কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ

এখন দুই ছােট গােল্লার ভেতর দুটা ফোটা দাওতারপর দেখ কী হয়েছে। 

আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা বালকের মুখ আঁকা হয়েছে যে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। 

কিছু শৈশবকার্টুনিস্ট আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দিলেনবালকের মুখ হয়ে গেল বিড়ালের মুখবিড়ালটা লেজ উঁচু করে বসে আছে। 

আমার বিস্ময়ের সীমা রইল নাকী করে সম্ভব? তিনি লাল নীল পেন্সিলটা আমাকে দিয়ে দিলেনআমি আনন্দে অভিভূত হলামঅনেক অনেক দিন এই পেন্সিল আমার পকেটে পকেটে ঘুরেছেতবে ছবি আঁকা তেমন হয় নিকারণ ছবি আঁকার কাগজ নেইবাবার একটা বড় খাতা ছিলজন্মবৃত্তান্ত খাতা, যেখানে তার ছেলেমেয়েদের সঠিক জনুক্ষণ, রাশিফল ইত্যাদি লেখা থাকতখাতার সাদা পাতা চুরি করে কিছু ছবি আঁকা হতােব্যাপারটা একদিন প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর বাবা দয়াপরবশ হয়ে ছবি আঁকার কাগজ কেনার একটা বাজেট করে দেনতারাে বেশ কয়েক বছর পর তিনি তার ছেলেমেয়েদের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী করেন আমাদের বাসার বারান্দায় সব ছবি ঝুলিয়ে দেয়া হয়তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে প্রতিটি ছবি দেখেন এবং একটি ছবিকে প্রথম ঘােষণা করেনছবিটা জাফর ইকবালের আঁকা সাইকেলের ছবি

কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ

সাইকেলের সামনের চাকাটা বড়, পেছনেরটা বেশ ছােটদুটা চাকা দুরকম কেন? জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দেয় সামনের চাকাটা কাছে বলে বড়পিছনেরটা দূরে, তাই ছােটবাবা তার শিশুপুত্রের কাছে এমন জবাব পাবেন কল্পনাও করেন নিতিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তার পুত্রকন্যাদের প্রতিভা বিষয়ক মুগ্ধতা আমৃত্যু লালন করেছেন। 

কার্টুনিস্টের কাছে ফিরে যাইউনার সঙ্গে আমার এক ধরনের অসম বন্ধুত্ব হলােআমার বসার জন্যে তিনি একটা উঁচু টুলের ব্যবস্থা করলেন। কাজের ফাকে দিনে কয়েকবার তিনি চা এবং টোস্ট বিসকিট খেতেনটোস্ট ভেঙে অর্ধেকটা আমার হাতে দিতেনতিনি যখন চা খেতেন পিরিচে করে তার খানিকটা আমাকে দিতেন। তাঁর চায়ের কাপে টোস্ট ভিজিয়ে তিনি খেতেন, আমিও খেতাম। আমার জন্যে মােটামুটি আনন্দময় সময়হঠাৎ হঠাৎ আমার চেহারা নিয়ে দ্রুত কার্টুন এঁকে আমার কাছে দিতেনআমি মুগ্ধ হয়ে নিজের ছবি দেখতাম। 

ছবি আঁকার সময় তার দুই হাত বন্ধ থাকত তখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে আমাকেই সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই বের করে দিতে হতােএকবার পকেট থেকে সিগারেট বের করছি, উনি বললেন, পকেটে আর কিছু আছে ? আমি বললাম, একটা সিকি আছে। তিনি বললেন, সিকিটা তুই নিয়ে যা এরপর থেকে পকেটে হাত দিলে পয়সা পেলে তুই নিয়ে যাবি, আমাকে কিছু বলতে হবে নাএকদিন আনন্দের সমাপ্তি ঘটলখারাপভাবেই ঘটল ঘটনাটা কার্টুনিস্ট ছবি আঁকছেনআমি তার ঘাড়ের উপর মাথা বের করে গভীর আগ্রহে দেখছি। আমার স্কুল বন্ধসকাল থেকেই আছি

কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ

অর্টিস্টের জন্যে চা এবং টোস্ট বিস্কিট এসেছে টোস্ট বিস্কিটের অর্ধেকটা ভেঙে কখন আমার হাতে দেয়া হবে তার জন্যে আমার ব্যাকুল প্রতীক্ষাএই সময় এক লােক অফিসে ঢুকলধাক্কা দিয়ে সে আর্টিস্টকে ফেলে তার গলা পা দিয়ে চেপে ধরলঅফিসে যে দুজন ছিল তারা ছুটে এলােএবং তারাও আর্টিস্টের উপর ঝাপিয়ে পড়লআমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে চিৎকার আসছে মেরে ফেলকুত্তাটারে মেরে ফেলঅফিসের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়া হলােবন্ধু অফিসের ভেতর থেকে গােঙানির শব্দ আসছেআমি বাইরে দাড়িয়ে কাদছি। 

কার্টুনিস্টের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখাঅফিসের বন্ধ দরজা এরপর আর খুলে নিমানুষটার কী হলাে? অফিসটার কী হলাে? কিছুই জানি না। 

কতবার যে অফিসের বন্ধ দরজার সামনে গিয়েছি একে ওকে জিজ্ঞেস করেছিকেউ কিছু বলে নাক্লাস টুতে পড়া একটি শিশুর প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়ােজন বড়রা মনে করে না। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতাে দেখতে এই মানুষটাকে নিয়ে আমি শিশু কিশােরদের জন্যে একটা উপন্যাস একসময় লিখি উপন্যাসটির নাম বােতলভূত। 

লেখক হবার একটা সুবিধা আছেএকজন লেখক কাউকেই হারিয়ে যেতে দেন না

প্রসঙ্গ মাশিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে তার মা যে বদলাতে থাকে এই তথ্য কি কোনাে শিশু জানে ? শিশুর বয়স যখন দুই তখন তার মা এবং শিশুর বয়স যখন আট তখনকার মা দুই মানুষ

কিছু শৈশব-পর্ব-(১০)-হুমায়ূন আহমেদ

অতি শৈশবের মাকে আমার মনে নেযে মাকে মনে আছে তাঁর বয়স আঠারােউনিশঝলমলে তরুণী! যে তার বিশাল সংসার নিয়ে ব্যতিব্যস্তবিশাল সংসার, কারণ স্বামীপুত্রকন্যা ছাড়াও সংসারে বাড়তি দুজনএকজনদেবর, আরেকজন তাঁর ছােটভাইএই দুজনের প্রধান কাজ সারাদিন খটাস ধটাস শব্দে ক্যারাম খেলা এবং প্রতিবছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ফেল করারেজাল্ট আউট হওয়ার পরের কয়েকদিন ক্যারাম খেলা বন্ধ থাকে, আবার শুরু হয় খটাস খটাস

আঠারােউনিশ বছরের একজন তরুণীর চোখে নানান স্বপ্ন থাকেআমার মায়েরও নিশ্চয়ই ছিলস্বপ্নকে প্রবাহিত করার কোনাে সুযােগ কি ছিল ? আমার মনে হয় নামহিলার স্বামী মানুষ হিসেবে ইন্টারেস্টিংভাবুক, প্রেমিক, জটিলতামুক্ত প্রায় মহাপুরুষ পর্যায়ের একজনমহাপুরুষ দিয়ে সংসার চলে নাসংসারের চালিকাশক্তি অর্থমহাপুরুষের অর্থ ছিল নাতার বেতন ছিল। সর্বসাকুল্যে আশি টাকাএই টাকার একটি অংশ চলে যেত দেশের বাড়িতেএকটি অংশ বই কেনায়, ক্যামেরার ফিল্ম কেনায়, একটি অংশ গানবাজনার আসরে বন্ধুদের পেছনেবাকি যা থাকত তা তিনি স্ত্রীর হাতে দিয়ে মধুহাসি হেসে বলতেন, কষ্ট করে চালিয়ে নাও | মা চোখের পানি ফেলতেন। 

 

Read more

কিছু শৈশব-পর্ব-(১১)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *