শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

‘দুই সের চাইল, আর চাইর আনা পয়সা। এই কাপড়টা দিছে পুরানা পল্টনের এক বেগম সায়েব। শঙ্খনীল কারাগার

দেখি কী কাপড়। রাবেয়া গম্ভীর হয়ে কাপড় দেখত, ভালাে কাপড়। ‘ছাপটা বালা? ‘হ্যাঁ হ্যা, খুব ভালাে ছাপ। রাবেয়াটা বেশ পাগলাটে। ছােট বয়স থেকেই। 

‘ও! ইনি আবিদ হােসেন। 

রাবেয়া হাসিমুখে বলল। চকোলেটের প্যাকেট পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছে। 

কোথায় দেখা হয়েছে তাঁর সাথে? 

বাসায় এসেছিলেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ হল। ছােটবেলা তােকে নাকি লিফট দিতেন গাড়িতে? 

‘হ্যাঁ। স্কুলটা অনেক দূরে পড়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বাবা সঙ্গে যেতেন, আসবার সময় প্রায়ই এই ভদ্রলােকের সঙ্গে দেখা হত। আমাদের দুজনের মধ্যে খুব খাতির হয়েছিল। দাঁড়া, সবটা বলি। চা বানিয়ে আনি আগে। 

ঘরে আলাে জ্বলছিল না। বাইরে ভীষণ দুর্যোগ। অল্প একটু ঝড়-বাদলা হলেই এখানকার কারেন্ট চলে যায়। ঘরে যে একটিমাত্র হ্যারিকেন ছিল, সেটি জ্বালিয়ে লুডু খেলা হচ্ছে। বাবাও খেলছেন বেশ সাড়াশব্দ করেই। রুনুর গলা সবচেয়ে উচুতে। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

সে কি বাবা, তােমার চার হয়েছে, পাঁচ চাললে যে? পাঁচই তাে উঠল। ‘ই, আমার বুঝি চোখ নাই। এবার থেকে তােমার দান আমি মেরে দেব।” 

অন্ধকার ঘরে বসে বৃষ্টি পড়া দেখছি। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে গেল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। টিনের চালে বাজনার মতাে বৃষ্টি, অপূর্ব লাগে। রাবেয়া চা। নিয়ে খাটে উঠে এল। দু’ জনে চাদর গায়ে মুখােমুখি বসলাম। রাবেয়া বলল ‘গােড়া থেকে বলি? 

‘বল।” 

‘থ্রিতে পড়ি তখন। মর্ণিং স্কুল। এগারােটায় ছুটি হয়ে গেছে। আমি আর উকিল সাহেবের মেয়ে রাহেলা বাসায় ফিরছি, এমন সময় ঐ ভদ্রলােক কী মনে করে লম্বা পা ফেলে আমাদের কাছে এলেন। আমাকে বললেন, ‘তােমরা কোথায় যাবে? চল তােমাদের পৌছে দিই। গাড়ি আছে আমার। ঐ দেখ, দাঁড় করিয়ে রেখেছি। 

রাহেলা বলল, ‘আমরা হেঁটে যেতে পারব।’ 

‘না-না, হেঁটে যাবে কেন? এস এস, গাড়িতে এস। মিষ্টি খাবে তােমরা? নিশ্চয়ই খাবে। কি বল ? 

ভদ্রলােক আমাদের দিকে না তাকিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, ‘তুমি নেমে যাও, একটা রিকশা করে জিনিসগুলি নিয়ে যাও, আমি বাচ্চাদের নিয়ে একটু ঘুরে আসি।’ 

আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। গাড়িতে চড়ার লােভ ষােলআনা আছে। আবার ভয়-ভয়ও করছে। রাহেলা ফিসফিস্ করে বলল, ও কে রে ভাই? 

আমি মিথ্যা করে বললাম, ‘আমাদের এক জন চেনা লোক, চল বেড়িয়ে আসি। 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

রাহেলা বলল, ‘ছেলেধরা না তাে? 

তখন চারদিকে খুব ছেলেধরার কথা শােনা যেত। ছেলেধরারা নাকি ছেলে মেয়ে ধরে নিয়ে হােটেলে বিক্রি করে দেয়। সেখানে মানুষের মাংস রান্না হয়। বে অবির মাংস খেতে গিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ের কড়ে আঙুল পেয়েছে। এই জাতীয় গল্প । রাহেলার কথা শুনে ভয় পেলেও হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছি, ছেলেধরা এমন হয় 

বুঝি? ভদ্রলােক গাড়ির দরজা খুলে আমাদের ডাকলেন। উঠে বসলাম দু জনেই।। | মিষ্টির দোকান দেখে তাে আমি হতভম্ব। মেঝেতে কার্পেট, দেয়ালে দেয়ালে ছােট ছােট লম্বা মাদুরে অদ্ভুত সব ছবি, টেবিলগুলির চারপাশে ধবধবে প্লাস্টিকের চেয়ার, প্রতিটি টেবিলে সবুজ কাঁচের ফুলদানিতে টাটকা ফুল। ঘরের মাঝখানায় কাঁচের জারে রং-বেরংয়ের মাছ। রাহেলা পাংশু মুখে বলল, আমার বড় ভাই করছে ভাই।’ | ‘বল খুকিরা, কী খাবে? কোনাে লজ্জা নেই, যত ইচ্ছে, আর যা খুশি। আমি নিজে মিষ্টি খাই না। তােমরা খাও।” 

ভদ্রলােক হড়বড়িয়ে কথা বলতে বলতে সিগারেট ধরালেন। রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তােমার কী নাম খুকি ?

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ 

‘রাহেলা। পাংশু মুখে বলল রাহেলা। ‘খাও খাও, লজ্জা করাে না। রাহেলা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, ‘আমার ভয় করছে, আমি বাসায় যাব।’ 

অল্প দিনেই ভয় ভেঙে গেল আমাদের। ভদ্রলােকের সঙ্গে রােজ দেখা হতে লাগল। তিনি যেন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাদের জন্যেই। দেখা হলেই বলতেন, গাড়িতে করে বেড়াতে ইচ্ছে হয় খুকি? ড্রাইভার, মেয়ে দু’টিকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আস।’ | শুধু রাহেলাই নয়, মাঝে মাঝে অন্য মেয়েরাও থাকত। তারা বলত, ‘রাবেয়া, কেউ যদি দেখে ফেলে, তবে? 

এর মধ্যে আমি অসুখে পড়লাম। এক মাসের মতাে স্কুল কামাই। হাড় জিরজিরে রােগা হয়ে গেছি। পায়ের উপর দাঁড়াতে পারি না এমন অবস্থা, মাথার সব চুল পড়ে গেছে, আঙুল ফুলে গেছে। অফিস থেকে ফিরেই বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বেড়াতেন। এক দিন এমন বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ দেখি ঐ লােকটি গটগট করে এসে ঢুকছে গেট দিয়ে, মুখে সিগারেট, ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়ছে। বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘কী চান আপনি? 

মেয়েটির অসুখ করেছে? ‘হ্যাঁ। 

কী অসুখ? লিভার ট্রাবল। 

‘আপনি যদি বলেন তবে আমি এক জন বড়াে ডাক্তার পাঠাতে পারি, আমার এক জন বন্ধু আছেন।’ 

শঙ্খনীল কারাগার-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ

বাবা একটু রেগে বললেন, ‘মেয়েকে বড়াে ডাক্তার দেখাব না টাকার অভাবে, এই ভেবেছেন আপনি? 

ভদ্রলােক বললেন, ‘কাকে দেখিয়েছেন, আপনি যদি দয়া করে– ‘শরাফত আলিকে। ভদ্রলােক খুশি হয়ে গেলেন। আমি শরাফতের কথাই বলছিলাম। বাবা বললেন, আপনি চলে যান। কেন এসেছেন এখানে?’ ‘না, মানে– ‘আর আসবেন না। 

ভদ্রলােক খুব দ্রুত চলে গেলেন। কথাবার্তা শুনে মা বেরিয়ে বললেন, কী হয়েছে ? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’ 

‘তবিদ হােসেন এসেছিল। 

যদিও আমি তখন খুব ছােট, তবু বাবা-মা দু’ জনের ভাবভঙ্গি দেখেই আচ করেছিলাম এই লােকটি তাদের চেনা এবং দু’ জনের কেউই চান না সে আসুক। 

তারপর আর দেখি নি তাঁকে। এই এত দিন পরে আবার এসেছেন চকোলেট নিয়ে। 

‘লােকটি কে রে রাবেয়া ? 

রাবেয়া জবাব দেবার আগেই বাবা ঢুকলেন, ভাত দিয়ে যাও মা। সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ি। 

‘আগে চকোলেট খাও বাবা। এই নাও।’ 

কে এনেছে চকোলেট, খােকা তুই নাকি? “না বাবা, আবিদ হােসেন এনেছেন। 

বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘দেশে ফিরেছে জানি না তাে। এক জার্মান। মেয়েকে বিয়ে করেছিল শুনেছিলাম। সেখানেই নাকি থাকবে! 

আমি বললাম, আবিদ হােসেন কে বাবা? 

‘আমার এক জন বন্ধুমানুষ। রেলওয়ে ইঞ্জিনীয়ার, খুব ভালাে সেতার বাজাতে জানে। 

সকাল সকাল খাওয়া সারা হল। একটিমাত্র হ্যারিকেনে চারদিক ভৌতিক লাগছেআমাদের বড়াে বড়াে ছায়া পড়েছে দেয়ালেবাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টিঝড় উঠেছে হয়তাে, শোঁ শোঁ আওয়াজ দিচ্ছেমন্টু বলল, বাবা, গল্প বলেন। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *