আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৩ হুমায়ূন আহমেদ

আজ আমি কোথাও যাব না পর্ব – ৩

এতে লাভ আছে। পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। আরামে জেলে থাকবেন। ওদের জেলখানাও আমাদের থ্রি স্টার হোটেলের মতো। এলাহি কারবার। সকালে ব্যবস্থা আছে। সপ্তাহে তিনটা মুভি দেখায়। প্রতিদিন বিকেলে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। খাবার খুবই ভালো।তুমি ওদের জেলের ব্যাপার জানলে কীভাবে? ছবিতে দেখেছি। কমনসেন্স সে-রকমই বলে। বেহেশতে যদি জেলখানা থাকে সেই জেলখানাও তো বেহেশতের মতোই হবে।আমেরিকা বেহেশত নাকি?

অবশ্যই বেহেশত।শামসুদ্দিন রফিকের দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা। কী সুন্দর হাসিখুশি স্বভাব। রাহেলা ভুল করছে। অভাবে স্বভাব নষ্ট যে বলে তাই হয়েছে। রাহেলার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। মন হয়েছে ছোট। যা দেখছে সবই ছোট চোখে দেখছে।ভাইজান।হুঁ।আপনাকে চিন্তিত লাগছে কেন? চিন্তিত না তো।অবশ্যই আপনি চিন্তিত। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে ভাইজান। আমাদের সকল সমস্যার মূলে আছে দুশ্চিন্তা। ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস… শুরুটা দুশ্চিন্তায়।তোমার ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা কী?

ভালো না! লাক ফেভার করছে না। এক জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিলাম; সে বলল, আরো দুই বছর এই অবস্থা যাবে। তৃতীয় বছর থেকে পালে বাতাস লাগবে। দুটা বছর পার করাই সমস্যা। আপনাকে দেখে ভাইজান হিংসা হয়–একা মানুষ, নিজেই সরকার প্রধান, নিজেই বিরোধী দলের প্রধান। যখন যা ইচ্ছা করতে পারেন। ঐ গানটা শুনেছেন। স্ত্রী হইল হাতের বেড়ি পুত্র ঘরের খিল? না। খুবই বাস্তব গান। আপনি গানের মর্ম বুঝবেন না, কারণ আপনার স্ত্রী পুত্রের কারবারই নাই। আমারা যারা বিবাহিত তারা এই গানের মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝি।অসুখী বিবাহিত পুরুষ হয়তো বুঝে। সুখী যারা তাদের বোঝার কথা না। তাদের কাছে সংসার অতি আনন্দের ব্যাপার।রফিক খাট থেকে নামতে নামতে বলল, সংসার কোনো আনন্দের ব্যাপার ভাইজান। খুবই নিরানন্দের ব্যাপার। সংসার মানেই দ্বীপান্তর। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। যাই, আপনি ঘুমিয়ে পড়েন।

শামসুদ্দীন মুবার আয়োজন করলেন। মশারির ভেতর তিনি ঘুমাতে পারেন না। বাধ্য হয়ে কিছুদিন ধরে মশারির ভেতর ঘুমাতে হচ্ছে। খুব মশার উপদ্রব। তিনি মশারি ফেলে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। বালিশের কাছে এক বোতল পানি রাখলেন। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলেই তার পানির পিপাশা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পানি না খেলে মনে হয় বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্ন ইদানীং ঘন ঘন দেখছেন। একটাই দুঃস্বপ্ন–তিনি ট্রেন লাইন দিয়ে হাঁটছেন, পেছনে ট্রেন ছুটে আসছে। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। ট্রেন লাইন থেকে নেমে গেলে হয়। তিনি নামছেন না, লাইন বরাবর দৌড়াচ্ছেন। পেছন থেকে আসছে আন্তঃনগর ট্রেন। এই স্বপ্নটাই নানান ভাবে নানান ভঙ্গিমায় দেখছেন। কখনো তিনি একা। কখনো তার হাত ধরে থাকে বাচ্চা একটা ছেলে। কখনো বা দেখেন তিনি রেল লাইনের স্লিপারে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন।

রাত প্রায় বারোটা। তিনি এখনো জেগে আছেন। তার সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যদি রাত একটার ভেতর ঘুম না আসে তাহলে বাকি রাত আর ঘুম হবে না। এই বয়সে অদ্রিা রোগ হয়। এটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না, বরং একদিক দিয়ে ভালো–নানান বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা যায়। তার চিন্তা করতে খারাপ লাগে না তবে তার সমস্যা হলে ছোট্ট ঘরটার ভেতর বসে থাকতে হয়। তার ঘরটা মৃল বাসার সঙ্গে যুক্ত না। আলাদা। মূল দরজা বন্ধ করে দিলে তাকে তার ঘরেই বসে থাকতে হয়। বারান্দাও নেই যে বারান্দায় গিয়ে দাড়াবেন। তাঁর ঘরটা যদি মূল বাড়ির অংশ হতো তাহলে অনিদ্রা রোগে কোনো সমস্যা হতো না। হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন।

চা খেতে ইচ্ছা হলে রান্নাঘরে চুপি চুপি চলে যেতেন। নিঃশব্দে চা বানিয়ে বসার ঘরের বেতের সোফায় বসে থাকতেন। তাঁর নিজের একটা ছোটখাটো টিভি থাকলে ভালো হতো। টিভিটা মশারির ভেতর নিয়ে খাটে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখতেন। আজকাল নানান চ্যানেল হয়েছে। সারারাতই না-কি টিভি চলে।একটা বেজে গেছে। ঘুম আর হবে না। শামসুদ্দিন খটি থেকে নামলেন। বাতি জ্বালালেন। আবার এসে মশারির ভেতর ঢুকে পড়লেন। অদ্রিার রোগী কখনো অন্ধকারে খাকতে পারে না।

কোনো একটা বিষয় নিয়ে এখন আয়োজন করে চিন্তা শুরু করা যেতে পারে। চৈতার বাপ নিয়েই চিন্তা করা যায়। আচ্ছা, আদর করে কেউ কখনো নিজের ছেলেকে চৈতার বাপ ডাকে? চৈতাটা কে? কোনো মানুষের নাম, নাকি চৈত্র মাস থেকে চৈতা? তার জন্য তো চৈত্র মাসে হয় নি। জন্ম হয়েছে আষাঢ় মাসে। তাহলে নাম চৈতার বাপ কেন? তার মন খারাপ লাগছে বাবাকে এই প্রশ্নটা করা হয় নাই।খট করে শব্দ হলো। কে যেন সদর দরজা খুলল। খালি পায়ে এগিয়ে আসছে। কে হতে পারে? শামসুদ্দিন সাহেব কান খাড়া করলেন। তার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। শামসুদ্দিন বললেন, কে?

রাহেলা বলল, ভাইজান আমি। দরজা খুলুন।শামসুদ্দিন দরজা খুললেন। রাহেলা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শামসুদ্দিন বললেন, কী হয়েছে? রাহেলা বলল, আমার কিছু হয় নি। তোমার কী হয়েছে বলো। রাত দুটা বাজে, বাতি জ্বালিয়ে রেখেছ কেন? ঘুম আসছে না।বাতি জ্বালিয়ে রাখলে ঘুম আসবে কেন? বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকলেই না ঘুম আসবে।রাহেলা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, তোমার আমেরিকা যাবার তারিখ কি ঠিক হয়েছে?

না।মনে করে তুমি ভোমার হাঁচি রোগের চিকিৎসা করে আসবে। ওদের চিকিৎসা নিশ্চয়ই ভালো।চিকিৎসা ভালো হলেও খুবই খরচান্ত ব্যাপার। আর হাঁচি রোগ এমন না যে চিকিৎসা না হলে মারা যাব।এক নাগাড়ে একশ হাঁচি দাও–এই রোগ খারাপ না তো কোন রোগ খারাপ? ভাগ্যিস তুমি বিয়ে কর নি।বিয়ে করলে সমস্যা কী হতো? বাসর রাতে একশ দেড়শ ঘঁচি দিতে। হাঁচি শুনে বউ-এর কলজে শুকিয়ে যেত।

শামসুদ্দিন কিছু বললেন না। রাহেলার গোলগাল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড় বড় চোখ। গোলগাল মুখ। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। তার মুখে শিশুসুলভ সরলতা আছে। মানুষের চিন্তা চেতনা থেকে সারল্য চলে যায় কিন্তু তারা তা চেহারায় ধরে রাখে। রাহেলা তার চেহারায় ধরে রেখেছে।ভাইজান, আমার প্রায়ই কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয় মার কথাটা আমার শোনা উচিত ছিল। মার কথা না শুনে বিরাট ভুল করেছি।উনার কোন কথা?

রাহেলা মাথা নিচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, মারা যাবার আগে আগে মা আমাকে বলল তুই শামসুকে বিয়ে করিস। সে আলভুলা মানুষ। তোর হাতে থাকলে ঠিক থাকবে।শামসুদ্দিন চুপ করে গেল। খুবই অস্বস্তিকর একটা প্রসঙ্গ। রাহেলা এই প্রসঙ্গ মাঝে মাঝেই তুলে।রাহেলা বিড়বিড় করে বলল, তুমি বয়সে আমার অনেক বড়, তারপরেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। মা মরার সময় একটা কথা বলে গেছে আমি আপত্তি করব কেন? কিন্তু মা যে এই কথা আমাকে বলে গেছে এই কথাটাই কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই ভাবল আমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। এই জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে এই ধরনের কথা বলেছি। আমাকে নিয়ে সবার কী হাসাহাসি! শামসুদ্দিন বললেন, রাহেলা ঘুমুতে যা, রাত অনেক হয়েছে।রাহেলা বলল, ভাইজান রাত জাগলে ক্ষিধে পায়। তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? না।

রাতে ভালোমতো খেতেও পার নি। আমার উল্টাপাল্টা কথা শুনে তোমার খাওয়া হয়ে গেল বন্ধ।ঠিকমতোই খেয়েছি। কৈ মাছের ঝোল খুব ভালো হয়েছিল।এক পিস কৈ মাছ এখনো আছে। ভাত গরম করে আনি, খাও।আরে না! তুই পাগল না-কি! এক রাতে কয়বার খাব? যতবার ক্ষিধে লাগবে ততবার খাবে। আমার যখন ঘুম হয় না তখন রাতে ক্ষিধে লাগে। আমি ভাত গরম করে ডিম ভেজে খেয়ে নেই।তোরও কি অনিদ্রা রোগ আছে?

রাহেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যে মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে অনিদ্রা রোগ তো হবেই। এখন আমি পৃথুর বাবাকে পাহারা দেবার জন্যে জেগে থাকি। ভান করি যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। আসলে জেগে থাকি।এরকম করলে তো তার শরীর খারাপ করবে। এই সময়ে শরীর খারাপ করা ঠিক না।রাহেলা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, আমি চাই শরীর খারাপ হোক। আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না ভাইজান। অনেক দিন থেকেই করে না। কতজনের কাছে শুনি পোয়াতি অবস্থায় বাথরুমে পা পিছলে পড়েছে। এবরশন হয়ে গেছে। রক্ত যেতে যেতে মৃত্যু। আমি আমার বাথরুমটা ইচ্ছা করে পানি দিয়ে সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখি। পৃথুর বাবা দুদিন পা পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। আমার এখন পর্যন্ত কিছু হয় নি।

এই ধরনের উদ্ভট চিন্তা করিস না।বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়। বাতি জ্বালানো থাকলে কোনোদিনই ঘুম আসবে না। আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। ঘুমের ওষুধ দেব? না।রাহেলা শামসুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভাইজনি শোন, তোমাকে গোপন একটা কথা বলি–আমার কাছে সাতচল্লিশটা ঘুমের ট্যাবলেট আছে।শামসুদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? রাহেলা বলল, ঘুমের ওষুধ মানুষ কী জন্যে রাখে? ঘুমাবার জন্যে। আমি ঠিক করে রেখেছি আমার পেটে যে যন্ত্রণাটা আছে সেই যন্ত্রণা খালীস হবার পর আমি শান্তিমতো ঘুমাব। দুই তিনটা ট্যাবলেটে শান্তির ঘুম হবে না। ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম যাতে না ভাঙে সেই ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমাব।

তোর মাথা আসলেই খারাপ হয়েছে।মাথা খারাপ হয় নাই ভাইজান। মাথা খারাপ মানুষ ঘুম-অঘুম নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের কাছে ঘুমও যা জেগে থাকাও তা। সুস্থ মানুষই ঘুম-অঘুম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। আমি খুবই সুস্থ মানুষ। ভাইজান, বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যাও।রাহেলা তার ঘরে ঢুকল। সেখানেও বাতি জ্বলছে। খাটে পা ঝুলিয়ে রফিক বসে আছে। রফিকের গা ঘেঁসে পৃথু বসে আছে। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে। মাকে দেখে সে পা দোলানো বন্ধ করল। ভীত চোখে তাকিয়ে রইল মার দিকে। পৃথুর বয়স সাত বছর। সে মাকে খুবই ভয় পায়।রফিক বলল, বিরাট দুর্ঘটনা ঘটেছে। পৃথু বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে। ভেজা বিছানায় তো আর শোয়া সম্ভব না কাজেই তাকে আমাদের বিছানায় নিয়ে এসেছি। সে আমাদের দুজনের মাঝখানে হাইফেন হয়ে শুয়ে থাকবে। কী রে বাবা, পারবি না?

পৃথু প্রবল বেগে মাথা নেড়ে জানাল যে সে পারবে। রাহেলা কঠিন গলায় বলল, গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে তিন জন ঘুমাতে পারব না। পথু তার নিজের ঘরেই ঘুমাবে। ভেজা বিছানাতে শুয়ে থাকবে। এটা তার বিছানা ভেজাননার শাস্তি। এত বড় ছেলে হয়েছে এখনো বিছানা ভেজানো? তাকে তো কানে ধরে চাবকানো দরকার।রফিক বলল, ইচ্ছা করে তো বিছানা ভেজায় না। রাহেলা শোন, ও একা। ঘুমুতে ভয় পাচ্ছে, আমি ওর সঙ্গে গিয়ে ঘুমাই।রাহেলা কঠিন গলায় বলল, তুমি আমার সঙ্গে এই ঘরে থাকবে।নো প্রবলেম। এক কাজ করলে কেমন হয় তোমরা দুজন খাটে শোঁও, আমি মেঝেতে কম্বল পেতে শুয়ে পড়ি।রাহেলা জবাব দিল না। রফিক আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এত রাতে ভাইজানের সঙ্গে কী নিয়ে আলাপ করছিলে? রাহেলা বলল, ভয় নাই, কোনো ষড়যন্ত্র করছিলাম না। ভাইজান ষড়যন্ত্রের মানুষ না।রফিক বলল, কী বলছ! ষড়যন্ত্রের কথা আসছে কেন?

যে যে-রকম, অন্যকে সে সে-রকমই ভাবে। এই জন্যেই ষড়যন্ত্রের কথা আসছে। তুমি যে আমাকে আর ভাইজানকে নিয়ে সন্দেহ কর এটাও আমি জানি।রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, সন্দেহ কেন করব? ছিঃ ছিঃ।কথায় কথায় ছিঃ ছিঃ করবে না। তোমার মন যে কত ছোট সেটা আর কেউ জানলেও আমি জানি।রফিক চুপ করে গেল। পৃথু আবার পা দোলাতে শুরু করেছে। তাকে একা একা আলাদা একটা ঘরে ঘুমুতে হবে না এই আনন্দেই সে আনন্দিত। মেঝেতে যখন বিছানা হচ্ছে তখন এই বিষয়টা নিশ্চিতই হচ্ছে। পৃথুর ইচ্ছা করছে বাবার সঙ্গে ঘুমুতে। মেঝের বিছানাটা বেশ ভালো হচ্ছে। তাছাড়া বাবার সঙ্গে ঘুমানোর আনন্দ আছে। বাবার উপর পা তুলে দিলে ৰাৰা কিছুই বলে না।

মায়ের গায়ে পা তোলা যায় না। মা ধমক দিয়ে বলেন–গাদা পা সরা। গাবদা পা জিনিসটা কী পৃথু জানে না। তারপরেও সে নিশ্চিত যে তার পা গাবদা না। পৃথুর পা মোটেই গাবদা না।রাহেলা বাথরুমে ঢুকে গেছে। কল ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত মুখে পানি ঢালছে। প্রায়ই তার শরীর জ্বালা করে। এই সময় মুখে পানি দিতে হয়।কলের পানির শব্দটা পৃথুর ভালো লাগছে। বাবার সঙ্গে এখন ফিস ফিস করে কথা বললে মা শুনতে পাবে না। পৃথু চাপা গলায় ডাকল, বাবা।রফিক ছেলের দিকে তাকিয়ে পৃথুর মতোই গলা চাপা করে বলল, কী?

আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।খুবই ভালো কথা। আমাকে ভিজিয়ে দিবি না তো? না। বাবা, গাবদা পা মানে কী? গাবদা পা মানে হলো গাধার পা।আমার পা কি গাবদা? তুই যদি গাধা হোস তাহলে তোর পা গাবদা। তোর হাত তাহলে হবে গাবহা। আর মুখ হবে গাবমু।পৃথু শব্দ করে হেসে উঠল। বাবা এমন মজার মানুষ। বাবার মতো মানুষ। পৃথিবীতে আর তৈরি হয় নি। কোনোদিন হবেও না।মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। তার কী নাম, তার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছে কিছুই মনে পড়ছে না।

শামসুদ্দিন অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষটা রীতিমতো সুটেট বুটেট। সোনালি রঙের ব্লেজার, লাল টাই। মাথায় হালকা নীল রঙের ক্যাপ। সোনালি ফ্রেমের সানগ্লাসে চোখ ঢাকা।মানুষটা শামসুদ্দিনের পা ছুঁয়ে সালাম করল। বিনীত ভঙ্গিতে হাসল। শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বোধ করছেন। সুটেট-বুটেট ধরনের কারো সঙ্গে তার পরিচয় আছে বলেই মনে পড়ছে না।চাচাজি, আমাকে চিনেছেন? না।

সানগ্লাসটা খুললে চিনবেন। সানগ্লাস পরা থাকলে মানুষকে চেনা যায় না। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এই জন্যে সানগ্লাস পরে থাকে। পাবলিক চিনতে পারে না।লোকটা সানগ্লাস খুলে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, এখন চিনেছেন? না। সুটেট বুটেট মানুষটাকে খুবই আনন্দিত মনে হলো। যেন তাকে চিনতে না পারা খুবই আনন্দময় ঘটনা।মাথার টুপিটা খুললে হয়তো চিনবেন। আমি জয়নাল। একসঙ্গে ভিসা পেয়ে গেলাম।বলো কী! তুমি জয়নাল! আপনি যে আমাকে চিনতে পারেন নি এতে আপনাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। আমি নিজেই আজ সকালে নিজেকে চিনতে পারি নি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে ক্যাপটা মাথায় দিয়ে হতভম্ব। আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে লোকটা কে? Who is him? চাচাজি ইংরেজি কি ঠিক আছে? Who is him.

Who is he হবে।ভুলভাল যাই হোক ইংরেজি বলে যাচ্ছি। ভাষাটা সরগর হয়ে থাক। আমেরিকানরা বুঝতে পারলেই হলো। আমার যুক্তিটা হচ্ছে চাচাজি, তোরা যখন আমাদের দেশে আসিস তখন তো বাংলা বলতে পারিস না–আমরা ভুলভাল যাই বলি তোদের ভাষাতেই বলি। ঠিক না? হ্যাঁ ঠিক। জয়নাল বসো। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।জয়নাল বসতে বসতে বলল, আমার ড্রেসটা কেমন হয়েছে চাচাজি? খুবই ভালো।জুতা বাদ দিয়ে কমপ্লিট ড্রেসে কত খরচ পড়েছে একটু আন্দাজ করেন তো? দেখি আপনার আন্দাজ।এইসব বিষয়ে আমার একেবারেই আন্দাজ নাই। পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি তো হবেই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *