কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

কী আশ্চর্য! মামিকে বলতেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন সাথে সাথে রওনা হলে গেলেনতাঁকে দেখে মনে হলাে তিনি জীবনে এত আনন্দিত হন নিবড়দের কাণ্ডকারখানা বােঝা খুব মুশকিল। 

কিছু শৈশবআমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে কী হয় দেখছি। 

মামি ঢুকলেন ফেঁপাতে ফোঁপাতেমামা তাঁর হাতে ফুলগুলাে দিতেই তিনি শব্দ করে কেঁদে উঠলেন, ফুলগুলাে ছুড়ে দিলেন মেঝেতে। 

মামা বিড়বিড় করে বললেন, তুমি অবিকল রাজকুমারী সুবর্ণরেখামতাে কাদছএরকম করে কেঁদো নাতােমার কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়ে যাচ্ছেতারপর আরাে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলােমামা করলেন কী... থাক আমি বলব নাছােটদের সব কথা বলতে নেইআমি জানালার পাশ থেকে 

সরে এলামছােটদের সবকিছু দেখতেও নেইতাছাড়া আমার নিজেরও তখন খুব কান্না পাচ্ছেদেখতে চাইলেও পারতাম নাঝাপসা চোখে কি কিছু দেখা যায়

কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

বড়মামার জীবনের গল্প একজন ব্যর্থ মানুষের জীবনের গল্পসুন্দরকে স্পর্শ করার বাসনা তাঁর ছিলসুন্দর তাঁকে সেই সুযােগ দেয় নিকোরান শরীফে আল্লাহপাক বলেছেনকাউকে কাউকে আমি হিসাব ছাড়াই দেই, আবার কাউকে কিছুই দেই নাইহা আমার ইচ্ছাবড়মামা কি দ্বিতীয় দলে

তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি ঢাকা থেকে ছুটে গেলাম সন্ধ্যার পর পর উপস্থিত হলাম আলাে এবং অন্ধকারের সে এক অদ্ভুত সময়মৃত্যুশােকে কাতর বাড়িতে আমি কখনাে যাই নাআমার ভালাে লাগে নাযাকে জীবিত দেখেছি তাকে মৃত দেখতে ইচ্ছা করে না| উঠোনে বড়মামার শবদেহ শাদা চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছেমুখ সামান্য খােলাআগরবাতি জ্বলছেখাটিয়ার চারপাশে অনেক মােমবাতিতাতেও যেন অন্ধকার কাটছে নাসবাই শেষবারের মতাে প্রিয় মুখ দেখে যাচ্ছেমা আমাকে বললেন, যা শেষবারের মতাে তাের বড়মামাকে দেখে আয়আমি বললাম না। 

বাড়ির পেছনে বড়মামার জন্যে কবর খােড়া হয়েছেজায়গাটা জঙ্গলের মতোকোনাে লােকজন নেইশুধু গােরখােদক হারিকেন জ্বালিয়ে টুলের উপর বসে আছেকবর তৈরি হয়ে যাবার পর সারাক্ষণই নাকি কাউকে কবরের পাশে থাকতে হয়এই নিয়ম গােরখােদক নিয়ম রক্ষা করছেআমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম তিনি আমাদের মামার দিক থেকে দূরসম্পর্কের আত্মীয় তিনি বললেন, নাতি, কখন আসছ ?

কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

কিছুক্ষণ আগে এসেছিআচ্ছা নানা, আমি যদি কিছুক্ষণের জন্যে কবরে নামি তাহলে কি কোনাে সমস্যা আছে

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কবরে নামবে কেন

আমি বললাম, মৃত অবস্থায় তাে নামতেই হবে, জীবিত অবস্থায় নেমে দেখি কেমন লাগে। 

তিনি বললেন, আচ্ছা নামাে। 

তিনিই ধরাধরি করে আমাকে নামালেন। আমি বসলামবসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের জগতে কিছু একটা ঘটলভয়ঙ্কর কিছুসব অন্ধকার হয়ে গেল । 

সাধারণ অন্ধকার নাএই অন্ধকার সীসার পাতের মতােঅথচ কবরের বাইরেই একজন হারিকেন হাতে বসে আছেআমি আকাশের দিকে তাকালামআকাশে নক্ষত্রের আলাে থাকার কথাতাও নেইআকাশ ঘন অন্ধকারদ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটল আকাশের দিকে তাকানাের পর পর, আমার জগৎ শব্দহীন হয়ে গেলমরাবাড়ির কোনাে শব্দ পাচ্ছি নাঝিঝি পােকার শব্দ নাবাতাসের শব্দ

আমার নিজের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ নেইহৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ নেইএইটাই কি মৃত্যু ? আলাে শব্দহীন অসীম এক ভুবনআমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম, দাঁড়াতে পারলাম নাচিৎকার করতে চেষ্টা করলাম, তাও পারলাম না। একসময় আমার মনে হলাে আমি তলিয়ে যাচ্ছিঅতি দ্রুত নিচে কোথাও প্রবেশ করছিদ্রুতগতির শব্দ আছে, অথচ আমি যে তলিয়ে যাচ্ছি শব্দহীনভাবেই তলাচ্ছিএই সময় হঠাৎ কবরের ভেতর উপর থেকে হারিকেনহাতে একটা হাত নেমে এলাে, কেউ বলল, নাতি শখ মিটছে ? এখন উঠবা ?

কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

তিনি আমাকে হাত ধরাধরি করে উঠিয়ে আনলেন। 

কবরের ভেতর আমার কী হয়েছিল তা নিয়ে ভাবি উত্তর পাই নামনােরােগ চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা বলবেন, মৃত্যুচিন্তা, শােক, ভ্রমণজনিত ক্লান্তিসব মিলিয়ে এক ধরনের ট্রমা; এর বেশি কিছু না। 

আমি জানি, আমার অভিজ্ঞতা ট্রমা নাঅন্য কিছুযদি আরাে কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম তাহলে অভিজ্ঞতা পূর্ণ হতাে। 

যে রহস্যময় জগতে আমরা বাস করি তার অনেক কিছুই আমরা জানি, আবার অনেক কিছুই জানি নানা জানার পাল্লাটাই মনে হয় ভারী। 

গরম পীরের মাজার গরম পীরের মাজারনামটার মধ্যেই গা ছমছমানি ব্যাপার আছেনামই বলে দিচ্ছে, মাজারে যিনি শায়িত তার মেজাজ ভালাে নাতুচ্ছ বিষয়েও তিনি রেগে যেতে পারেনতিনি রেগে গেলে বিপদ আছেবাসার সামনের এই মাজারটির বিষয়ে ছােটবেলাতেই আমার ভেতর এমন একটা ধারণা ঢুকলমাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পাওয়া যায় ধূপকাঠির গন্ধএই গন্ধটাও যেন কেমন কেমনমৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়সন্ধ্যাবেলা মাজারের বিভিন্ন খােপে খােপে জ্বলে মােমবাতিরহস্যময় আবহ তৈরি হয়এশার নামাজের পর কিছু মুসুল্লি জিকিরে বসেনসমবেত জিকির ধ্বনি বুকে ধাক্কার মতাে লাগেহিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজনও নমস্কারের ভঙ্গিতে মাজারের বাইরে দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে থাকেনশিশুর মনে রহস্যের পর রহস্য দানা বাঁধে। 

মাজারের মসজিদে শুক্রবারে বাদ জুমা শিন্নি দেয়া হতােবিভিন্ন বাড়ি থেকে শিন্নি আসতনামাজের শেষে কলাপাতায় সেই শিন্নি ভাগ করে দেয়া হতােকী সুস্বাদু ছিল সেইসব খাবার সবাই একটা করে কলাপাতা নিত, আমি নিতাম দুটাএকটা আমার জন্যে, একটা আমার বােনের জন্যেযিনি পরিবেশন করতেন তিনি যদি চোখ কুঁচকে তাকাতেন আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতাম, এটা আমার বােনের; সে তাে মসজিদে আসতে পারে নাপরিবেশনকারী তখন আর আপত্তি করতেন না

কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ

মসজিদে জমজমাট খাওয়া হতাে রােজার সময়, ইফতারিতেযার বাড়িতে ভালাে যা কিছু তৈরি হতাে তার একটি অংশ আসত মসজিদেঅসংখ্য মাটির সানকি ধােয়া থাকতখাবার সানকিতে সাজিয়ে দেয়া হতােআজানের পর পর মুসুল্লিরা পানি খেয়ে রােজা ভেঙেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেননামাজ শেষ হবার পর ইফতারিতার আগে না ভালাে ইফতারির লােভে আমি এবং আমাদের 

কাজের ছেলে রফিক বেশ কয়েকবার ইফতারির সময় মসজিদে ঢুকেছিআমাদের প্রথম প্রশ্ন যা করা হয়েছে তা হলাে, রােজা রেখেছ

জিনাতাহলে যাওইফতার রােজাদারদের জন্যে। 

মুখ শুকনা করে চলে এসেছিতখন খারাপ লেগেছেএখন বুঝি ক্ষুধার্ত মানুষ অন্যকে খাদ্যের ভাগ দিতে পছন্দ করে নাসারাদিন রােজার পর ক্ষুধার্ত মানুষ চায় না একদল শিশু খাদ্যে ভাগ বসাক । 

 

Read more

কিছু শৈশব-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *