সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১০

সে ছিল আসলে যাকে বলে সত্যযুগ। তখন স্বর্গ থেকে দেবতারা ‘আসতেন পৃথিবীতে। দেবরাজ ইন্দ্রের বাহনের নাম ঐরাবত। ঐরাবতও মাঝে মাঝে স্বর্গের জলে চান করে সুখ পেত না—তেষ্টা মিটত না। চলে আসত পৃথিবীতে। জোলাপাড়ার কাছে ছিল একটা দিঘি। সেই দীঘিতে নেমে শুড়ে জল তুলে খেলা করত। তারপর স্বর্গে ফিরে যেত।

নিঝুম রাতের আতঙ্ক 

একদিন হয়েছে কী, ঐরাবত নেমেছে দিঘির জলে—সেই সময় করিম চান করছে। যেই ঐরাবত চান সেরে আকাশে উঠতে শুরু করেছে, সেই তার লেজটা ধরেছে চেপে। 

স্বর্গে পৌছল ঐরাবত । করিম লেজ ছেড়ে এদিক ওদিক দেখে অবাক। স্বর্গ বলে কথা! এদিকে দেবতা অপ্সরারা মানুষ দেখে ভিড় জমিয়েছেন। সশরীরে মানুষ যখন স্বর্গে এসেছে তখন না জানি কোন মহাপুণ্যবান মহাপুরুষ। সবাই খুশি হয়ে বলেন—কী চাও বৎস, কী চাও বলে ? করিম ভেবেই পেল না কী চাইবেশেষে বলল—সুতাে চাই, হুজুর। 

প্রচুর সুতাে দেওয়া হল তাকে। তারপর ঐরাবত যখন আবার পৃথিবীতে চান করতে নামছে, তার পিঠে চাপিয়ে দয়ালু দেবতারা ( করিমকে ফেরত পাঠালেন। 

জোলাপাড়ার সবাই ব্যাপারটা দেখে অবাকএত সুতাে দিয়েছেন দেবতারা। তারা করিমকে বলল—ভাই, একদিন ঐরাবত নামলে যেন আমাদের খবর দিও। 

যথারীতি ঐরাবত নেমেছেসে জোলা পাড়া সুদ্ধ; খবর দিলতারপর ঐরাবতের লেজ ধরল। বাকি সব লােক একের পর এক তার পেছনে কোমরের কাপড় আঁকড়ে ধরলঐরাবত যখন আকাশে উড়ল, দেখা গেল লম্বা একটা মানুষের শেকল তার লেজ ধরে উঠছে। 

কিছুটা ওঠার পর সবার নীচের লােকটি জিজ্ঞেস করল—ভাই কেত্তা সুতা মিলেগা ? করিম তো ছিল লেজ ধরে। সে দুহাত ছেড়ে সুতাের পরিমাণ দেখিয়ে বলল—এত্তা সুতা মিলেগা ! ব্যস, সবাই আকাশ থেকে দুমদাম পড়ে গেল। স্বর্গে যাওয়া হল না তাে বটেই, কজনের হাড়গােড় আস্ত রইল সেও ভাববার কথা। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১০

এই গল্পটা কিন্তু সবচেয়ে সরেস। 

করিমের বাবার বড় দুঃখ ছিল, সবাই করিমকে বােক বলে। তার বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে হাসাহাসি করে। এ কলঙ্ক দূর করতেই হবে। তাই করিমের বাবা ঠিক করল, ওকে শহরে পাঠাবে বুদ্ধি কিনতেদশটা টাকা দিয়ে পাঠাও। 

করিম বুদ্ধি কিনতে গেছে শহরে। বাজারে ঢুকে একখানে দেখে আলুর আড়তসে জিগ্যেস করল—এগুলাে গােল-গোল দেখতে, কী ভাই ? আলুওয়ালা বুঝতে পারল, এ নিশ্চয় সেই করিমবলল– বলব কেন? টাকা দিতে হবেতবেই বলব। 

করিম দরাদরি করে পাঁচ টাকায় রফা করল। আলুওয়ালা টাকাটা পকেটে পুরে বলল-বুঝলে ভায়া? ওর নাম 

. একটা বুদ্ধি কেনা হল। করিম এগিয়ে যায়। তারপর চোখে পড়ল দালানবাড়ি। একজন রাস্তার লােককে জিগ্যেস করল-~এটা কি ভাই ? সে লােকটা ছিল ঠক। প্রশ্ন শুনেই বুঝল, এ নিশ্চয়। সেই করিম। সেও আলুওয়ালার মতাে টাকা চাইল। বাকি পাঁচটা টাকা তাকে দিলে সে বলল –বুঝলে ভায়া? এ হচ্ছে পাকা দফান করিম তত বুদ্ধি কিনে আনন্দে আটখানা হয়ে গায়ে ফিরল। খবর পেয়ে তাকে খুব খাতির করতে থাকল পাড়ার লােকে। | একদিন গায়ের পথে যাচ্ছে রাজার ছেলের বরযাত্রী। হাতীঘোড়া লোকলস্কর বাজনা। করিমের বাবা অবাক। এমন কাণ্ড তাে সে কখনও দেখেনি। তাই সে তার বুদ্ধিমান ছেলেকে জিগ্যেস করল এ কী বলল তো করিম ? 

বুদ্ধিমান করিম অনেকক্ষণ ধরে বিয়ের মিছিল দেখে-টেখে শেষে, গম্ভীর মুখে বলল—হয় গােল আলু, নয়তাে পাকা দালান। ঘুঘুডঙিার ব্রহ্মদৈত্য ভূতের স্বপ্ন তাে সবাই দেখে ! তাই বলে কি ভূত বিশ্বাস করতে হবে? এই হচ্ছে ভবভূতিবাবুর স্পষ্ট কথাতিনি যৌবনে দুর্দান্ত শিকারী ছিলেন। বনে জঙ্গলে পােড়া বাংলােয় ঘুরেছেন। কোথায় ভূত

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১০

তাঁর বন্ধু গজপতি গো ধরলেন-আজকাল এই ভিড় হল্লা আলো আর যন্তরের ঠেলায় বেচারী ভূতেরা থাকবে কোথায়? তাই মানুষের স্বপ্নে গিয়ে আড্ডা নিয়েছে। গজপতি আরও বলেন, উপায়টা কী? মানুষের হাতে আজকাল কত রকম জব্বর অস্ত্রশস্ত্রঅ্যাটমবােমা, হাইড্রোজেন বােমা, নিউট্রন বােমাতার ওপর কত রকম সাংঘাতিক ওষুধপত্র বেরিয়েছে। তাই ভূতেরা মানুষের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়ে নিরাপদে কাটাচ্ছেস্বপ্নে মানুষ তাে একেবারে অসহায় বুঝলে নাভবভূতি তা মানতে রাজি নন। 

বলেন—হ্যা, একথা সত্যি, সুন্দরবন বাঘ প্রকল্পের অভয়ারণ্যের মতাে রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্পের এক অদ্ভুত অভয়ারণ্যে স্বপ্নে ভ্রমণ করে এসেছি। কিন্তু স্বপ্ন ইজ স্বপ্নঅর্থাৎ স্বপ্ন জিনিসটা জলজ্যান্ত মিথ্যে। যাকে পদ্যে বলে, ‘আপন মনের মাধুরী। মাধুরী ? বলে গজপতি চোখ কটমট করে তাকানমাধুরী বলছ ? 

গজপতিকে অমন করে তাকাতে দেখে ভবভূতি বাঁকা হেসে বলেন -আলবাৎ মাধুরী। 

গজপতি বলেন—মাধুরীকে তুমি চেনাে ? ভবভূতি অবাককী কথায় কী! বলেন—তার মানে ? —মাধুরী ছিলেন আমার পিসতুতাে দিদি। তঁার বিয়ে হয়েছিল ঘুঘুডাঙায় ! জামাইবাবু ছিলেন রেলের গার্ডঅ্যাকসিডেন্টে মারা যানতারপর 

কি বুঝলাম নাভবভূতি বাধা দিয়ে বলেন| বিরক্ত গজপতি বলেনকথা শেষ করতে দেবে তাে? খালি তত্ত্ব আর তক্ক। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে এক একর জায়গায় একটা বাড়ি ছিল জামাইবাবুরপৈতৃক বাড়িওর মৃত্যুর পর সেই বিশাল বাড়িতে একা মাধুরীদিদি থাকতেন। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১০

 ভবভূতি খিক খিক করে বলেন-~আর থাকতেন তােমার জামাইবাবু, অর্থাৎ ভূত। 

গজপতি রীতিমতাে গর্জন করে বলেন—না ব্ৰহ্মদৈত্য। 

-ব্রহ্মদৈত্য! ভবভূতি তাজ্জব হয়ে যান। 

হ্যা উঠোনের কোনায় একটা বেলগাছ। সেই গাছে সে মাঝে মাঝে রাত দুপুরে প্রায় উঠানে পায়চারি করতে নামতমাধুরীদি জেগে থাকলে বলতকী গাে ! গরম লাগছে বুঝি? ব্ৰহ্মদৈত্য বলত—না গাে ! আজ সন্ধেবেলা একটা ভােজ ছিল। খাওয়াটা বেজায় রকমের হয়ে গেছেতাই হজম করার তালে আছি। তাে তখন মাধুরীদিদি জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হজমের গুলি দিতে ডাকছেন—নাও গো ! টুক করে গিলে ফেলে এক গেলাস জল খেও। সব হজম হয়ে যাবেব্ৰহ্মদৈত্য মস্ত লম্বা কালাে হাতখানা জানলা অব্দি বাড়িয়ে দিতহাতে কাড়িকাড়ি নােমভবভূতি আরও হেসে বলেন—তুমি দেখেছ ?

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *