এপিটাফ পর্ব:০৩ হুমায়ূন আহমেদ

এপিটাফ পর্ব:০৩

টেলিফোনের শব্দে দিলশাদ জেগে উঠল। অনেক রাত, ঘর অন্ধকার। মাথার কাছে দেয়ালঘড়ি টিক টিক করছে। বেশ বাতাস। বাতাসে জানালার পর্দা নড়ছে। চারপাশের পৃথিবী পরিচিত, শব্দাবলি পরিচিত। কিন্তু যে টেলিফোনের শব্দ ঘুম ভাঙাল সেই টেলিফোন এলো কোত্থেকে? এ বাসায় টেলিফোন নেই। কখনো ছিল না। সাজ্জাদের যখন দিনকাল ভালো ছিল তখনো না। সাজ্জাদ টেলিফোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিল, লাইন আসে নি। কে জানে এতদিনে হয়তো এসেছে। পুরনো বাড়িতে টেলিফোন মিস্ত্রিরা ঘোরাঘুরি করছে।

তাহলে ঘুমের মধ্যে টেলিফোনের পরিষ্কার আওয়াজ সে শুনল কীভাবে? শুধু যে ঘুমের মধ্যে শুনেছে তা না। ঘুম ভাঙার পরেও শুনেছে টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। আশ্চর্য তো! তাহলে কি কলিংবেলের আওয়াজ? এ বাসায় কলিংবেল আছে, তার শব্দও টেলিফোন রিং-এর কাছাকাছি। তবে গত দুদিন ধরে সেই কলিংবেল নষ্ট। ফ্ল্যাট বাড়ির কেয়ারটেকার ত্রিশ টাকা নিয়ে গেছে কলিংবেল ঠিক করার জন্যে, এখনো ঠিক হয় নি।দিলশাদ বিছানা থেকে নামল। বাতি জ্বালাল না।

বেশিরভাগ মানুষ রাতে ঘুম ভাঙলে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে বাতি জ্বালানো। হুড়মুড় করে ছুটে যায় সুইচ বোর্ডের দিকে। যেন এই মুহূর্তে সুইচ না টিপলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। দিলশাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। সে রাতে ঘুম থেকে উঠে কখনোই বাতি জ্বালায় না। পানির পিপাসা পেলে অন্ধকারেই খাবার টেবিলের দিকে যায়। খাবার টেবিলে পিরিচে ঢাকা জগ থাকে, গ্লাস থাকে। দিলশাদের অন্ধকারে চলাচল করতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া রাতে এই ফ্ল্যাট কখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। ফ্ল্যাটের বারান্দায় চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাতি সারারাত জ্বলে। বড় রাস্তার পাশে ফ্ল্যাট। রাস্তার হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোও ঘরে ঢোকে।

সাজ্জাদের ধারণা, পুরোপুরি অন্ধকার দেখতে হলে জঙ্গলে যেতে হবে। সত্যিকার অন্ধকার শুধু জঙ্গলেই দেখা যায়। দিলশাদ ঠিক করে রেখেছে নাতাশার চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাবার আগে দুদিনের জন্যে হলেও সাজ্জাদের সেই বিখ্যাত জঙ্গল দেখে আসবে। তার নিজের জন্যে নয়, জঙ্গল দেখা বা সত্যিকারের অন্ধকার দেখার শখ তার নেই। নাতাশার জন্যে যেতে হবে। নাতাশা তার বাবার জঙ্গল দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সেই অপেক্ষার ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না। এই মেয়ের সবকিছুই গোপন। নিজ থেকে সে কখনোই বলবে না তার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার শারীরিক সুবিধা-অসুবিধার কথা জানার কোনো উপায় নেই।

দিলশাদের ধারণা, এখন নাতাশার চোখের সমস্যা হচ্ছে। বই পড়ার সময় বই চোখের খুব কাছে নিয়ে আসছে। বেশিক্ষণ পড়ছেও না। মনে হয় পড়তেও কষ্ট হচ্ছে। আগে মাঝে মাঝে দেখা যেত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সে তার খাতায় রাত জেগে লেখালেখি করছে। এখন তাও করে না।দিলশাদ মেয়ের ঘরে ঢুকল। নাতাশা হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। খাটের একপাশ দেয়ালের সঙ্গে লাগানো, অন্যপাশে দুটি চেয়ার দেয়া। এই ঘরে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। জিরো পাওয়ারের আলো চাঁদের আলোর কাছাকাছি। শুধু চাঁদের আলোয় রহস্য আছে, এই আলোয় রহস্য নেই।নাতাশা ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাঁদর। কোলবালিশের উপর তার রোগা একটা হাত।

কোলবালিশ নাতাশার পছন্দ না, তবু রোজ রাতে দিলশাদ কোলবালিশটা এনে বিছানায় দিয়ে যায়। খাটের পাশে চেয়ার দিয়ে দেয়াল তোলাও নাতাশার অপছন্দ। সে আহত গলায় বলে, তুমি চেয়ার দাও কেন মা? তোমার কি ধারণা আমি গড়িয়ে পড়ে যাব? চেয়ার সরিয়ে নাও তো, আমার বন্দি বন্দি লাগে। নাতাশার খুব অপছন্দের এই কাজটিও দিলশাদ করে। অনেক অপ্রিয় কাজ মাদের করতে হয়।নাতাশার ঘরে পা দিয়েই দিলশাদের মনে হলো নাতাশা ঘুমুচ্ছে না, জেগে আছে। এরকম মনে হবার যদিও কোনো কারণ নেই। ঐ তো দেখা যাচ্ছে নাতাশার চোখ বন্ধ। ঘুমন্ত মানুষের মতো ধীর লয়ে তার নিঃশ্বাস পড়ছে।দিলশাদ নরম গলায় ডাকল, নাতাশা! এই বুড়ি! নাতাশা জবাব দিল না। অথচ দিলশাদ মোটামুটি নিশ্চিত ছিল নাতাশা চোখ মেলে বলবে, কী?

দিলশাদ খাবার ঘরের দিকে গেল। তার পানির পিপাসা হচ্ছে। খাবার টেবিলে পানির জগ-গ্লাস নেই। ফুলির মা আজকাল কাজকর্ম ঠিকমতো করছে না। রুটিন কাজে প্রায়ই ভুল করছে। তিনজন মানুষের সংসারে এরকম হবে কেন? দিলশাদ বাতি জ্বালাল। ফ্রিজের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করল। পানি ঠাণ্ডা হয় নি। ফ্রিজে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে বা অন্য কিছু হয়েছে। পানি ঠাণ্ডা হয় না। ফ্রিজ ঠিক করার সামর্থ্য এখন দিলশাদের নেই। প্রতিটি পয়সা এখন তার কাছে সোনার টুকরোর মতো। তবে ফ্রিজটা ঠিক করতে হবে।

নাতাশা ঠাণ্ডা পানি খেতে ভালোবাসে। তৃষ্ণা পেলেই বলবে, মা, ঠাণ্ডা পানি দাও তো।খাবার ঘরের চেয়ারে দিলশাদ কিছুক্ষণ বসে রইল। বসে থাকতে ভালো লাগছে, তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। খুব মশা। এক্ষুনি মশা তাকে হেঁকে ধরবে। দিলশাদ আবার নাতাশার ঘরে ঢুকল। আশ্চর্য, মেয়ে চুপচাপ খাটে বসে আছে। দিলশাদ বলল, ব্যাপার কী রে? নাতাশা লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না।আমি যখন তোকে ডাকলাম তখন তুই কি জেগে ছিলি?

হুঁ।জবাব দিস নি কেন? এমনি।পানি খাবি? না।দিলশাদ খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসল। নাতাশার গায়ে কি জ্বর আছে? কিছুদিন হলো রাত করে জ্বর আসছে। বেশ ভালো জ্বর। দিলশাদ বলল, গা গরম নাকি রে মা? উঁহু।মেয়ের কথা দিলশাদের বিশ্বাস হলো না। সে মশারির ভেতর হাত ঢুকিয়ে মেয়ের গায়ের তাপ দেখল। জ্বর নেই, গা ঠাণ্ডা। একটু কি বেশি ঠাণ্ডা? শরীর কেমন হিম হয়ে আছে।মাথার যন্ত্রণা নেই তো মা?

