চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ১৪ হুমায়ূন আহমেদ

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ১৪

হ্যাঁ।তোমার চোখে আমাকে যেন সুন্দর লাগে এই জন্যে সকাল থেকে সাজছি। কাজল দিয়েছি, মাশকারা দিয়েছি। গাল গোলাপী লাগছে না? রাসন দিয়েছি। আমার চেহারা অতি দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার সেই চেহারা তুমি দেখ। কাজেই এই তোমার আমাকে শেষ দেখা।ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসছে। কী সুন্দর হাসি। এত সুন্দর করে একটা মেয়ে হাসে কি করে?

তাছাড়া এখন কি তার হাসির সময় আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, আমার বাবা খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। এই কদিনে তার ওজন এত কমেছে যে বলার না। কোনো প্যান্ট এখন পরতে পারেন না। ঢিলা হয়ে গেছে। বেল্ট লাগে। বাবাকে আজ দেখে খুবই মায়া লাগল। কথাবার্তাও এখন ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথা আটকে যায়।তোমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন।

এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন না। তার ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন। বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেশের বাইরে নিতে হবে। টাকা কোথায়? বাবা তার সারা জীবনে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন সব ঐ ফ্ল্যাট কিনতে শেষ করছেন। যেই মুহূর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, আমরা হয়ে যাব পথের মানুষ—জাগ্রত জনতা।

আসমানী আবারো হাসছে। ফরহাদ মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। আসমানী আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি হাসছে। বেশি কথা বলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরহাদের কি বলা উচিত—এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি চুপ করে থাক।আসমানী শাড়ির আঁচলে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল–একজন ভালো মেয়ে হিসেবে আমার বাবাকে বলা উচিত ফ্ল্যাট বিক্রি করার কোন দরকার নেই।

চিকিৎসা করে লাভ যা হবে তা হচ্ছে মনের সান্তনা। তোমরা বলতে পারবে মেয়ের চিকিৎসার জটি হয় নি। এই মনের সান্তনার জন্যে পথের ফকির হবে কেন? কিন্তু এরকম কোনো কথা আমি বলি নি। আমি খুব স্বার্থপর তো এই জন্যে বলিনি। এই শোন তোমাকে আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। ছাই রঙা সার্টেও লাগছে। তোমাকে বলেছিলাম না ছাই রঙা সার্টটা পুড়িয়ে ফেলবে। পুড়াও নি কেন?

গরিব মানুষ তো, সার্ট পুড়াতে মায়া লাগে।সার্ট গা থেকে খুলে দাও। আমি পুড়াব। আমিও গরিব তবে আমার এত মায়া নেই। কই খুলছ না কেন? সার্ট সত্যি খুলব? অবশ্যই খুলবে।আসমানী মিটি মিটি হাসছে। মনে হয় তার মনে কোনো দুষ্ট বুদ্ধি খেলা করছে।আমার সামনে সার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে।হ্যাঁ।তাহলে একটা কাজ কর–টেবিলের উপর দেখ একটা প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়। মনে নেই, তোমার জন্যে সাতটা সার্ট কিনে ছিলাম?

কোন বারে কোন সার্ট পরবে কাগজে লিখে রেখেছি। আজ বুধবার। আজ তোমার কপালে হালকা সবুজ রঙের সার্ট। চিরুনীটা নিয়ে যাও। মাথা আঁচড়াবে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে। তারপর স্ট্রেইট দরজা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বক বক করে আমার মাথা ধরেছে এবং মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব।তোমাকে একা ফেলে চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে। আমি একা থাকব না—বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। ও আরেকটা কথা প্রতিটি সার্টের বুক পকেটে একটা করে চিঠি আছে। যে দিন যে সার্ট পরবে সেদিন চিঠিটাও পড়বে।আচ্ছা। আগামী সাতদিনে সাতটা চিঠি পড়া হয়ে যাবে। ইন্টারেস্টিং না।হুঁ।আমি কি ভেবে রেখেছিলাম জান—আমি ভেবে রেখেছিলাম সারা জীবন তোমাকে এরকম করে চিঠি লিখব। সার্ট গায়ে দিয়ে অফিসে যাচ্ছ। সার্টের বুক পকেটে একটা চিঠি। যত রাগ হোক, ঝগড়া হোক তুমি চিঠি পাবেই।

আচ্ছা শোন তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না আমার মাথা ঘুরছে।আমি শুয়ে থাকব। আর শোন বাথরুম থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখ আমি ঘুমিয়ে পরেছি— খবরদার আমার ঘুম ভাঙ্গাবে না। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন ঘুমটা আমার জন্যে খুবই দরকার।ফরহাদ সার্ট বদলে মাথার চুল আঁচড়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করল। হাসপাতালের সব আয়না হাসপাতালের রুগীদের মতোই অসুস্থ।

আয়নায় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না তারপরেও ফরহাদের মনে হলো সবুজ রঙের সার্টটায় তাকে খুব মানিয়েছে। বুধবারের সার্টের পকেটে শুধু যে চিঠি তাই না। একটা বলপয়েন্ট কলম। কলমটা কেন দিয়েছে কে জানে। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করলেও এখন পড়া যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। এখন পড়লে আসমানী বুঝে ফেলবে। এইসব ক্ষেত্রে আসমানীর সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।

ফরহাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল আসমানী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার ঘুম ভাঙ্গানোর কোনো মানে হয় না। ফরহাদ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিশা এবং তার বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নিশার হাতে একটা প্যাকেট। নিশার বাবার হাতে কিছু বইপত্র। তিনি দূর থেকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

এটা ফরহাদের কল্পনাও হতে পারে। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর এখন কিছু নেই। কেউ কাউকে দেখতে পায় নি এমন ভাব করলে কেমন হয়। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। মনে হয় এটাই সবচে ভালো বুদ্ধি। তাছাড়া আসমানীর চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করছে। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়া যাবে।

ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সিড়ি বা লিফট আছে। তার পুরানো ছাই রঙের সার্টটা হাসপাতালে রয়ে গেছে। সার্ট দেখে নিশা এবং তার বাবা নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। যার যা ইচ্ছা করুক। তাকে এই মুহূর্তে আসমানীর চিঠি পড়তে হবে।

চিঠি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত—যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ আঁকিবুকি টানা সামান্য এক টুকরা কাগজ। পড়তে শুরু করলেই সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষের মতোই সে রাগ করে। অভিমান করে।বাবু সাহেব, প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে আপনার জন্যে আজ চিঠি লিখলাম। সব মিলিয়ে সাতটা চিঠি লেখা সহজ ব্যাপার না। শুধু এই চিঠিটাই সামান্য বড়। বাকি সবগুলি এক লাইন দুলাইনের।

এই চিঠি লিখতে লিখতে আমি মজার একটা জিনিস ঠিক করি। মজার জিনিসটা হচ্ছে তোমার জন্যে একটা পরিস্থিতি তৈরি করা। যাতে তুমি সার্ট গায়ে দিয়ে যখন বাথরুম থেকে বের হবে তখন দেখবে আমি ঘুমিয়ে। এই ঘুম আসল ঘুম নামকল যুম। অভিনয় ঘুম।

আমাকে ঘুমন্ত দেখে তুমি কি কর তাই আমার দেখার ইচ্ছা। আমার ধারণা তুমি আমার পাশে বসবে এবং খুব সাবধানে (যাতে আমার ঘুম না ভাঙ্গে) কপালে হাত রাখবে। কিংবা মাথা নিচু করে ঝুঁকে এসে… থাক বাকিটা আর লিখলাম না, লজ্জা লাগছে। তুমি কি করবে তা নিয়ে আমি মনে মনে একটা বাজি ধরেছি। দেখি বাজিতে জিততে পারি কি-না। এই শোন আমি আর লিখতে পারছি

—প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। ভুল বললাম, অনেক কিছু না একটা কথাই বারবার নানান ভঙ্গিতে লেখার ইচ্ছা, I Love You, তাও লিখতে পারছি না। শরীর বিদ্রোহ করেছে। ভালবাসাবাসির সঙ্গে শুধু মন না, এখন মনে হচ্ছে শরীরও জড়িত। তুমি ভালো থেকো।

ইতি তোমার আসমানী।

ফরহাদ আকাশের দিকে তাকালো।কী সুন্দর ঝকঝকে নীল আকাশ। সোহরাওয়ার্দীর সামনের গাছগুলিকেও কী সুন্দর লাগছে। ফরহাদের আবার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছা করছে।আসমানীর বাবা যা ভাবার ভাবুক। সে আসমানীর হাত ধরে বসে থাকবে। উপায় নেই, আজ তাদের বাড়ি ছাড়তে হবে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোকজন অপেক্ষা করছে।

জাহানারা মায়ের জন্যে দোতলার বড় একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে। দুটা চেয়ার আছে। টেবিল আছে। মেঝেতে কার্পেটও আছে। কার্পেট পুরানো হলেও পরিষ্কার। ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম।জাহানারা বলল, এসি লাগানো ঘর তোমাকে দিতে পারতাম মা। একটা ছিল, কিন্তু এটাচড বাথরুম নেই। বাবা রাতে তিন চারবার বাথরুমে যায় এই জন্যে এই ঘর।

ঘরের সঙ্গে বারান্দা আছে। বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতে পারবে। তোমার জামাইকে বলেছি সে তার অফিস থেকে একটা টিভি এনে লাগিয়ে দেবে।টিভির দরকার নেই।দরকার থাকবে না কেন? অবশ্যই দরকার আছে। মা শোন তুমি এমন মুখ কালো করে আছ কেন? ঘর পছন্দ হয় নি? ঘর খুব সুন্দর। বারান্দাটাও সুন্দর।তাহলে মুখটা কাল কেন?

গুষ্ঠি শুদ্ধ তোর এখানে থাকতে এসেছি। ভাবতেই খারাপ লাগছে।মেয়ের বাড়িতে মা এসে থাকে না? তুমি তো আর সারা জীবনের জন্য থাকতে আসনি? তাও ঠিক। অল্প কিছু দিন থাকব তুই যা বাড়াবাড়ি করছিস এই জন্যেও খারাপ লাগছে। মঞ্জু বাড়ি ভাড়ার জন্যে যে রকম ছোটাছুটি করছে হয়তো আজ সন্ধ্যাবেলাতেই এসে বলবে—বাড়ি ঠিক হয়েছে চল। ছেলের যে স্বভাব যদি একবার বলে, আজ চল। আজই যেতে হবে।

আগে বলুক তারপর দেখা যাবে। মা শোন-তোমার আর বাবার জন্যে ঘরে খাবার দিয়ে যাবে। খাবার ঘরে তোমাদের খেতে যাবার দরকার নেই। মজিদের মা বলে একটা কাজের মেয়ে আছে তোমার যখন যা দরকার তাকে বলবে। মজিদের মাকে চিনেছ তো ঐ যে উঁচু দাঁত। ঠিক আছে–মা? হ্যাঁ ঠিক আছে।তোমার তো আবার ঘন ঘন চা খাবার অভ্যাস। তোমাকে সকালবেলায় এক ফ্লাক্স গরম পানি দিয়ে যাব। ঘরে টি কাপ, চিনি, দুধ থাকবে। শুধু চা-টা বানিয়ে নেয়া।ফরহাদ কোথায় থাকবে?

একতলায় ব্যবস্থা করেছি। বড় ভাইজান বলেছে, সে থাকবে না। সে নাকি কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে থাকবে। মঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে তো আমার দেখাই হয়নি। সে এখানে থাকবে কি না, তাও জানি না। বড় ভাইজানের ঘরে দুটা খাট আছে তারা দুইজন থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না।মেয়ে তাদের যত্ন করছে তাতে তার খুশি হওয়া উচিত।

তিনি খুশি হতেন যদি জানতেন তার দুই ছেলে তার জন্যে বাসা ভাড়া করবে। তিনি ভাড়া বাসাতে উঠে যাবেন। মঞ্জু তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে—পাগল হয়েছ মা। আমি বাড়ি ভাড়া করব কীভাবে? আমার আছে কি তোমাকে যে মাসে এক হাজার করে টাকা দিব বলেছি এটাই আমার ফাইন্যাল কথা। সেটা দিব। তোমাদের একটা সুবিধা করে দিচ্ছি। আমার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব।

ফরহাদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ফরহাদ মাথা নিচু করে বলেছে– দেখি একটা কিছু ব্যবস্থা করব। সেই ব্যবস্থাটা কী সে বলতে পারছে না। ব্যবস্থাটা কবে নাগাদ হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলছে না। ফরহাদের দৃষ্টি ভরসা হারা দৃষ্টি।তিনি ফরহাদকে মোটামুটি কঠিন গলায় বলেছেন—আমরা জামাইয়ের বাড়িতে কত দিন পড়ে থাকব? সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর হওয়া উচিত।

সেই সহজ উত্তরটা সে দিচ্ছে না। এমন ভাব করেছে যেন মায়ের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না।তুই কি আমাদের সঙ্গে থাকবি? উঁহু। আমি নান্টু ভাইয়ের মেসে থাকব।না, তুই অবশ্যই আমাদের সঙ্গে থাকবি। আমাদের কখন কী দরকার হয়। এ বাড়িতে কাকে কি বলব? রাহেলা মনে প্রাণে চাচ্ছেন ছেলে তার সঙ্গে থাকুক।

সঙ্গে থাকলেই অন্যের বাড়িতে থাকার অপমানটা গায়ে লাগবে। তখন একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে উঠে পরে লাগবে। রাহেলার মনে ক্ষীণ ভয় ঢুকে গেছে তার দুই ছেলে কোনো ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত করবে না। বাকি জীবনটা তার কাটবে জামাইয়ের অন্ন খেয়ে। অতি দ্রুত তিনি কাজের বুয়ার স্তরে নেমে যাবেন। ফরহাদের বাবা হয়ে যাবে বিনা বেতনের মালি। বাড়ির সামনে মাটি কুপিয়ে গাছ পুতবে। ঝাঝরি দিয়ে সকাল বিকাল গাছে পানি দিবে। জামাইয়ের গাড়ি এসে থামলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিবে।

নিজের অসহায় অবস্থা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবেন সেই উপায় নেই। আগে যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। এখনকার সমস্যাটা তিনি কিছুতেই মেয়েকে জানাতে দিতে চান না। স্বামীর সঙ্গে আলাপ করার প্রশ্নই উঠে না। লোকটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলে তার ধারণা। কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। কখন কি বলছে—কেন বলছে তাও জানে না। জাহানারার শাশুড়ি যখন বললেন, বেয়াই সাহেব! কেমন আছেন?

তার উত্তরে সে হড়বড় করে বলল, গাছের কথা বলছেন? সব তুলে ফেলেছে। জায়গা পরিষ্কার। কে বলবে দুদিন আগে কত গাছ ছিল, কত ধরনের গাছ ছিল। পাঁচটা লবঙ্গ চারা লাগিয়েছিলাম তার মধ্যে চারটা বেঁচেছে। আর একটা বছর পার করতে পারলে গাছের লবঙ্গ খাওয়াতাম।জাহানারার শাশুড়ি বললেন, গাছের কথা না বেয়াই সাহেব, আপনার কথা জানতে চাচ্ছি।ফরহাদের বাবা হতভম্ব হয়ে বলল, আমার কি কথা? আপনি আছেন কেমন? শরীরটা কেমন?

ফরহাদের বাবা এমনভাবে চারদিক দেখতে লাগলো যেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন জীবনে কেউ তাকে করে নি।রাহেলা বললেন, বেয়ান সাহেব উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করা না করা অর্থহীন। গাছ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে করেন—জবাব দিবে। অন্যকোনো প্রশ্নের জবাব দিবে না। আপনার বেয়াই সাহেবের আমার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে একটা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বিয়ে হলে তার জীবনটা সুখে কাটত।

এই কথায় জাহানারার শাশুড়ি খুবই আনন্দ পেলেন। হেসে ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। হাসতে হাসতে বললেন, বেয়ান তো বড়ই রসিক। বেয়ান যে এত রসিক তা তো জানতাম না।রাহেলা মোটেই রসিক না। রস করার মতো মনের অবস্থা তাঁর না। এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে তাকে নানান ধরনের মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। যেমন জাহানারার শাশুড়িকে বললেন–আমার দুই ছেলে বুঝলেন বিয়ান সাহেব।

বাস্তববুদ্ধি বলে কিছু নাই। কতবার বললাম রহমত উল্লার জায়গাটা কিনে রাখ। দেশের বাড়ির জমিজমা তো কোনো কাজে আসবে না সাত ভূতে লুটেপুটে খাবে। সেই সব বিক্রি করে এই জায়গাটা কিনে ফেল। ঢাকায় বাস করছিস ঠিকানা বাগবে না? দুই ভাই-ই বলে, বাদ দাও। বাদ দিয়ে অবস্থাটা তো দেখেছেন? একেবারে রাস্তায়।জাহানারার শাশুড়ি বললেন, কি বলেন বেয়ান সাহেব রাস্তায় হবেন কেন?

আমরা আছি কি জন্যে সেটা তো ঠিকই। ছোট ছেলে আমাকে কি বলে শুনুন। সে বলে—মা মাসের এই ভাংতি কিছুদিনের জন্যে তো আর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি হোটেলের একটা ঘর ভাড়া করে দিচ্ছি। তোমরা দুই বুড়োবুড়ি হোটেলে থাক। ও আল্লা আমার বড় ছেলেরও দেখি তাতে সায় আছে। সেও বলল, এটাই ভালো। হোটলে থাকার অনেক মজা। চল আমরা বাকি জীবন হোটেলে কাটিয়ে দেই।

আমি তখন দিলাম ধমক—বললাম, তোরা আমাকে আমার মেয়ের কাছে দিয়ে নিজেরা হোটেল ভাড়া করে থাক। সঙ্গে অবশ্যই তোর বাবাকেও নিবি। সে হোটেলের টবের গাছে পানি দিবে।জাহানারার শাশুড়ি বললেন—বেয়ান সাহেব! আপনি এত মজা করে কথা বলেন। আপনার এই গুণের কথা তো আগে জানতাম না। আপনার ছেলেরা বাড়ি ভাড়া করলেও আপনি থাকবেন আমার সঙ্গে। আমরা দুই বুড়ি পান জর্দা খাব। গল্প করব। টিভিতে হিন্দী ছবি দেখব। বেয়ান আপনি হিন্দী বুঝেন তো?

রাহেলা জাহানারার শাশুড়ির কথায় স্বস্তি পেলেন। যাক বুড়ি তার মিথ্যা কথাগুলি বিশ্বাস করছে। এ জাতীয় মিথ্যা কথা জাহানারাকে বলা যাবে না। এই মেয়ের অনেক বুদ্ধি। মিথ্যা বললেই ধরা পড়তে হবে। তার ধারণা জাহানারাকে যখন বলেছেন ম বাড়ি ভাড়ার জন্যে ছোটাছুটি করছে—তখন মেয়ে বুঝে ফেলেছে মা মিথ্যা কথা বলছে। তবে তিনি তার মেয়ের উপর সন্তুষ্ট। খুবই সন্তুষ্ট।

মেয়ে তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে পারত। কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। সে বলতে পারত—ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছ কই আমি তো কিছু জানলাম না। আমি যখন রানীর সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম, তখনো চুপ করে রইলে। মেয়েকে শুধু মনে পড়ে বিপদের সময়ে জাহানারা কিছু জানতে চায় নি। দাদাজানের মৃত্যুর কারণে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, সেই ভাঙ্গা বিয়ে আবার কবে জোড়া লাগবে সে ব্যাপারেও কোনো কৌতূহল দেখায় নি।

এখন দেখায় নি বলে যে কোনদিন দেখাবে না তা না। এক সময় না এক সময় জানতে চাইবে। রাহেলা তখন কি বলবেন সব ঠিক করে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ঐ বিয়ে হবে না। তোর ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব আমি তোর হাতে দিলাম। মা তুই ব্যবস্থা কর। এটা বলতে তার কোনো অসুবিধা নেই কারণ তিনি জানেন বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সেই বিয়ে আর কখনো হয় না। এটা তিনি যে একা জানেন তা না। সবাই জানে।

তার উপর খবর পাওয়া গেছে মেয়েটা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে আছে। এমন অবস্থা যে দেশে চিকিৎসা হচ্ছে না, বিদেশ যেতে হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে যে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল এই জন্যেই চাচ্ছিল। রোগ গোপন করে মেয়ে পার। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বাতাস না থাকলেও আপনা আপনি নড়ে। আল্লাহর ইশারায় বিয়ে ভেঙ্গে গেল। কাউকে কিছু করতে হলো না, বলতে হলো না।

রাহেলা ঠিক করে রেখেছেন রানীর সঙ্গে ফরহাদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে এখনো কোনো কথা বলবেন না। চুপচাপ অপেক্ষা করবেন। তার মন আগেও বলেছে বিয়েটা হবে, এখনো বলছে হবে। জাহানারা একটু সাহায্য করলেই হবে। সেই সাহায্য কি জাহানারা করবে? করবে তো বটেই বাপ-ভাই বলে কথা। তবে জাহানারা মনে কষ্ট পেয়েছে। পরে এক সময় মেয়ের সঙ্গে নিরিবিলিতে অনেক কথা বলবেন।

 

Read more

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ১৫ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *