌকোটাকে আরাে গভীর জলের দিকে নিয়ে গিয়ে ঝপাং করে নােঙর ফেলে দিল।
দ্বীপটাতে ছাড়া ছাড়া গাছপালা রয়েছে। তারপর ধূ ধূ করছে বালি। সেই বালিতে কোথাও কোথাও ঘাস হয়েছে। একটা খড়ের চালাঘরও রয়েছে একপাশে। সেই ঘরে কিন্তু কোনাে মানুষ নেই।
কাদা মাখা পায়ে ওপরে উঠে আমরা বালিতে পা ফসে নিলুম। বিমান বললাে, একটা কিছু ফ্ল্যাগ নিয়ে এলে হতাে। তাহলে সেই ফ্ল্যাগটা পুঁতে আমরা এই দ্বীপটা দখল করে নিতুম।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমি বললুম, তা কী করে হবে। আগেই তাে এখানে মানুষ এসেছে। দেখছিল , ঘর রয়েছে।
আমরা ঘরটার কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মধ্যে পাতা আছে একটা খাটিয়া। আর চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে শুকনাে গােবর। জায়গাটায় বিচ্ছিরি গন্ধ।
বিমান বললাে, এখানে লােকেরা গরু চরাতে আসতে। কিন্তু গরুগুলােকে নিয়ে আসতে কি করে?
আমি বললুম, বড় বড় নৌকোয় করে নিয়ে আসতাে। আমি নৌকোয় গরু মােষ পার করতে দেখেছি।তারা এখন আর আসে না কেন?
বর্ষাকাল এসে গেছে, সেইজন্য এখন আসে না। এতাে সােজা কথা। – দ্বীপটা কী রকম চুপচাপ লক্ষ্য করছিস? কোনাে শব্দ নেই। – মানুষজন নেই, শব্দ হবে কি করে? তবু আমি কিন্তু একটা শব্দ শুনতে ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প পাচ্ছি। কান পেতে শােন। দুজনেই চুপ করে দাঁড়ালুম।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সত্যি খানিকটা দূরে গাছপালার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে একটা ফোস ফোস শ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলছে খুব জোরে। কোনাে মানুষ অবশ্য অত জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। বিমানের মুখটা শুকিয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বললাে, ওটা কিসের শব্দ বলতাে সুনীল ? সাপ নাকি?
আমি বললুম, সাপ অত জোরে ফোস ফোস করে?
– সমুদ্রে বড় বড় অজগর সাপ থাকে শুনেছি। সমুদ্র থেকে যদি এখানে চলে অসে, ঐ জন্যই বােধহয় মাঝিরা এখানে আসতে ভয় পায়। | – একটা অজগর সাপ থাকলে সেটাকে মেরে ফেলতে পারতাে না? চল,
এগিয়ে গিয়ে দেখি। | – সঙ্গে লাঠি ফাঠি কিছু একটা আনলে হতাে।
— ভয় পাচ্ছিস কেন, বড় সাপ তাে আর তাড়া করে এসে কামড়াতে পারে
ডান দিকে খানিকটা দূরে দু’তিনটে বড় বড় গাছের পাশে কিছুটা ঝােপ ঝাড়ের মতন। শব্দটা আসছে সেদিক থেকেই।
আমরা গুটি গুটি পায়ে এগােলুম সেদিকে। শব্দ মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে। কাছাকাছি গিয়ে আমিই ভয় পেয়ে বিমানের হাত চেপে ধরলাম। ঝােপের মধ্যে কী যেন বিশাল একটা জন্তু রয়েছে।
বিমান বললাে, ওটা তাে একটা মােষ। কাত হয়ে শুয়ে আছে। | এবারে আর একটু এগিয়ে আমরা মােষটার মাথাটা দেখতে পেলাম। দেখলেই বােঝা যায়, মােযটা মরে যাচ্ছে। মােযটার দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। ওরকম করুণ চোখ আমি কখনাে দেখিনি। মােযটা মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন তার পেটটা ফুলে উঠছে। ঐটুকুতেই বােঝা যায় যে ও বেঁচে আছে।
আমি বললুম, এত বড় একটা মােষ … কী হয়েছে ওর? সাপে কামড়েছে? বিমান বললাে, অসুস্থ হতে পারে। মােষেরাও তাে অসুস্থ হয়।
– কিন্তু কোন লােকজন নেই ? একলা একলা একটা মােষ এখানে পড়ে আছে?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মােষের মালিক বুঝতে পেরেছে, ও আর বাঁচবে না। সেইজন্য একে ফেলে রেখে চলে গেছে।
আমরা আর ঝােপটার মধ্যে না ঢুকে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। যতবার মােষটার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি, ততবার মন খারাপ লাগছে।
বিমান বললাে, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস, এখানে গাছের পাতাগুলাে কেমন যেন শুকনাে শুকানাে। এখন বর্ষাকালে তাে গাছের পাতা শুকিয়ে যায় না।
আমি বললুম, গাছগুলাের ছাল খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। এখানে তাে জল নােনা, তাই বােধহয় গাছের স্বাস্থ্য ভালাে থাকে না। | বিমান বললাে, বাজে কথা বলিস না। সুন্দরবনে অত গাছ রয়েছে না? সেখানকার জল তাে আরও বেশি নােনা। এখানকার গাছগুলাের বােধহয় কিছু একটা রােগ হয়েছে। এটা কী রে?
– ওটা তাে একটা পাথর। -আশ্চর্য তাে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! – কিসের আশ্চর্য ? —তুই বুঝলি না? গঙ্গানদীর দ্বীপে পাথর আসবে কি করে? –কেন?
– এখানে কি কোথাও পাথর আছে? এদিকে কি কোথাও পাহাড় আছে? এখানে এত বড় একটা পাথর কে নিয়ে আসবে?
পাথরটা এমনিতে খুবই সাধারণ। একটা মাঝারি ধরণের আলমারির সাইজের। যে-কোন পাহাড়ী জায়গায় গেলে এরকম পাথরের চাই পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু নদীর ওপরে একটা নতুন দ্বীপে ওরকম পাথর তাে দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক নয়।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমরা পাথরটার কাছে গেলুম। সেটার গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে। আমি পাথরটার গায়ে হাত দিয়ে বললুম, সমুদ্রের তলায় অনেক জায়গায় ভুবাে পাহাড় থাকে। হয়তাে গঙ্গার এখানটাতে ডুবাে পাহাড় আছে। দ্বীপটা তরী হবার সময় পাথরটা উঠে এসেছে।
বিমান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললাে, তাের কি বুদ্ধি : পাথর কি বাচ্চা জিনিস যে জলের উপরে ভেসে উঠবে? তাছাড়া দ্যাখ, এর তলায় কিছু ঘাস চাপা পড়ে আছে। এই দ্বীপটা হবার পরে কেউ পাথরটা এখানে এনেছে। কিন্তু শুধু শুধু কেন এত বড় একটা পাথরকে এখানে বয়ে আনবে ?
আমি পাথরটার গায়ে হাত বুলাতে বুলােত বললুম, উল্কা নয় । অনেক সময় উল্কার টুকরাে পৃথিবীতে এসে পড়ে – বলতে বলতে আমি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলুম। বিমান দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাে, কী হলাে, সুনীল?কী হলাে তাের?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলুম। আমিও অবাক হয়ে গেছি খুব। কী হলাে কিছুই বুঝতে পারছিনা। এরকম তাে আমার কখনাে হয় না।
বিমান আমায় ঝাকুনি দিয়ে বলতে লাগলাে, কী হলাে রে,কী হলাে?
আমি বললুম, জানি না। হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে গেল।
-চুপ করে বসে থাক, উঠিস না।
আমার কিছু হয়নি। – তবু বসে থাক। একটা জিনিস দ্যাখ, সুনীল, এই পাথরের নিচের ঘাসগুলাে দ্যাখ? কেমন যেন খয়েরি হয়ে গেছে। ঘাস চাপা পড়লে হলদে হয়ে যায়, কিন্তু খয়েরি ? তুই কখনাে খয়েরি ঘাস দেখেছিস?
— এ বােধহয় অন্য জাতের ঘাস।
—পাশের এই গাছটা দ্যাখ। এই গাছটার গাটা লাল। আমি লাল রঙের গাছ কখনাে দেখিনি।
বিমান, ঐ যে মােযটা মরে যাচ্ছে, ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে রে! এমনি এমনি একটা মােৰ মরে যাচ্ছে ইস! | মােযটাকে ওর মালিক কেন যে ফেলে গেল।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিমান, আমার ইচ্ছা করে এখানে শুয়ে পড়তে। -মন্দ বলিসনি। এখানে খানিকক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলে বেশ হয়।
যদি নৌকোটা চলে যায় ?
-ইস, গেলেই হলাে, পুরাে পয়সা দিয়েছি না। তাছাড়া যদি যায় তােত চলে যাক। আমরা এখানেই থেকে যাবে। | হঠাৎ আমি লাফিয়ে উঠে পড়লুম। দারুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলুম, বিমান, বিমান, এই পাথরটা জ্যাস্ত।
বিমান বললাে, কী বলছিস? তাের মাথা খারাপ হয়ে গেছে? -না রে, আমি সত্যি দেখলুম। পাথরটা নড়ে উঠল। -কী বলছি যাত। পাথরটা নড়বে কি করে? – আমি স্পষ্ট দেখলুম, পাথরটার পেটের কাছে একবার যেন চুপসে গেল,আবার ফুলে উঠলাে। ঠিক ব্যাঙের মতন। -দূর। পাথরের আবার পেট কী? তুই ভুল দেখেছিস। -মােটই ভুল দেখিনি। বিমান গিয়ে পাথরটার গায়ে হাত দিতেই আমি বিমানের অন্য হাতটা ধরে এক হ্যাচকা টানে সরিয়ে আনলুম ওকে। আমার বুকের মধ্যে দুম দুম আওয়াজ হচ্ছে। ঐ পাথরটার গায়ে হাত দিয়েই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম। ঐ। পাথরটার কিছু একটা ব্যাপার আছে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
দূরে শুনতে পেলুম বুড়াে মাঝি আর সুলেমান চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে, বাবু। আমি বললুম, চল, বিমান নৌকোয় ফিরে যাই। বিমান বললাে না- এক্ষুণি যাবাে না। এখানে শুয়ে থাকবাে বললুম যে।
, আমার মােটেই ভালাে লাগছেনা। চল, নৌকোয় ফিরে যাই। বিমানকে প্রায় জোর করেই আমি টানতে টানতে নিয়ে চললুম। তারপর নৌকোয় উঠেই বুড়াে মাঝিকে বললুম, চলাে, শিগগীর চলাে।
নৌকোয় উঠে বিমান লম্বা হয়ে শুয়ে রইলাে। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। ভাঙ্গা গলায় বলল, আমার কিছুই ভালাে লাগছে না রে।।
সুলেমান আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ঐ দ্বীপে গেলে তােমাদের কী হয় বলাে তাে?
সুলেমান বললাে, কী জানি বাবু, ওখানে গেলেই মনটা কেমন কেমন করে। কাজ করতে ইচ্ছে করে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।।
বুড়াে মাঝি বললাে, বাবু, আগে তাে আমরা ঐ চরে যেতাম। বেশি ঝড় বৃষ্টি হলে ওখানে নৌকো বেঁধে চালা ঘরটায় বসে জিবরাম। অনেক লােক আগে ওখানে গরু-মােহষ চরাতে আসতো। এখন আর কেউ যায় না।
-কেন যায় না বলে তাে?
ওখানে গেলেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গরু-মােষগুলােও আলসে হয়ে পড়ে। কেমন যেন মনমরা লাগে।
আমাদেরও সেই রকমই লাগছিল। কিন্তু কেন হয় ওরকম বলাে তো? –কী জানি গাছপালালাে কেমন ও শুকিয়ে যাচ্ছে দেখলে না? ও দ্বীপে খারাপ নজুৰ লেগেছে।
ওখানে একটা বড় পাথর আছে দেখেছাে? আগে ওটা ছিল? -না, আগে ছিল না। এই তাে মাসখানেক ধরে দেখছি।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কী করে পাথরটা ওখানে এলাে? —কেউ তা জানে না। কেউ কেউ বলে ওটা আকাশ থেকে খসে পড়েছে।
আমার মাথাটা এখনও দুর্বল লাগছে। আমি আর কথা বলতে পারলাম না। শুয়ে পড়লুম বিমানের পাশে।
হলদিয়ায় ফিরে এসে আমরা দুজনেই সােজা চলে গেলুম বিছানায়। রাত্তিরে কিছু খেতেও ইচ্ছে করলাে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলুম। তার মধ্যে বারবারই দেখতে লাগলুম সেই পাথরটাকে। ঠিক একটা ব্যাঙের মতাে তার পেটটা একবার চুপসে যাচ্ছে। একবার ফুলছে। একটা জ্যান্ত পাথর। আমি শিউরে শিউরে উঠতে লাগলুম।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সকালবেলা বিমানের দাদা স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, তােদের কাল কী হয়েছিল? সন্ধে থেকে খালি ঘুমােচ্ছিলি?
স্বপনদাকে সব কথা বলতেই হলাে। স্বপনদা সবটা শুনে হাে হাে করে হেসে উঠে বললেন, গাঁজাখুরি গল্প বলার আর জায়গা পাসনি। একটা জ্যান্ত পাথর … সেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মন খারাপ হয়ে যায়, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। দূর! যত সব।
বিমান বললাে, দাদা আমি পাথরটাকে নড়তে দেখিনি। সুনীল দেখেছে। কিন্তু আমারও ওখানে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল।
—বেশ করছিল। শুয়ে থাকলেই পারতিস।
তাহলে আমাদেরও নিশ্চয়ই ঐ মােষটার মতন অবস্থা হতাে। আমি বললাম, স্বপনদা, নৌকোর মাঝিরাও কেউ ঐ দ্বীপটায় এখন যেতে চায় | । ওরাও ভয় পায়। পুলিশে একটা খবর দেওয়া দরকার।
স্বপনদা বললেন, পুলিশও তােদর কথা শুনে আমার মতন হাসবে। দেখবি, মিঃ দাসকে ডাকবাে?
হলদিয়ার এস ডি পি ও মিঃ দাস স্বপনদার বন্ধু। স্বপনদা তাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠালেন। বললেন, মিঃ দাস, একবার আমার বাড়িতে চলে আসুন, কোশ্লস্ট খেয়ে যাবেন। আর এটা মজার গল্প শােনাবাে। দশ মিনিটের মধ্যেই মি দাস এসে গেলেন। তিনি বললেন, শুধু এক কাপ । বে। বড় কাজ পড়ে , এক্ষুণি যেতে হবে। কাল রাত্তিবে একটা লঞ্চ —..
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
স্বপনদা বললেন, বসুন, বসুন। কাল দুপুরে এই দুই শ্ৰীমান নৌকো ভাড়া করে গিয়েছিল আগুনমারির চরে। সেখানে নাকি ওদের এক সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওরা দুজনে–
স্বপনদাকে থামিয়ে দিয়ে পুলিশ সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তােমরা দু’জনে কাল আগুনমারির চরে গিয়েছিলে? আশ্চর্য ব্যাপার ঐ দ্বীপটার পাশেই তাে কাল রাত্তিরে লঞ্চটা ডুবেছে। ঝড়বৃষ্টি কিছু নেই। শুধু শুধু একটা লঞ্চ ডুবে যাওয়া খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।
স্বপনদা জিজ্ঞেস করলেন, কেউ মারা গেছে?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পুলিশ সাহেব বললেন, নাঃ। মরেনি কেউ। সবাইকে উদ্ধার করা গেছে। আমাদের পুলিশের লঞ্চ খুব তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছােয়। কিন্তু লঞ্চটা যে কী করে ডুবলাে তা ওরা কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারছে না। সবাই বলছে, কী যেন হলাে কিছুই জানি না। হঠাৎ একটা ধাক্কাতে লঞ্চটা কেঁপে উঠলাে, তারপরই হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকতে লাগলাে।
স্বপনদা বললেন, লঞ্চটা একদম ডুবে গেছে বলতে চান?
পুলিশ সাহেব বললেন, হ্যা। সেটা ভােলার ব্যবস্থা করতে হবে। ঐ লঞ্চের একজন খালাসি শুধু অদ্ভুত একটা গল্প বলছে। আগুনমারির চর থেকে একটা মস্ত বড় পাথর নাকি উড়ে এসে প্রচন্ড জোরে লঞ্চটাকে ফুটো করে দেয়। এরকম গাঁজাখুরি কথা কেউ শুনেছে? গঙ্গার ওপরে দ্বীপ। সেখানে পাথর আসবে কী করে? যদি বা পাথর থাকে, সেটা কেউ না ছুঁড়লে এমনি এমনি উড়তে উড়তে আসবেই বা কী করে? | স্বপনদা বললেন, এরাও ঐ দ্বীপে একটা বড় পাথর দেখেছে বলছে।
পুলিশ সাহেব বললেন, ভােৱবেলা আমি আমার লঞ্চে সেই দ্বীপটা ঘুরে দেখে এসেছি। সেখানে পাথর টাথর কিছু নেই। মানুষজনের কোন চিহ্ন নেই। শুধু একটা মরা মােষ রয়েছে দেখলুম।
আমি আর বিমান চোখাচোখি করলুম। আগুনমারির চরের পাথরটাই যে | লঞ্চটাকে ডুবিয়েছে তাতে আমাদের কোনাে সন্দেহ নেই।
লােকসান না লাভ?
ও আশাপূর্ণা দেবী একেই বলে ললাটলিপি।
কবে থেকে ঠিক হয়েছিল এবার পুজোয় গ্যাংটক। পরপর দু’বছর সমতলে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে, এবারে পাহাড় চাই।।
এই চাওয়াটি অবশ্য নীতু আর পিতু দুই ভাইবােনের। ক’বছর আগে একবার দার্জিলিংয়ে যাওয়া হয়েছিল তখনই ওরা গ্যাংটক গ্যাংটক করেছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। বাবার ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
এবার ওরা নাছােড়। নীতুর বাবা বলেছিলেন, এত দেশ থাকতে গাাংটক! কী যে মাথায় চাপে তােদের।তাহলেও রাজি হয়েছিলেন।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সমস্ত ঠিক। হােটেল বুক করা টিকিট কেনা সব প্রস্তুত, হঠাৎ বাবা অফিস। থেকে ফিরে বলে উঠলেন গ্যাংটক যাওয়া হবে না।
হবে না মানে। নীতুর মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল আর পিতু বসেই পড়ল।
-ও বাপী হবে না মানে? – হবে না মানে হবে না। ওদিকে এখন দারুণ গােলমাল চলছে। নীতু পিতুর মাও প্রায় বসে পড়ে বললেন, অফিসের লােক বলেছে বুঝি? তাই একেবারে বেদবাক্য।
– শুধু অফিসের লােক কেন, দেশসুদ্ধ সবাই বলবে। কাগজ পড়ছ না ? দেখছনা কী হচ্ছে ওদিকে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কাগজে অমন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে। যাবার জন্যে পা বাড়ানাে, আর এখন বলে বসলে যাওয়া হবে না। গেলে দেখবে তেমন কিছুই গােলমাল নেই।।
নীতু পিতু অবশ্যই মায়ের সমর্থক। কিন্তু ভাগ্য ওদের সমর্থক নয়।
পরদিনই ওদের সেই সিট বুক করে রাখা গ্যাংটকের হােটেল থেকে একটি টেলিগ্রাম এসে হাজির ঃ খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি ~ অনিশ্চিতকালের জন্যে আমাদের হােটেল বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। অতএব আপনারা …
অর্থাৎ পৌঁছে গেলে যাতে না অসুবিধেয় পড়তে হয় খদ্দেরকে, তাই এই অগাধ বিবেচনা।
নীতুদের বাবা বললেন, বলতেই হবে লােকটা খুব ভদ্র। নীতু পিতু আড়ালে এসে বলল, বলতেই হবে লােকটা অতি অভদ্র। কিন্তু সে তো হল। এখন কিংকর্তব্য?
ছুটি শুরু হতে তাে মাত্র তিনটি দিন। এর মধ্যে নতুন আর একটা জায়গায় যাওয়ার কথাই ওঠে না। টিকিট কোথায়? গিয়ে ওঠা হবে কোথায়? বলে দেড় দু’মাস আগে থেকে এসব ব্যবস্থা করতে হয়। এখন নাে হােপ।
কিন্তু তাই বলে কোথাও যাওয়া হবে না?
বিজয়বাবু, মানে নীতুদের বাবা বললেন, তবে আর কী হবে? তােমরা | চন্দননগরে গিয়ে ছুটিটা কাটিয়ে এস –আমি যা হােক করে চালিয়ে নেব।
চন্দননগরে নীতুদের মামার বাড়ী।
নীতুদের মা রেগে বললেন, আহা, মা, বাবা, পিসিমা …., আগে থেকে বেনারসে গিয়ে বসে আছেন না? চন্দননগরে কার কাছে যাব?
ওহহা তাও তাে বটে।
মিনিট খানেক টেবিলের ওপর আঙুলের টোকা মেরে বিজয়বাবু বলে উঠলেন, তাহলে এক কাজ করা যাক, ছুটিটা গাড়িতে কাটিয়ে আসা হােক।
– গাডি। — গাড়ি।
— হা গাডিই। কেন নয়? ওখানে যেতে ট্রেনের টিকিট, রিজার্ভেশন এত সব চিন্তা করতে হবে না, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে। আর কোথায় গিয়ে ওঠা হবে তারও চিন্তা নেই। নিজেদের বাড়ি রয়েছে। যাওয়া তাে হয় না সাতজন্মে। েতরা তত জীবনে দেখিস নি।
হ্যা, নিজেদের বাড়িই।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নীতু পিতুর পরলােকগত ঠাকুর্দা না কি ওই ‘গানুডি’ নামের একদা দেহাতি জায়গায় একদা একখানা বিরাট বাড়ি বানিয়ে বসেছিলেন মাঝে মাঝে হাওয়া বদলাতে যাবেন বলে। কিন্তু ভদ্রলােকের ভাগ্যে বেশি বার আর হাওয়া বদলাতে যাওয়া হয়নি সেখানে অনেক দূরে চলে যেতে হল।
শেষে যখন গিয়েছিলেন সবাই মিলে, পিতু তখন বছর চারেকের আর নীতু এক বছরের।
নীতুদের ঠাকুমা বহুকাল আগেই চন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন। বিজয়গিন্নী রেগে বললেন, সেই বাড়িতে এখন হঠাৎ গিয়ে থাকা যাবে? সাপ খােপ কী চোর ডাকাতের আড্ডা হয়ে বসে আছে কিনা কে জানে!
বিজয় বললেন, কেন সাপখােপের আড়াই বা হবে কেন? মালি নেই? বাবা তাকে ঘরবাড়ি করে দিয়ে চিরকালের জন্য পুষে রেখে যাননি? আর দরাজ কুম দিয়ে যাননি ওই বাগানে সে যত ফল ফুল ফলাতে পারবে সব নেবে। তাই থেকেই তার খাওয়া দাওয়া চলবে। মস্ত বাগান তাে। চেষ্টা করলে কত কী ফল তরকারী ফলানাে যায়।
পিতু হেসে বলল, তা সে সব হয়তাে ঠিকই চলছে, তবে বাড়িটা থাকার যােগ্য করে রেখেছে কিনা সন্দেহ। | তারপর বলল, বাড়িটা আমার একটু একটু মনে পড়ছে। মস্ত বড় বাগান, বাগানের মধ্যে একটা মন্তু পরী-পুতুল। আর খুব উঁচু গেট। সেই গেটের লােহায়
পা রেখে রেখে গেটের মাথায় উঠে পড়তাম। খুব উঁচু গেট তাই না বাপী ? | বাপী হেসে বললেন, এমন কিছু উঁচু না। তবে খুব ছেলেবেলায় একটু বড়কেই অনেক বড় লাগে। তাের দাদুকে মনে পড়ে না?
পিতু বলল, সেও একটু একটু। আমায় পিতু না বলে ডাকতেন প্রীতিরা..নী, আর পাকা পাকা গোঁফ – এই যা মনে পড়ে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চল। গিয়ে হয়তাে আরাে কিছু মনে পড়বে। . নীতুর কাছে কোন স্মৃতি নেই। না দাদুর, না দাদুর বাড়ির। কাজেই নীতু বেজার মুখে বলল, মনে পড়েই বা কী হবে? গ্যাংটকের বদলে গালুডি। ধুস! একদম মার্ডার কেসাসেই নাকের বদলে নরুনের মত।
মন মেজাজ খারাপ ওদের মায়েরও। প্রতি বছর কোন না কোন ভাল জায়গায় যাওয়া হয়। ভাল ভাল হােটেলে ওঠা হয়, আরাম আয়েস বিশ্রাম। আর এ কিনা একটা দেহাতি গ্রামে পােড়াে বাড়িতে গিয়ে পড়া। জলের কল বলে কিছু নেই।ইদারা থেকে ভােলা জলে যা কিছু কাজ।
-আর নিজেকে রান্না বান্নাও করতে হবে। পিতু বলল, তা শশীদাকে নিয়ে চল না মা?
-চমৎকার। এখানের বাড়িটি আগলাবে কে আঁ? আমার কান্না পাচ্ছে। বেচারী বিজয়বাবুর অবস্থা যেন চোরের মত।
যেন গ্যাংটকে গােলমালটি তিনিই বাধিয়েছেন। সেখানকার মােনালী উপত্যকা হােটেলটি তিনিই বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এখন বৌ আর ছেলেমেয়েদের দুর্গতি ঘটাবার জন্যেই তার বাবার রেখে যাওয়া একটা পােড়াে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে যাচ্ছেন। যেখানে নাকি সাপখােপ আর ডাকাতের আড়া।
একরাশ বেজার বিরক্তি, আর একগাদা বেডিং সুটকেস, ব্যাগ, টিফিন কৌটো, বেতের টুকরি, ওয়াটার বটল, ফ্লাস্ক এবং ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার আর গাদাগুচ্ছের গানের ক্যাসেট নিয়ে গাড়িতে চেপে বসা হল। কিন্তু সত্যি বলতে – খানিকক্ষণ চলার পর মনটা বেশ ভালই হয়ে গেল দুই ভাইবােনের। বাবার ওপর একটু কৃপা করুণাও এল।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মাঝে মাঝেই বলতে লাগল, বাপী এতক্ষণ গাড়ি চালাতে তােমার কষ্ট হচ্ছে। ? বাপী ঠিক রাস্তা চিনে যেতে পারছ তাে? ভুলে গিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে না তাে?
এইসবের মাঝখানে ক্ষণে ক্ষণেই খাওয়া চলছে। কলা, কমলা লেবু, কেক, | ফাইভ স্টার, সল্টেড কাজু, পটেটো চিপস্ আরাে কত কী!
বিচ্ছিরি একটা গাঁইয়া জায়গায় যাচ্ছেন বলে ওদের মা ‘টুকটাক’ সঙ্গে নিয়েছেন বিস্তর। ডালমুটই তাে এক বস্তা।
এই সবেতেই মনটা কিন্তু কিঞ্চিৎ ভাল হয়ে উঠেছিল। তবে এমন একটা ভয়ঙ্কর আহলাদের ঘটনা যে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সেটা কেউ স্বপেও কল্পনা করতে পারেনি। এক মিনিট আগেও নয়। আবিষ্কারের গৌরব পিতুর। বাড়ির কাছ বরাবর আসা মাত্রই হঠাৎ উল্লাসে চিৎকার করে উঠল পিতু, পন্টু কাকা!
পটু কাকা। মানে পন্টু।
পল্ট। সেকী ? আরে? অ্যা। তুই কোথা থেকে? বলতে বলতে গাড়ির স্পীড কমিয়ে ফেলে বিজয়বাবু ডাক দেন, আয় উঠে।
ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প পন্টু হেসে হাত নেড়ে বলল, এই তাে বাড়ি এসেই গেছে। সত্যিই এসে গেছে বাড়ি।
বুড়াে মালি ব্যাসদেও ব্যস্ত হয়ে গেট-এর দুটো পাল্লাই দুহাট করে খুলে ধরে পিঠ গােল করে সালাম জানায়।
কিন্তু সেদিকে কে তাকাচ্ছে? এখন আর কেউ নয় শুধু পন্টু। পল্টকাকা।
মানে গ্যাটকে যেতে না পারার দুঃখটা মােন তাে বটেই বরং মনে হল ভাগ্যিস গ্যাংটকে যাওয়া হয়নি। ভাগ্যিস গাড়িতে আসা হয়েছে। নইলে তাে পটুকাকাকে মিস করা হত।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পটুকাকা যে কি নিধি সে তত এরা ভালই জানে। আর বিজয়বাবু?
প্রায় বছর দু-তিন পরে হঠাৎ এই চিরদিনের স্নেহ আদরের মামাতাে ছােট ভাইটিকে দেখে তাে আনন্দে বিহুল। যেন হাতে আকাশের চাদ নেমে এসেছে।
পন্টু সেই যে সেবার বললি ম্যাজিক শাে’ দিতে না কি জাভা না বােণিও কোথায় যাচ্ছিস তারপর একেবারে নাে পাত্তা হয়ে গেলি কেন? আঁ? নিখোজ নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলি কোথায় এতদিন? চেহারাখানি তাে ঠিকই রেখেছিস দেখছি। যেমনটি ছিল তেমনটি। তা এখানে হঠাৎ মানে এই গাঁইয়া গাড়িতে। বলে ছেলেমেয়েদের দিকে একবার নজর ফেললেন বিজয়বাবু।
পন্টু বলল, কেন, গাডিটা কি খারাপ জায়গা? আমার তাে এই কদিনেই স্বাস্থ্য ভাল হয়ে উঠেছে।ভাল ভাল। তা কোথায় আছিস? বাঃ! কোথায় আর। তােমাদের এই চারুকুটিরেই। আফটার অল আমার নিজের পিসির বাড়ি তাে? নিজের পিসের তৈরী। থাকাটা দোষ হয়েছে? হা হা হা।বিজয়বাবু অপ্রতিভ হয়ে বলেন, ছি ছি! কী যে বলিস। মানে বলছিলাম, এখানে একা, খাওয়া দাওয়ার কী করছিস?
কেন, ব্যাসদেও তাে রয়েছে। ও আমায় চেনেনা না কী ? আমাকে দেখে তাে আনন্দে কেঁদেই ফেলল। বলে কেউ তাে আসে না। আমি বুড়ােবাবুর এই বাড়ি বাগিচা আগলে পড়ে আছি। ওঃ কী যত্ন যে করছে। আর যা ফার্স্টক্লাস রান্না। হা হা হা! মুখ ছেড়ে যায়। | -তত এতদিন ছিলি কোথায়?
কোথায় নয়? —মানে খুব ঘুরেছিস?
-এখনাে ম্যাজিক দেখাস?
বা। ওটাই তাে আমার পেশা। পেশা আর নেশা এও হচ্ছে স্বভাবের মত। মরলেও ছাড়ে না।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মায়ের তাড়নায় এতক্ষণে পিতু আর নীতু হাত মুখ ধােয়া সেরে ছুটে এসেছে। এখন দুজনে পকাকার দুদিকে।
-~-ও বাপী তুমি আর কতক্ষণ পল্টকাকাকে নিয়ে আটকে রাখবে? ও পূণ্টকাকা সব গপপাে তােমার প্রাণের বন্ধু বিজুদার সঙ্গে করে ফেলছাে ? ইস, আমরা বলে তােমার জন্য … ইঃ। তােমায় দেখে না আমাদের।….. জান পন্টুকাকা, আমাদের গ্যাংটকে যাওয়ার কথা ছিল …।
পন্টু চমকে বলল, কেন? গ্যাংটকে কেন?
বাঃ। কেন আবার, এমনি। তাে সেখানে যাওয়া হল না~~~ ভালই হয়েছে।
তা সত্যি। ভাগ্যিস যাওয়া হয়নি। দুই ভাইবােনে একযােগে কথা বলে চলেছে, তাই না বাপীর বাবার এই গাড়িতে আসা হল। আর তােমাকে পেয়ে যাওয়া হল। ও পন্টুকাকা কী মজা!নাচতে ইচ্ছে করছে আমাদের।
ও পল্টকাকা, তাস আছে তােমার সঙ্গে ম্যাজিক দেখাবে তাে? ইস। আমরা যে তাসগুলাে কেন আনলাম না! ও বাপী তােমার এই গাড়িতে তাস পাওয়া যায় না? যদি না পাওয়া যায়? যদি পটুকাকার কাছে না থাকে?
পন্টু বলে ওঠে, আরে বাবা, আগে থেকেই হতাশ হচ্ছিস কেন? আছে আছে। ভানুমতীর খেলের অনেক কিছুই আছে সঙ্গে। ভেবেছিলাম আর ম্যাজিক ফ্যাজিক নয়। কিন্তু আমি ছাড়তে চাইলেও ম্যাজিক আমায় ছাড়তে চায় না।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাঃ ছাড়তে চাইছিলে কেন? পটু একটু রহস্যময় হেসে বলল, সে অনেক কথা। গিয়েছিলাম জাভায়। সেখানে ম্যাজিক দেখে একটা দল হঠাৎ আমায় যাদুকর ভেবে …..
—ও মা! ম্যাজিক দেখানােওয়ালারা তাে যাদুকরই। পি সি সরকার, জুনিয়ার পি সি সরকার এঁরা সব যাদুসম্রাট’, ‘যাদুর বাজা’ এই সব নয় ?
আরে সে তত আমরা জানি। ওরা ভাবে যাদুকর মানে ডাইনী।
-হি হি। পুরুষ মানুষ আবার ডাইনী হয়? পন্টু গভীরভাবে বলে, বােকাদের কাছে এমন কত হয়। সে যাকগে, তােরা খাওয়া দাওয়া করবি না? সেই কখন ভােৱবেলা বেরিয়েছিস।
পিতুর মা হেসে গড়িয়ে পড়েন, আহা, পন্টু ঠাকুরপাে, ওরা যেন সারা রাস্তা নির্জলা উপােসে এসেছে। সারাক্ষণ মুখ চলেছে —
সঙ্গে সঙ্গে নীতু হৈ চৈ করে ওঠে, ও পন্টু কাকা সল্টেড কাজু খাবে? ‘মুখরােচক মুড়মুড় ভাজা’? পটেটো চিপস্ ? মা, বেতের সেই টুকরিটা?
পন্টু বলল, হবে হবে। এখন দেখ গিয়ে ব্যাসদেও তােদের জন্য কী ব্যবস্থা করে উঠতে পেরেছে।
নীতুদের মা কতই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, বাড়িটা সাপখােপের আড্ডা হয়ে আছে, হয়তাে গিয়ে নিজেকে রান্নাবান্না করতে হবে, বেড়ানাের বারােটা বেজে যাবে, মনের কষ্ট আরাে কত কী!
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কিন্তু দেখে লজ্জাতেই পড়ে গেলেন। | অতবড় বাড়ি, অতবড় বাগান সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফিটফাট। কোথাও নেই একটু ধুলােবালি। তবে বাগানের মাঝখানের সেই আস্ত মানুষের মাপেকংক্রিটের তৈরী সেই পরী-পুতুলটার যদি এতদিনের বােদে জলে নাক দিয়ে যায়, আর সর্বাঙ্গে ফাটল ধরে,
তাহলে ব্যাসদেও কী করবে? আর গেটের লােহার রেলিংগুলাে মরচে পড়ে খসে খসে পড়তে চাইলেই বা বেচারী বুড়াে মানুষ কী করবে? বাড়ির আসবাবপত্রও জীর্ণ হয়ে গেলে উপায় কী? তবুতাে সব ঝেড়ে মুছে রেখেছে।
আর রান্না ? এরা আসামাত্রই কি করে যে সব বানিয়ে ফেলল।
ভােৱবেলা বেরিয়ে বেলা একটা নাগাদ এখানে পৌঁছানাে গেছে, আর বেলা দুটোর মধ্যে সব রেডি। টেবিলে খাবার সাজানাে।
এৱা তাে হাঁ। -ও ব্যাসদেও –! তুমি তাে জানতে না আমরা আসব। কি করে এতসব করলে? ব্যাসদেও চিরকালই অল্পভাষী। এখন আরাে বেশী। কাজেই তার উত্তর শুধু দাড়ির খাঁজে একটু হাসির মত।
নীতুদের বাবার এখন আর ‘চোর’ ভাব নেই। বরং রাজার ভাব। যেন, কী? এখানে আনাটা খুব খারাপ হয়েছে?
—এ কী! শুধু আমাদের খালা? পন্টু তুই খাবি না?
—আরে আমায় তাে ব্যাসদেও সেই বাবােটার আগে খাইয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা পন্টু তােরা কি করে জানলি আমরা আসছি। —মনে মনে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তাজ্জব। আসা মাত্রই চা। গােসলখানার চৌবাচ্চা ভর্তি জল। আর এই সব রান্ন। নীতু দেখছিস? গােবিন্দভােগ চালের ভাত, ভাজা মুগের ডাল, আলু ভাজা, কপি কড়াইশটির তরকারি, মুরগি, টমেটোর চাটনী। ভাবা যায় না। বল? পল্ট, বাজার করলাে কে? আর কখনই বা? এখানে তাে মাত্র হাটবার এর ওপরই নির্ভর।
ব্যাসদেও বলল, বাজার লাগবে কেন? সবই তাে আপনার বাগানের। বাদে চাউল। ওটা স্টকে থাকে। -সব বাগানের?
-জী হা। -~~-আর মুরগী ? সেও গাছে ফলে? হা হা হা। –ও তাে পােবা আছে।
বিজয়বাবু বললেন, পটু দেখছিস। বাবা কত বুদ্ধির কাজ করে রেখে গেছেন। আর আমার পুত্রকন্যা বাড়ি দেখে বলছিল কিনা এইরকম একটা অজজায়গায় এতবড় একখানা বাড়ি বানানাের কোনাে মানে হয় না। দাদুর বাপু বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন ছিল না।
পন্টু তার স্বভাবগতভাবে হেসে ওঠে। বলেছে বুঝি ? হা হা হা। ওদের খুব | বুদ্ধি? হাে হাে হাে।
অনেকদিন পড়ে থাকা বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে যেন সেই হাসিটা ধাক্কা | মেরে মেরে আরাে অনেকক্ষণ আওয়াজ তুলতে থাকে।
নীতু আর পিতুর গা ছমছম করে ওঠে।
মায়ের দিকে তাকায়। দেখে মাও কেমন ভয় ভয় চোখে দেওয়ালগুলাের দিকে তাকাচ্ছেন।
খেয়ে উঠে তাে অনেকক্ষণ গল্প, বাগানে গিয়ে ফটো তােলা, পন্টু কাকাকে ক্যাসেট শােনানাে হল। আর তার ফাকে ফাকে জোর আবদার ও পন্টুকাকা, কখন তাস বের করবে, কখন ম্যাজিক দেখাবে?
— হবে হবে। একেবারে বিকেলের চা খেয়ে দোতলায় ওঠা হবে। অতঃপর পিসেমশাইয়ের বড় ঘরটায় বসে – সব ঘরে তাে তালা চাবি লাগানাে। শুধু ওই ঘরটাই আমি খুলিয়ে নিয়েছি।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
— বাপী কটা ফিল্ম এনেছ? – চারটে।
– বেশ বেশ। পণ্টকাকা কাল ভােরবেলা বেড়াতে বেরিয়ে ছবি তােলা হবে কী বল?
-আরে আজ তাে তুললি কতগুলাে? | – ও তাে বাড়ির লােকের। কাল প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভােলা হবে। ব্যাসদেও তুমি কিন্তু আজ ফাকি দিয়েছ। গ্রুপ ফটো তােলার সময় কাজ আছে বলে পালিয়েছ। কাল সকালে তােমার লম্বা দাড়ির একটা ফটো ভােলা হবে। হি হি হি।
বিকেলে চা খেতে খেতে নীতুদের মা বললেন, একটা আশ্চর্য! এতবছর কেবল মাত্তর নিজের ভাল রুটি পাকিয়ে চালিয়ে এসেও ব্যাসদেওয়ের রান্নার হাত কী চোস্ত রয়েছে। . বিজয়বাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। বললেন, বাবা ওকে নিজে তালিম দিয়ে ভাল ভাল রান্না শিখিয়েছিলেন।
—রাত্রে কী খাওয়াবে ব্যাসদেও। বলল নীতু। -যা আপনাদের মর্জি। পিতু হি হি করে হেসে উঠে বলে, যা আমাদের মর্জি? যদি বলি বিগ বিগ চিংড়ির মালাইকারী, মাটন রােল, আর মােগলাই পরােটা?
ব্যাসদেও দাড়ির ফাকে একটু হাসি দেখায়, হােবে। সব হােবে।
হাে হাে হাসির রােল উঠল অর্থাৎ ব্যাসদেও ও ঠাট্টা তামাসা করতে জানে। কিন্তু শুধুই হাসি গল্প চালালে চলবে কেন?
~~ও পটুকাকা, তাস বের কর।
-বলছিস?
—বলছিই তাে। আর দেরি করলে কিন্তু আমরা গিয়ে তােমার বাক্স হাতড়ে বের করে আনব।
পটু বলে ওঠে, আনবি কী, এনেই তাে ফেলেছি।
—আঁ। কই? কোথায় হঠাৎ দেখা গেল ঝড়ের সময় শুকনাে পাতা ছিটকে আসার মত জানলা দিয়ে | বাইরে থেকে সাহেব বিবি গােলামরা ছটাছট ছিটকে চলে আসছে ঘরের মধ্যে। দারুণ। তার মানে শুরু হয়ে গেছে পটুকাকার ম্যাজিক। এটি যে পন্টুর নতুন অবদান’ তাতে সন্দেহ নেই। এরকমটি আগে কখনাে দেখেনি এবা।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কিন্তু কী মুশকিল। এ যে এসেই চলেছে। ঘরের মেঝে, খাট, বিছনা, টেবিল, চেয়ার, আলমারির মাথা সব বােঝাই হয়ে গেল তাসে। – ওরেব্বাস। বিজয়বাবু চেঁচিয়ে ওঠেন, ও পন্টু, এবার থামা। একী খেলা শিখে এসেছিস বাবা জাভা থেকে না কোথা থেকে? কশাে জোড়া তাস এনেছিস বাবা ? | নীতুদের মাও কোলের ওপর থেকে সাহেব বিবি টে দশদের ঝাড়তে ঝাড়তে বলেন, সত্যি বাবা! ও পন্টু ঠাকুরপাে, এগুলাে তাস না আমাদের চোখের প্রম? স্রেফ ইন্দ্রজাল ?
নীতু আর পিছু কথাই বলতে পারছে না। দুজনে দুজনের স,ে প্রায় সেঁটে গেছে।
তারা সেই চিরাচরিত খেলাই দেখতে চেয়েছিল। যেমন ম্যাজিক দেখানেওয়ালার হাতের ছড়ানাে তাস থেকে মনে মনে ভাবা একটি তাস, দশ হাত দূর থেকে চলে এল তার নিজের পকেটে। কিংবা প্যাকেটের বাহান্নখানা তাসই হয়ে গেল নীতুর ভাবা তাসটি। অর্থাৎ সবগুলােই চিড়িতনের টেক্কা বা ইস্কাবনের বিবি।
অথবা নীতু নিজে সাফল করে কোনাে একটি তাস বেছে নিজের হাতের মধ্যে রেখে প্যাকেট ফেরত দিয়ে দেখল সেই তাস পণ্টকাকার সেই প্যাকেটের মধ্যে।
আর নীতুর কাছে রাখা তাসটা ? সেটা একটা তামই নয়। একখানা তাসের মাপের সাদা কার্ড।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এই সমস্তই দেখেছে নীতুরা আগে। ভাতেই মােহিত হয়েছে, হৈ চৈ করেছে, চোখ গােল করেছে। এটা আবার কেমন বাবা।
আজ তত ওরা দুই ভাইবােন পরামর্শ করে রেখেছিল ভীষণভাবে চোখ ঠিকরে লক্ষ্য করে হাত সাফাই দেখবে পটুকাকার। এ খেলা সেদিক দিয়েই গেল না। গেল না মানে কী? যাচ্ছে না। ঘরের শিলিং থেকে বালি চাপড়া খসে পড়ার মত এখনাে তাস ঝরছে।
পিতু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কেবল তাস জমে জমে পাহাড় হচ্ছে, ম্যাজিক দেখব কখন?
-কী মুশকিল, এটা ম্যাজিক নয়? হাে হাে করে হেসে উঠল পটু। আবার সেই পুরনো বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে হাসির প্রতিধ্বনি। এখন বেলা পড়ে গিয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে।
পন্টু বলল, তাে দেখ বাবা বাহান্নখানার খেলাই দেখ। বলে ইশ করে | একবার কাক তাড়ানাের মত হাত নাড়ল পন্টু। আর সেই তাসের পাহাড় এক পলকে গুছিয়ে একটি ছিমছাম প্যাকেট হয়ে পটুর বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে। ঘরে আর কোথাও নেই একখানিও তাসের চিহ্ন।
এখন হাততালির ধূম। বিজয়বাবু বললেন, নাঃ অনেক নতুন খে শিখে ফেলেছিস দেখছি এই দু তিন বছরে। এসব খেলা কোথা থেকে শেখা রে পন্টু?
পন্টু হেসে ওঠে, কেন? তুমি সেখানে গিয়ে শিখে নেবে? অমন কাজটি করাে না।
নীতুর মা হেসে ওঠেন, হ্যা, তােমার দাদাটি নইলে আর কে তাসের ম্যাজিক শিখবে। কোনটা কী তাস তাই জানে কিনা সন্দেহ।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এই সময় হঠাৎ কে যেন ঘরে একটা পেট্রোম্যাক্স বসিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু কে ও? ও তাে ব্যাসদেও নয়। দাড়ি কই ওর? বিজয়বাবু একটু চমকালেন, কে লােকটা?
পটু বলল, আরে ব্যাসদেওয়ের একটা ভাইপাে আছে কাছাকাছি। কাকার সাহায্য করতে আসে। কাল ও আলাে জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল। আসলে বুড়াে এই আলােটা জ্বালাতে জানে না।
হেসে ওঠে পিতু, এত ভাল ভাল রান্না করতে পারে আর একটা হ্যাজাক জ্বালতে পারে না?
~ সবাই কি সব পারে?
পন্টু আবার হেসে ওঠে, আর বলে, এই যে বিজুদা এত মােটরগাড়ি চালাতে l পারে, আমি একটা গরুর গাড়ি চালাতে পারি না।
এই রকমই কথাবার্তা পল্টর। না হাসিয়ে ছাড়ে না। বিয়েটিয়ে করেনি, কেবল বাউন্ডুলের মত ঘুরে বেড়ায় আর ম্যাজিক শেখে এবং দেখায়।
ম্যাজিকের একটা দলও আছে তার। তবে সে সব তাে জগঝম্প আসবাব পত্র নিয়ে। এমন ঘরােয়া আসরে চলে । তাই বেস্ট। সর্বত্র চলে। | সেই তাসের পাহাড়কে বাহান্নখানায় দাঁড় করিয়ে পন্টু এবার তার সেই | পুরনাে খেলা দেখাল কিছু কিছু। যাতে সকলের আনন্দ। তবে তার সঙ্গে নতুন কিছুও জুড়ল, রীতিমত রােমাঞ্চকর।
যেমন নীতুর পকেটে রাখা হরতনের নহলাকে একটা একশাে টাকার নােট আবার তাকে দোকানের ক্যাসমেমাে, লন্ড্রির বিল, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, বাসের টিকিট, হেঁড়া শালপাতা বানানাে এইরকম সৰ অনেক খেলা।
নিথর পাথর হয়ে বসে দেখতে দেখতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেছে। কেউ টের পায়নি। সিঁড়ির সামনে একটা গলা খাঁকারি। দরজার কাছে সাদা দাড়ির আভাস।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিজয়বাবু বলে উঠলেন, ছি ছি, কত রাত হয়ে গেল। চল চল খেয়ে নেওয়া যাক। বেচারা বুড়ােমানুষ এতক্ষণ বসে আছে।
বসে আছে কী? হি হি দু’ভাইবােন একসঙ্গে হি হি করে হেসে ওঠে, ও || এতক্ষণ বাগানের গাছ থেকে বিগ বিগ গলদা চিংড়ি পেড়ে মালাইকারী রাঁধছিল।।
সিঁড়িতে নামার সময় পন্টু আবার একটু নতুন খেলা দেখিয়ে মাৎ করে দিল। তাসেদের অর্ডার দিল, এই তােরা সব যেখান থেকে এসেছিলি, সেখানে ফিরে আর বলা মাত্রই তাসগুলাে বোঁ বোঁ করে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। | বিজয় গিন্নী সরে এসে মেয়ের হাত ধরলেন। মেয়ে ভাইয়ের হাত। এ কী সাতিক খেলা বাবা! পি সি সরকারের মানুষকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলার থেকে কিছু কম নয়। যেন অলৌকিক। অথবা ভৌতিক। | যাই বলিস পন্টু, এই বছর দুই তিন বাইরে ঘুরে এসে অনেক লাভবান হয়েছিল।
-লাভবান? তা হবে? আবার সেই পেটেন্ট হাসি পল্টর হা হা হা। যেটা কলকাতার বাড়িতে খুবই আনন্দের আর মজাদার। কিন্তু গাড়িতে ঠাকুর্দার আমলের এই খাঁ খাঁ করা বিশাল বাড়িটায় যেন গা ছমছমাননা।
কিন্তু খাবার টেবিলে বসে তার শতগুণ গা ছমছমানি। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে ব্যাসদেও। ফুটখানেক করে লম্বা সাইজের গলদা চিংড়ির কারি, মটনবােল, মােগলাই। পরােটা।
নীতু বলল, আমার খেতে ভয় করছে। পিছু বললাে, লােকটা ভূত না ভগবান?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ওদের মা বললেন, ওকেও কি ম্যাজিক শিখিয়ে ফেলেছ পন্টু ঠাকুরপাে ? তাসের মত কারবার। ডাল রুটিকে এইসব দেখছি। যেমন বাহায়খানা তাস বারশাে হয়ে যাওয়া।
শুধু বিজয়বাবুই তারিফ করে খেতে লাগলেন। এবং রাত্রে তিনি আর পল্ট একটা ঘরে এবং বাকিরা আর একটা ঘরে শুয়ে পড়ল।
কথা হল পরদিন ভােরে সবাই মিলে গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বেরনাে হবে। বারান্দার ওধারে হাতমুখ খােবার জন্যে দু বালতি ভর্তি জল। মা বললেন, লােকটা ময়দানব না কী রে বাবা?
– ও মা, এ সেই সিনেমার গল্প হলেও সত্যির কাজ করার লােকের মত। – যা বলেছিস।। -ব্যাসদেও আমাদের কিন্তু পাঁচটার সময় চা চাই। — জী হাঁ! সেলাম ঠুকে চলে গেল ব্যাসদেও।
আর বলব কী পাঁচটার আগে উঠে পড়েও নীতুরা দেখল দোতলায় বারান্দায় বেতের টেবিলের ওপর টিকেজি ঢাকা দিয়ে চা আর কাপ ডিশ চিনি-টিনি ইত্যাদি সাজাননা।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিজয়বাবু বললেন, হােটেল বলে আক্ষেপ করছিলে, কটা ভাল হােটেলে তুমি এমন সার্ভিস পাবে? কোন একটা জিনিস চাইলে তাে দিতে ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। যাক চটপট রেডি হও।
কিন্তু পণ্টকাকা ?
-বাপী পন্টুকাকা কই? বিজয়বাবু বললেন, সে তাে বাপু কখন উঠে পড়েছে জানি না। ঘুম ভেঙে তাে দেখছি না। | – বাঃ চা খাবে না ? দেখ কোথায় ?
— সে হয়তাে ব্যাসদের সঙ্গে চা খেতে লেগে গেছে। পন্টু দাদাবাবুর ওপর | ভারি ভক্তি ব্যাসদেওর।
বিজয়বাবু সিড়ির ধারে এসে গলা তুলে হাঁক পাড়লেন, পন্টু! পন্টু! ব্যাসদেও। ব্যাসদেও।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। কোথায় বা পন্টু কোথায় বা ব্যাসদেও। রান্নাঘরের দরজায় শুধু শেকল ভােলাই নয়, তাতে একটা মর্চে পড়া তালাও লাগানাে। এই ভাের সকালে দুটোতে গেল কোথায়।
— আর কোথায়! এতজনের ভােজ’-এর রসদ জোগাড় করতে।
-এত ভােরে এখানে বাজার বসে? – আরে না না, এসব দেহাতি জায়গায় চাষীদের বাড়ি থেকে জিনিষ নিয়ে আসা যায়। সজি, ফল, ডিম, দুধ, মাখন। দেখেছি, আগে।
পিতু হি হি করে হেসে বলে ওঠে, আর চুপি চুপি এনে রেখে বলা যায়, | বাগানে ফলেছে।
কিন্তু কই রে বাবা আসছে কই?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-নাঃ। বেড়ানােটা মাটি করল দুটোয়। -নাঃ। মার্ডার কেস। নােদ উঠে গেল। দেখা নেই ওদের।
এদের সাজা গােজা রেডি। গাড়িতে ক্যামেরা তোলা হয়ে গেছে। কিছু খাবার দাবারও।
-~ও বাপী, কী হবে? জমিতে চাষ করিয়ে সজি টজি আনছে না কী ভােমার ব্যাসদেও ?
বাপী বললেন, সত্যি এত দেরি করছে কেন? যাক, এক কাজ করা যাক, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া থােক। চারদিকে তাকাতে তাকাতে যেতে হবে। নিশ্চয় দেখা হয়ে যাবে।
তবে তাই। ছটফটানিটা তাে কাটুক। কোথাও বেরবার সময় যদি কারাে জন্যে অপেক্ষা করতে হয় তার থেকে যন্ত্রণা আর নেই।
বেরনাে হল। এবং চারজনের চার দুগুণে আটটা চোখ রাস্তার আশপাশ সামনে পিছনে তদন্ত করতে করতে চলল।
কিন্তু কোথায় কী? নাে পাত্তা। দু দুটো মানুষ যুক্তি করে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। অন্য কোন রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেনি তাে? দুর আবার রাস্তা কোথায়? আচ্ছা বাগানে ছিল না তাে? দূর! অত চেঁচিয়ে ভাকাডাকি করা হলাে।
এইসব বলাবলির মধ্যে হঠাৎ এক কাত হয়ে গেল। বিজয়বাবুর গাড়িকে ‘ভুলভুলাইয়া’ পেয়ে বসল। যেদিক দিয়েই এগােতে যান রে ফিরে সেই একই রাস্তা।
-কী হল বাপী?
— বুঝতে পারছি না তাে। বিজয়বাবু বলেন, গাড়ি। ওপর কন্ট্রোল রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন নিজের ইচ্ছে, চলছে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-বাপী কোন কিছু না ভেবে কোনাে একদিকে সােজা বে’ য়ে যাও। —তাতে কী হবে? ~ এই গােলকধাঁধাটা থেকে বেরিয়ে পড়া যাবে। —কিন্তু তারপর? রাস্তাটা চেনাবে কে? – চেনাবে রাস্তার লােক। জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে।
~ কিন্তু জিজ্ঞেস করার মত লােকই বা কোথায়? এমননিতেই তাে ফাকা মেঠো রাস্তা। যাও বা দুএকজন যাচ্ছে, তারা নেহাতই ৰােবা মত।
দেখতে দেখতে অনেক দূর আসা হয়ে গেল। কী ভাগ্যি হঠাৎ একটি ভবিযুক্ত লােককে দেখতে পাওয়া গেল। মধ্য বয়সী। বােধহয় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এই অক্টোবরেও গলায় কার মাথায় টুপি। গায়ে ধুতির ওপর লম্বা কোর্ট।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বিজয়বাবুর প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন।
গানুডি এখান থেকে কত দূর? গাড়িতেই তাে রয়েছেন মশাই। বিজয়বাবু নিজে মনে মনে অবাক হন। এতখানি গাড়ি চালিয়ে এসেও তবে চটপট সামলে নিয়ে বলেন, না মানে গাড়ির চারুকুটিরের রাস্তাটা …
– চারুকুটির। ভদ্রলােক আরও অবাক হয়ে বলেন, চারুকুটির? কোন চারুকুটির ?
বিজয়বাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, চারুকুটির এখানে কটা আছে মশাই আমার জানা নেই। আমি খাসনবীশদের চারুকুটিরের কথা বলছি। স্বর্গীয় অজয় খাসনবীশের বাড়ি।
মাই গড়। অজয় খাসনবীশের চারুকুটির। সেইখানে আপনারা উঠতে যাচ্ছেন?
নীতু আর পারে না। টনটনে গলায় বলে ওঠে, উঠতে যাব কেন? সেইখানেই তাে আছি। শুধু সকালে বেড়াতে বেরিয়ে একটু রাস্তা গুলিয়ে ফেলে .
– সেইখানে আছাে ? মানে চারুকুটিরে? মানে খাসনবীশের চারুকুটিরে? | নীতু গলা আরাে টনটনে করে, তা এত অবাক হচ্ছেন কেন? থাক না কেন? বাড়িটা তত আমাদের নিজেদেরই। ওই অজয় খাসনবীশ তাে আমাদের দাদু ছিলেন।
ভদ্রলােক মুখটা পাথুরে করে বললেন, কতদিন পরে এসেছ এখানে? -~অনেকদিন পরে।
হ্যা সে তাে বুঝতেই পারছি। তাে কবে এসেছ? এই বাড়িতে ছিলে || নাকি?
– ছিলামই ।
ভালো (মস একদল পাগলকে দেখছেন, এই না? এদের #লের দিকে } তাকিয়ে নে, ছিলে, কোথায় শুয়েছিলে?
” দোলার ঘরে। কত ধর। খাট বিছানা মত!
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-বটে। তাে খাওয়া দাওয়া কোথায় করেছিলে? বিজয়বাবু বিজয়গিনী এবং পিছু তিনজনেই বুঝে ফেলেছেন লোেকটা সুবিধের নয়। নীতুর সঙ্গে চালাকি খেলছে। পিতু অলক্ষ্যে নীতুকে একটা চিমটি কাটল। কিন্তু নীতু এখন মরীয়া। রাগের গলায় বলল, কোথায় আবার বাড়িতেই। বুড়াে মালি রান্না বান্না করে দিল। সে যা ফার্স্টক্লাস রান্না।
–বুড়াে মালি? ব্যাসদেও? পাকা দাড়ি? -~-হ্যা, হ্যা, চেনেন তাকে? — চিনতাম।
ভদ্রলােক নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সে তােমাদের রান্না করে খাইয়েছে। সে তাে অনেক দিন হল মারা গেছে।
বিজয়বাবু এখন হাল ধরেন। বলেন, এ কী তামাসা মশাই? ব্যাসদেও কাল দুবেলা আমাদের চব্যচোষ্য খাইয়েছে। আজও সকালে চা বানিয়ে ..
ভদ্রলােক শিউরে উঠে বলেন, এখনাে আপনারা টিকে আছেন? খুব লাকের জোর বলতে হবে। যে লােক আজ সাত-আট বছর, কি দশ বছর আগে বাগানে কাজ করতে করতে ইদারায় পড়ে মারা গিয়েছিল।
পুলিশকে জানানাে সত্ত্বেও আসেনি। পাড়ার কেউ ও মুখাে হতে যায়নি। কাজেই লাশ উদ্ধার হয়নি। ইদারার মধ্যেই সলিল সমাধি। এবং সেই থেকে ওইখানেই তার প্রেতাত্মা বসবাস করছে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-~-কী?
— কী আর? সােজা বাঙলায় ভূত হয়ে রয়ে গেছে। ইদানিং নাকি আবার রাতের দিকে খুব হা হা হাসির শব্দ শােনা যায়। অবশ্য বাড়ি বলতে আর তেমন কিছু নেই। বিশাল বাগান শুকিয়ে যাওয়ায় জঙ্গলে ভরে গেছে। বাড়িটা গাছপালা
আর জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য। লােকে ও রাস্তা দিয়ে বড় একটা হাঁটে না। | বাগে মাথা জ্বলে যায় নীতুর। তীক্ষ গলায় বলে, আপনি বােধ হয় অন্য কোন চারুকুটিরের কথা বলছেন।
ভদ্রলােকও কড়া গলায় বলেন, তা হবে, আমরা মানে এখানে সবাই অজয় খাসনবীশের চারুকুটিরের হিস্ট্রি জানি। ইচ্ছে করলেই আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন। ওই ভাঙা মসজিদের মােড়টা ঘুরলেই …
হতভম্ব বিজয়বাবু আস্তে বলেন, আমারই বােধহয় ভুল হচ্ছে। আমাদের সেই চারুকুটির তাে অনেক দূরে। প্রায় আধঘন্টা গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছি। … কিন্তু বাড়ির নাম, মালির নাম দুই মিলে যাবে। স্ট্রেঞ্জ। কাইন্ডলি যদি গাড়িটায় উঠে এসে আমায় দেখিয়ে দেন। বড় ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছি।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আসলে কিন্তু বিজয়বাবু এই লােকটাকেই সন্দেহ করছেন। বেশ বােঝা যাচ্ছে। লােকটা ভাঁওতাবাজ। অকারণ বিভ্রান্ত করতে চায়। এই রােগ থাকে অনেকের।
ভদ্রলােক উঠে এলেন গাড়িতে। তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, শুধু ধাঁধা! সে তাে রক্ষে। মারা যে পড়েন নি এই ঢের। চারুকুটিরে থেকেছেন, রাত কাটিয়েছেন, বুড়াে মালির হাতের রান্না খেয়েছেন। ওরে বাপ! শুনেই মাথা ঘুরছে মশাই। … ওই তাে সামনে। ওই ঝােপঝাড় জঙ্গল গজাননার মধ্যে সামনের গেট। আমায় এখানেই নামিয়ে দিন মশাই। আর যাচ্ছি না।
প্রায় চলন্ত গাড়িটা থেকে নেমে পড়ে ভদ্রলােক উল্টোমুখখা চোঁ চোঁ দৌড়তে থাকেন।
আর সপরিবার বিজয়বাৰু ? নীতু পিতু আর তাদের মা?
স্তম্ভিত হয়ে দেখতে পান পােড়ােবাড়ির লতাগুল্ম গাছগাছালির আড়ালের ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কজা ভাঙা গেটটার ঝুলে পড়া একটা পাল্লায় কোণ ছিড়ে বাঁকা হয়ে ঝুলিছেকাঠের নেম প্লেটটা। কালাে জমিতে সাদা দিয়ে লেখা।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
‘চারুকুটির। এ কে খাসনবীশ। নিচে একটা তারিখ রয়েছে যেটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এবং এই খানিক আগে যেটা দেখে নীতু বলেছে বাপী, উনিশশাে কত? গেটের ফাক থেকে সেই নাক খাদা হাত ভাঙা ফাটাচটা পরী-পুতুলটা দেখা যাচ্ছে। সকালের রােদে ভরা আকাশ। দেখে বুঝতে ভুল হয় না এ বাড়িতে বহুকাল মানুষের পা পড়েনি।
নীতু মাথা উঁচু করে ওপর দিকে তাকালাে। দোতলার ঘরটা দেখা যাচ্ছে। আগাছার জঙ্গল অতটা পর্যন্ত উঠতে পারেনি। কার্নিশ ভাঙা, খড়খড়িটার একটা জানলার পাল্লা হাট করে খােলা। ওই ঘরটায় বসেই না তারা কাল রাত্রে তাসের ম্যাজিক দেখছিল।
-দিদি। দেখছিস। -কী দেখবে দিদি? আচমকা একটা ঝােড়াে হাওয়া উঠল। আর সাঁই সাঁই করে মুঠো মুঠো শুকনাে পাতারা সেই জানলা দিয়ে ঢুকতে লাগল। কিন্তু ওগুলাে কী গাছের পাতা? না তাসের সাহেব বিবি গােলাম টেক্কার দল?
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কিভাবে কোন পথে গাড়ি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফিরে আসতে পেরেছেন বিজয়বাবু তা তিনিই জানেন। বিজয়গিন্নী তাে সারা রাস্তা কপাল চাপড়েছেন, তার রাশি রাশি শাড়ি ভরা সুটকেসটা আর গাদা জিনিস সেই ভূতের বাড়িতে পড়ে রইল। আর পিতু নীতু মাঝে মাঝেই ডুকরে উঠছে, ও বাপী। আমরা যে ভূতের হাতে খেলাম।
আমাদের কী হবে? ও বাপী সেই মােগলাই পরােটা, চিংড়ির কারি যে আমাদের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে। | বাপী বললেন, রাতদিন কত ভুতুড়ে জিনিস আমাদের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ছে তার হিসেব জানিস? এই যে লােকজন সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে কে মানুষ আর কে ভূত কে জানে?
যাক একটা জিনিস বেঁচেছে। সেটা হচ্ছে ক্যামেরা। গাড়িতেই ছিল। কিন্তু গাড়ির পেছনে এসব কোথা থেকে এল? নীতুদের মার সেই শাড়ির সুটকেস, বাক্স, বিছানা, ব্যাগ ব্যাগেজ। … কে কখন রেখেছিল এর মধ্যে?
একটি জিনিসও খােয়া যায়নি। মায় বিজয়বাবুর সিগারেট কেসটা পর্যন্ত। সব কিছু সযত্নে রাখা রয়েছে।
রাক্ষুসে পাথর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সেসব নামাতে নামাতে বিজয়বাবু গম্ভীরভাবে বলেন, বুঝতে পারছ জগতে কে মানুষ কে ভূত বােঝা শক্ত। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব’ থাকে সে মরে ভূত হয়ে গিয়েও মনুষ্যত্ব বজায় রাখে। এখন বল গ্যাংটকের বদলে গালুড়ি গিয়ে তােমাদের লােকসান হল ? না লাভ হল?
নীতুরা দু ভাইবােনেই চেঁচিয়ে উঠল, লাভ লাভ। আর কেউ কখনাে আমাদের মত ভূতের সঙ্গে থেকেছে? ভূতের হাতে খেয়েছে? কপালে লেখা না থাকলে এমন হয়? আহা বন্ধুরা কি বিশ্বাস করবে?
কিন্তু পল্টকাকাও কী ? না কি ওঁর চলে যাওয়াটা ওঁর স্বভাবগত খেয়ালীপনা ? কে বলতে পারে আবার হঠাৎ কোনদিন কোথাও উদয় হয়ে বলে উঠবেন, কি রে নীতু চিনতে পারিস?