বজলু সাহেব
উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছােটাছুটি করতে লাগলেন। সবই আগের মতাে, শুধু আসিফ এবং লীনা নেই। এরা দু’জন যেন হঠাৎ উবে গেছে।
অথচ সবাই জানে তারা আগের জায়গাতেই আছে, সেই আগের বাসায়। পূর্ব নাট্যদলের যেমন কোনাে পরিবর্তন হয় নি, তেমনি আসিফ এবং লীনারও কোনাে পরিবর্তন হয় নি। আসিফ শুধু বলেছে, সে অভিনয় করবে না। কেন অভিনয় করবে না, সমস্যাটা কি—এই কথা পূর্ব নাট্যদলের কেউ জানতে পারে নি। অনেক চেষ্টা করেও পারে নি। শুধু পুষ্প খানিকটা জানে। তাকে আসিফ একটা চিঠি লিখেছিল।
আমার খুব ইচ্ছা ছিল মুখােমুখি কিছুক্ষণ তােমার সঙ্গে কথা বলি, কেন অভিনয় ছেড়ে দিলাম তা তােমাকে গুছিয়ে বলি। তা সম্ভব হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, জানতে চেও না।
সাজঘর (শেষ-পর্ব): হুমায়ূন আহমেদ
দেখ পুষ্প, অভিনয় আমার বড়ই শখের জিনিস। এর কারণে আমি যেমন একদিকে সব কিছু হারিয়েছি, আবার তেমনি অনেক পেয়েছিও। লীনার মতাে একটি মেয়েকে পাশে পাওয়া কত বড় ভাগ্যের ব্যাপার, তা আমি তােমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আর শুধু কি লীনা? তােমাকেও কি আমি অভিনয়ের কারণেই পাই নি? লজ্জা পেও না পুষ্প, সত্যি কথাটা বলে ফেললাম। বেশিরভাগ সময়ই আমরা সত্যি কথা লুকিয়ে রাখি, তবু মাঝে–মাঝে বলতে ইচ্ছে করে।
যে কথা বলছিলাম, অভিনয় আমার জীবনের অনেকখানি, কে জানে হয়তােবা সবখানি। সেই অভিনয় থেকে সরে আসা যে কী কষ্টের, তা মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ। কেন সরে এলাম? পুরােটা তােমাকে বলতে পারছি না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, আমার এবং লীনার জীবনে একটি গভীর ট্র্যাজিডি আছে। গহীন একটি ক্ষত। লীনার কেন জানি মনে হয়েছে, আমরা দুজনই যদি বড় কোনাে সেক্রিফাইস করি, তাহলে হয়তাে বা ট্র্যাজিডির অবসান হবে। লীনার মনের শান্তির জন্যে এইটুকু আমাকে করতেই হবে। অভিনয় তাে জীবনের চেয়ে বড় নয়, তাই না?
তােমাকে এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু দুঃখের কাঁদুনি গাওয়া নয়। এই জিনিস আমি কখনাে করি না। তােমাকে চিঠি লেখার একটিই কারণ, তা হচ্ছে তুমি যেন অভিনয় ছেড়ে না দাও| অভিনয়ের যে অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে তুমি জন্মেছ, সেই ক্ষমতাকে নষ্ট করাে না। সব মানুষকে সব ক্ষমতা দিয়ে পাঠান হয় না। যাদেরকে দেয়া হয়, তাদের উপর আপনাতেই সেই বিশেষ প্রতিভার লালন করার দায়িত্ব এসে পড়ে। তুমি অনেক বড় হবে পুষ্প। অনেক অনেক বড়। এইটি আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
সাজঘর (শেষ-পর্ব): হুমায়ূন আহমেদ
সত্যি–সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে সেদিন আমার চেয়ে সুখী কেউ হবে না, এই কথাটি তােমাকে জানানাের জন্যেই আমার দীর্ঘ চিঠি। তালাে থেক, সুখে থেক।
পনের বছর পরের কথা।
আসিফ তার স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে ময়মনসিংহে আসছেন। মেয়েটির বয়স চোদ্দ। তার নাম চন্দ্ৰশীলা। অসম্ভব চঞ্চল মেয়ে। এক দণ্ডও সুস্থির হয়ে বসতে পারে না। ট্রেনে সারাক্ষণ বকবক করেছে। তার মাথায় একটা রঙিন স্কার্ফ বাঁধা ছিল, জানালা দিয়ে অনেকখানি মাথা বের করায় হাওয়ায় সেই স্কার্ফ উড়ে চলে গেছে। লীনা খুব রাগ করেছেন।
সেই রাগ অবশ্যি চশীলাকে মােটেই স্পর্শ করে নি। সে বাবার গায়ে হেলান দিয়ে কি একটা বই পড়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। লীনা বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে? চুপ করে ভদ্রভাবে বস না। চশীলা বলল, ‘তুমি নিজে চুপ করে ভদ্রভাবে বসে থাক তাে মা, আমাকে বকবে না। এনিতেই স্কার্ফ হারিয়ে আমার মনটা খারাপ।
লীনা কঠিন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই সব কঠিন কথা কেমন এলােমেলাে হয়ে যায়। মেয়েটা অবিকল এপার মতাে হয়েছে। কঠিন কিছু বললেই নিচের ঠোট উল্টে ফেলে।
আসিফ সাহেব বললেন, ‘বই টই সব ব্যাগে গুছিয়ে ফেল মা, এসে পড়েছি।
চন্দ্ৰশীলা বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম কেন বাবা? আমার নামতে ইচ্ছা করছে না।
‘কী করতে ইচ্ছা হচ্ছে?
‘ট্রেনেই থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা বাবা, সারাজীবন যদি আমরা ট্রেনে–ট্রেনে থাকতাম, তাহলে ভালাে হত না?‘
‘হা, ভালােই হত।‘
স্টেশনে অসম্ভব ভিড়। আসিফ সাহেব অনেক কষ্ট্রে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে নামলেন। ভিড় ঠেলে এগুতে পারছেন না, এমন অবস্থায় লীনা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী ব্যাপার বল তাে?
সাজঘর (শেষ-পর্ব): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ বললেন, ‘মনে হচ্ছে বিখ্যাত কেউ ট্রেন থেকে নেমেছেন। লােকজনদের হতে প্রচুর মাল–টালা দেখা যাচ্ছে।
চন্দ্ৰশীলা বাবার হাত ধরে সাবধানে ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে। সে আড়ে–আড়ে ভীত চোখে মার দিকে তাকাচ্ছে, কারণ ভিড়ের চাপে তার বাঁ পায়ের স্যান্ডেলটি সে হারিয়ে ফেলেছে। মা জানতে পারলে আবার খোঁজাখুজি শুরু করবেন। চশীলার ইচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়া। একটা স্যান্ডেল গিয়েছে তাে কী হয়েছে? আরেক জোড়া কিনলেই হবে। এই জোড়াটা এনিতেও তার পছন্দ না। ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙ। সে
এবার মেরুন রঙের স্যান্ডেল কিনবে। | চন্দ্ৰশীলা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। হতভম্ব হয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘বাবা দেখ, ট্রেন থেকে কে নামছেন দেখ। পুষ্প, পু। বাবা, উনি পুষ্প না? কী আশ্চর্য, আমরা এক ট্রেনে এসেছি।
আসিফের কাছে ভিড়ের রহস্য স্পষ্ট হল। আজকের পত্রিকায় অবশ্যি ছিল—পুষ্প ময়মনসিংহ টাউন ক্লাবে যাবে। সেখানে কি একটা অনুষ্ঠান করার কথা।
‘বাবা, উনি কি পূল্প? ‘ । ‘বাবা, উনি কি আমাকে একটা অটোগ্রাফ দেবেন? ‘এই ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে যাবার কোনাে উপায় নেই মা।
পুষ্প বিরাট একটা কালাে চশমায় চোখ ঢেকে রেখেছে। তাঁকে ঘিরে আছে বলিষ্ঠ কিছু ছেলেমেয়ে, যেন কেউ কাছে যেতে না পারে। তবু লােকজন এগুতে চেষ্টা করছে।
সাজঘর (শেষ-পর্ব): হুমায়ূন আহমেদ
বাবা একটু দেখ না, ওনার একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যায় কি না। আমার খুব শখ। উনি দেখতেও তাে খুব সুন্দর, তাই না বাবা?”
আসিফ মেয়েকে নিয়ে ভিড় ঠেলে কাছে যেতে চেষ্টা করছেন। লীনা একা–একা দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছেন। তাঁর চোখ জ্বালা করছে। জল আসবার আগে–আগে চোখ এমন জ্বালা করে।
আসিফ মেয়েকে নিয়ে পুষ্পের কাছাকাছি পৌছে গেছেন। চন্দ্ৰশীলা ছােট নােটবুক উচু করে ধরে আছে। | পুষ্প তার হাত থেকে নােটবুক নিয়ে দ্রুত কী সব লিখে নােটবুক ফেরত দিল। চোখের কালাে চশমা খুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল আসিফের দিকে, তারপর সবাইকে হতভম্ব করে নিচু হয়ে তাঁর পা স্পর্শ করল। পরমুহুর্তেই এগিয়ে গেল সামনে। মানুষের ভিড় বড়ই বাড়ছে। স্টেশন থেকে বের হয়ে যেতে হবে। তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই।
চন্দ্ৰশীলা কান্না–কান্না গলায় বলল, “বাবা, উনি তােমাকে চেনেন? তুমি তাে কোনােদিন বল নি। তুমি এরকম কেন বাবা? অভিমানে তার নিচের ঠোঁট বেঁকে গেছে। চোখে জল টলমল করছে। হয়ত সে কেঁদে ফেলবে। এই বয়সী মেয়েরা অল্পতেই কেঁদে ফেলে।
(চলবে)