উঁহু।মশারির ভেতর মশা ঢুকে নি তো? দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। দিলশাদের উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু নাতাশার বোধহয় বিশ্রাম দরকার।নাতাশা! উঁ।আচ্ছা, তুই কি টেলিফোনের শব্দ শুনেছিস? না তো! আমি শুনলাম টেলিফোন বাজছে।ঘুমের মধ্যে শুনেছ।তাই হবে, কিন্তু এত স্পষ্ট শুনলাম।মাঝে মাঝে স্বপ্ন খুব স্পষ্ট হয়। আমি আজকাল প্রায়ই একটা খুব স্পষ্ট স্বপ্ন দেখি।দিলশাদ আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী দেখিস?

নাতাশা শব্দ করে হাসল। দিলশাদ হাসি শুনেই বুঝল এই মেয়ে আর কিছু বলবে না। এই প্রশ্ন আবার করলে সে আবারো হাসবে। দিলশাদ মশারির ভেতর ঢুকে গেল। নিজের ঘরে এখন আর তার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। নাতাশার পাশে শুয়ে পড়লেই হবে। বালিশ নেই। বালিশ আনতে নিজের ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না।নাতাশা! উ।তোর সঙ্গে ঘুমুলে তুই কি রাগ করবি? নাতাশা হাসল। মিষ্টি হাসি। হাসতে হাসতে বলল, মা, তোমার ঘুম আসছে না, তাই না? ঠিক ধরেছিস।এবং তুমি একটু ভয় পেয়েছ।ভয় পাব কেন? টেলিফোনের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছ।আমি এত সহজে ভয় পাই না।আজ একটু পেয়েছ।আচ্ছা যা, একটু পেয়েছি।

দিলশাদ পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। নাতাশা যে বলেছে মশা নেই তা ঠিক না। এই তো একটা মশা রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো পাওয়া যাবে। নাতাশা বলল, তোমার বালিশ লাগবে না? না।নাতাশার মাথা ধরেছে। চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা শুরু হলে দুটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। হয় কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড ঘুম পায়, নয়তো ব্যথা দেখতে দেখতে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন ইচ্ছা করে প্রচণ্ড শব্দে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে। যেন মাথাটা ফাটলেই ব্যথাটা বের হয়ে যাবে। আজ মাথার চাপা ব্যথাটা কোন দিকে যাবে নাতাশা বুঝতে পারছে না। আতঙ্কে তার শরীরের ভেতরটা কাঁপছে। এই কাপন বাইরের কারো বোঝার উপায় নেই।

নাতাশা! কী মা? তুই কি তোর বাবাকে তোর অসুখের কথা কিছু লিখেছিস? না।না লেখাই ভালো, শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করবে। বিদেশে যাবার সব ঠিকঠাক হলে আমিই জানাব।আচ্ছা।গল্প শুনবি? শুনব।নাতাশা মার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে শুয়েছে। দিলশাদ মেয়ের গা ঘেসে এলো। একটা হাত রাখল মেয়ের গায়ের উপর। হালকা করে রাখল যেন চাপ না পড়ে।ভূতের গল্প শুনবি? হুঁ।ভূতের গল্প শুনে আবার ভয় পাবি না তো?

ভয় পাবার জন্যেই তো ভূতের গল্প শোনা। হাসার জন্যে তো কেউ ভূতের গল্প শুনে না।তাও তো কথা। শোন তাহলে, সত্যিকার ভূতের গল্প। এক বর্ণ মিথ্যা না। আমার মার মামার বাড়ি হচ্ছে সান্দিকোনা বলে একটা জায়গায়। তারা এককালে বিরাট জমিদার ছিলেন। খুব রমরমা ছিল। তাদের বসতবাড়ির নাম ছিল শতদুয়ারি। বাড়িটার দরজা ছিল একশটা। এইজন্যে শতদুয়ারি নাম। প্রকাণ্ড সব দরজা। যেমন মজবুত তেমন ভারি। দরজার কজায় প্রতি সোমবারে ঘি দেওয়া হতো যেন কাঁচ ক্যাচ শব্দ না হয়। সপ্তাহে ঘিয়ের বরাদ্দ ছিল একসের এক ছটাক…।

তুমি দেখেছ সেই বাড়ি? হ্যাঁ। সেই গল্পই তো বলছি।এখনো ঘি দেয়? এখন ঘি দেবে কোত্থেকে? খাওয়ারই পয়সা জুটে না আর ঘি! গল্পটা শোন। শতদুয়ারি বাড়ির একটা দুয়ার সবসময় বন্ধ থাকত। খোলা নিষেধ ছিল। আমার নানাজানের বাবা নিষেধ করে গিয়েছিলেন। শুধু যে মুখে নিষেধ করে গিয়েছিলেন তাই না– দরজার গায়ে খোদাই করে লিখে গিয়েছিলেন। সংস্কৃত মেশানো অদ্ভুত বাংলা অদ্য দ্বাত্রিংশ শ্রাবণঃ ঐশ্য নির্দেশং ক্ষুধিতং…।

তোমার মুখস্থ মা? হ্যাঁ। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। আমি আর বড় আপা। তখন মুখস্থ করেছি।তোমার বয়স তখন কত? ঠিক খেয়াল নেই। তবে কত আর হবে? সাত-আট হবে।কোন ক্লাসে পড়তে? তোর সঙ্গে গল্প করা ভারি মুশকিল। এত প্রশ্নের জবাব দিয়ে কি আর গল্প করা যায়? কোন ক্লাসে পড়তে মনে নেই? না।আচ্ছা আর প্রশ্ন করব না। তুমি বলো।দিলশাদ খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল।নাতাশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীর ঝিম ঝিম করছে। বড় ধরনের কোনো আনন্দময় ঘটনার আগে আগে শরীর যেমন ঝিম ঝিম করে সেরকম। নাতাশার এই আনন্দের কারণ তার মা’র গল্প নয়। আনন্দের কারণ হচ্ছে তার মাথাব্যথাটা ঘুমের দিকে যাচ্ছে।

এক্ষুনি সে ঘুমিয়ে পড়বে। মা’র গল্প এখন খুব অস্পষ্টভাবে তার কানে যাচ্ছে। মা যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছেন। তার গলার স্বর অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে। নাতাশার ঘুম আসছে গাঢ় ঘুম, শান্তিময় ঘুম।সেদিন কী হলো নাতাশা শোন। ঠিক করা হলো বন্ধ দরজাটা খোলা হবে। তালার চাবি তো অনেক আগে থেকেই নেই। মিস্ত্রি আনা হয়েছে তালা খোলার জন্যে। সে সন্ধ্যা থেকেই তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তালা খুলছে না… নাতাশা, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?….

নাতাশা জবাব দিল না। দিলশাদ মেয়ের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল। ঘুমিয়ে পড়েছে। দিলশাদ মেয়ের কপালে হাত রাখল। কপাল ভেজা। সে ঘামছে। এমন ঘামা ঘেমেছে, মনে হচ্ছে গোসল সেরে উঠল।গল্পটা শেষ করতে না পেরে দিলশাদের খারাপ লাগছে। আজ আর ঘুম আসবে না। তার বিশ্রী স্বভাব হয়েছে, রাতে ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকতে হয়। তখন বড় নিঃসঙ্গ লাগে। দিলশাদ সাবধানে মেয়ের পাশ থেকে উঠে এলো। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে পুবদিকের বারান্দার দরজা খুলল। খুব সাবধানে খুলল। মেয়ের ঘুম যেন না ভাঙে। বিছানা থেকে নেমে আসার পর মনে হলো আরে, মশাগুলি তো মারা হলো না। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। দিলশাদ বারান্দার দিকে পা বাড়াল।

রেলিং দেয়া ছোট্ট বারান্দা। নামেই বারান্দা। আলো-বাতাস নেই। আকাশ দেখা যায় না। বারান্দার সামনে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং উঠছে– বারোতলা দালান। দৈত্যের মতো এই দালান দিলশাদের ছোট্ট বারান্দা ঢেকে ফেলেছে। রাতের বেলা বারান্দায় এলে সামনের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটাকে জেলের পাঁচিলের মতো লাগে।বারান্দায় একটা গদি বসানো বেতের চেয়ার আছে। মেঝের পুরোটা ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটের মতো করে শীতল পাটিতে ঢাকা। ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলন্ত টবে অর্কিড। দিলশাদের খুব শখের গাছ। নীল রঙের ফুল যখন ফুটে দিলশাদের অদ্ভুত লাগে।দিলশাদ বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসল না। মেঝের শীতল পাটিতে বাচ্চাদের মতো পা ছড়িয়ে বসল।

কাল বৃহস্পতিবার হাফ অফিস। কাল সারাদিনে কী করবে ভেবে নেয়া যাক। অফিসের পর সে বাসায় না এসে সরাসরি চলে যাবে বড় দুলাভাই ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের অফিসে। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের নিজের অফিস বলেই তিনি ছুটির দিনেও অফিসে থাকেন। তারপরেও টেলিফোন করে যাবে। নাতাশাকে বাইরে পাঠানোর টাকা এক্ষুনি জোগাড় করতে হবে। হাতে সময় নেই। বড় দুলাভাইয়ের কাছে সরাসরি চাওয়াই ভালো। আপার কাছে চেয়ে কিছু হবে না। দুলাভাইয়ের সংসারে আপার অবস্থা জাপানি পুতুলের মতো। তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু না।

ওয়াদুদুর রহমান সাহেবকে দিলশাদ সহ্যই করতে পারে না। তার আচার আচরণ দিলশাদের কাছে অতীতে অরুচিকর মনে হয়েছে, এখনো হয়। বড় আপার বিয়ের পর তিনি এক রাতে তাঁর দুই শালী এবং স্ত্রীকে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে ঘোষণা দিলেন আমার দুই শালী থাকবে আমার দুই পাশে এবং আমি আমার দুহাত শালীদের কোলে ফেলে রাখব। এইটুকু সুযোগ না পেলে সুন্দরী শালী থাকার মানে কী? হা হা হা।তিনি যে সিনেমাহলে ঢুকে সত্যি সত্যি শালীদের কোলে হাত রাখবেন দিলশাদ তা কল্পনাও করে নি।

সে হতভম্ব হয়ে গেল এবং চাপা গলায় বলল, দুলাভাই, হাত সরিয়ে নিন। ওয়াদুদুর রহমান বললেন, পাগল হয়েছ? দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আমি কিন্তু উঠে চলে যাব। ওয়াদুদুর রহমান হাত সরিয়ে নিলেন।বাসায় ফিরে দিলশাদের বড় আপা দিলশাদের সঙ্গে খুব রাগরাগি করল। থমথমে গলায় বলল, তুই এরকম করলি কেন? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে?

দুলাভাইরা শালীদের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করে না? তুই বিশ্রী ব্যবহার করলি! বেচারা মনে কষ্ট পেয়েছে। কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।দিলশাদ বলল, গম্ভীর হয়ে থাকলেও কিছু করার নেই আপা। এই জাতীয় ঠাট্টা আমার পছন্দ না।কোলে হাত রাখলে কী হয়? কিছুই হয় না, কিন্তু আমার ভালো লাগে না।আসলে তুই বেশি পেকে গেছিস। এত পাকা ভালো না।

পেকে যখন গেছি তখন তো আর করার কিছু নেই। পেকে যাওয়া ফল কাঁচা করার কোনো পদ্ধতি নেই।এখন চা নিয়ে তোর দুলাভাইয়ের কাছে যা, তার রাগ ভাঙা। বেচারা যা মন খারাপ করেছে আমারই কান্না পাচ্ছে।দিলশাদ চা নিয়ে গেল। দেখল, দুলাভাই মোটেই মন খারাপ করে নেই। দিলশাদের মেজোআপা দিলরুবার সঙ্গে মোটা দাগের রসিকতা করে যাচ্ছেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছেন। দিলশাদের বড় আপা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল এবং হাসিমুখে বলল, এই শোন, দিলুদের ঐ গল্পটা বলো তো, মোটা শাশুড়ি আর চিকন বৌয়ের গল্প। একটু অবসিন কিন্তু দারুণ ফানি। ওরা শুনলে মজা পাবে। প্লিজ। একটু রেখে-ঢেকে বলল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *