ভয়েভয়ে টিউবেলের কাছে গিয়ে সেই ঝােপটার দিকে তাকালুম।
কেউ নেই তাে ওখানে! একহাতে টিউবেলের হাতল চেপে অন্যহাতে জল খাওয়া ভারি কঠিন। হঠাৎ মনে হল হাতলটায় কেউ চাপ দিচ্ছে। গলগল করে জল পড়তেও দেখলুম। জলের তেষ্টা এত বেশি যে অত কিছু লক্ষ্য না করে জল খেতে থাকলুম।
জল খাওয়ার পর ভয়টা অনেকটা কেটে গেল। তখন মনে হল, নেহাত চোখের ভুল। সেই সময় চোখ গেল মুক্তকেশীর মন্দিরের দিকে। অমনি আবার বুক কেঁপে উঠল। কী অবাক। পােদো মন্দিরের বারান্দা থেকে হাত ইশারা করে ডাকছে।
মনে হল, তাহলে নিশ্চয় পেদো একেবারে মারা পড়েনি। তার মানে, শ্মশানে গিয়ে যেভাবেই হােক বেঁচে উঠেছিল—কিংবা কোন সাধু সন্ন্যাসীর দয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। আমাদের খবরটা কোন কারণে জানানাে হয়নি।
ছেলেমানুষের বুদ্ধিতে এভাবেই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করলুম। মরিয়া হয়ে মন্দিরের জঙ্গলে ঢুকে পড়লুম।
সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম—পপাদো! তুই বেঁচে আছিস?
পােদো ঠোটে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর বারান্দার ওপর থেকে একটা ভাজ করা কাগজ ফেলে দিল। কাগজটা খুলে দেখি, সংস্কৃতের প্রশ্নের কতকগুলাে উত্তর লেখা রয়েছে। ঠিক এগুলােই আমার জানা ছিল না। | কাগজে গােটা-গােটা অক্ষরে লেখা উত্তরগুলো প্রাণপণে মুখস্থ করতে থাকলুম। পােদোর বাঁচা-মরা ব্যাপারটা তখন মাথায় আর নেই, পরীক্ষা বলে কথা।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৮
একটু পরেই আচমকা কে আমার কান ধরে ফেলল। অমনি আঁতকে উঠে দেখি পণ্ডিতমশাই।
পণ্ডিতমশাই চেরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন—ওরে হতচ্ছাড়া তস্কর। ওরে কূটবুদ্ধি কুষ্মাণ্ড ! পড়াশুনায় ফাকি দিয়ে এখন এমনি করে চুরির রাস্তা ধরেছ ?
কঁদোকঁদো স্বরে বললুম -না স্যা-স্যর । পাে-পাে-পাে•••
-চোপরাও ! স্তব্ধ হও তস্কর বালক। পণ্ডিতমশাই আমাকে সেই কাগজটা শুদ্ধ, হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চললেন।•••
ক্লাস এইটে ফেল করেছিলুম সেবার—সে ওই পােদোর ভূতের জন্যেই। কিন্তু কেউ কি সেকথা বিশ্বাস করল ? বাবা বলেছিলেন পড়াশুনা করবে না। তাই টুকলিফাই ছাড়া উপায় ছিল না। ধরা পড়ে বেচারা পােদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে !
কিন্তু কাকে বােঝাৰ, ব্যাপারটা কত সত্যি। আমি বলেছিলুম -কিন্তু হাতের লেখাটা তাে আমার নয়! পােদোর লেখা ওটা। মিলিয়ে দেখ না।
শুনে দাদা বলেছিলেন-হতভাগা ! অসুখের আগে পােদে। তাের কাছে সংস্কৃতের মানে বইটা নিয়ে গিয়েছিল না? আমি দেখেছি, বইটা ফেরত আনার পর ওটার মধ্যে পােদোর হাতে লেখা একটা কাগজ ছিল। চালাকি করিস নে ! | আমি কিন্তু দেখিইনি কোন কাগজ। যাক গে, যা হবার হয়েছে। এই গল্পটা অ্যাদ্দিন কাকেও বলিনি। বললেই তাে বলবে, টুকলিফাই করে ভূতের ঘাড়ে বদনাম দেওয়া হচ্ছে। মহা ধড়িবাজ ছেলেরে বাবা!
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৮
দুকুর বেলায় বটের তলায় তখন ঠিকঠাক দুরবেলা। আকাশে কোন বদমেজাজী দেবতা যেন ‘আজব ঝুড়িটি দিয়েছে উপুড় করে। আর সােনালী রােদ্দর গড়িয়ে পড়েছে মাঠ-ঘাট জুড়ে। কী গরম, কী গরম ! বুড়াে বটগাছটার মাথা গেছে গরম হয়ে। আপন মনে গজগজ করছে।
আর তাই শুনে সাতভাই পাখপাখালি শুকনাে পাতার ওপর গড়াগড়ি দিয়ে হেসে খুন। একশো ঝিঝিপােকা হাসতে গিয়ে শেষটা দেখি কেঁদেই ফেলল। ওই শােন, টানা সুরে ইনিয়ে বিনিয়ে কঁদছে কখন থেকে।•••
আরে। ওটা কে? মিলু নাকি? এস, এস। তােমার হাতে ওটা কী? গুলতি? কী মারবে? ব্যাঙ না পাখি? কাঠবেড়ালি,
ভেদড় পােকা, না মাকড় ?
ওসব নয় ? তাহলে কী মারবে ? ওরে বাবা ! বাঘ! তা বাঘ এখানে কোথায়? বাঘ তাে সেদিরবনে। তবে যদি সিংহ মারতে চাও, কথা শােন। সােজা চলে যাও রায়বাবুদের পুকুরপাড়ে । ছাতিমতলায় দাড়িয়ে আছেন মা দুগগা, তার পায়ের তলায় একটা সিংহ পেতেও পারাে।
কী বলছ? ওটা খড়ের সিংহ? একটু দাড়িয়ে থেকে দেখই না, কী হয়। খড়ের সিংহ খাটি সিংহ হয়ে যাবে দেখতে দেখতে। ঢাক বাজবে। কঁসি বাজবে। মা দুগগার সিংহটা তখন পঁাত খিচিয়ে অসুরের কঁাধ ধরবে কামড়ে।
হু, তােমার অত সময় নেই। তর সইছে না। তাই না? বেশ বেশ। শোন তাহলে । বরং একটা কুকুর মেরেই হাত পাকিয়ে নাও। ওই দেখ, সানুদের খেকি কুকুর ঘাস শুকতে শুকতে এদিকেই আসছে। গুলতি বাগিয়েই ধরে দিকি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৮
ওকি! ঘেউ শুনেই ভয় পেয়ে গেলে দেখছি। রামােঃ! তুমি দেখছি ভীতুর ভীতু। আরে, পালাচ্ছ কেন? ও মিলু !••• বাবা ?? . সত্যি ছেলেটা ভোঁ দৌড় দিল যে!
—তুমি আবার কে? বিলু? তুমিই বুঝি মিলুর বােন? বেশ, বেশ। তােমার হাতে ওটা কি? বই ? বাঃ! বই পড়তে খুব ভালাে লাগে তােমার? বইয়ে কিসের গল্প আছে? ভূতপেরেত রাক্ষস-খােক্কস দত্যিদানার তত। ছ্যা ছ্যা! ওসব তাে নিছক গল্প। সত্যিকার ভূতপেরেত রাক্ষস–খােক্কস দত্যিদানা দেখতে চাও? ভয়, কিসের ?
-আরে, পালাচ্ছ কেন? ও বিলু! যা-বাবা। এও যে পালিয়ে গেল।
হু, আবার একজন আসছে।•••কে তুমি? আরে, তােমার চোখ দুটো দেখছি বেজায় লাল। ফুলে–ফুলাে গল । জল ছপছপ করছে। কঁদছ কেন সােনা ? মা বকেছে ? এস, এস। ছায়ায় বসে টুকুন সােনা। এই দেখ, টুকটুকে লাল ফল ফেলে দিচ্ছি। এর নাম বটফল। এই নিয়ে খেলা করে। কেমন ? একটু পরে দেখবে রাজ্যের পাখপাখালি বটফল খেতে এসে তুমুল ঝগড়া করছে। শেয়াল মামাও এসে যাবে ওবেলা। তখন মনে হবে সে এক আজব বাজার বসেছে। আমার পাতার ফাঁকে কত লাল টুকটুকে ফল ধরেছে দেখছ ? নাও, যত ইচ্ছে নাও। খেলা করাে •••
এখন ঠিকঠাক দুরবেলা। ওই দেখ, বুড়াে বটের ছায়ায় বসে কাদের বাড়ির খুকুমণি চোখ মুছতে মুছতে দু’হাত ভরে রাঙা টুকটুকে বটফল কুড়ােচ্ছে।••• ‘
করিম জোলার গল্প
আগের দিনে পাড়াগাঁয়ের লােকেরা ছিল বড় সরল । তাদের মধ্যে করিম জোলা ছিল আরও সরল। তাকে ঠকানাে ছিল খুব সােজা। তার বােকামি নিয়ে কত গল্প চালু ছিল এক সময়।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৮
আসলে করিম জোলার বােকামি নয়, বেশি রকমের সরলতারই পরিচয় মেলে ওইসব গপ্পে। করিম সবাইকে বিশ্বাস করত। টের পেত না, ওকে বেকায়দায় ফেলে তামাসা করা হচ্ছে।
একবার করিম জোলা চলেছে অন্য গায়ে কাপড় বেচতে। হঠাৎ সামনে পড়ল উলুকাশের বন। কাশফুল ফুটে সারা মাঠ সাদা হয়ে আছে। সে মুশকিলে পড়ল। এমন জিনিস তাে কখনও দেখেনি।
এক চাষীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল—ভাই, ওটা কী? দুষ্টুমি করে চাষী বলল—সমুদ্র! সাঁতার কেটে পার হও। তাই শুনে করিম উলুকাশের বনে ঝাঁপ দিল এবং সাঁতার কাটতে শুরু করল। গা কেটে রক্তারক্তি।
বুঝতেই পারছ, চাষীকে বিশ্বাস করেই বেচারা সরল লােকটার দুর্দশা।
Read More