কি বিশ্রী নাম—খুকি। এর পর যদি ছেলে হয় হয়ত নাম রাখবে—খােকা।
লীনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তাদের প্রথম মেয়ের নাম সে রেখেছিল লােপামুদ্রা, পরের মেয়েটির নাম পা। ওরা কোথায় গেল? মৃত্যুর পর শিশুরা কোথায় যায়?
সেই দেশে একা একা ওরা কী করে? বাবা মার জন্যে অপেক্ষা করে কি? একদিন লীনা যখন যাবে ওরা কি তখন সেই ছােটটিই থাকবে না বড় হয়ে যাবে? যদি ছােট থাকে তাহলে কি চিনতে পারবে তাদের মাকে? মা মা বলে ছুটে আসবে তার দিকে? যদি ছুটে আসে তাহলে কাকে সে প্রথমে কোলে নেবে? লােপাকে না পাকে?
” লীনার বুক জ্বালা করছে। সে দরজা খুলে বারান্দায় এল। বেনু বলল ‘ঘুমান নাই আফা?’
দেখেন না কি বিরক্ত করে। ইচ্ছা করতাছে একটা আছাড় দেই। ‘ছিঃ এসব কী কথা। দেখি আমার কাছে দাও তাে।’ | বেনু তার মেয়েকে লীনার কাছে দিল। মেয়েটির কান্না থামল না। লীনা বলল, গরম লাগছে বােধ হয়, জামাটা খুলে দেব?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘দেন।
‘মেয়ের তাে খুব ঘামাচি হয়েছে। আমার ঘর থেকে পাউডার নিয়ে এস তাে বেলু, পাউডার দিয়ে দিই।
গায়ে পাউডার দেয়াতে হয়ত একটু আরাম হয়েছে। খুকি ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত-পা ছড়িয়ে ঘুম। মেয়েটা দেখতে সুন্দর হয় নি। বাবার মতো ভোঁতা ধরনের চেহারা। দাঁতগুলােও সম্ভবত উচু—তবু কী সুন্দরই না লাগছে। মানব শিশুর মতাে সুন্দর এ পৃথিবীতে আর কিছুই বােধ হয় নেই।
লীনার খুব ইচ্ছে করছে বলে—বেন, তােমার মেয়ে আজ থাকুক আমার এখানে। তা সে বলতে পারল না। সহজ গলায় খুব সাধারণভাবে যা বলল তা হচ্ছে, ‘নিয়ে যাও বেনু, ঘুমিয়ে পড়েছে। | বেনু তার মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। লীনা ঠিক আগের ভঙ্গিতে খাটের উপর বসে আছে। পানি খেতে পারলে ভালাে হত। বুক শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না।
পাশের ঘরে এখনাে ভিসিপি চলছে। এরা কি সত্যি-সত্যি সারা রাত ছবি দেখাবে নাকি। হাশমত আর বেনু দু’জনেই খুব হাসছে। এ রকম হাসাহাসির মধ্যে বাচ্চা ঘুমুবে কী করে? এই সহজ জিনিসটা বােঝে না কেন?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লীনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার লােপার কথা মনে পড়ছে। কেমন থপ থপ করে হাঁটত। চলন্ত কোনাে পােকা টোকা দেখলেই খপ করে ধরে মুখে পুরে ফেলত। সেই মুখ তখন কিছুতেই হাঁ করান যেত না। যেন পৃথিবীর সবচে লােভনীয় খাবারটি তার মুখে। এক বছর বয়সে কত কথা শিখে গেল-L কিছু কিছু কথার আবার কোনাে অর্থই নেই। যেমন, ইরি কিরি মিরি মিরি।
লীনা বলত, ‘এসব কোন পৃথিবীর ভাষা মা? লােপা ভাতে আরাে মজা পেত। হাত নেড়ে নেড়ে আরাে অনেক উৎসাহ নিয়ে বলত, ‘ইরি কিরি মিরি মিরি।’
লীনার চোখ জ্বালা করছে। সে বিছানায় উঠে বসল। কী করা যায়? কী করলে এই মেয়েটার কথা ভুলে থাকা যায়? লােপা পা এদের কথা সে কিছুতেই মনে করতে চায় না। কিছুতেই না।
পাশের ঘরে খুকি কাঁদছে। বেনুর বিরক্ত গলা শােনা যাচ্ছে। লীনা কি উঠে গিয়ে ওদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলবে, ‘বেনু, ওকে আমার কাছে দিয়ে যাও।
নাকি চুপচাপ বিছানায় বসে থাকবে।
একা একা বসে থাকতে আসিফের কখনাে খারাপ লাগে না। | আজ লাগছে। সােফাটায় কোনাে ঝামেলা আছে কি না কে জানে। কোনােভাবে বসেই আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে—খাওয়া যাচ্ছেনা। সাইন বাের্ড ঝুলছে—ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। চোখের সামনে এ রকম কড়া একটা সাইন বাের্ড নিয়ে সিগারেট ধরান যায় না। তা ছাড়া ঘরে ফিনাইলের গন্ধ। এই গন্ধ নাকে এলেই কেমন যেন নিজেকে অসুস্থ মনে হয়।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ ঘড়ি দেখল, বারটা দশ। যে অপারেশন এগারটায় হবার কথা সেটা এখন হবে রাত একটায়। এনেসথেসিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নাকি কোন বিয়ে বাড়িতে গেছেন, বলে গেছেন বারটার দিকে ফিরবেন। সেইভাবেই ব্যবস্থা হয়েছে। আসিফের বড় বােন রেহানা খুব ছটফট করছেন। একবার তিন তলায় যাচ্ছেন আবার আসছেন এক তলায়।
এই ক্লিনিকটা বেশ ভালাে। লিফট আছে। মাঝরাতেও লিফটম্যান আছে। রেহানা লিফটে উঠছেন না। সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা-নামা করছেন। রেহানার শরীর বিশাল, কিন্তু তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে এবং তিনি খুব ঘামছেন।
আসিফ বলল, তুমি শান্ত হয়ে বস তাে আপা। এ রকম করছ কেন? এনেসথেসিস্টতে এখনও এল না। অন্য কোনাে ক্লিনিকে নিয়ে যাব?
