হুমায়ন আহমেদ এর হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

 গেছে আটটার মধ্যে চলে আসবেআটটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, আজ মীরা আসতে অনেক দেরীকরবেবারােটা একটা বেজে যেতে পারেকাজেই অপেক্ষা করা অর্থহীন। 

আশরাফুজ্জামান সাহেব ভুরু কুচকে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, দেরি করবেবলছেন কেন

আমার মনে হচ্ছে দেরি হবেএক ধরনের ইনটিউশন আমার ইনটিউশন ক্ষমতা প্রবল। 

ভদ্রলােক অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেনআমি বললাম, আপনি ওভাবেতাকাচ্ছেন কেন? আপনি যা বলেছেন আমি বিশ্বাস করেছিআমার কথা আপনিবিশ্বাস করছেন না কেন?” 

 মীরা কখনাে রাত আটটার পর বাইরে থাকে নাআমার এখানে টেলিফোন নেই দেরি হলে টেলিফোনে খবর দিয়ে সে আমার দুশ্চিন্তা দূর করতে পারবেনবলেই কখনাে দেরি করবে নাআপনি আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখুন। 

মেজো মুপু বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছেনতাঁর মাথার নিচে রাবার শ্লথতার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছেবিভ্রান্ত হবার মতাে কোনাে দৃশ্য নাযারা মেজো সুপর সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন, মাথায় পানি ঢালা তার হবি বিশেষ তিনি খুব আপসেট, মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে ঠিক করা হচ্ছে, এটা তিনি মাঝেমধ্যেই প্রমাণ করতে চানআমি আরে ঢুকেই বললাম, ফুপু কী খবর

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

ফুপু আমাণ করে বললেন, কে

এটাও তার অভিনয়ের একটা অংশ। তিনি বুঝতে চাচ্ছেন যে তার অবস্থা এতই খারাপ যে তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না। 

মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, ব্যাপার কী ফুপু?” 

তুই কিছু জানিস না? আমাদের সবার তাে কাপড় খুলে নেংটো করে ছেড়ে দিয়েছে” 

বাদলের শ্বশুরবাড়ির লােকজনরাত এগারােটা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে মেয়ে 

এই ব্যাপারমেজো ফুপু ঝপাং করে উঠে বসলেনযে পানি ঢালছিল তার হাতের এইম নষ্ট হওয়ায় পানি চারদিকে ছড়িয়ে গেল মেজো ফুপু হুংকার দিয়ে বললেন, এটাসামান্য ব্যাপার? তাের কাছে এটা সামান্য ব্যাপার

ব্যাপার খুবই গুরুতরমেয়ে মার সঙ্গে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে, এখন করা যাবে কী? আজকালকার মেয়ে, এরা কথায়কথায় মাদের সঙ্গে রাগ করে। 

মেয়ে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে এই গাজাখুড়ি গল্প তুই বিশ্বাসকরতে বলিস? তুই ঘাস খাস বলে আমিও ঘাস খাই! মেয়েকে ওরাই লুকিয়ে রেখেছে। 

কিছু করা যায় কি নাবাদল আঁখির টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে যোগাযােগ করে দেখি‘ 

বাদল তােকে মেয়ের টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে। 

তাই নাকি?অবশ্যই তাইশুধু শুধু লুকিয়ে রাখবে কেন?সেটা তুই জেনে দেআমি কীভাবে জানব?” 

তুই ওদের বাসায় যাবিমেয়ের সঙ্গে কথা বলবি, ব্যাপার কী সৰ তেআসবিমেয়ের বাবাকে বলবি েেড় কাশতে আমি সব জানতে চাই

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

জেনে লাভ কী?লাভ আছেআমি ওদের এমন শিক্ষা দেব যে তিন জন্মে ভুলবে নাশিক্ষা দিয়ে কী হবে, তুমি তাে আর স্কুল খুলে বসেনি‘ 

তাের গা-জ্বালা কথা আমার সঙ্গে বলবি নাতােকে যা করতে বলেকরবিএক্ষুণি চলে যা।ওদের গােপন কথা ওরা আমাকেই বা শুধুশুধু বলবে কেন?” 

তুই ভুং ভাজুং দিয়ে মানুষকে ভুলতে পারিসওদের কাছ থেকে বনবের করে আন তারপর দেখ আমি কী করি‘ করবেটা কী

মানহানির মামলা করবআমি সাদেককে বলে দিয়েছিএর মধ্যে মনে হয় করা হয়েও গেছেমেয়ের বাপ আর মামাটাকে জেলে ঢুকাব তার আগেআমার সামনে এসে দুজনে দাঁড়াবেকানে ধরে দশবার উঠবােস করবে‘ 

তােমার বেয়াই তােমার সামনে কানে ধরে উঠবােস করবে এটা কী ঠিক হবে? বিবাহ সম্পর্কিত আত্মীয় অনেক বড় আত্মীয়‘ 

তারা আমার আত্মীয় হল কখন?” 

দুধ কলা দিয়ে আমি তো দেখি কালসাপ পুষেছি” 

তাই তাে মনে হচ্ছেযে মেয়ে তােমাদের সবাইকে নেংটো করে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখছে তার জন্যে এত ব্যাকুলতা তার টেলিফোন নাম্বার নিলো ছােটাছুটি‘ 

মেজো মুচপুর রাগ চরমে উঠে গিয়েছিলতিনি বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে রাগ সামলালেনথমথমে গলায় বললেন, হিমু শোন বাদল যদি মেয়ের কথা মুখে আনে তাকে আমরা ত্যাজ্যপুত্র করবএই কথাটা তাকে তুই বললি । 

এক্ষুণি বলছি। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

বাদল বাসায় নেই, কোথায় যেন গেছেতুই বসে থাকবাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাবি না‘ 

আচ্ছা যাব নাবাদল গেছে কোথায়?‘ 

জানি নাআঁখিদের বাসায় চলে যায়নি তাে?‘ 

মেজো ফুপু রক্তচক্ষু করে তাকাচ্ছেএইবার বােধ হয় তার ব্লাড প্রেশার সত্যি সত্যি চড়েছেঅকারণে মানুষের চোখ এমন লাল হয় না। 

 ফুপু তুমি শুয়ে থাকতােমার মাথায় পানিটানি দেয়া হােকআমি বাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাচ্ছি নাফুপা কোথায়

আর কোথায়, ছাদে” 

আমি ছাদের দিকে রওনা হলাম আজ বুধবার ফুপার মধ্যপান দিবসতাঁর ছাদে থাকারই কথাফুপু ওয়াল ক্লথে মাথা রেখে আবার শুয়েছেনকিপুল উৎসাহে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। মুপা ছাদেই আছেন । 

তাকে যেন আনন্দিত বলেই মনে হলজিনিস মনে হয় পেটে পড়েছেএবং ভাল ডােজেই পরেছেতার চোখে মুখে উদাস এবং শান্তি শান্তি ভাব। 

কে, হিমু?

হিমু, তুই কী আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস?” 

না, ফাজলামি করছি নাকোনাে একটা সমস্যায় বিয়ে হয় নি, সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে বিয়ে হতে আপত্তি কী? তা ছাড়া 

তা ছাড়া কী? বাদলের মন মেয়ের কাছে পড়ে আছে| বাদলের মন মেয়ের কাছে, কী বলছিস তুই! যেমেয়ে লাথি দিয়ে তাকেনর্দমায় ফেলে দিল, যে তাকে নেংটো করে দিল এত মানুষের সামনে তার।  যা পাওয়া যায় না তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়‘ 

বাদল যদি কোনদিন মেয়ের নাম মুখে আনে তাকে আমি জুতাপেটা করবজুতিয়ে আমি তার রস নামিয়ে দেব। 

জুতাপেটা করেও লাভ হবে না ফুপুআমি বরং দেখি জোড়াতালি দিয়ে। 

আছ কেমন হিমু?জ্বি ভালকেমন ভাল বেশি, কম, না মিডিয়াম?মিডিয়াম। 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪ 

আমার মনটা খুবই খারাপ হিমু” 

বাদলের বিয়েতে তাে তুমি যাও নিবিরাট অপমানের হাত থেকে কে গেছ তারা বিয়ে দেয় নিমেয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলেছে‘ 

বলেন কী? বানােয়াট গল্প ফেঁদেছে মেয়ে নাকি রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছেএটা কি বিশ্বাসযােগ্য কথা? যার বিয়ে সে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি যাবে‘ 

আজকালকার ছেলেমেয়ে, এদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না‘এটা তুমি অবিশ্যি ঠিক বলেছআমাদের সময় আর বর্তমান সময় এক সােসাইটি চেঞ্জ হচ্ছে ঘরে ঘরে এখন ভিসিআর, ডিস অ্যান্টেনাএই দেখেশুনে ইয়াং ছেলেমেয়েরা নানান ধরনের ড্রামা করা শিখে যাচ্ছে বিয়ের দিন হিমsell said. এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলেই রাগ করে বান্ধবীর বাড়িতে গেছে‘ 

ছেলের বিয়ে হয় নি বলে আপনারা লজ্জার মধ্যে পনেছেন। ওদের লজাতাে আরও বেশিমেয়ের বিয়ে হল না‘ 

 অবশ্যই অবশ্যই ভাগ্যিস মুসলমান পরিবারের মেয়েহিন্দু মেয়ে হলেতাে পড়া হয়ে যেতএই মেয়ের আর বিয়েই হত নাহিমু ছেলেরা হলেন হাঁসের মত গায়ে পানি লাগে নাআর মেয়েরা হচ্ছে মুরগির মতাে একফোটা পানিও ওদের গায়ে লেপ্টে যায় আঁখি মেয়েটার জন্যে খুবই মায়া হচ্ছে হিমু‘ 

মান্না হওয়াই স্বাভাবিকদিন অবিশ্যি খুবই রাগ করেছিলাম ভেবেছিলাম মানহানির মামলা ” 

আপনার মতাে মানুষ মানহানির মামলা কীভাবে করে! আপনি তাে গ্রামেরমামলাবাজ মােড়ল নাআপনি হচ্ছেন হৃদয়বান একজন মানুষ

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

 ভাল কথা বলেছ হিমু হৃদয়বান কথাটা খুব খাঁটি বলেছগাড়ি করে যখনআমি শেরাটন হােটেলের কাছে ফুলওয়ালি মেয়েগুলি ফুল নিয়ে আসে ধমকদিতে পারি নাকিনে ফেলি ফুল নিয়ে আমি করব কী বললােতােমার ফুপুকেযদি দিই সে রেগে যাবে, ভাববে আমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছেকাজেই নর্দমায়দেলে দি‘ 

একবার তােমার ফুপুকে ফুল দিয়েছিলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলেছিলঢং তাই নাকি

তােমার দুই বন্ধু এখন আসছে না কেন বল তাে

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ওদের কী আসার কথা নাকি

আসার কথা তাে বটেইওদের আমার খুব পছন্দ হয়েছেপ্রতিবুধবারেকালে নলছিভেরি গুড কোম্পানিওরা যে আমাকে স্ত্রী পরিমাণ শ্রদ্ধা করে সেটা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না‘ 

ফুপু বলছিলেন ওরা নাকি নেংটা হয়ে স্থানে নাচানাচি করছিল। 

ফুপা গ্লাসে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, তােমার মুরুপু বিন্দুতে সিদ্ধ দেখেকাশির শব্দ শুনে ভাবে যক্ষারাতে কিছুই হয় নিবেচালালের গরম লাগছিল আমি বললাম, শার্ট খুলে ফেলােগরমে কষ্ট করার মানে কীওরাশার্ট খুলেছেআমিও খুলেছি ব্যস

আচ্ছা‘ 

হিম, তােমার বন্ধু দুজন দেরি করছে কেন? এইসব জিনিস একা একা খাওয়া যায় নাখেতে খেতে মন খুলে কথা না বললে ভাল লাগে নাদুধ একাখাওয়া যায়, কিন্তু ড্রিংকসে বন্ধু বান্ধব লাগে‘ 

আসতে যখন বলেছেন অবশ্যই আসবে‘ 

হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪

তুমি বরং এক কাজ করাে ঘরের বাইনাে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাে ওরা হয়তাে বাসার সামনে দিয়ে ঘােরাঘুরি করছেবাসা চিনতে পারছে না বলে ঢুকতে পারছে নাগেট দিয়ে সােজা ছাদে নিয়ে আসবেতােমার আপুর জানারদরকার নেইদুটো নিতান্তই গােবেচাল্লা ভদ্র ছেলে অথচ তােমার ফুপু এলের বিষ দৃষ্টিতে দেখছেI don’t know why? শাস্ত্রে বলে না নারীচরিত্র দে না 

জানন্তি কুত্রাপি মনুষ্য ব্যাপার আর কী? হিমু Young friend রাস্তায় গিয়ে ওদের জন্যে একটু দাড়াও । 

জ্বি আচ্ছা।’  আমি নিচে নেমে দেখি ফুপুর মাথায় পানি ঢালাঢলি শেষ হয়েছেতিনি গম্ভীর মুখে বসার ঘরে বসে আছেনতাঁর সামনে তার চেয়েও তিন ডাবল গম্ভীর মুখে অন্য একজন বসে আছেআমি দরজা খুলে রাস্তায় চুপিচুপি নেমে যাৰ ফুপু গম্ভীর গলায় বললেন, এই হিমু শুনে যাআমি পরিচয় করিয়ে দি হচ্ছে সাদেক

হাইকোর্টে প্রাকটিস করেআমার দূর সম্পর্কের ভাই হয় ভয়ংকর কাজের ছেলেমানহানির মামলা ঠুকতে বলেছিলাম, এখন মামলা সাজিয়েছেকাল মামলা দায়ের করা হবে তারপর দেখবি কত গমে কত আটাসাদেক, তুমি হিমুকে মামলার ব্যাপারটা বলাে

সাদেক বিরক্ত মুখে বললেন, উনাকে শুনিয়ে কী হবেআহা শােনাও না! হিমু আমাদের নিজেদের লােকঅমামলাটা কী সাজানাে হয়েছে সে শুনুক, কোন সাজেশান থাকলে দিকএই হিমু, বসে ভাল করেশােন সাদেক তুমি গুছিয়ে বলাে।’ 

 

জি আচ্ছা বাদ দিচ্ছি

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *