এখন দুই ছােট গােল্লার ভেতর দুটা ফোটা দাও। তারপর দেখ কী হয়েছে।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা বালকের মুখ আঁকা হয়েছে যে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
কার্টুনিস্ট আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দিলেন। বালকের মুখ হয়ে গেল বিড়ালের মুখ। বিড়ালটা লেজ উঁচু করে বসে আছে।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ কী করে সম্ভব? তিনি লাল নীল পেন্সিলটা আমাকে দিয়ে দিলেন। আমি আনন্দে অভিভূত হলাম। অনেক অনেক দিন এই পেন্সিল আমার পকেটে পকেটে ঘুরেছে। তবে ছবি আঁকা তেমন হয় নি। কারণ ছবি আঁকার কাগজ নেই। বাবার একটা বড় খাতা ছিল– জন্মবৃত্তান্ত খাতা, যেখানে তার ছেলেমেয়েদের সঠিক জনুক্ষণ, রাশিফল ইত্যাদি লেখা থাকত। ঐ খাতার সাদা পাতা চুরি করে কিছু ছবি আঁকা হতাে। ব্যাপারটা একদিন প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর বাবা দয়াপরবশ হয়ে ছবি আঁকার কাগজ কেনার একটা বাজেট করে দেন। তারাে বেশ কয়েক বছর পর তিনি তার ছেলেমেয়েদের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী করেন । আমাদের বাসার বারান্দায় সব ছবি ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে প্রতিটি ছবি দেখেন এবং একটি ছবিকে প্রথম ঘােষণা করেন। ছবিটা জাফর ইকবালের আঁকা সাইকেলের ছবি।
কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ
সাইকেলের সামনের চাকাটা বড়, পেছনেরটা বেশ ছােট। দু’টা চাকা দু’রকম কেন? জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দেয় সামনের চাকাটা কাছে বলে বড়। পিছনেরটা দূরে, তাই ছােট। বাবা তার শিশুপুত্রের কাছে এমন জবাব পাবেন কল্পনাও করেন নি। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তার পুত্র–কন্যাদের প্রতিভা বিষয়ক মুগ্ধতা আমৃত্যু লালন করেছেন।
কার্টুনিস্টের কাছে ফিরে যাই। উনার সঙ্গে আমার এক ধরনের অসম বন্ধুত্ব হলাে। আমার বসার জন্যে তিনি একটা উঁচু টুলের ব্যবস্থা করলেন। কাজের ফাকে দিনে কয়েকবার তিনি চা এবং টোস্ট বিসকিট খেতেন। টোস্ট ভেঙে অর্ধেকটা আমার হাতে দিতেন। তিনি যখন চা খেতেন পিরিচে করে তার খানিকটা আমাকে দিতেন। তাঁর চায়ের কাপে টোস্ট ভিজিয়ে তিনি খেতেন, আমিও খেতাম। আমার জন্যে মােটামুটি আনন্দময় সময়। হঠাৎ হঠাৎ আমার চেহারা নিয়ে দ্রুত কার্টুন এঁকে আমার কাছে দিতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে নিজের ছবি দেখতাম।
ছবি আঁকার সময় তার দুই হাত বন্ধ থাকত তখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে আমাকেই সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই বের করে দিতে হতাে। একবার পকেট থেকে সিগারেট বের করছি, উনি বললেন, পকেটে আর কিছু আছে ? আমি বললাম, একটা সিকি আছে। তিনি বললেন, সিকিটা তুই নিয়ে যা । এরপর থেকে পকেটে হাত দিলে পয়সা পেলে তুই নিয়ে যাবি, আমাকে কিছু বলতে হবে না। একদিন আনন্দের সমাপ্তি ঘটল। খারাপভাবেই ঘটল ঘটনাটা । কার্টুনিস্ট ছবি আঁকছেন। আমি তার ঘাড়ের উপর মাথা বের করে গভীর আগ্রহে দেখছি। আমার স্কুল বন্ধ। সকাল থেকেই আছি।
কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ
অর্টিস্টের জন্যে চা এবং টোস্ট বিস্কিট এসেছে । টোস্ট বিস্কিটের অর্ধেকটা ভেঙে কখন আমার হাতে দেয়া হবে তার জন্যে আমার ব্যাকুল প্রতীক্ষা। এই সময় এক লােক অফিসে ঢুকল। ধাক্কা দিয়ে সে আর্টিস্টকে ফেলে তার গলা পা দিয়ে চেপে ধরল। অফিসে যে দুজন ছিল তারা ছুটে এলাে। এবং তারাও আর্টিস্টের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে চিৎকার আসছে ‘মেরে ফেল। কুত্তাটারে মেরে ফেল। অফিসের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়া হলাে। বন্ধু অফিসের ভেতর থেকে গােঙানির শব্দ আসছে। আমি বাইরে দাড়িয়ে কাদছি।
কার্টুনিস্টের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। অফিসের বন্ধ দরজা এরপর আর খুলে নি। মানুষটার কী হলাে? অফিসটার কী হলাে? কিছুই জানি না।
কতবার যে অফিসের বন্ধ দরজার সামনে গিয়েছি । একে ওকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু বলে না। ক্লাস টুতে পড়া একটি শিশুর প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়ােজন বড়রা মনে করে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতাে দেখতে এই মানুষটাকে নিয়ে আমি শিশু কিশােরদের জন্যে একটা উপন্যাস একসময় লিখি । উপন্যাসটির নাম ‘বােতলভূত।
লেখক হবার একটা সুবিধা আছে। একজন লেখক কাউকেই হারিয়ে যেতে দেন না।
প্রসঙ্গ ‘মা’ শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে তার মা যে বদলাতে থাকে এই তথ্য কি কোনাে শিশু জানে ? শিশুর বয়স যখন দুই তখন তার মা এবং শিশুর বয়স যখন আট তখনকার মা দুই মানুষ।
কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ
অতি শৈশবের মা’কে আমার মনে নেই। যে মা’কে মনে আছে তাঁর বয়স আঠারাে–উনিশ। ঝলমলে তরুণী! যে তার বিশাল সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বিশাল সংসার, কারণ স্বামী–পুত্র–কন্যা ছাড়াও সংসারে বাড়তি দুজন— একজন। দেবর, আরেকজন তাঁর ছােটভাই। এই দুজনের প্রধান কাজ সারাদিন খটাস ধটাস শব্দে ক্যারাম খেলা এবং প্রতিবছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা। রেজাল্ট আউট হওয়ার পরের কয়েকদিন ক্যারাম খেলা বন্ধ থাকে, আবার শুরু হয় খটাস খটাস।
আঠারাে–উনিশ বছরের একজন তরুণীর চোখে নানান স্বপ্ন থাকে। আমার মায়েরও নিশ্চয়ই ছিল। স্বপ্নকে প্রবাহিত করার কোনাে সুযােগ কি ছিল ? আমার মনে হয় না। মহিলার স্বামী মানুষ হিসেবে ইন্টারেস্টিং। ভাবুক, প্রেমিক, জটিলতামুক্ত প্রায় মহাপুরুষ পর্যায়ের একজন। মহাপুরুষ দিয়ে সংসার চলে না। সংসারের চালিকাশক্তি অর্থ। মহাপুরুষের অর্থ ছিল না। তার বেতন ছিল। সর্বসাকুল্যে আশি টাকা। এই টাকার একটি অংশ চলে যেত দেশের বাড়িতে। একটি অংশ বই কেনায়, ক্যামেরার ফিল্ম কেনায়, একটি অংশ গান–বাজনার আসরে বন্ধুদের পেছনে। বাকি যা থাকত তা তিনি স্ত্রীর হাতে দিয়ে মধুর হাসি হেসে বলতেন, কষ্ট করে চালিয়ে নাও | মা চোখের পানি ফেলতেন।
Read more