মেয়ের প্রেমিককে অপছন্দ করা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে। তাই বলে এত অপছন্দ? সে রাজপুত্র না, তার চেহারা পিটার ও টুলের মত না, বিদেশী কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্টও সে না। তারপরেও একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষ সামাজিক সৌজন্য বজায় রাখবে না? তার মেয়ে আজেবাজে টাইপের একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে এই কারণে তিনি যদি রাগ করে থাকেন, সেই রাগটা তিনি করবেন মেয়ের উপর। ফরহাদের উপর না।
কলিংবেলে চাপ দিয়ে ফরহাদ খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব। রিটায়ার্ড করা লোকজনের উপর সংসারের আজেবাজে কাজগুলি করার দায়িত্ব এসে পরে। ছোট ছেলে হয়ত কলেজের পড়া তৈরি করছে। কলিংবেল শুনে সে যাবে না। কাজের বুয়াও যাবে না। সেও জরুরী কিছু কাজ করছে। পারাটা ভাজছে। একমাত্র কর্মহীন মানুষ হিসেবে বাড়ির কর্তাকেই যেতে হবে। বলাই বাহুল্য দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব এবং চোখ মুখ কুঁচকে বলবেন—তুমি কে? কাকে চাও?
ফরহাদকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল আসমানী। নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যেই সে মনে হয় এই ভোরবেলাতেই আসমানী রঙের একটা শাড়ি পরেছে। চুল টান টান করে মাথায় যে টাওয়েলটা পেঁচানো তার রঙও হালকা নীল। ফরহাদ মনে মনে ভাবল-মেয়েরা যদি জানতে গোসলের পর মাথায় টাওয়েল জড়ানো অবস্থাতেই তাদের সবচে সুন্দর লাগে—তাহলে সব মেয়ে বিয়ে বাড়িতে কিংবা জন্মদিনের উৎসবে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে যেত। বিউটি পার্লারে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা থাকত।আসমানী বলল, এই আমার চিঠি কখন পড়েছ?
রাত দুটায়।চিঠিতে কি লেখা ছিল যখন এই চিঠি তোমার হাতে পড়বে তখনি তুমি এ বাড়িতে আসবে। লেখা ছিল না? হুঁ।আসনি কেন? রাত দুটার সময় চলে আসব? অবশ্যই।তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান এত রাতে আমাকে কম্পাউণ্ডের ভেতরই আসতে দিত না। সে গেট খুলত না।গেট না খুললেও ইন্টারকমে খবর পাঠাতে। আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যেতাম। তুমি মস্ত একটা সুযোগ নষ্ট করেছ।কি সুযোগ?
আমার প্রতি তোমার ভালবাসা যে কত তীব্র তা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালে। এ রকম সুযোগ আর পাবে না।পাব।উঁহু পাবে না। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর তুমি আমার জন্যে যত পাগলামীই কর কোন পাগলামী এখনকার মত ভাল লাগবে না। নাশতা খেয়ে এসেছ?
না।ভাল করেছ। মামার সঙ্গে নাশতা খাও। খেতে খেতে গল্প কর। তারপর তোমাকে নিয়ে আমি বের হব।কোথায়? বিয়ের শপিং করব। আমি আজ দশটা শাড়ি কিনব শাড়িগুলি তুমি পছন্দ করে দেবে। আর তোমার জন্য সার্ট পেন্ট এই সব আমি পছন্দ করে কিনব। মামা আমাকে এক হাজার ডলার দিয়েছেন। আচ্ছা শোন–ডলার কোথায় ভাঙ্গাতে হয় তুমি জান?
জানি।আজ সারাদিনের জন্যে মামা আমাকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন। মাইক্রোবাস। দুজন মাইক্রোবাসে সারাদিন ঘুরব। তোমার অফিস নেইতো? অফিস আছে।একদিন অফিসে না যাবার জন্যে নিশ্চয়ই তোমার চাকরি চলে যাবে না? তা যাবে না। শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে একবার দেখা দিয়ে আসতে হবে।পাঁচ মিনিট কেন তুমি আধঘন্টার জন্যে দেখা দিয়ে এসো। আমি গাড়িতে বসে কোক খাব আর তুমি আধঘন্টার জন্যে যাবে। হবে না?
হবে।
তোমাকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন?
চিন্তিত না। রাতে ভাল ঘুম হয় নি।
আসমানী হাসতে হাসতে বলল—বিয়ের ডেট ফাইন্যাল হবার পর মেয়েরা রাতে এক ফোটা ঘুমুতে পারে না। ছেলেরা নাক ডাকিয়ে ভোস ভোস করে ঘুমায়। তোমার ব্যাপারে দেখি উল্টোটা হচ্ছে।
বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
ইয়েস স্যার। আগামী শুক্রবার।
আসমানী হাসছে। ফরহাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর করে কোন মেয়ে হাসতে পারে তাই তার কল্পনায় ছিল না। বিয়ের পর আসমানীকে যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে প্রতিদিন ভোরে নাশতা খাবার আগে তোয়ালে দিয়ে মাথা পেঁচিয়ে তার সামনে বসে (উঁহু দাঁড়িয়ে) হাসতে হবে। হাসি থামতে না বলা পর্যন্ত হাসি থামানো যাবে না।ফরহাদ বলল, তোমার মামা লোক কেমন? ভয়ংকর টাইপ। একটু উনিশ বিশ করেছ কি তোমাকে কপ করে গিলে ফেলবে।তোমার বাবার চেয়েও ভয়ংকর?
বাবা ভয়ংকর কোথায়? বাবা খুবই অর্ডিনারী টাইপ মানুষ। সামান্য বোকা। শিক্ষিত বোকা। শিক্ষিত বোকারা যেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলেন। বাবাও তাই করেন। এটাই তার একমাত্র দোষ। রিটায়ার্ড করার পর অফিসে বোকামী করার সুযোগ পাচ্ছে না। যা করার বাসায় করছে।তোমার মামা জ্ঞানী কথা বলেন না? না। জ্ঞানী কথা শুনলে তিনি আছাড় দেন। খবর্দার তুমি কোন জ্ঞানী কথা বলতে যাবে না।উনার নাম কি?
কামরুল ইসলাম। আশ্চর্য তুমি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছ না-কি? মামা অতি অতি অতি ভালমানুষ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।আসমানীর মামা কামরুল ইসলাম উদোম গায়ে চক্রাবক্রা রঙের বার্মিজ লুঙ্গি পরে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর ভারী। মুখের ভাব গম্ভীর হলেও মানুষটা হাসিখুশি। তিনি এক হাতে নিজের ভুড়িতে থাবা দিতে দিতে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন—তুমি হচ্ছ ফরহাদ?
ফরহাদ উঠে দাঁড়াল।তিনি বললেন, আসমানী বলছিল তুমি বেঁটে। বেঁটে কোথায়? আমার কাছেতো লম্বাই মনে হচ্ছে। হাইট কত? পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি মানে কত সেন্টিমিটার? এক ইঞ্চি সমান কত? ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফোর সেন্টিমিটার না? আমি বলতে পারছি না।কাগজ কলম নিয়ে বের করে ফেলতো? কলম আছে?
জ্বি না।আচ্ছা দাঁড়াও কাগজ কলম কিছুই লাগবে না। ক্যালকুলেটর এনে দিচ্ছি। জাপান থেকে গোটা ছএক ক্যালকুলেটর এনেছি। যাকে যাকে উপহার দিতে ইচ্ছা করছে তাদেরকে শুরুতে একটা অংক করতে দিচ্ছি। তারা যখন অংক নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন গিফট হিসেবে ক্যালকুলেটর। ভাল বুদ্ধি না? জ্বি। এইবার তোমার ভাইবা শুরু হচ্ছে। নানান ধরনের প্রশ্ন টশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। প্রথম প্রশ্ন–তোমার সেন্স অব হিউমার কেমন?
ভাল।
তুমি কি মজার মজার কথা বলে লোকজন হাসাতে পার?
জ্বি না।
তাহলে তুমি কি করে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল?
অন্যের কথায় হাসতে পারি।
অর্থাৎ জোকস ধরতে পার?
জ্বি পারি।
আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করেছিস, কি জন্যে করেছিস? সে বলেছে, তার সেন্স অব হিউমার দেখে। সেন্স অব হিউমার প্রসঙ্গে এই কারণেই প্রশ্ন করলাম।ফরহাদ চুপ করে আছে। মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা দীর্ঘদিন থাকেন তাদের মানসিকতায় সাধারণত দুধরনের পরিবর্তন হয়। একদল হয়ে পড়েন শুকনা কাঠখোট্টা রোবট। আরেক দল হন অতিরিক্ত রকমের সাধারণ মানুষ। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে দ্বিতীয় দলের।
ফরহাদ।
জ্বি।
মেয়েদের কিছু পিকিউলিয়ার ব্যাপার আছে। তারা প্রেমিকের সেন্স অব হিউমার খুব পছন্দ করে কিন্তু স্বামীর সেন্স হিউমার পছন্দ করে না। এটা কি জান?
জি-না।বিয়ের পর আসমানীর সঙ্গে রসিকতা করলে দেখবে সে বিরক্ত হচ্ছে বা রেগে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তোমার সামান্য রসিকতাতেই হাসবে। ব্যাপারটা আমার কাছে সব সময়ই স্ট্রেঞ্জ মনে হয়। যাই হোক এখন তোমার সম্পর্কে বল—
কি বলব?
তুমি অষুধ কোম্পানীতে আছ?
জ্বি।
কোম্পানীর নাম কি?
ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল।
বিদেশী কোম্পানী?
জ্বি-না। দেশী কোম্পানী।
কাজটা কি?
ছোট কাজ। অষুধের বাক্স নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরা।
কাজটা করতে ভাল লাগে?
জ্বি-না।
অন্য কোন কাজের চেষ্টা করছ?
তেমন কিছু পাচ্ছি না।
বেতন যা পাও—তাতে কি তোমাদের চলে?
জ্বি।
বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না?
না।
নিজের বাড়ি?
জ্বি-না নিজের বাড়ি না।
নিজের বাড়ি না, কিন্তু ভাড়া দিতে হয় না। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি দেশের বাইরে থাকেন।
তোমরা সেই বাড়ির কেয়ার টেকার?
জ্বি।
তোমার আত্মীয় যদি দেশে চলে আসেন তখন কি হবে? কিংবা ধর বিদেশে থেকেই বাড়িটা বিক্রি করে দেন তখন?
ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার পর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
বোনদের বিয়ে হয়েছে?
আমার একটিই বোন। তার বিয়ে হয়েছে।
বোনের স্বামী কি করেন?
ব্যবসা করেন।
বড় ব্যবসা না-কি ছোট ব্যবসা?
ছোট।
নাশতা চলে এসেছে। পরোটা-ভাজি, মুরগির ঝোল, পায়েস। একটা বাটিতে কলা। বিরাট আয়োজন। নাশতা নিয়ে এসেছে আসমানীর ছোটবোন নিশা। মেয়েটা এম্নিতেই গম্ভীর—আজ তাকে আরো গম্ভীর লাগছে।সে ফরহাদের দিকে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ফরহাদ বলল কেমন আছ নিশা?নিশা জবাব দিল না। সে ট্রে থেকে টেবিলে নাশতার থালা-বাটি নামাতে ব্যস্ত। এমন ভাব করছে যেন প্রশ্নটা শুনতে পায় নি।
আসমানীর মামা বললেন, ফরহাদ নিশার সঙ্গে তোমার বোধহয় তেমন আলাপ পরিচয় নেই। ও দারুণ রসিক মেয়ে এটা কি তুমি জান? ফরহাদ বলল, জ্বি-না। জানি না।ওর গল্পগুজব শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তাকে দেখে অবশ্যি এটা বোঝার কোন উপায়ই নেই। এই নিশা তোর দরজির গল্পটা বলতো।
নিশা গম্ভীর গলায় বলল, গল্পটা মনে নেই মামা।
অবশ্যই মনে আছে বলতো।
নাশতা খাও তারপর বলছি।
আসমানীর মামা বললেন, ও গল্প বলবে না। দাঁড়াও আমিই বলি—এক দরজি তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেছে। সেখানে অন্য এক লোকের সঙ্গে দেখা। লোকটা বলল, এ আপনার ছোট ছেলে না? দরজি বলল, হ্যাঁ। লোকটা বলল, আপনার বড় ছেলেটা কত বড়? দরজি বলল, ছোটটার চেয়ে চাইর গিরা বড়।
ফরহাদ তাকিয়ে আছে। কামরুল ইসলাম সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। তার হাসির কারণে যে সোফায় বসেছিলেন সেই সোফা কাঁপছে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে—শুধু সোফা না, পুরো বাড়িই কাপছে। ফরহাদের হাসি আসছে না। বাড়িঘর কাঁপিয়ে হাবার মত কোন গল্পও এটা না। কিন্তু ভদ্রলোক এমন হাসছেন কেন?
অস্বস্তি দূর করাবার জন্যে হাসছেন? ফরহাদের নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে।আরেকটা গল্প বলি শোন। এটা অবশ্যি নিশা বলে নি। কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। এক ছেলে তার বন্ধুকে বলেছে—শেষ পর্যন্ত আমার চাচা শান্তি পেয়েছেন। চিরশান্তি। বন্ধু বলল, তোর চাচা কি মারা গেছেন? সে বলল, না চাচা মারা যান নি চাচী মারা গেছেন।
গল্প শেষ করে ভদ্রলোক আগের চেয়েও অনেক বেশী উচ্ছাস নিয়ে হাসছেন। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। এক সময় তিনি হাসি থামিয়ে বললেন, তোমাকে পর পর দুটা মজার মজার গল্প বললাম। তুমি একটুও হাস নি। তুমি যে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল—এটাতো তুমি ঠিক বলনি।মাইক্রোবাসে উঠতে উঠতে আসমানী বলল, মামাকে কেমন লাগল।ফরহাদ বলল, ভাল।
মামা হলেন সেলফ মেড ম্যান। মেট্রিক পাশ করে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিন বছর তাঁর কোন খোঁজই ছিল না। কেউ জানত না তিনি কোথায়। তিন বছর পর দেশে ফিরলেন। কলেজে ভর্তি হলেন। পাশ করলেন। ইউনির্ভাসিটিতে গেলেন। এম.এসসি শেষ করে আবারো দেশের বাইরে।বিয়ে করেছেন? না বিয়ে করেন নি। আমরা বিয়ে করতে বলছি! মামা বলছেন—এখন আমার বয়স চুয়ান্ন চলছে এখন বিয়ে করব কি?
আমি বললাম, মামা পিকাসোসতুর বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। মামা বললেন, আমি কি পিকাসো নাকি? আমি অতি নগন্য কামরুল ইসলাম।আসমানী হাসতে হাসতে বলল, মামা যতই না না করুক আমরা উঠে পরে লেগেছি মামাকে বিয়ে দিয়ে দেব।ভাল। মামা ভাগ্নির এক সঙ্গে বিয়ে।আসমানী হাসছে। মেয়েরা তাদের হাসি যে কোন সময় চট করে থামিয়ে দিতে পারে। আসমানী পারে না। একবার হাসতে শুরু করলে সে অনেকক্ষণ হাসে। ফরহাদ বলল—আমরা কোনদিকে যাব? প্রথমে তুমি কি ডলার ভাঙ্গাবে?
ডলারতো ভাঙ্গাবই তবে প্রথমে ভাঙ্গাব না। দ্বিতীয়তে ভাঙ্গাবো। প্রথমে গাড়ি করে আমরা এক ঘন্টা ঘুরব। তোমাকে অফিসে কখন যেতে হবে?
বারোটার দিকে গেলেই হবে।
মনে থাকে যেন। জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্যে যাবেও না, সরি তোমাকে আধঘন্টা টাইম দিয়েছিলাম।
পাঁচ মিনিটের বেশী লাগবে না।
আমি তোমাকে লম্বা একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তুমি যদি আজ না আসতে এই চিঠি তোমাদের বাসায় দিয়ে আসতাম।
চিঠি কি সঙ্গে আছে?
চিঠি সঙ্গে থাকবে কেন? আমি পোস্টম্যান নাকি?
ফরহাদ সিগারেট বের করল। আসমানী বলল—তুমি দয়া করে জানালার ধার ঘেসে বস। সিগারেটের ধোয়া জানালা দিয়ে বাইরে ফেলবে।
আচ্ছা।
যেদিন বিয়ে হবে সেদিন থেকে কিন্তু তোমার সিগারেট বন্ধ। শুধু ভোরবেলা নাশতার সময় একটা, দুপুরে ভাত খাবার পর একটা এবং রাতে ঘুমুবার আগে একটা।
আচ্ছা।
তবে বিশেষ বিশেষ উৎসবে কয়েকটা সিগারেট এড করা যেতে পারে যেমন তোমার জন্মদিন, তোমার বিবাহ বার্ষিকী…
থ্যাংক য়্যু।
সিগারেটের ধোয়া তোমারতো বাইরে ফেলার কথা ছিল। তুমি ভেতরে ফেলছ কেন?
সরি।
তোমাকে যে চিঠি লিখেছিলাম সেটা কি সত্যি সত্যি পড়তে চাও।
সঙ্গে আছে।
পড়তে চাও কি-না সেটা বল।
অবশ্যই চাই।
পড়লে কিন্তু রাগ করবে। কারণ চিঠিতে মিষ্টি মিষ্টি কোন ব্যাপারই নেই।না থাকুক।আসমানী তার কোলে রাখা ব্যাগ থেকে চিঠি বের করল। চিঠির সঙ্গে ছোট্ট একটা আয়না। কিশোরীদের মত আনন্দময় গলায় বলল—চিঠি পড়ার আগে আয়নাটা দেখ। আয়নাটা সুন্দর না?
হুঁ।না দেখেই বলে ফেললে। এটা হল বিশেষ ধরনের নাইট মেকাপ আয়না। এই আয়নায় পাওয়ারফুল সোলার ব্যাটারী আছে। দিনেরবেলায় সূর্যের আলো থেকে এই ব্যাটারী চার্জ হয়ে থাকে। রাতে বোতাম টিপলেই আয়নার বাল্ক এমনভাবে জ্বলে যে আলোটা ঠিক মুখে এসে পরে। সেই আলোতে আয়নায় মুখ দেখে মেকাপ নেয়া। সুন্দর না? খুব সুন্দর।হাতে নিয়ে দেখ। একটা সুন্দর জিনিস তোমার হাতে নিতে ইচ্ছা করে না?
ফরহাদ আয়না হাতে নিল। বোতাম টিপে আলো জ্বালালো। আসমানী বলল, মামা প্রতিবারই যখন বিদেশ থেকে আসে সবার জন্যে মজার মজার জিনিস নিয়ে আসে। নিশার জন্যে কি এনেছে জান? মাকড়সা! মাকড়সা?
হুঁ। প্লাস্টিকের মাকড়সা। দূর থেকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলে দেয়ালে লেগে যায়। তারপর এক্কেবারে আসল মাকড়সার মত দেয়াল বেয়ে নামতে থাকে।
বল কি?
খুবই ঘিন্নাকর। দেখবে?
তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ নাকি?
তোমাকে দেখাবার জন্যে এনেছি।
এখন আমি মাকড়সা দেখব না। চিঠিটা আগে পড়ি।
তুমি চিঠি পড়বে আমি কি করব?
তুমি জাপানী আয়নায় মেকাপ ঠিক কর। কিংবা মাকড়সা নিয়ে খেলা কর। ফরহাদ চিঠি পড়তে শুরু করল—
এই যে বাবু সাহেব,
আসসালামু আলায়কুম। এবার আপনি এত দেরী করে ঢাকায় ফিরলেন কেন? আমার খুবই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আপনি কি জানেন যখন আমার আপনাকে দরকার হয় তখনি আপনি ঢাকায় থাকেন না। এবং আপনার মধ্যে আছে রাক্ষস স্বভাব। যখন আপনি বলেন দুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি তখন আপনি এক সপ্তাহ পার করে আসেন।
বাবু সাহেব আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক। পুরো ব্যবস্থাটা যিনি করেছেন তিনি আমার মামা। মামা এমন মানুষ যার মুখের উপর কারোরই কিছু বলার ক্ষমতা নেই। যাই হোক পুরো ঘটনাটা—অর্থাৎ মামা কিভাবে আমার পক্ষে চলে এল সেটা বলি। আমার পুরো ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে। মন দিয়ে শোনও সরি মন দিয়ে পড়।
মামা বাসায় এসে পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা। তাঁর যেদিন আসার কথা ছিল তার একদিন আগে চলে এলেন কাজেই আমরা যে তাকে হৈ চৈ করে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসব তা আর করা গেল না। তিনি বাসায় পা দিতেই চারদিকে আনন্দের বন্যা শুরু হয়ে গেল। মা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলেন সে কান্নাও আনন্দের কান্না। এই কাঁদছেন এই হাসছেন—মোটামুটি হিস্টিরিয়ার মত অবস্থা। আমরা উপহার নিয়ে টানাটানি করছি।
মামা স্যুটকেস খুলে বলেছেন—যার যেটা পছন্দ বেছে নে। এতেই সমস্যা হয়েছে। কাড়াকাড়ি পরে গেছে। সারারাত আমরা কাটালাম গল্প করে। ঘুমে যখন মামার চোখ জড়িয়ে আসে তখন কফি বানিয়ে আমরা মামার ঘুম ভাঙ্গাই। এমন অবস্থা।সকালবেলা মামার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম আনিস। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স।
লাজুক ধরনের মানুষ। গায়ের রঙ ময়লা হলেও অতি সুদর্শন। মেয়েদের মত টানা টানা চোখ। ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে মামাকে খবর দিতে গেলাম। মামা বললেন, ও আচ্ছা আনিস। ওকে বসতে বল। চা-টা খাওয়া। তোরা দুই বোন গল্প কর। আমি ঘন্টা দুএক না ঘুমিয়ে উঠতে পারব না। তোরা কোম্পানী দে। নিশা বলল, ভদ্রলোক কি করেন মামা?
মামা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জাহাজে কাজ করে। খালাসি ফালাসি হবে।খালাসি বলেতো মনে হচ্ছে না।মামা বিরক্ত গলায় বললেন, মানুষের কাপড় চোপড় দেখে কখনোই বিভ্রান্ত হবি না। চেহারা দেখেও হবি না। শেখ সাদীর বিখ্যাত গল্প মনে রাখবি।মামা ঘুমুতে গেলেন। আমি খালাসি ভদ্রলোককে চা দিতে গিয়ে জানলাম ভদ্রলোক মোটেই খালাসি না।
জাহাজের সেকেণ্ড ক্যাপটেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমি যখন ভদ্রলোককে বললাম—মামা বলেছেন আপনি জাহাজের খালাসি। উনি মজা পেয়ে খুব হাসলেন। আমি বললাম, জাহাজের গল্প বলুন। তিনি বললেন, জাহাজের কোন গল্প নেই। পৃথিবীর সবচে বিরক্তিকর এবং ক্লান্তিকর জিনিস হচ্ছে জাহাজের চারপাশের সমুদ্রের পানি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই জিনিস দেখলে যে কোন সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পরে।
আমি বললাম, হ্যাঁ। এখন আমার চিকিৎসা চলছে।কী চিকিৎসা? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, স্থল চিকিৎসা। স্থলে সময় কাটাচ্ছি এতেই কাজ হচ্ছে।মামা দুপুর পর্যন্ত ঘুমুলেন। আনিস সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। নিশা তাকে ধরে রেখে দিল। দুপুরের মধ্যে এই ভদ্রলোক ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন। মার সঙ্গে গল্প করলেন, বাবার সঙ্গে গল্প করলেন। এবং দুপুরের খাবারের আগে বাবার একটা লুঙ্গি পরে বাথরুমে গোসল করতে গেলেন। তিনি আবার গোসল না করে খেতে পারেন না।
রাতে মামা চা খেতে খেতে আমার আর নিশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বললেন—এই আসমানী আনিস ছেলেটা কেমন? আমি বললাম, খুব ভাল। ছেলেরা যতটা ভাল হয় তারচে একটু বেশি ভাল। আরেকটু কম ভাল হলেও ক্ষতি ছিল না।সে যে অহংকারী কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিস? না।
বেশ অহংকারী ছেলে। তবে দোষের অহংকার না। ওর দোষের মধ্যে একটাই মদ্যপান করে। জাহাজে চাকরি করলে যা হয়। কিছু করার নাই—তাই মদ খাওয়া। তুই অভ্যাসটা ছাড়িয়ে দিবি।আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি অভ্যাস ছাড়াব কেন? মামা বললেন, তুই না ছাড়ালে কে ছাড়াবে? স্বামীর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব স্ত্রীর না? তুমি কি বলছ মামা?
আনিসের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। এই জন্যেই ছেলেকে আসতে বলেছি। আনিস যাবার সময় বলে গেছে তোকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। আর আমার ধারণা তোরও ছেলে পছন্দ হয়েছে। ব্যাস আমার দায়িত্ব শেষ। এখন যা করার করবেন কাজি সাহেব।
মামার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি শুরু করলাম কান্না। আমি যেমন হাসতে পারি, তেমন কাঁদতেও পারি। তুমিতো আমাকে কাঁদতে দেখনি। কাঁদতে দেখলে তোমার খবর হয়ে যেত।কান্নার চোটে আমার হেঁচকি উঠে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগার হল। মামা নিশাকে জিজ্ঞেস করলেন—নিশা! ও এরকম করছে কেন? নিশা বলল, আপার একজন পছন্দের মানুষ আছে বলে এ রকম করছে।
মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, পছন্দের মানুষ থাকলে সে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে। আমি কি তাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছি না-কি? হাত পা ছড়িয়ে কাঁদার কি হল। এমন বিশ্রী কান্না সে কোথায় শিখল? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কান্না বন্ধ করে বল কাকে বিয়ে করতে চাস। যা তাকে ধরে নিয়ে আয়। যা আজ রাতেই বিয়ে দেব।এই হচ্ছে ঘটনা।
বুঝলেন বাবু সাহেব? চিঠি পড়তে পড়তে আপনার কি আনিস নামের ছেলেটার প্রতি হিংসা হচ্ছিল? হিংসা যাতে হয় এই জন্যেই তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু লিখেছি। ভদ্রলোকের চেহারা আসলেই খালাসির মত।
একটা সত্যি কথা বলি? তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব ছেলেকেই আমার কাছে খালাসির মত মনে হয়। কি এখন খুশীতো?
ইতি–
তোমার আ
দুপুর বারটায় মেইন রোডে গাড়ি রেখে ফরহাদ অফিসে গেল। কান্ট্রি। রিপ্রেজেনটেটিভ অশোক বাবুকে বলবে মফস্বলের আজেবাজে হোটেলে খেয়ে তার ফুড পয়জনিং-এর মত হয়েছে। আজ আর কাল এই দুদিনের ছুটি দরকার। অশোক বাবু ভাল মানুষ ধরনের। তিনি না করবেন না। তাছাড়া সে ছুটিছাটা তেমন নেয় না।
Read more