এসে পড়বেন। তুমি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছ। বস আমার পাশে। তােমার নিজের হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে।’
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
রেহানা বসলেন না। ছটফটিয়ে আবার তিন তলায় রওনা হলেন। তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এনেসথেসিস্ট এসে পড়ল। এক ধরনের টেনশান আসিফের মধ্যেও ছিল। এখন আর তা নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সােফায় বসতেও তার আরাম লাগতে শুরু করেছে।
ঘুম ঘুমও পাচ্ছে। এ ভাবে বসে থাকলে ঘুম এসে যেতে পারে। আসিফ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে, ধরান যাচ্ছে না। চারদিকে আত্মীয়স্বজন। ঢাকা শহরে যেখানে যে ছিল সবাই চলে এসেছে। ক্লিনিকের সামনে ছ’সাতটা গাড়ি।
আসিফদের পাঁচ বােনের চার জনই থাকে ঢাকাতে। তারা সবাই এসেছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। হুলস্থূল ব্যাপার। এদের প্রায় কাউকেই সে ভালােমতো চেনে
কয়েকবার হয়ত দেখা হয়েছে, ‘কি কেমন? ভালাে?’—এই জাতীয় কথাবার্তা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। বােনদের স্বামীর বাড়ির লােকজনদের সে যেমন চেনে না, ওরাও চেনে না। তবু কয়েকজন চকচকে চেহারার মানুষ আসিফকে বলল, ‘কি,
ভালাে?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ খুবই পরিচিত ভঙ্গিতে হেসেছে। কথাবার্তা পর্ব এই পর্যন্তই।
এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে গার্লস হাইস্কুলের একজন দরিদ্র এ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার তাঁর পাঁচ মেয়েকেই খুব ভালাে বিয়ে দিয়েছেন, অথচ মেয়েগুলাে পড়াশােনা বা দেখতে শুনতে এমন কিছু না। আসিফ তার বাবা মার পাঁচ কন্যার পরের সন্তান।
শুধুমাত্র এই কারণেই যতটুকু আদর তার পাওয়া উচিত ছিল তার শতাংশও সে। পায় নি। আসিফের বাবা সিরাজুদ্দিন সাহেব তাঁর সর্বশেষ সন্তানকে কঠিন হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন। তাঁর এই ছেলে যে হীরের টুকরাে ছেলে এটা তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান।
অন্য বাচ্চারা যখন এক দুই শিখছে, তখন তাঁর ছেলে শিখছে তিনের ঘরের নামতা। ক্লাশ টুতে উঠেই সে রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতা গােটাটা মুখস্থ বলে লােকজনদের চমকে দিতে শিখে গেল। সিরাজুদ্দিন সাহেবও পুত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ। বাড়িতে কেউ এলে আসিফকে তার প্রতিভার পরীক্ষা দিতে হয়। বীরপুরুষ কবিতা মুখস্থ বলবার পর সিরাজুদ্দিন সাহেব নিজেই বলেন, ‘আচ্ছা বাবা, তিন আঠার কত বল তাে?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ গম্ভীর গলায় বলে, চুয়ান্ন। অতিথি চমকে উঠে বলেন, ‘আঠারাের ঘরের নামতা জানে না কি! সিরাজুদ্দিন সাহেব উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, ‘ইংরেজি জিজ্ঞেস করেন। বানান জিজ্ঞেস করেন। আচ্ছা বাবা, জিরাফ বানানটা কি বল তাে?” আসিফ বানান বলে। অতিথি যত না চমৎকৃত হন, বাবা হন তারচে বেশি। গম্ভীর গলায় বলেন, ‘সবই হচ্ছে ট্রেনিং। যত্ন নিতে হয়।
(চলবে)