কী আশ্চর্য! মামিকে বলতেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন । সাথে সাথে রওনা হলে গেলেন। তাঁকে দেখে মনে হলাে তিনি জীবনে এত আনন্দিত হন নি। বড়দের কাণ্ডকারখানা বােঝা খুব মুশকিল।
আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে কী হয় দেখছি।
মামি ঢুকলেন ফেঁপাতে ফোঁপাতে। মামা তাঁর হাতে ফুলগুলাে দিতেই তিনি শব্দ করে কেঁদে উঠলেন, ফুলগুলাে ছুড়ে দিলেন মেঝেতে।
মামা বিড়বিড় করে বললেন, তুমি অবিকল রাজকুমারী সুবর্ণরেখা’র মতাে কাদছ। এরকম করে কেঁদো না। তােমার কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তারপর আরাে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলাে। মামা করলেন কী... থাক আমি বলব না। ছােটদের সব কথা বলতে নেই। আমি জানালার পাশ থেকে
সরে এলাম। ছােটদের সবকিছু দেখতেও নেই। তাছাড়া আমার নিজেরও তখন খুব কান্না পাচ্ছে। দেখতে চাইলেও পারতাম না। ঝাপসা চোখে কি কিছু দেখা যায় ?
কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ
বড়মামার জীবনের গল্প একজন ব্যর্থ মানুষের জীবনের গল্প। সুন্দরকে স্পর্শ করার বাসনা তাঁর ছিল। সুন্দর তাঁকে সেই সুযােগ দেয় নি। কোরান শরীফে আল্লাহপাক বলেছেন— ‘কাউকে কাউকে আমি হিসাব ছাড়াই দেই, আবার কাউকে কিছুই দেই না। ইহা আমার ইচ্ছা। বড়মামা কি দ্বিতীয় দলে ?
তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি ঢাকা থেকে ছুটে গেলাম । সন্ধ্যার পর পর উপস্থিত হলাম । আলাে এবং অন্ধকারের সে এক অদ্ভুত সময়। মৃত্যুশােকে কাতর বাড়িতে আমি কখনাে যাই না। আমার ভালাে লাগে না। যাকে জীবিত দেখেছি তাকে মৃত দেখতে ইচ্ছা করে না। | উঠোনে বড়মামার শবদেহ শাদা চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে। মুখ সামান্য খােলা। আগরবাতি জ্বলছে। খাটিয়ার চারপাশে অনেক মােমবাতি। তাতেও যেন অন্ধকার কাটছে না। সবাই শেষবারের মতাে প্রিয় মুখ দেখে যাচ্ছে। মা আমাকে বললেন, যা শেষবারের মতাে তাের বড়মামাকে দেখে আয়। আমি বললাম না।
বাড়ির পেছনে বড়মামার জন্যে কবর খােড়া হয়েছে। জায়গাটা জঙ্গলের মতো। কোনাে লােকজন নেই। শুধু গােরখােদক হারিকেন জ্বালিয়ে টুলের উপর বসে আছে। কবর তৈরি হয়ে যাবার পর সারাক্ষণই না–কি কাউকে কবরের পাশে থাকতে হয়। এই নিয়ম । গােরখােদক নিয়ম রক্ষা করছে। আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম । তিনি আমাদের মামার দিক থেকে দূরসম্পর্কের আত্মীয় । তিনি বললেন, নাতি, কখন আসছ ?
কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ
কিছুক্ষণ আগে এসেছি। আচ্ছা নানা, আমি যদি কিছুক্ষণের জন্যে কবরে নামি তাহলে কি কোনাে সমস্যা আছে ?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কবরে নামবে কেন ?
আমি বললাম, মৃত অবস্থায় তাে নামতেই হবে, জীবিত অবস্থায় নেমে দেখি কেমন লাগে।
তিনি বললেন, আচ্ছা নামাে।
তিনিই ধরাধরি করে আমাকে নামালেন। আমি বসলাম। বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের জগতে কিছু একটা ঘটল। ভয়ঙ্কর কিছু। সব অন্ধকার হয়ে গেল ।
সাধারণ অন্ধকার না। এই অন্ধকার সীসার পাতের মতাে। অথচ কবরের বাইরেই একজন হারিকেন হাতে বসে আছে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে নক্ষত্রের আলাে থাকার কথা। তাও নেই। আকাশ ঘন অন্ধকার। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটল আকাশের দিকে তাকানাের পর পর, আমার জগৎ শব্দহীন হয়ে গেল। মরাবাড়ির কোনাে শব্দ পাচ্ছি না। ঝিঝি পােকার শব্দ না। বাতাসের শব্দ।
আমার নিজের নিঃশ্বাস–প্রশ্বাসের শব্দ নেই। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ নেই। এইটাই কি মৃত্যু ? আলাে ও শব্দহীন অসীম এক ভুবন। আমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম, দাঁড়াতে পারলাম না। চিৎকার করতে চেষ্টা করলাম, তাও পারলাম না। একসময় আমার মনে হলাে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। অতি দ্রুত নিচে কোথাও প্রবেশ করছি। দ্রুতগতির শব্দ আছে, অথচ আমি যে তলিয়ে যাচ্ছি শব্দহীনভাবেই তলাচ্ছি। এই সময় হঠাৎ কবরের ভেতর উপর থেকে হারিকেন। হাতে একটা হাত নেমে এলাে, কেউ বলল, নাতি শখ মিটছে ? এখন উঠবা ?
কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ
তিনি আমাকে হাত ধরাধরি করে উঠিয়ে আনলেন।
কবরের ভেতর আমার কী হয়েছিল তা নিয়ে ভাবি । উত্তর পাই না। মনােরােগ চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা বলবেন, মৃত্যুচিন্তা, শােক, ভ্রমণজনিত ক্লান্তি— সব মিলিয়ে এক ধরনের ট্রমা; এর বেশি কিছু না।
আমি জানি, আমার অভিজ্ঞতা ট্রমা না। অন্য কিছু। যদি আরাে কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম তাহলে অভিজ্ঞতা পূর্ণ হতাে।
যে রহস্যময় জগতে আমরা বাস করি তার অনেক কিছুই আমরা জানি, আবার অনেক কিছুই জানি না। না জানার পাল্লাটাই মনে হয় ভারী।
গরম পীরের মাজার ‘গরম পীরের মাজার‘ নামটার মধ্যেই গা ছমছমানি ব্যাপার আছে। নামই বলে দিচ্ছে, মাজারে যিনি শায়িত তার মেজাজ ভালাে না। তুচ্ছ বিষয়েও তিনি রেগে যেতে পারেন। তিনি রেগে গেলে বিপদ আছে। বাসার সামনের এই মাজারটির বিষয়ে ছােটবেলাতেই আমার ভেতর এমন একটা ধারণা ঢুকল। মাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পাওয়া যায় ধূপকাঠির গন্ধ। এই গন্ধটাও যেন কেমন কেমন। মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। সন্ধ্যাবেলা মাজারের বিভিন্ন খােপে খােপে জ্বলে মােমবাতি। রহস্যময় আবহ তৈরি হয়। এশার নামাজের পর কিছু মুসুল্লি জিকিরে বসেন। সমবেত জিকির ধ্বনি বুকে ধাক্কার মতাে লাগে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজনও নমস্কারের ভঙ্গিতে মাজারের বাইরে দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে থাকেন। শিশুর মনে রহস্যের পর রহস্য দানা বাঁধে।
মাজারের মসজিদে শুক্রবারে বাদ জুমা শিন্নি দেয়া হতাে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে শিন্নি আসত। নামাজের শেষে কলাপাতায় সেই শিন্নি ভাগ করে দেয়া হতাে। কী সুস্বাদু ছিল সেইসব খাবার । সবাই একটা করে কলাপাতা নিত, আমি নিতাম দু’টা। একটা আমার জন্যে, একটা আমার বােনের জন্যে। যিনি পরিবেশন করতেন তিনি যদি চোখ কুঁচকে তাকাতেন আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতাম, এটা আমার বােনের; সে তাে মসজিদে আসতে পারে না। পরিবেশনকারী তখন আর আপত্তি করতেন না।
কিছু শৈশব-পর্ব-(২০)-হুমায়ূন আহমেদ
মসজিদে জমজমাট খাওয়া হতাে রােজার সময়, ইফতারিতে। যার বাড়িতে ভালাে যা কিছু তৈরি হতাে তার একটি অংশ আসত মসজিদে। অসংখ্য মাটির সানকি ধােয়া থাকত। খাবার সানকিতে সাজিয়ে দেয়া হতাে। আজানের পর পর মুসুল্লিরা পানি খেয়ে রােজা ভেঙেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামাজ শেষ হবার পর ইফতারি। তার আগে না । ভালাে ইফতারির লােভে আমি এবং আমাদের
কাজের ছেলে রফিক বেশ কয়েকবার ইফতারির সময় মসজিদে ঢুকেছি। আমাদের প্রথম প্রশ্ন যা করা হয়েছে তা হলাে, রােজা রেখেছ ?
জি–না। তাহলে যাও। ইফতার রােজাদারদের জন্যে।
মুখ শুকনা করে চলে এসেছি। তখন খারাপ লেগেছে। এখন বুঝি ক্ষুধার্ত মানুষ অন্যকে খাদ্যের ভাগ দিতে পছন্দ করে না। সারাদিন রােজার পর ক্ষুধার্ত মানুষ চায় না একদল শিশু খাদ্যে ভাগ বসাক ।।
Read more