শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার বড়দাও ভারি গানপাগল ছিলেন। রােজ রাতে আমরা ছাপে •সে ৬ বাজাতাম। চিন্ময়ের রবীন্দ্রসংগীত যা ভালােবাসত বড়দা!শঙ্খনীল কারাগারমা, তুমিও তাে গান জান! তােমার নাকি রেকর্ড আছে গানের?’ 

মা রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসেন, খুশি খুশি গলায় বলেন, ‘স্কুলে যখন পড়ি, তখন রেকর্ড হয়েছিল। মেসবাহউদ্দিন ছিলেন তখন রেডিওর রিজিওনাল ডাইরেক্টর। তিনিই সব করিয়েছিলেন। এক পিঠে আমার, এক পিঠে পিনু হকের। পিনু হককে চিনিস না? এখন তাে সিনেমায় খুব প্লেব্যাক গায়। খুব নাকি নামডাক। তখন এতটুকু মেয়ে, আমার চেয়েও ছােট।

যদিও আমরা সবাই জানতাম, গানের একটা রেকর্ড আছে, তবু গানটি শুনি নি কেউ। পুরনাে রেকর্ড বাজারে পাওয়া যেত না। নানার বাড়িতে যে-কপিটি আছে, সেটি আনার কথা কখনাে মনে পড়ে নি। মা কিন্তু কোনাে দিন গান গেয়ে শােনান নি, এমন কি ভুল করেও নয়। | মার প্রসন্ন দিনগুলির জন্যে আমরা আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কি ভালােই না ল’ণ’ বা নিজে তাে মহাখুশি, কি যে করবেন ভেবেই যেন পাচ্ছেন না। অফিসের কোন কলগ কি করেছে, তাই কমিক করে হাসাতেন আমাদের। বাবা খুব ভালাে 

*ব করতে পারতেন। অফিসের ছােটাবু কেমন করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বড়াে বার চেম্বারে হাজিরা দিতেন–তা এত সুন্দর দেখাতেন! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম আমরা। মা বলতেন, আর নয়, পেট ব্যথা করছে আমার। ঝুনু চোখ বড়াে বড়াে করে বলত, রাবেয়া আপা, বাবা খুব ভালাে জোকার, তাই না? 

রাবেয়া রেগে গিয়ে বলত, মারব থাপ্পড়। বাবাকে জোকার বলছে! দেখছ বাবা-মেয়ের কেমন ফিচলে বুদ্ধি হয়েছে? 

বাবা বলতেন, ‘ঝুনুর আমার এই এতটা বুদ্ধি। যাও তাে রুনু-ঝুনু, একটু নাচ দেখাও। 

কিটকির কাছে শেখা আনাড়ি নাচ নাচত দু’ জনে। মা মুখে মুখে তবলার বােল দিতেন। বাবা বলতেন, ‘বাহা রে বেটি, বাহা। কী সুন্দর শিখেছে, বাহ্ বাহ! এবার মন্টু সােনা, একটি গান গাও। 

বলার অপেক্ষামাত্র–মন্টু যেন তৈরি হয়েই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু– 

কাবেরী নদীজলে.-। শুধু এই গানটির সে ছয় লাইন জানে! ছয় লাইন শেষ হওয়ামাত্র বাবা বলতেন, ঘুরেফিরে ঘুরেফিরে!’ 

মন্টু ঘুরেফিরে একই কলি বার বার গাইত। ভালাে গানের গলা ছিল। ছেলেমানুষ হিসেবে গলা অবশ্যি মােটা, চড়ায় উঠতে পারত না, তবে চমৎকার সুরজ্ঞান ছিল। | মাঝামাঝি সময়ে দেখা যেত রাবেয়া এক ফাঁকে চা বানিয়ে এনেছে। বিশেষ উপলক্ষ বলেই রুনুঝুনু-মন্টু আধ কাপ করে চা পেত সেদিন। সুখের সময়গুলি 

খুব ছােট বলেই অসম্ভব আকর্ষণীয় ছিল। ফুরিয়ে যেত সহজেই, কিন্তু সৌরভ থাকত অনেক অ-নে-ক দিন। 

ভাবতে ভাবতে রাত বেড়ে গেল। মানুষের চিন্তা যতই অসংলগ্ন মনে হােক, কিন্তু তলিয়ে দেখলে সমস্ত কিছুতেই বেশ একটা ভালাে মিল দেখা যায়। বৃষ্টির রাতে গল্প বলা থেকে ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে এসেছি। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিকে ভিজে আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বিদ্যুৎ-চমকানিতে ক্ষণিকের জন্য নীলাভ আলাে ছড়িয়ে পড়ছে। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

‘মা গাে, এত ঘুমুতেও পারেন ? 

কিটকি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ‘কাল সারা রাত ঘুমান নি, না? 

‘দেরিতে ঘুমিয়েছি। তুই যে এত সকালে? শাড়ি পরেছিস, চিনতে পারছি না মােটেই। রীতিমতাে ভদ্রমহিলা। 

‘আগে কী ছিলাম? ভদ্রলোেক? 

না, ছিলি ভদ্রবালিকা। বেশ লম্বা দেখাচ্ছে শাড়িতে, কত লম্বা তুই? ‘পাঁট ফুট এক ইঞ্চি। ‘বস, মুখ ধুয়ে আসি।’ কলঘরে যাওয়ার পথে রাবেয়ার সঙ্গে দেখা, চায়ের ট্রে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। 

ও খােকা, কিটকি বেচারি কখন থেকে বসে আছে, ঘুম ভাঙে না তাের। রাতে কি চুরি করতে গিয়েছিলি? 

 হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসলাম কিটকির সামনে। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপিষ্টিক, কপালে জ্বলজ্বল করছে নীল রঙের টিপ। কিটকি বলল, ‘বলুন তাে, কী জন্যে এই সাত-সকালে এসেছি? 

‘কোনাে খবর আছে বােধ হয়? 

বলুন না, কী খবর? দল বেঁধে পিকনিকে যাবি, তাই না? ‘কিছুটা ঠিক। আমরা ম্যানিলা যাচ্ছি। 

কোথায় যাচ্ছিস?’ 

‘ম্যানিলা। পাঁচ বৎসরের চুক্তিতে আৱা যাচ্ছেন এই ডিসেম্বরে। কী যে ভালাে লাগছে আমার। 

খুশিতে ঝলমল করে উঠল কিটকি। বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল আমার।খুব খুশি লাগছে তাের? 

‘হ্যাঁ, খুব। ‘আমাদের জন্যে খারাপ লাগবে না? ‘লাগবে না কেন, খুব লাগবে। আমি চিঠি লিখব সবাইকে। ‘কিটকি, দেখি তাের হাত। ‘হাত কি দেখবেন ? ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দেয় কিটকি। লাল টুকটুকে এতটুকু ছােট্ট হাত। 

‘হাত দেখতে জানেন আপনি? এত দিন বলেন নি তাে? ভালাে করে দেখবেন কিন্তু। সব বলতে হবে। 

কিটকির নরম কোমল হাতে হাত রেখে আমি আশ্চর্য যাতনায় ছটফট করতে থাকি।। 

‘কী দেখলেন বলুন? বলুন না। 

ও এমনি, আমি হাত দেখতে জানি না।’ তবে যে দেখলেন?’ ‘কি জন্যে দেখলাম, বুঝতে পারিস নি? তুই তাে ভারি বােকা। কিটকি হাসিমুখে বলল, ‘বুঝতে পারছি। ‘কী বুঝতে পারলি? ‘বুঝতে পারছি যে, আপনিও বেশ বােকা। 

কিটকিরা ডিসেম্বরের ন’ তারিখে চলে গেল। এ্যারােড্রামে অনেক লােক হয়েছিল। রাবেয়াকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে। কিটকির যে এত বন্ধু আছে, তা 

জানতাম না। হেসে হেসে সবার সঙ্গেই সে কথা বলল। কিটকিকে মনে হচ্ছিল একটি সবুজ পরী। সবুজ শাড়ি, সবুজ জুতাে, সবুজ ফিতে-এমন কি কাঁধের মস্ত ব্যাগটাও সবুজ।। 

রাবেয়াকে বললাম, ‘কিটকিকে কী সুন্দর মানিয়েছে, দেখেছিস? তুই এমন মিল করে সাজ করিস না কেন? 

‘সাজ দেখে যদি তাের মতাে কোনাে পুরুষ-হৃদয় ভেঙে যায়, সেই ভয়ে। খালা লাউঞ্জের এক কোণায় বসে ছিলেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *