গেছে আটটার মধ্যে চলে আসবে। আটটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, আজ মীরা আসতে অনেক দেরী। করবে। বারােটা একটা বেজে যেতে পারে। কাজেই অপেক্ষা করা অর্থহীন।
আশরাফুজ্জামান সাহেব ভুরু কুচকে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, দেরি করবে। বলছেন কেন?
“আমার মনে হচ্ছে দেরি হবে। এক ধরনের ইনটিউশন । আমার ইনটিউশন ক্ষমতা প্রবল।
ভদ্রলােক অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। আমি বললাম, আপনি ওভাবে। তাকাচ্ছেন কেন? আপনি যা বলেছেন আমি বিশ্বাস করেছি। আমার কথা আপনি। বিশ্বাস করছেন না কেন?”
মীরা কখনাে রাত আটটার পর বাইরে থাকে না। আমার এখানে টেলিফোন নেই । দেরি হলে টেলিফোনে খবর দিয়ে সে আমার দুশ্চিন্তা দূর করতে পারবেন। বলেই কখনাে দেরি করবে না। আপনি আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখুন।
মেজো মুপু বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর মাথার নিচে রাবার শ্লথ। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। বিভ্রান্ত হবার মতাে কোনাে দৃশ্য না। যারা মেজো সুপর সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন, মাথায় পানি ঢালা তার হবি বিশেষ । তিনি খুব আপসেট, মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে ঠিক করা হচ্ছে, এটা তিনি মাঝে–মধ্যেই প্রমাণ করতে চান। আমি আরে ঢুকেই বললাম, ফুপু কী খবর?
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
ফুপু আমাণ করে বললেন, কে?
এটাও তার অভিনয়ের একটা অংশ। তিনি বুঝতে চাচ্ছেন যে তার অবস্থা এতই খারাপ যে তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, ব্যাপার কী ফুপু?”
‘তুই কিছু জানিস না? আমাদের সবার তাে কাপড় খুলে নেংটো করে ছেড়ে দিয়েছে।”
বাদলের শ্বশুরবাড়ির লােকজন। রাত এগারােটা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে মেয়ে
ও এই ব্যাপার।‘ মেজো ফুপু ঝপাং করে উঠে বসলেন। যে পানি ঢালছিল তার হাতের এইম নষ্ট হওয়ায় পানি চারদিকে ছড়িয়ে গেল । মেজো ফুপু হুংকার দিয়ে বললেন, এটা। সামান্য ব্যাপার? তাের কাছে এটা সামান্য ব্যাপার?
ব্যাপার খুবই গুরুতর। মেয়ে মার সঙ্গে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে, এখন করা যাবে কী? আজকালকার মেয়ে, এরা কথায়–কথায় মা‘দের সঙ্গে রাগ করে।
‘মেয়ে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে এই গাজাখুড়ি গল্প তুই বিশ্বাস। করতে বলিস? তুই ঘাস খাস বলে আমিও ঘাস খাই! মেয়েকে ওরাই লুকিয়ে রেখেছে।
কিছু করা যায় কি না। বাদল আঁখির টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে – যোগাযােগ করে দেখি।‘
‘বাদল তােকে ঐ মেয়ের টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে।
তাই নাকি?” “অবশ্যই তাই।” “শুধু শুধু লুকিয়ে রাখবে কেন?” সেটা তুই জেনে দে।” “আমি কীভাবে জানব?”
“তুই ওদের বাসায় যাবি। মেয়ের সঙ্গে কথা বলবি, ব্যাপার কী সৰ তে। আসবি। মেয়ের বাবাকে বলবি েেড় কাশতে । আমি সব জানতে চাই ।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
জেনে লাভ কী?” লাভ আছে। আমি ওদের এমন শিক্ষা দেব যে তিন জন্মে ভুলবে না। “শিক্ষা দিয়ে কী হবে, তুমি তাে আর স্কুল খুলে বসেনি।‘
“তাের গা-জ্বালা কথা আমার সঙ্গে বলবি না। তােকে যা করতে বলে। করবি। এক্ষুণি চলে যা।” ‘ওদের গােপন কথা ওরা আমাকেই বা শুধুশুধু বলবে কেন?”
“তুই ভুং ভাজুং দিয়ে মানুষকে ভুলতে পারিস। ওদের কাছ থেকে বন। বের করে আন তারপর দেখ আমি কী করি।‘ করবেটা কী?
মানহানির মামলা করব। আমি সাদেককে বলে দিয়েছি—এর মধ্যে মনে হয় করা হয়েও গেছে। মেয়ের বাপ আর মামাটাকে জেলে ঢুকাব । তার আগে। আমার সামনে এসে দুজনে দাঁড়াবে। কানে ধরে দশবার উঠবােস করবে।‘
“তােমার বেয়াই তােমার সামনে কানে ধরে উঠবােস করবে এটা কী ঠিক হবে? বিবাহ সম্পর্কিত আত্মীয় অনেক বড় আত্মীয়।‘
“তারা আমার আত্মীয় হল কখন?”
“দুধ কলা দিয়ে আমি তো দেখি কালসাপ পুষেছি।”
তাই তাে মনে হচ্ছে। যে মেয়ে তােমাদের সবাইকে নেংটো করে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখছে তার জন্যে এত ব্যাকুলতা । তার টেলিফোন নাম্বার নিলো ছােটাছুটি।‘
মেজো মুচপুর রাগ চরমে উঠে গিয়েছিল। তিনি বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে রাগ সামলালেন। থমথমে গলায় বললেন, হিমু শোন । বাদল যদি ঐ মেয়ের কথা মুখে আনে তাকে আমরা ত্যাজ্যপুত্র করব। এই কথাটা তাকে তুই বললি ।
“এক্ষুণি বলছি।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
বাদল বাসায় নেই, কোথায় যেন গেছে। তুই বসে থাক। বাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাবি না।‘
“আচ্ছা যাব না। বাদল গেছে কোথায়?‘
জানি না।‘ “আঁখিদের বাসায় চলে যায়নি তাে?‘
মেজো ফুপু রক্তচক্ষু করে তাকাচ্ছে। এইবার বােধ হয় তার ব্লাড প্রেশার সত্যি সত্যি চড়েছে। ‘অকারণে মানুষের চোখ এমন লাল হয় না।
‘ফুপু তুমি শুয়ে থাক। তােমার মাথায় পানিটানি দেয়া হােক। আমি বাদলের সঙ্গে কথা না বলে যাচ্ছি না। ফুপা কোথায়?
“আর কোথায়, ছাদে।”
আমি ছাদের দিকে রওনা হলাম । আজ বুধবার ফুপার মধ্যপান দিবস। তাঁর ছাদে থাকারই কথা। ফুপু ওয়াল ক্লথে মাথা রেখে আবার শুয়েছেন। কিপুল উৎসাহে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। মুপা ছাদেই আছেন ।
তাকে যেন আনন্দিত বলেই মনে হল। জিনিস মনে হয় পেটে পড়েছে। এবং ভাল ডােজেই পরেছে। তার চোখে মুখে উদাস এবং শান্তি শান্তি ভাব।
“কে, হিমু?”,
“হিমু, তুই কী আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস?”
“না, ফাজলামি করছি না—কোনাে একটা সমস্যায় বিয়ে হয় নি, সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে বিয়ে হতে আপত্তি কী? তা ছাড়া
তা ছাড়া কী? বাদলের মন ঐ মেয়ের কাছে পড়ে আছে।‘ | ‘বাদলের মন ঐ মেয়ের কাছে, কী বলছিস তুই! যে–মেয়ে লাথি দিয়ে তাকে। নর্দমায় ফেলে দিল, যে তাকে নেংটো করে দিল এত মানুষের সামনে তার। ‘যা পাওয়া যায় না তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়।‘
বাদল যদি কোনদিন ঐ মেয়ের নাম মুখে আনে তাকে আমি জুতাপেটা করব। জুতিয়ে আমি তার রস নামিয়ে দেব।
জুতাপেটা করেও লাভ হবে না ফুপু। আমি বরং দেখি জোড়াতালি দিয়ে।
“আছ কেমন হিমু?” “জ্বি ভাল। “কেমন ভাল বেশি, কম, না মিডিয়াম?‘ ‘মিডিয়াম।
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
‘আমার মনটা খুবই খারাপ হিমু।”
‘বাদলের বিয়েতে তাে তুমি যাও নি। বিরাট অপমানের হাত থেকে কে গেছ । তারা বিয়ে দেয় নি। মেয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলেছে।‘
বলেন কী? ‘বানােয়াট গল্প ফেঁদেছে । মেয়ে নাকি রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি চলে গেছে। এটা কি বিশ্বাসযােগ্য কথা? যার বিয়ে সে রাগ করে বান্ধবীর বাড়ি যাবে।‘
“আজকালকার ছেলেমেয়ে, এদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না।‘ ‘এটা তুমি অবিশ্যি ঠিক বলেছ। আমাদের সময় আর বর্তমান সময় এক । সােসাইটি চেঞ্জ হচ্ছে । ঘরে ঘরে এখন ভিসিআর, ডিস অ্যান্টেনা। এই দেখেশুনে ইয়াং ছেলেমেয়েরা নানান ধরনের ড্রামা করা শিখে যাচ্ছে । বিয়ের দিন হিম। sell said. এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলেই রাগ করে বান্ধবীর বাড়িতে গেছে।‘
‘ছেলের বিয়ে হয় নি বলে আপনারা লজ্জার মধ্যে পনেছেন। ওদের লজাতাে আরও বেশি। মেয়ের বিয়ে হল না।‘
“অবশ্যই অবশ্যই । ভাগ্যিস মুসলমান পরিবারের মেয়ে। হিন্দু মেয়ে হলে। তাে পড়া হয়ে যেত। এই মেয়ের আর বিয়েই হত না। হিমু ছেলেরা হলেন হাঁসের মত গায়ে পানি লাগে না। আর মেয়েরা হচ্ছে মুরগির মতাে একফোটা পানিও ওদের গায়ে লেপ্টে যায় । আঁখি মেয়েটার জন্যে খুবই মায়া হচ্ছে হিমু।‘
মান্না হওয়াই স্বাভাবিক। “ঐ দিন অবিশ্যি খুবই রাগ করেছিলাম । ভেবেছিলাম মানহানির মামলা ল।”
“আপনার মতাে মানুষ মানহানির মামলা কীভাবে করে! আপনি তাে গ্রামের। মামলাবাজ মােড়ল না। আপনি হচ্ছেন হৃদয়বান একজন মানুষ।‘
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
ভাল কথা বলেছ হিমু । হৃদয়বান কথাটা খুব খাঁটি বলেছ। গাড়ি করে যখন। আমি শেরাটন হােটেলের কাছে ফুলওয়ালি মেয়েগুলি ফুল নিয়ে আসে ধমক। দিতে পারি না। কিনে ফেলি । ফুল নিয়ে আমি করব কী বললাে। তােমার ফুপুকে। যদি দিই সে রেগে যাবে, ভাববে আমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছে। কাজেই নর্দমায়। দেলে দি।‘
একবার তােমার ফুপুকে ফুল দিয়েছিলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলেছিল– ঢং “তাই নাকি?
তােমার দুই বন্ধু এখন ঐ আসছে না কেন বল তাে?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ওদের কী আসার কথা নাকি?
আসার কথা তাে বটেই। ওদের আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রতিবুধবারে। কালে নলছি। ভেরি গুড কোম্পানি। ওরা যে আমাকে স্ত্রী পরিমাণ শ্রদ্ধা করে সেটা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।‘
‘ফুপু বলছিলেন ওরা নাকি নেংটা হয়ে স্থানে নাচানাচি করছিল।
ফুপা গ্লাসে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, তােমার মুরুপু বিন্দুতে সিদ্ধ দেখে। কাশির শব্দ শুনে ভাবে যক্ষা। ঐ রাতে কিছুই হয় নি। বেচালালের গরম লাগছিল —আমি বললাম, শার্ট খুলে ফেলাে। গরমে কষ্ট করার মানে কী। ওরা। শার্ট খুলেছে। আমিও খুলেছি ব্যস!
“ও আচ্ছা।‘
“হিম, তােমার বন্ধু দু‘জন দেরি করছে কেন? এইসব জিনিস একা একা খাওয়া যায় না। খেতে খেতে মন খুলে কথা না বললে ভাল লাগে না। দুধ একা। খাওয়া যায়, কিন্তু ড্রিংকসে বন্ধু বান্ধব লাগে।‘
“আসতে যখন বলেছেন অবশ্যই আসবে।‘
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর খন্ড-১৪
“তুমি বরং এক কাজ করাে ঘরের বাইনাে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাে । ওরা হয়তাে বাসার সামনে দিয়ে ঘােরাঘুরি করছে। বাসা চিনতে পারছে না বলে ঢুকতে পারছে না। গেট দিয়ে সােজা ছাদে নিয়ে আসবে। তােমার আপুর জানার। দরকার নেই। দুটো নিতান্তই গােবেচাল্লা ভদ্র ছেলে —অথচ তােমার ফুপু এলের বিষ দৃষ্টিতে দেখছে। I don’t know why? শাস্ত্রে বলে না নারীচরিত্র দে না
জানন্তি কুত্রাপি মনুষ্য ঐ ব্যাপার আর কী? হিমু – Young friend রাস্তায় গিয়ে ওদের জন্যে একটু দাড়াও ।।
“জ্বি আচ্ছা।’ আমি নিচে নেমে দেখি ফুপুর মাথায় পানি ঢালাঢলি শেষ হয়েছে। তিনি গম্ভীর মুখে বসার ঘরে বসে আছেন। তাঁর সামনে তার চেয়েও তিন ডাবল গম্ভীর মুখে অন্য একজন বসে আছে। আমি দরজা খুলে রাস্তায় চুপিচুপি নেমে যাৰ ফুপু গম্ভীর গলায় বললেন, এই হিমু শুনে যা। আমি পরিচয় করিয়ে দি এ হচ্ছে সাদেক।
হাইকোর্টে প্রাকটিস করে। আমার দূর সম্পর্কের ভাই হয় । ভয়ংকর কাজের ছেলে। মানহানির মামলা ঠুকতে বলেছিলাম, এখন মামলা সাজিয়েছে। কাল মামলা দায়ের করা হবে তারপর দেখবি কত গমে কত আটা। সাদেক, তুমি হিমুকে মামলার ব্যাপারটা বলাে।
সাদেক বিরক্ত মুখে বললেন, উনাকে শুনিয়ে কী হবে? “আহা শােনাও না! হিমু আমাদের নিজেদের লােক। অমামলাটা কী সাজানাে হয়েছে সে শুনুক, কোন সাজেশান থাকলে দিক। এই হিমু, বসে ভাল করে। শােন । সাদেক তুমি গুছিয়ে বলাে।’
“জি আচ্ছা বাদ দিচ্ছি।‘
Read More