এপিটাফ পর্ব:০২ হুমায়ূন আহমেদ

এপিটাফ পর্ব:০২

বাবার সঙ্গে রিকশায় ঘোরার আনন্দের কোনো তুলনা নেই। কত মজার মজার কথা যে বাবা রিকশায় যেতে যেতে বলেন! হাসির কথা, জ্ঞানের কথা। কত রকম ধাঁধা, কত রকম অংক। একবার বাবা বললেন, টিয়া পাখি, দেখি তোর বুদ্ধি কেমন। কঠিন একটা ধাঁধা দিচ্ছি। হুট করে উত্তর দিতে হবে না। ভেবে-টেবে বলবি। ব্যাপারটা হলো শিকল নিয়ে। শিকল দি চেইন। সবাই চায় চেইন থেকে মুক্তি। চেইন খুলে যাওয়া মানে মুক্তি, আনন্দ। শুধু একটি ক্ষেত্রেই চেইন খুলে যাওয়া মানে বন্ধন। আটকা পড়ে যাওয়া। বল তো দেখি কোন ক্ষেত্রে?

আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, রিকশার ক্ষেত্রে। রিকশার চেইন খুলে যাওয়া মানে রিকশা বন্ধ।বাবা হৃষ্ট গলায় বললেন, তোর অসম্ভব বুদ্ধি তো রে মা। রানি ভিক্টোরিয়ার বুদ্ধিও তোর চেয়ে কম ছিল বলে আমার ধারণা। তুই বুদ্ধি পেয়েছিস তোর মা’র কাছ থেকে। আমার কাছ থেকে বুদ্ধি পেলে তোর সর্বনাশ হয়ে যেত।আমি বললাম, তোমার বুদ্ধি কি কম নাকি বাবা? কম মানে? আমার বুদ্ধি হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। প্রায় চতুষ্পদীয় গোত্রের।

বাবাকে আমার খুব বুদ্ধিমান মনে হয়। একধরনের মানুষ আছে যারা নিজেদের অন্যের কাছে বোকা হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসে। বাবা সে ধরনের। মানুষের এই অদ্ভুত স্বভাবের কারণ কী কে জানে! ইচ্ছে করে বাবা অন্যের সামনে বোকামি সব কাণ্ডকারখানা করে বসেন। যেমন ধরা যাক– মার কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছেন। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা চা খাচ্ছেন। গল্পগুজব করছেন। হাসাহাসি করছেন। তখন বাবা হুট করে ঘরে ঢুকবেন। তাঁর গায়ে থাকবে ময়লা একটা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। সেই লুঙ্গি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে। তিনি ঘরে ঢুকে খুবই বিব্রত হওয়ার ভঙ্গি করবেন। মা অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করবেন, কী ব্যাপার?

বাবা আমতা আমতা করে বলবেন– দিলশাদ, খুব খিদে লেগেছে। আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও তো, পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ঝাল করে।বাবার কথায় অতিথিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবেন। মা’র ভুরু কুঁচকে যাবে। চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে যাবে। বাবা অসহায়ের মতো সবার দিকে একবার করে তাকাবেন। অথচ কেউ বুঝবেন না বাবা এই কাণ্ড ইচ্ছে করে ঘটিয়েছেন। তাঁর খিদে পেলে তিনি ফুলির মাকে বলে ডিম ভেজে খেতে পারেন। তিনি তা না করে সবার সামনে মাকে বিব্রত করে একধরনের মজা পাচ্ছেন। এই ব্যাপারগুলো আমি বুঝি, মা বুঝেন না। এইজন্যেই মাকে আমার খুব বুদ্ধিমতী বলে মনে হয় না। বুদ্ধিমতী যে-কোনো মেয়ে এই ব্যাপারটা ধরে ফেলত।

সবাই বলে ছোট পরিবার সুখী পরিবার। রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকে। চিঠির উপর সিল মারা থাকে ছোট পরিবার যার, সুখের অন্ত নাই তার। আমাদের পরিবার ছোট পরিবার। আমি, বাবা আর মা। না, ভুল বললাম, ফুলির মা আছে। সে আমার জন্মের আগে থেকে এ বাড়িতে আছে। কাজেই সেও তো পরিবারেরই একজন। তাকে নিয়ে আমরা চারজন। আমাদের খুব সুখী হবার কথা। আমরা বোধহয় সুখী না। বাবা-মা’র সম্পর্ক বরফের মতো। তারা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করেন। এমন কঠিন ঝগড়া! কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া তা একটু বলি– আমাদের ফুলির মা’র সিগারেট খাওয়ার বিশ্রী অভ্যাস আছে।

বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সে সিগারেট চুরি করে রাখে। অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আরাম করে খায়। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে স্মাৎ করে নাক দিয়ে সেই ধোয়া টেনে নেয়। আমি কয়েকবার দেখেছি। একদিন বাবা করলেন কী তাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনে দিয়ে বললেন, চুরি করার দরকার নেই। এই প্যাকেটটা রাখ। শেষ হলে বলবে, আবার এনে দেব। মা এটা শুনে হৈচৈ শুরু করলেন। আর ফুলির মা শুরু করল কান্না। ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়ে যেতে পারত, শেষ হলো না। রাত দুটার সময় মা বাবাকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার বাস করা সম্ভব না। তুমি চলে যাও। বাবা বললেন, রাত দু’টার সময় আমি কোথায় যাব?

তুমি যদি না যাও আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব।ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, তবে আপাতত বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকছি। ভোর বেলা চা খেয়ে চলে যাব।তুমি এখনি যাবে।বাবাকে রাত দুটার সময়েই চলে যেতে হলো। তবে তার জন্যে তাঁকে খুব দুঃখিত বলেও মনে হলো না। এই ঘটনা থেকে মনে হতে পারে মা’র দোষই বেশি। আসলে তা না। বাবা মাকে রাগিয়ে দেবার জন্যে যা যা করা দরকার সবই করেন। খুব গুছিয়ে করেন। মাকে রাগিয়ে তিনি কী আনন্দ পান তিনিই জানেন।সাপ মা’র খুব অপছন্দের প্রাণী। সাপের নাম শুনলেই তিনি শিউরে ওঠেন।

কোনোদিন যদি মা কোনো সাপের ছবি দেখেন তাহলে সেদিন তিনি কিছু খেতে পারেন না। এইসব জেনেশুনেও বাবা একবার সাপুড়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা সাপ কিনে নিয়ে এলেন। ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সে সাপটা ভরা। বাক্সের ডালায় সাপের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে একটি ফুটো। মা বললেন, বাক্সে কী? বাবা হাই তুলতে তুলতে বললেন, নাথিং। অ্যাবসুলিউটলি নাথিং।নাথিং মানে কী? একটা সাপ কিনলাম।মা চমকে উঠে বললেন, কী কিনলে? সাপ। সরীসৃপ। আমার অনেক দিনের শখ।মা আতঙ্কে শিউরে উঠে বললেন, তোমার অনেক দিনের শখ সাপ কেনা?

হুঁ।তোমার এই শখের কথা তো কোনোদিন শুনি নি।তুমি সাপ ভয় পাও এইজন্যে বলা হয় নি। এখন যেহেতু সাপ পুষব দেখবে তোমার ভয় কেটে যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি। আমার শখ মিটল, তোমার ভয় কাটল।তুমি এই সাপ পুষবে? অবশ্যই। সাপ পোষা অত্যন্ত সহজ। খাওয়ার খরচ নেই বললেই হয়। সপ্তাহে একটা ইঁদুর। লোকে যে বলে সাপ দুধ খায়, কলা খায় সবই ফালতু কথা। দুধ চুমুক দিয়ে খেতে ফুসফুস লাগে। সাপের ফুসফুস নেই। কলা খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সাপ তো আর বাদর না যে কলা খাবে।

সাপ অবশ্যি শেষপর্যন্ত পোষা হয় নি। বাবাকে কাঠের বাক্সসদ্ধ ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছে। বাবাও জানতেন ফেলা হবে। পুরো ব্যাপারটা তিনি করেছেন মাকে কিছু যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে। যন্ত্রণা দেয়া গেছে এতেই তিনি খুশি। পঞ্চাশ টাকায় সাপ কেনা তার সার্থক। পঞ্চাশ টাকায় এতটা আনন্দ পাবেন তা বোধহয় বাবা নিজেও ভাবেন নি। তার আনন্দিত মুখের ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে।বাবা অনেক দিন হলো আমাদের সঙ্গে থাকেন না। থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবনে। কাঠের ব্যবসা করেন। কাঠের ব্যবসা যারা করে তারা ক্রমাগত ধনী হয়, বাবা শুধুই গরিব হন। মা’র ধারণা, ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু না।

ব্যবসার অজুহাতে জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকা, নিরিবিলিতে মদ খাওয়া। মার ধারণা সত্যি হতেও পারে।নেশা করার কুৎসিত অভ্যাস বাবার আছে। খুব প্রবলভাবেই আছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। গালটাল ভেঙে কী বিশ্রী যে তাকে দেখায়! অথচ যৌবনে বাবা কী সুন্দরই না ছিলেন! বিয়ের পর তোলা বাবা ও মা’র একটা বাধানো ছবি মা’র শোবার ঘরে আছে (এখন নেই। মা সেই ছবি সরিয়ে ফেলেছে)। সেই ছবিতে বাবাকে দেখায় রাজপুত্রের মতো। মা অসম্ভব রূপবতী, তারপরেও বাবার পাশে মানায় না। রাজপুত্রের পাশে রাজকন্যার মতো লাগে না। রাজপুত্রের পাশে মন্ত্রিকন্যার মতো লাগে।

মা’র যখন বিয়ে হয় তখন বাবা বিদেশী এক ওষুধ কোম্পানির প্রোডাকশান ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর ছিল টকটকে লাল রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়ি। গাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি লাল টাই পরতেন। মাকে পাশে বসিয়ে খুব ঘুরতেন। বিয়ের একবছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিলেন– তাঁর নাকি বোরিং লাগছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। সেই চাকরি বছর দুই করার পর তাও তার কাছে বোরিং লাগতে লাগল। প্রাইভেট কলেজে কিছুদিন মাস্টারি করলেন। সেটাও ভালো লাগল না।

ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসার শুরুটা খুব ভালো ছিল। ব্যবসা করতে গিয়েই মদ খাওয়ার অভ্যাস হলো। কাজ বাগাবার জন্যে নানান পার্টিতে নাকি যেতে হয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একটু-আধটু খেতে হয়। জীবনের কোনো কিছুই তার দীর্ঘদিন ভালো লাগে নি, মদ খাওয়া ভালো লেগে গেল। মদ খাওয়াটা ছাড়তে পারলেন না। সংসারে অশান্তির সীমা রইল না। অশান্তি শেষ হলো যেদিন বাবা বললেন, দিলশাদ, কাঠের ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি। বান্দরবন চলে যাব। কাঠ কেটে হাতি দিয়ে নামানো। খুবই লাভের ব্যবসা। মা কঠিন গলায় বললেন, তোমরা যা ইচ্ছা কর।

কাঠ হাতি দিয়ে টেনে নামাও বা নিজেই টেনে নামাও আমার কিছু যায় আসে না।তোমাদের ছেড়ে বাইরে থাকতে হবে।দয়া করে তাই থাক।কোনোরকম চিন্তা করবে না, প্রতিমাসে খরচ পাঠাব।তোমাকে কোনো খরচ পাঠাতে হবে না। দয়া করে তুমি ঢাকায় এসো না। তাহলেই আমি খুশি হব।তোমার যে চাকরি তাতে তো আর বাড়িভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে পারবে না।সেটা আমি দেখব।তুমি বরং এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ভালো কোনো অ্যাপার্টমেন্ট নাও, যেখানে সিকিউরিটি সিস্টেম ভালো। একা একা থাকবে…।

আমাদের নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।বাবা চলে যাবার দিনও বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন। সেলাই মেশিন দিয়ে জানালার পর্দা সেলাই করছিলেন। বাবা স্যুটকেস হাতে নিয়ে বললেন, যাই। মা সেলাই করতে করতে বললেন, আচ্ছা। মা ফিরে তাকালেন না বা উঠে দাঁড়ালেন না। বাবা আবার বললেন, যাচ্ছি তাহলে, কেমন? মা বললেন, আচ্ছা।চিঠি দিও। আমি পৌঁছেই ঠিকানা জানিয়ে দেব।মা জবাব দিলেন না। সেলাই মেশিন চালাতে লাগলেন। ঘরঘর শব্দ হতে লাগল। বাবা বিষণ্ণ মুখে দরজার দিকে যাচ্ছেন। তাকে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছিল। আমি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তিনি মাথা নিচু করে হাঁটছেন, মনে হচ্ছে আমাকে চিনতেও পারছেন না। রিকশায় ওঠার সময় আমি বললাম, প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিও বাবা। তিনি বললেন, হুঁ হুঁ।

সেই রাতেই আমার প্রথম মাথায় যন্ত্রণা হলো। টিভিতে নাচের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। নজরুলগীতির সঙ্গে নাচ। গানটা খুব সুন্দর, নাচটাও সুন্দর হচ্ছিল। স্টুডিওতে নকল একটা নদী বানিয়েছে। সেই নদীতে চাঁদের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। বোঝা যাচ্ছে নকল, তারপরেও ভালো লাগছে। এই সময় হঠাৎ আমার কাছে সবকিছু ঝাঁপসা লাগতে লাগল। প্রথম ভাবলাম ইলেকট্রিসিটির ভোল্টেজে কিছু হয়েছে। তারপর দেখি ঘরবাড়ি দুলছে। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, মা মা! মা ছুটে এলেন আর তখনি তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাবার মতো হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি পড়ে যাচ্ছি।

মা এসে আমাকে ধরে ফেললেন। আর তখনি ব্যথা কমে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল।মা ভাবলেন, বাবা চলে গেছেন এইজন্যেই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়েছে। আমি কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম বাবার যাওয়া না-যাওয়া না– এই ব্যথা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার খুব ভয় ভয় করতে লাগল। রাতে মাকে বললাম, মা, আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।অনেক দিন পর মা’র সঙ্গে শুয়েছি। মা আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, বাবা চলে যাবার জন্যে মনটা খুব খারাপ, তাই না?

আমি বললাম, হুঁ।তুই তোর বাবাকে কি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসিস? হুঁ।তাকে কতটা বেশি ভালোবাসিস? সামান্য বেশি না অনেকখানি? অনেকখানি।আমাকে তোর ভালো লাগে না? ভালো লাগে না তা তো বলি নি। ভালো লাগে, তবে বাবার চেয়ে অনেক কম ভালো লাগে।এই যে তোর বাবা প্রতিরাতে নেশা করে বাসায় ফেরে, নেশার ঘোরে হৈচৈ চিৎকার করে, সংসারের কোনো কিছু দেখে না তারপরেও তাকে ভালো লাগে?

হুঁ।মা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তো স্বীকার করতেই হয় তোর বাবা খুব ভাগ্যবান। এরকম জীবনযাপন করার পরও ছেলেমেয়ের ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবার ভাগ্যে এটা হয় না।আমি বললাম, তোমাকেও আমি খুব ভালোবাসি মা বাবার জন্যে ভালোবাসা একরকম আর তোমার জন্যে ভালোবাসা অন্যরকম।সেটা কী বুঝিয়ে বল।বুঝিয়ে বলতে পারব না।আচ্ছা থাক, বলতে না পারলে বলতে হবে না। ঘুমো।আমার মা খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে।

খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এলোমেলো কিছুই তার পছন্দ না। সামান্য একটা শাড়ি যখন ঘরে পরেন তখন এমন গুছিয়ে পরেন, মনে হবে সেজেগুঁজে আছেন– এক্ষুনি কোথাও বেড়াতে বের হবেন। কাউকে যখন কাঁচের গ্লাসে পানি দেবেন সেই গ্লাস ঝকঝক করবে। একবার পানি খাবার পর আবার পানি খেতে ইচ্ছা করবে। মাকে আমার অনেকের চেয়েই আলাদা মনে হয়।

মার অন্য দুই বোন– আমার বড় খালা আর মেজোখালার সঙ্গে তার কোনোরকম মিল নেই। অথচ তারা তিনজনই দেখতে একরকম। গলার স্বরও একরকম। বড় খালা ও মেজোখালা দুজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই হলো শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি করা। বড়খালা সবসময়ই কিছু না কিছু কিনছেন। মেজোখালা দেখে বেড়াচ্ছেন। কিনছেন না, দরদাম করছেন। তাদের সমস্ত কথাবার্তাই কেনাকাটা নিয়ে। বড়খালা হয়তো এলেন, তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলেন। তাঁর ভারি শরীর, তিনি অল্পতেই হাঁপিয়ে যান।

ঘরে ঢুকেই বলবেন, ও দিলশাদ, ঠাণ্ডা পানি দে। মরে গেলাম রে। তাঁকে পানি দেয়া হলো। গ্লাসের দিকে তাকিয়েই বললেন– গুলশানের একটা দোকানে গ্লাসের একটা সেট দেখলাম। অসাধারণ। সোনালি কাজ করা। খুব হালকা কাজ। ছোট ছোট পাতা। গ্লাসে পানি ভরলে গ্লাসটা দেখা যায় না, পানিও দেখা যায় না। শুধু সোনালি কাজগুলি দেখা যায়।মা এ জাতীয় কথায় অংশগ্রহণ করেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। তার চোখের দৃষ্টিতে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কিছুই থাকে না। বড়খালার তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি কথা বলতেই থাকেন।মেড ইন জাপান, বুঝলি। জাপানিরা এরকম গ্লাস বানাবে ভাবাই যায় না। দুটা সেট ছিল, একটা কিনলাম। দাম কত বল তো? তোর অনুমান দেখি।

আমার অনুমান ভালো না।

আহা, তবু একটা অনুমান কর না।

এক হাজার টাকা।

তোর কি মাথাটা খারাপ নাকি? এক হাজার টাকা তো সাধারণ একটা গ্লাস সেট কিনতেই লাগে। ঐ দিন জার্মানির কাট গ্লাসের একটা সেট কিনলাম, আট পিসের সেট। দাম পড়ল ন হাজার টাকা। তোর দুলাভাই খুব রাগ করছিল। রাগ করলে লাভ হবে? এরকম জিনিস কি সবসময় পাওয়া যায়? হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়। এইজন্যে সবসময় চোখ-কান খোলা রেখে বাজারে ঘুরতে হয়। ভালো জিনিস কখনো পড়ে থাকে না। কেউ দেখল, ফট করে নিয়ে নিল।

বড় খালার দীর্ঘ গল্প কী যে বিরক্তিকর! একনাগাড়ে এই গল্প শুনলে যে-কেউ ঘুমিয়ে পড়বে। বড়খালা আমার মা হলে গুলশান-বনানী নিউমার্কেটের দোকানগুলির সব জিনিসপত্রের দাম আমার মুখস্থ থাকত। তিনি হয়তো পাঁচশ পাতার একটা খাতা আমাকে বানিয়ে দিতেন। সেই খাতায় আমাকে সব জিনিসপত্রের দাম লিখে রাখতে হতো। কে জানে, তখন হয়তো আমাকেও তার সঙ্গে দোকানে দোকানে ঘুরতে হতো।

মেজোখালা ভয়ঙ্কর কৃপণ বলেই কিছু কেনেন না। শুধু দেখেন। তিনি গল্প রেন অন্য বিষয় নিয়ে। তার গল্প হলো কে কে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই গল্প। মেজোখালার ধারণা, তিনি এই পৃথিবীর সবচে’ রূপবতী মেয়ে এবং তাঁর চোখে আছে অসম্ভব আকর্ষণী ক্ষমতা। যে পুরুষ একবার তার চোখের দিকে ভালোমতো তাকাবে সে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে যাবে। মেজোখালা খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু এত বুদ্ধিমতী একজন মহিলা এমন বোকার মতো একটা ধারণা নিয়ে বাস করেন কীভাবে কে জানে। তবে মেজোখালা গল্প করেন খুব সুন্দর করে। গলার স্বর নিচু করে, হাত নেড়ে, চোখ বড় বড় করে সুন্দর বর্ণনা। শুনতে খুব ভালো লাগে।

বুঝলি দিলশাদ, কী কাণ্ড হয়েছে শোন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সোহাগ কম্যুনিটি সেন্টারের ঘটনা। চন্দনার বিয়েতে গিয়েছি। চন্দনাকে চিনেছিস তো? ঐ যে ব্রিগেডিয়ার লতিফের মেজো মেয়ে। আমি পরেছি একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি, বিসকিট কালারের জমিন, মেজেন্টা পাড়। একদিকে মেজেন্টা, অন্যদিকে সবুজ। খাওয়া-দাওয়ার পর আমি পান নিচ্ছি, হঠাৎ সাফারি পরা এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। আপনি কি শুনবেন? আপনার কাছে হাতজোড় করছি। আমি বললাম, বলুন।এখানে খুব ভিড়। আপনি যদি গেটের কাছে একটু আসেন। জাস্ট ফর এ সেকেন্ড।এমন করে বলছে না গেলে খারাপ দেখা যায়। আমি গেলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। তারপর যা হলো সে এক ভয়ঙ্কর।

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *