আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ২ হুমায়ূন আহমেদ

আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ২

দুবার ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ধরা খেয়েছি। দুবারই নকলের ভালো সুবিধা পেয়েছিলাম। নিশ্চিন্ত মনে নকল করেছি। পরীক্ষার সময় টিচারও ভালো পেয়েছিলাম–নকলে হেল্প করেছেন। তারপরেও কিছু হয় নি। সবই কপাল! কপাল ফেটে তিন চার টুকরা হয়ে আছে। আমেরিকায় যেতে পারলে ফাটা কপাল জোড়া লাগাতাম। কপাল জোড়া লাগানোর আইকা গাম শুধুমাত্র সাদা চামড়াদের দেশেই পাওয়া যায়। আমার কপাল জোড়া লাগে–আল্লাহপাকের সেটাও ইচ্ছা না।এখনই এত নিরাশ হয়ো না। হয়তো ভিসা পাবে।পাব না। স্বপ্নেও দেখেছি পাব না। গত রাতে স্বপ্ন কী দেখেছি শুনলেই বুঝবেন। স্বপ্ন দেখেছি পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি–হঠাৎ পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেছি।

সাঁতার কেটে পাড়ে উঠতে যাব, সেখানে অদ্ভুত কিছু জন্তু দাঁড়িয়ে আছে–চ্যাপ্টা মুখ, বড় বড় দাত। পাড়ে উঠতে পারছি না। যতবার উঠতে চাই জন্তুগুলি লাথি দিয়ে ফেলে দেয়।জয়নালের হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে শামসুদ্দিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিয়ম থাকলে তিনি অবশ্যই তার পাসপোর্টটা ছেলেটার হাতে দিয়ে দিতেন এবং আনন্দের সঙ্গে বলতেন–যাও, আমেরিকায় যাও।শামসুদ্দিন টিভির সামনে বসে আছেন। টিভিতে সিসেমিস স্ট্রিট নামে শিক্ষামূলক কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। বকের মতো পোশাক পরা একটা লোক টেনে টেনে কথা বলছে। দেখতে ভালো লাগে না আবার খারাপও লাগে না। তার ঝিমুনির মতো এসে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেও জানেন না।

ঘুমের মধ্যে লম্বা চওড়া এক স্বপ্নও দেখে ফেললেন। স্বপ্নে নৌকায় করে নানার বাড়ি যাচ্ছেন। নৌকার মাঝি দেখতে সিসেমিস স্ট্রিটের বকের মতো। নৌকা চালাবার ফাঁকে ফাঁকে সে তার লম্বা ঠোঁটটা দিয়ে শামসুদ্দিনের পেটে খোঁচা দিয়ে দিয়ে বলছে- ও চৈতার বাপ। ঘুমাও কেন? নদীর দুই ধারে সুন্দর সুন্দর সিনারি। সিনারি দেখ। ও চৈতার বাপ।চৈতার বাপ তার শৈশবের একটা নাম। এই নামে তার বাবা তাকে ডাকতেন। এই অদ্ভুত নামটা তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে কেন দিয়েছিলেন শামসুদ্দিন সেটা জানেন না। তার ডাক নামটা খুবই অদ্ভুত এটা বোঝার আগেই তার বাবা মারা গেলেন। অদ্ভুত নামের রহস্য আর জানা হলো না। নামটা শামসুদ্দিন সাহেব নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমেরিকান এম্বেসির ভিসাপ্রার্থীর ওয়েটিং রুমে ছেলেবেলার নামটা ঘুমের মধ্যে মনে পড়ল।বকের মতো মাঝিটা বড় বিরক্ত করছে। ক্রমাগত চৈতার বাপ চৈতার বাপ বলে গায়ে খোঁচা দিচ্ছে। শামসুদ্দিন বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে দেখলেন জয়নাল তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। জয়নালের চোখ ভেজা। তার হাত-পা কাপছে। তিনি লক্ষ করলেন তাদের ঘিরে কিছু লোকজন দাড়িয়ে আছে।শামসুদ্দিন দুঃখিত গলায় বললেন, ভিসা হয় নি? জয়নাল জবাব দিল না। তার মুখ স্বাভাবিক করুণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে ছেলেটা এখনই কেঁদে ফেলবে।ঐ মেয়েটার ঘরে ডাক পড়েছিল? তিন নম্বর ঘর? জি।

কী বলে ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেবেন শামসুদ্দিন বুঝতে পারছেন না। সান্ত্বনার দুএকটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে। জয়নাল উদাস গলায় বলল, চলুন বের হই।চল। বেশি মন খারাপ করো না।জয়নাল বলল, আপনি কি এখনই বাসায় চলে যাবেন? পাঁচটা মিনিট আমার সঙ্গে থাকেন। এক কাপ চা খান। চায়ের পয়সা আমি দিব।বেশতো চুল।দূর্গের ভেতর থেকে তারা বের হয়েছেন। ছেলেটা মাথা নিচু করে হাঁটছে। একবার সার্টের হাতায় চোখ মুছল। শামসুদ্দিনের মনটা অস্বাভাবিক খারাপ হয়ে গেল। তিনি ছেলেটার পিঠে হাত রাখলেন।জয়নাল বলল, আপনি কোথায় থাকেন ঠিকানাটা বলুন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। ইনশাল্লাহ দুইজন একসঙ্গেই আমেরিকা যাব। আপনি খুবই নরম লোক–আপনাকে গাইড না করলে বিরাট বিপদে পড়বেন।শামসুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভিসা ছাড়া তুমি আমেরিকা যাবে কীভাবে?

জয়নাল লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চাচা মিয়া, আমার ভিসা হয়েছে। অনেক লোকজন ছিল তো এই জন্যে কিছু বললাম না। তাদের চোখ লাগতে পারে। হয়তো কারো চোখ লেগে গেল দেখা যাবে শেষ মুহূর্তে কিছু একটা হয়েছে। পাসপোর্টে সিল পড়ে নাই।ঐ মেয়ে তোমাকে ভিসা দিয়েছে? জি। কিছুই জিজ্ঞেস করে নাই। একবার শুধু মুখের দিকে তাকাল। খসখস করে একটা কাগজে কী ফেন লিখল। তারপর বলল, তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও।জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অথচ মুখটা হাসি হাসি। নান্দাইল হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শামসুদ্দিন সাহেবের মনে হলো তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে যে অল্প কটি অসাধারণ দৃশ্য দেখেছেন এটি তার একটি। তার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।

কৈ মাছের তরকারিটা খেতে এত ভালো হয়েছে।মনে হলো গত দশ বছরে তিনি এমন রান্না খান নি। ছোট ছোট আলু দিয়ে রান্না। ধনেপাতার হালকা গন্ধ। কাঁচা মরিচের ঝাল। ঝালটা জিভে লেগে থাকে, কখনো মিলায় না। টমেটোও দেয়া হয়েছে। টমেটো গলে যায় নি। আস্তু আছে। গলে গেলে কৈ মাছে টুক ভাব চলে আসত, সেটা আসে নি। কৈ মাছের সালুনকে অঙ্কের মতো ছাকা নাম্বার দিতে হবে। দশে দশ।বাটিতে একটাই মাঝারি সাইজের কৈ মাছ। তার আরেকটা মাছ চাইতে ইচ্ছা করছে। অনেক কষ্টে ইচ্ছা দমন করছেন। রাহেলার বাড়িতে সব কিছু হিসাব করা।রাহেলা তাঁর বোন।

আপন বোন না, খালাতো বোন। শামসুদ্দিনের বড় খালী হামিদা বানুর ছোট মেয়ে। শামসুদ্দিন বড় হয়েছেন হামিদা বানুর কাছে। এই মহিলার অনেকগুলি ছেলেমেয়ে, তারপরেও শামসুদ্দিনের জন্যে তার মমতার কোনো রকম ঘাটতি ছিল না। শামসুদ্দিন বোনের বাড়িতে আছেন চার বছর ধরে। অভাবি সংসার সামলাতে গিয়ে রাহেলা যে পুরোপুরি বিপর্যস্ত এটা তিনি চোখের সামনে দেখছেন কিন্তু কিছু করতে পারছেন না। মাসের দুই তারিখে তিনি রাহেলার হাতে পনেরশ টাকা দেন। রাহেলা হাত পেতে টাকা নিতে নিতে বলে–এ-কী! টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি কি আমার বাড়িতে পেইং গেস্ট যে মাসের প্রথমেই খরচ দেবে? আমার দরকার হলে আমি তো চেয়ে নিবই। তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে আমার কি কোনো অসুবিধা আছে?

শামসুদ্দিন জানেন সবই কথার কথা। তার পনেরশ টাকা রাহেলা সংসার খরচে ধরে রেখেছে। প্রতিটি টাকাই হিসাবের টাকা। শামসুদ্দিনের প্রায়ই ইচ্ছা করে পাঁচ দশ হাজার টাকা রাহেলার হাতে তুলে দিয়ে বলেন–নে, তুই ইচ্ছামতো খরচ কর। পছন্দ করে শাড়ি কিনে আন, স্যান্ডেল কিনে আন। বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যা। এতগুলি টীকা এক সঙ্গে হাতে পেয়ে রাহেলা কী করে এটা তার দেখার ইচ্ছা। কাজটা করা হয় নি। তবে ভবিষ্যতে করবেন। অবশ্যই করবেন। সব মিলিয়ে ব্যাংকে তাঁর আছে তিন লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা। আমেরিকার জন্য এক লাখ টাকা ধরা আছে। তার পরেও হাতে থাকবে দুই লাখ পঁচাত্তর।

রাহেলা এসে তাঁর সামনে বসেছে। শামসুদ্দিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হকচকিয়ে গেলেন। রাহেলার মুখ থমথম করছে। রফিকের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো ঝগড়াঝাটি নিশ্চয়ই হয়েছে। কিছুদিন পরপর ওরা ঝগড়া করছে। খুব ভুল কাজ হচ্ছে। রাহেলার সন্তান হবে। ছয় মাস চলছে। এই সময় মায়ের মেজাজ খারাপ থাকলে মায়ের পেটের সন্তানের ক্ষতি হয়।শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা মন খারাপ নাকি? রাহেলা চাপা গলায় বলল, না।মুখ এত গম্ভীর করে রেখেছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ লাগলে রেস্ট নে। শুয়ে থাক। আমার সামনে বসতে হবে না। একা খেয়ে আমার অভ্যাস আছে।রাহেলা সরাসরি শামসুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ভাইজান, তুমি নাকি আমেরিকা যাচ্ছ?

শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।কবে যাচ্ছ? যাওয়ার তারিখ এখনো ঠিক হয় নি। ভিসা হয়ে গেছে। এখন ইচ্ছা করলে যে-কোনো দিন যেতে পারি। বিমানের টিকিট কাটতে হবে।টিকিট কাটতে কত লাগবে? ঠিক জানি না। সত্তুর আশি হাজার টাকা লাগবে।আমেরিকায় থাকবে কোথায়? সস্তার হোটেল মোটেল খুঁজে বের করব। আমার কিছু ছাত্র আছে। ওদের ঠিকানা নিয়ে যাব।আমেরিকায় যাচ্ছ কেন? এই এমনি আর কী। বেড়াতে যাচ্ছি। এই জীবনে কিছুই তো দেখলাম না। নিজের দেশের দক্ষিণের পুরোটাই সমুদ্র। সেই সমুদ্রও দেখা হলো না।শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছ?

শামসুদ্দিন চুপ করে রইলেন। শুধু বেড়ানোর জন্যে আমেরিকা যাচ্ছেন এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। সামান্য বিষয় নিয়ে মিথ্যা বলা ঠিক হবে না।রাহেলা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমেরিকায় যাবে এই খবরটা গোপন করলে কেন? শামসুদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, গোপন করি নি তো। গোপন করব কেন? অবশ্যই তুমি গোপন করেছ। তুমি যে আমেরিকায় যাবার প্ল্যান করেছ সেটা কাউকে জানাও নি। পাসপোর্ট করেছ, ভিসা করেছ–তাও জানাও নি। আমি জিজ্ঞেস করে জানলাম। এখন বলো কেন আমার কাছে গোপন করলে? আমি তোমার আপন বোন না। অনেক দূরের বোন। এই জন্যে?

বলার সুযোগ হয় নি। ভিসা পাব কী পাব না তারই ঠিক ছিল না।রাহেলার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমার কি ধারণা তুমি আমেরিকা যাচ্ছ শুনে আমি ঘ্যানঘ্যান শুরু করব–আমাকে সঙ্গে নিয়ে চল? ভুল কথা ভেবেই ভাইজান। আমি স্বামীর সংসারে ঝি-গিরি করার ভাগ্য নিয়ে এসেছি। আমি তোমার সঙ্গে প্লেনে উঠব এরকম কল্পনাও আমার নেই।শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, তুই শুধু শুধু আমার সঙ্গে রাগ করছিস।রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি ভুল বলছ ভাইজান। আমি তোমার উপর রাগ করব কেন? তুমি কে? তুমি আমার কেউ না–শুধু দূরসম্পর্কের বড় ভাই। বোনের বিয়ে হবার পর আপন ভাই আর অই থাকে না, বাইরের মানুষ হয়ে যায়। তুমি অনেক দুরের ভাই। বাইরের একজন মানুষ।আমি বাইরের মানুষ?

অবশ্যই বাইরের মানুষ। পনের শ টাকা খরচ দিয়ে খাও দাও ঘুমাও। আমার সংসার কীভাবে চলছে তুমি কিছু জানো? না, জানো না।তুই খারাপ অবস্থায় আছিস এটা জানব না কেন? রফিকের ব্যবসাপাতি খারাপ যাচ্ছে, সবই জানি।ভাইজান, তুমি কিছুই জানো না। তোমার জানার দরকারও নাই। বাসায় একটা রঙিন টেলিভিশন ছিল। নষ্ট হয়ে গেছে, ওয়ার্কশপে সারাতে দেয়া হয়েছে। এটা তুমি জাননা, তাই না?হুঁ।তুমি আসল ঘটনা জানো না। রঙিন টিভি নষ্ট হয় নাই। সারাতেও দেয়া হয় নাই। বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আগে তো পেটে ভাত, তারপরে না রঙিন টিভি।বলিস কী? এতেই চমকে উঠলে! আরো ঘটনা শুনবে? আচ্ছা বেশ, শোন। বলতে যখন বসেছি সবই বলব।

রাখ ঢাক করব না। তোমাকে লজ্জাও করব না। তুমি কে? তুমি কেউ না। তুমি বাইরের একজন পেয়িং গেস্ট। নিজের ভাই হলে তোমাকে লজ্জা করার কথা আসত।শামসুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, রাহেলা তুই খুবই উত্তেজিত। এই সময় উত্তেজনা ভালো না। আরেকদিন সব শুনব? রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমাকে আজই শুনতে হবে। আজ বলতে না পারলে আমি আর কোনো দিনই বলতে পারব না। পৃথুর বাবার সম্পর্কে কথা।কী কথা? গত মাসের নয় তারিখ বিষ্যুদবার রাত তিনটার সময় আমার ঘুম ভেঙে গেছে। দেখি বিছানায় পৃথুর বাবা নাই। তার খোঁজে বিছানা থেকে নামলাম, কোথাও সে নাই। তারপর তাকে কোথায় পেলাম জানো? বুয়ার ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।

শামসুদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, সে-কী! রাহেলা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি তারপরেও এই বাসায় পড়ে আছি। কারণ আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। আমার মা নাই, বাবা নাই। আমার এক খালাতো ভাই আছে। তারও কোনো মেরুদণ্ড নাই। সে থাকে আমার সাথে। তার মনে মনে ভালো ভালো চিন্তা। সে আমেরিকা যাবে। হাফপ্যান্ট পরা মেমসাহেব দেখবে। মেম সাহেবদের সাদা সাদা পা দেখে তার ফুর্তি হবে।রাহেলা আমার কথা শোন…। তোমার তো কোনো কথা নাই ভাইজান। তোমার কথা আমি কী শুনব? তুমি আমার কথা শুনবে। পৃথুর বাবার লজ্জা তো ভেঙে গেছে, এখন কী করে জানো? প্রায় রাতেই বুয়ার ঘরে যায়। আমাকে বলে দিয়েছে এই নিয়ে যদি কোনো কথা বলি তাহলে বাসা থেকে বের করে দিবে। বাসা থেকে বের করে দিলে আমি যাব কোথায়?

দরজায় কলিং বেল বাজছে। রফিক এসেছে। রাহেলা চোখ মুছে উঠে গেল। শামসুদ্দিন ভেবেই পেলেন না রফিকের মতো ভালো একটা ছেলে এমন জঘন্য কাজ কীভাবে করে। রাহেলা ভুল করছে না তো? মেয়েরা এমনিতেই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় সন্দেহ রোগ অনেকগুণে বেড়ে যায়। হয়তো রফিকের রাতে পানির পিপাসা পেয়েছে। পানি খাবার জন্য সে গিয়েছে রান্না ঘরে আর তাতেই যা ভাবার না রাহেলা তাই ভেবে বসে আছে। কাইক্যা মাছকে ভেবেছে কুমির। রাহেলা যা বলছে তা হতেই পারে না। রফিক এরকম ছেলেই না। তা ছাড়া যে বয়াকে নিয়ে কথা হচ্ছে তাকে নিয়ে কোনো কিছুর ভাবারই অবকাশ নেই। কালো, ঠোঁট, মোটা, মধ্যবয়স্ক মহিলা। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগের মতো দাগ।

রাতের খাবার শেষ করে ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই শামসুদ্দিন শুয়ে পড়েন। রফিকের সঙ্গে তার দেখাই হয় না। সে কখনো রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটার আগে বাসায় ফিরে না। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরে সেদিন রফিক অবশ্যই একবার শামসুদ্দিনের ঘরে আসে। বিছানায় পা তুলে বসে জমিয়ে গল্প করে। পান সিগারেট খায়। সময়টা শামসুদ্দিন সাহেবের ভালো কাটে। রফিক মাঝে মাঝে এমন সব হাসির গল্প বলে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়।

শামসুদ্দিন ঘড়ি দেখলেন। দশটা চল্লিশ। রফিক আজ সকাল সকাল ফিরেছে। কাজেই একবার নিশ্চয়ই তার ঘরে আসবে। যদি আসে তাহলে কি তিনি তার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারবেন? তিনি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। সবচে ভালো হয় তিনি যদি বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রফিক নিশ্চয়ই গল্প করার জন্যে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে না। পরপর কয়েকদিন দেখা না হলে খুব ভালো হয়। এর মধ্যে রাহেলা তার ভুল বুঝতে পারবে। কাজের মেয়েটাকে বিদায় করার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে।ভাইজান জেগে আছেন?

বলতে বলতে রফিক হাসি মুখে ঢুকল। তার মুখ ভর্তি পান। মুখ থেকে জর্দার গন্ধ আসছে। হাতে দুটা সিগারেট। শামসুদ্দিনের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে রফিক বলল, বিয়ে খেয়ে এসেছি। এলাহী ব্যবস্থা। বিয়ের খাওয়ার পর চা কফি আছে, পান আছে। দুটা বাচ্চা মেয়ে আবার ট্রে ভর্তি সিগারেট নিয়ে ঘুরছে। যার ইচ্ছা সিগারেট নিচ্ছে। আমার ইচ্ছা ছিল এক সঙ্গে চারপাঁচটা নেই। শেষে লজ্জা লাগল, দুটা নিলাম। ডানহিল সিগারেট। দুটাই রেখে দিয়েছি আপনার সঙ্গে খাব বলে।শামসুদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, কার বিয়ে?

আমার এক বন্ধুর শালার বিয়ে। ট্রাকের ব্যবসা করে দুহাতে মাল কামিয়েছে। শরীর থেকে কাঁচা টাকার গন্ধ আসছে। ভাইজান, আপনি নাকি আমেরিকা যাচ্ছেন? রাহেলার কাছে শুনলাম। সত্যি নাকি? হুঁ।খুব ভালো। ভিসা হয়েছে? হুঁ।তাহলে ভাইজান আমার একটা উপদেশ শোনেন। আমেরিকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। দেশে আসার নামও করবেন না।তা কী করে হয়! ঐ দেশে আমি করব কী? কিছুই করতে হবে না। মাটি কামড় দিয়ে পড়ে থাকবেন। যদি দেখেন কিছুই হচ্ছে না, না খেয়ে আছেন তাহলে কোনো এক আমেরিকান মহিলাকে সবার সামনে চড় লাগাবেন, মুখে থুথু দিয়ে দেবেন।কেন?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *