আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

ডায়েরি হাতে নিলেনসেখানে স্বপ্নের কথা কিছু লেখা নেইতাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল ? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন ? গভীর গাঢ় স্বপ্ন

মিসির আলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেনলুচি বেগুনভাজা খেলেনচা খেলেনলিলি বলল, চাচাজি আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুনবাগান দেখুনলাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছিলাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন। 

তােমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে ? | হা কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছিবড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুরি হয় নাবরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবতখন আপনার কুকুরভীতি থাকবে না। 

নীল ফুল ফোটে গাছটা কোথায়

পেছনের বাগানেবিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেনগাছের শুড়িটা বাঁধানাে। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছেমন্দিরে ঢুকবেন

সাপের আড়া। 

কী মন্দির

কালী মন্দিরহিন্দু বাড়ি ছিলবাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেনস্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেনখুবই ইন্টারেস্টিং গল্প

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি ভাসা ভাসা জানিসুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে। 

আচ্ছা তাকে জিজ্ঞেস করব। 

লিলি বলল, আমি দিনের মতাে এক্সপ্রেসাে কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছিঠিক আছে চাচাজি

ঠিক আছে। 

মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেনরাতে বাড়িটা যত প্রকাণ্ড মনেহয়েছিল দিনের আলােয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্রকাণ্ডতবে প্রকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তুপবাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বেবাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় নাভয় ভয় করেমনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে

চিন্তা ভাবনা করছেচিন্তা ভাবনা শেষ হলেই বাড়ি গম্ভীর গলায় ডাকবে, এই যে ভদ্রলােক আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, দয়া করে শুনে যান| মিসির আলি বাড়ির পেছনে চলে গেলেনতিনি বৃক্ষ প্রেমিক নাগাছপালা নিয়ে তার বাড়াবাড়ি কৌতূহল নেই, কিন্তু নীল মরিচ ফুল গাছটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। 

বাড়ির পেছনের জায়গাটা আশ্চর্যরকমভাবে পরিষ্কারঝােপ ঝাড় নেই, বড় বড় ঘাস নেই, গাছের নিচে শুকনাে পাতা পড়ে নেইমনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাঁট দেয়া হয়েছেনীল মরিচ ফুল গাছটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছেএমন কিছু বিস্ময়কর গাছ বলে মনে হচ্ছে নাতবে মরিচ ফুল গাছের পাশেই চেরীগাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছেপাতাশূন্য গাছ সাদা ফুলে ঢেকে আছেমিসির আলি বিস্মিত গলায় বললেন, বাহ্ সুন্দর তাে

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

চেরী গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায়এখন শীত না, তারপরেও গাছে একটা পাতা নেই কেন ? জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে এসে গাছের জীনে কি কোনাে পরির্তন হয়েছে ? নাকি এটা চেরী গাছ না, অন্য কোনাে গাছতিনি নাম জানেন 

ভাঙা মন্দিরটা দেখা যাচ্ছেমন্দিরের অংশটা ঝােপঝাড়ে ঢাকাবড় বড় কয়েকটা আম গাছ জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছেউইয়ের টিবির মতাে কিছু উঁচু মাটি দেখা গেলমন্দিরের ঠিক সামনে সারি করে লাগানাে জবা গাছ জবা গাছ এত বড় হতে মিসির আলি দেখেন নিগাছগুলি আম কাঁঠালের গাছের মতােই প্রকাণ্ড

একটা গাছেই শুধু ফুল ফুটেছেকালচে লাল রঙের ফুলদেখতে ভালাে লাগে নাজবা ফুল ছাড়া কালী পূজা হয় নাপূজার ফুলের জন্যই কি এই গাছগুলি লাগানাে ? এত প্রাচীন গাছ ? মিসির আলি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কী সব লেখাপড়তে ইচ্ছা করছে। 

বাবু অশ্বিনী কুমার রায় কর্তৃক অদ্য শনিবার বঙ্গাব্দ ১২০৮ গৌর কালী মূর্তি অধিষ্ঠিত হইল। 

মিসির আলি নামফলকের দিকে তাকিয়ে আছেনগৌর কালী মূর্তি ব্যাপারটা বােঝা যাচ্ছে নাকালী কৃষ্ণ বর্ণ, গৌর বর্ণ না। 

চাচাজি আপনার কফিআপনাকে বলা হয়েছে মন্দিরের কাছে না আসতে আর আপনি সােজাসুজি মন্দিরে চলে এসেছেনআপনি দেখি একেবারে বাচ্চাদের মতােযেটা করতে না করা সেটাই করেন। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি কফির মগ হাতে নিতে নিতে বললেন, গৌর কালী ব্যাপারটা কী ? গৌর কালী হলাে যে কালীর গায়ের রঙ গৌরধবধবে সাদাবাবু অশ্বিনী রায় স্বপ্নে দেখেছিলেন মা কালী তাঁকে বলছেনতুই আমাকে প্রতিষ্ঠা করতবে গায়ের রঙ কালাে করিস না বাবাগৌর বর্ণ করবিঅশ্বিনী কুমার রায় বললেন, ঠিক আছে মা করবদেবী তখন বললেন, আমি তাের এখানে থাকব নগ্ন অবস্থায়আমার গায়ে যেন কোনাে কাপড় না থাকেঅশ্বিনী কুমার রায় বললেন, সেটা কি ঠিক হবে মা? কত ভক্তরা তােমাকে দেখতে আসবে! দেবী বললেন, কেউ আমাকে দেখতে আসবে নাতােকে যা করতে বললাম তুই কর। 

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী কুমার নগ্ন গৌর বর্ণের কালী প্রতিষ্ঠা করলেন

লিলি বলল, হ্যামন্দিরে কি মূর্তি আছে

অশ্বিনী কুমার রায় নিজেই মূর্তিটা মেঘনায় ফেলে দিয়েছিলেন। 

গল্পটা আমি পুরােপুরি জানি নাভাসা ভাসা জানিদূরবীনওয়ালা, অর্থাৎ সুলতান সাহেব ভালােমতাে জানেআপনাকে গুছিয়ে বলবে। 

আগে তােমার কাছ থেকে অগােছালােভাবে শুনিঅগােছালাে গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালাে লাগে। 

ঘটনাটা হলাে রকম যেদিন দেবী প্রতিষ্ঠিত হলাে সেই রাতেই অশ্বিনী বাবুকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, এই বােকা ছেলে! নরবলি ছাড়া শক্তির প্রতিষ্ঠা হয় ? তুই এক কাজ কর আগামী অমাবস্যায় নরবলি দেঅশ্বিনী বাবু বললেন, এইটা পারব না মাআমি মহাপাতক হবদেবী বললেন, পাপপুণ্যের তুই বুঝিস কী ?

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ

তােকে যা করতে বললাম করনয়তাে মহাবিপদে পড়বিঅশ্বিনী বাবু স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই কাজটা পারব না মানরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করবদেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করবতখন তাের দুঃখের সীমা থাকবে নীঅশ্বিনী বাবুর ঘুম ভেঙে গেলদুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেনখুবই 

কান্নাকাটি শুরু করলেন। আগামী অমাবস্যায় না জানি কি হয়

কিছু হয়েছিল ? হঁ্যা হয়েছিল। অশ্বিনী বাবুর বড় মেয়েকে মন্দিরের ভেতর পাওয়া গেলবড় মেয়ের নাম শ্বেতাবয়স আঠারাে উনিশবিয়ের কথা চলছিলসকালে মন্দিরে ঢুকে অশ্বিনী বাবু দেখেন, মেয়ের মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকেদেবীর খাড়ায় চাপ চাপ রক্ত। 

কী সর্বনাশ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *