চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ৪

অশোক বাবুকে তার বিয়ের কথাটা বলতে হবে। অনেক দিনতো সে মফস্বলে মফস্বলে ঘুরল এখন যদি তাকে হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়। এতে অবশ্যি তার রোজগার কমে যাবে। টিএ বিল পাবে না। না পাওয়া গেলে নাই। আসমানীর সঙ্গে থাকা এটাই কম কি?

অশোক বাবু ফরহাদের কথা শুনলেন। বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে বললেন—কনগ্রাচুলেশন। ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কি বিয়ে হচ্ছে যে মাঝে মধ্যে আমার টেলিফোনে টেলিফোন করে আপনাকে চাইতো?

ফরহাদ লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।তাকে একদিন আমি একটু ধমকের মত দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলবেন।স্যার এটা কোন ব্যাপারই না। আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি—আমাকে ঢাকায় আনার ব্যাপারটা আপনি একটু দেখবেন।অশোক বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অস্বস্থির সঙ্গে বললেন ফরহাদ সাহেব আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।

ফরহাদ বলল, এইসব নিয়ে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সাহস আমার নেই। যা করবার আপনি করবেন।অশোক বাবু শুকনো মুখে বললেন—আপনার চাকরি নিয়েই একটা সমস্যা হয়েছে। আপনার যে কজন—আউট অব টাউন রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন তাদের সবাইকেই টার্মিনেট করা হয়েছে। আউট অব টাউন সার্ভিসই কোম্পানী উঠিয়ে দিচ্ছে।

সেকি!আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। অন্যরা সবাই কথা বলেছে। বড় সাহেব অফিসে আছেন।ফরহাদ ঘড়ি দেখল। সে আসমানীকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে এসেছিল। দশ মিনিট হয়ে গেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরো আধ ঘন্টা লাগবে।অশোক বাবু বললেন, কথা বলে অবশ্যি কোন লাভ হবে না। ডিসিসান অনেক আগের। যাই হোক চেষ্টা করতেতো ক্ষতি নেই। আপনাদের মধ্যে যারা সিনিয়ার তাদের অন্য জায়গায় নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

ফরহাদ সিনিয়ারদের মধ্যে পড়ে না। সে সম্ভবত সবচে জুনিয়ার। সে বড় সাহেবের ঘরের সামনে গেল। বাইরে লালবাতি জ্বলছে। কাজেই এখন যাওয়া যাবে না। সে মাইক্রোবাসের দিকে ফিরে গেল। আসমানী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইশারায় হাতের ঘড়ি দেখাল। দূর থেকেই বুঝিয়ে দেয়া দেরী হয়েছে।আসমানী হাসি মুখে বলল, পাঁচ মিনিটের কথা বলে এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছ।ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানী বলল, মুখ এমন করে রেখেছ কেন? বড় সাহেবের বকা খেয়েছ?

ফরহাদ বলল, অফিসের বড় সাহেবরা বকা দেন খুব কম। বকা দিয়ে তারা এনার্জি নষ্ট করেন না। তাদের কাজ কর্ম লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বকা দেয়ার বদলে—এই প্রতিষ্ঠানে তোমার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই লিখে নিচে নাম সই করে দেন।তোমার তাই হয়েছে নাকি?

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীকে বাড়ি পাঠিয়ে তার উচিত আবার অফিসে ফিরে আসা। ব্যাপারটা কি খোঁজ নেয়া। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তার চাকরি গেলে নান্টু ভাইয়েরও গেছে। সেটা সহজ হবে না। নান্টু ভাই সহজ পাত্র না। অতি ঘঘাড়েল লোক। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা অতি সহজ। তাঁর একটা মোবাইল টেলিফোন আছে।

সবাইকে বলে দিয়েছেন—ভয়াবহ ইমার্জেন্সি হলে তবেই তাকে টেলিফোন করা যাবে। ইনকামিং কলের চার্জ দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। খেজুরে আলাপ করার জন্যে যদি কেউ টেলিফোন করে মিনিট হিসেব করে তাকেই বিল দিতে হবে।এই তুমি মুখ ভোতা করে বসে আছ কেন? ঠিক করে বলতে, অফিসে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?

না।

তাহলে গল্প কর, No মুখ ভোতা বিজনেস।

তুমি গল্প কর আমি শুনি।

আসমানী উজ্বল মুখে বলল, আচ্ছা তোমাকে একটা সহজ ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। তুমি যদি ধাঁধাটার জবাব দিতে পার তাহলে আজ সারাদিনে তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব। আর তুমি যদি না পার তাহলে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে। রাজি? আমি আসলে ধাঁধা একেবারেই পারি না। এটা খুবই সহজ ধাঁধা। বলতো মানুষের দাঁত কটা থাকে? বত্রিশটা।

হয় নি। মানুষের দাঁত থাকে ৫২টা। ছোটবেলায় যে দাঁতগুলি থাকে সেগুলি তুমি হিসাবে ধরছ না কেন? সেগুলিও তো দাঁত। কাজেই বাজিতে তুমি হেরে গেলে। এখন থেকে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।আচ্ছা। আজকের দিনে আমার সব ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আচ্ছা।বিয়ের রাতে আমি তোমাকে পাঁচটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। পাঁচটা ধাঁধার যে কোন একটাও যদি তুমি পার তাহলে বাকি জীবন আমি তোমার কথা শুনব। পাঁচটা ধাঁধাই সহজ। খুবই সহজ। কিন্তু কেউই পারে না।সহজ হলে পারে না কেন?

সবাই চিন্তা করে জটিল ভাবে তাই পারে না। যাই হোক আজ আমি বাজি জিতে গেছি কাজেই বাজির শর্ত অনুসারে আমার প্রতিটি ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আমার প্রথম ইচ্ছা হল—তুমি আমাকে একটা সার্টের দোকানে নিয়ে যাবে। আমি তোমার জন্যে সাতটা সাত রঙের সার্ট কিনব। একেক দিন একেক রঙের সার্ট পরবে। যেমন রোববারে পরবে মেরুন রঙের সার্ট, শুক্রবার পরবে সাদা রঙের সার্ট। যেন তোমার গায়ের সার্ট দেখে আমি বলে দিতে পারি আজ কি বার।

ফরহাদ ক্লান্ত গলায় বলল, চল যাই। শুধু কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে ছাড়তে হবে আমি কার্ডফোন থেকে একটা ফোন করব।কাকে ফোন করবে? নান্টু নামের এক ভদ্রলোককে। আমার সঙ্গে কাজ করেন। আমার সিনিয়ার ভাই।টেলিফোন করতেই হবে? খুবই জরুরী?

হুঁ।বেশতো আমাকে কোন একটা সার্টের দোকানে ঢুকিয়ে তুমি টেলিফোন করে আস। গুলশানের দিকে চল।গুলশানের দিকে না গেলে? ঐদিকের দোকানগুলি খুব এক্সপেনসিভ হয়।হোক এক্সপেনসিভ। আমি তোমাকে একটা উপহার দেব। সস্তা উপহার দেব না-কি? ড্রাইভার সাহেব গুলশানের দিকে যানতো। আর আপনার মাইক্রোবাসে যদি গান শোনার ব্যবস্থা থাকে তাহলে গান বাজান।

হিন্দী গান আছে আপা।

হিন্দী গুজরাটি কোন সমস্যা নেই।

আসমানী ফরহাদের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বলল, আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখতো। আঙ্গুল কি পাঁচটাই আছে না, দু একটা বেড়েছে। আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা যা তুমি পুরন করবে তা হল যতক্ষণ গাড়িতে থাকবে আমার হাত ধরে বসে থাকবে। মনে থাকে যেন।

মোবাইল টেলিফোনে কাউকে পাওয়া বেশ কঠিন। টেলিফোন করলেই কিছুক্ষণ কট কট, কট কট শব্দ হয়। তারপর খুব মিষ্টি গলায় একটা মেয়ে বলে, সকল চ্যানেল ব্যস্ত। আপনি আবার চেষ্টা করুন। মোবাইল টেলিফোনে নাম্বাররা থাকে এক গাদা। টিপতে টিপতে আংগুল ব্যথা।অবশ্যি আজ নান্টু ভাইকে প্রথম বারেই পাওয়া গেল। নান্টু ভাই ধমকের গলায় বললেন কে?

ফরহাদ বলল, নান্টু ভাই আমি।

তুই কোথায়?

গুলশানে। গু

লশানে কি করছিস এক্ষুণি চলে আয়।

কোথায় আসব?

অফিসে চলে আয়। কথা নাই, বার্তা নাই পাঁচটা লোকের চাকরি খেয়ে ফেলবে—আর আমরা তাদের বুড়া আংগুল চুষব। পেয়েছে কি? গজব করে দেব না। আমার নাম নান্টু পাগলা।বড় সাহেবের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

এক দফা হয়েছে। বড় সাহেব দেখা গেল আমাকে চিনে না। আইন দেখায়। আমাদের চাকরির শর্ত না-কি এই দিন যেকোন দিন যে কোন কারণ ছাড়াই চাকরি বাতিল হতে পারে। শালা আমাকে আইন দেখায়। আইন আমি তার গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকায়ে দিব।

নান্টু ভাই আপনার আশে পাশে কেউ নাই?

থাকুক। তুই চলে আয় মারাত্মক প্ল্যান করেছি।

কি প্ল্যান?

অফিসের সামনে আমরণ অনশন। স্ত্রী পুত্র পরিবার সহ। আমি আমার বউ আর তিন বাচ্চা নিয়ে আসব। বাচ্চা তিনটার মধ্যে একটা দুধের শিশু। সে সারাক্ষণ কেউ কেউ করে কাঁদবে।তিন বাচ্চা আপনি পাবেন কোথায়? আপনারতো একটাই ছেলে। বৌ বাচ্চা সব ভাড়া করব। তুই এক কাজ কর তোর খালাতো বোন, মামাতো বোন কাউকে রাজি করিয়ে নিয়ে আয় বউ এর প্রক্সি দেবে।

ফরহাদ হাসল। নান্টু টেলিফোনেই ধমক দিল, হাসি বন্ধ। নো লাফিং। চাকরি ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ হাসব না। দাড়ি গোফ কামাব না। পত্রিকার অফিসে খবর দিয়ে আসব। প্রয়োজনে পত্রিকাওয়ালাদের মাল খাওয়াব। মন্ত্রী মিনিষ্টার চেনা জানা আছে?

না।

এমন কাউকে খুঁজে বের কর যাদের মন্ত্রী মিনিষ্টারের সঙ্গে কানেকশান আছে। সবচে ভাল হয় মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে এমন কাউকে যদি পাওয়া যায়। আমরা স্ট্রেইট ম্যাডামের পা ধরে বসে থাকব। বাঙ্গালীমেয়ের পা একবার ধরতে পারলে সর্ব মুশকিল আসান। পা ধরতে পারাটাই কঠিন। তুই কথা বলে সময় নষ্ট করছিস কেন? চলে আয়।

আসছি।

আসছি না-এক্ষুণি লাফ দিয়ে বেবীটেক্সীতে ওঠ।

ফরহাদ লাফ দিয়ে বেবীটেক্সিতে উঠল না। উঠা সম্ভব না। তাকে সারাদিন আসমানীর সঙ্গে কাটাতে হবে। এক ফাঁকে জাহানারার মেয়ের জন্যে আংটি কিনতে হবে। জাহানারার মেয়ের আজ আকীকা। আংটি পৌঁছে দিতে হবে। সন্ধ্যাবেলা মার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হবে। মা সস্তার আংটি দেখে রাগ করবেন। রাগ করলেও কিছু করার নেই।আসমানী সাতটা সার্ট কিনল রঙগুলি হল—কমলা, গাঢ় নীল, হালকা নীল, হালকা সবুজ, সাদা, ছাই, কাল।চাইনীজ খেতে বসে কাগজ কলম নিয়ে লিষ্ট করল কোন রঙের সার্ট কখন পরা হবে।

রবিবার : (আনন্দের রঙ) কমলা

সোমবার : (আনন্দের পরই বিষাদ) কাল

মঙ্গলবার : (বিষাদ একটু কম) ছাই রঙ

বুধবার : (আবার আনন্দ ফিরে আসছে) হালকা সবুজ

বৃহস্পতিবার : (আনন্দ বাড়ছে) হালকা নীল

শুক্রবার : (পবিত্রতার রঙ) সাদা

শনিবার : (আর মাত্র একদিন পর রবিবার। খুব আনন্দ) গাঢ় নীল।

আসমানী নিজের জন্যে সাতটা শাড়ি কিনেছে। সবই লাল রঙের। বিয়ের পরের এক মাস সে লাল শাড়ি ছাড়া কিছুই পরবে না। আরেকটা খুব সুন্দর শাড়ি কিনল কণার জন্যে। কণা তার স্কুল জীবনের বান্ধবী।ফরহাদ বলল, তোমার মধ্যে ভালই পাগলামী আছে।আসমানী বলল, তা আছে। আচ্ছা শোন তুমি এখনো মুখ এমন আমশি করে রেখেছ কেন? তোমার কি কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। তার দুঃশ্চিন্তা অবশ্যই হচ্ছে। এই মুহূর্তে দুঃশ্চিন্তার কথা বলে আসমানীর মন খারাপ করিয়ে দেবার কোন মানে হয় না।দুশ্চিন্তা হল পোকার মত। পোকাটা মাথার ভেতরে মগজে জন্ম। জন্মেই মগজ খাওয়া শুরু করে। মগজ খায় আর আয়তনে বাড়ে। ফরহাদ সেই পোকাটাকে এখন অনুভব করতে পারছে। কুটকুট করে কামড়ে মগজ খাচ্ছে–সেই কুটকুট শব্দও শুনতে পাচ্ছে। আসমানীর হাসি মুখ, তার আনন্দ কোন কিছুই ভাল লাগছে না।আসমানী বলল, এই একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় যাবে?

কোথায়? এয়ারপোর্টের কাছে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। পানির মধ্যে রেস্টুরেন্ট। নৌকায় করে যেতে হয়।এত দূরে যাব? দূরে সমস্যা কি? আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়ি ভর্তি তেল। আমরা ইচ্ছ করলে কুমিল্লা চলে যেতে পারি। কুমিল্লা যাবে? চল কুমিল্লা চলে যাই।কুমিল্লা?

এখন রাস্তা ভাল। যাব আর চলে আসব। রাত হয়ও যদি কেউ কিছু বলবে না।কুমিল্লা যেতে ইচ্ছা করছে না, চল এয়ারপোর্টের কাছেই চল। নৌকা চালাই।আসমানী উজ্জ্বল মুখ করে বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়। চল আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে নৌকায় চড়ি। তারপর নৌকাটা মাঝখানে নিয়ে ড়ুবিয়ে দিয়ে সঁতরে পাড়ে আসি। তুমি নিশ্চয়ই সাঁতার জান? ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, তাতে লাভ কি?

আসমানী হাসি মুখে বলল, যারা রেস্টুরেন্টে মজা করতে এসেছিল তারা বাড়তি মজা পাবে। বাসায় ফিরে গল্প করতে পারবে। রেস্টুরেন্টওয়ালাদেরও উচিত শিক্ষা হবে। পানির নিচ থেকে নৌকা তুলতে হবে। তারা হয়ত এর পর নৌকা ব্যবসা ছেড়ে দেবে। হি হি হি।আসমানী হেসেই যাচ্ছে। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আসমানী এত হাসছে কেন?

এই শোন চলতো কিছু ক্যাসেটের দোকান থেকে ভাল ভাল ক্যাসেট কিনি। মাইক্রোবাসওয়ালার হিন্দী গান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা।

চল কিনি।

তুমি অংক স্যারদের মত মুখ করে আছ কেন?

শরীর ভাল লাগছে না। পেট ব্যথা করছে।

পুপু?

পুপু মানে?

পুপু মানে হাগু। হি হি হি। এ রকম অবাক হয়ে তাকাচ্ছ কেন? আমি তোমার বউ, আমি যা ইচ্ছা বলতে পারি। হাগু খুবই ভদ্র শব্দ। আমি এরচে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর শব্দ জানি। যথাসময়ে বলব। রাগ করলেও লাভ নেই।রাগ করব না।পেটে ব্যথা কি বেশী? পেট ব্যথা ছাড়াও তুমি অন্য কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছ। সেটা কি বলতো?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। চাকরির সমস্যার কথাটা আসমানীকে বলা কি ঠিক হবে? ফরহাদ বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এত আনন্দে আছে তার আনন্দ নষ্ট করা খুবই অনুচিত হবে। ব্যাপারটা গোপন করে যাওয়াও ঠিক হবে না। সরাসরি না বলে অন্য ভাবে হলেও বলা দরকার। বিয়েটা পিছাতে হবে।

আসমানী!

বল।

ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।

কেন?

ঘোরাঘুরির চাকরি ভাল লাগে না। আজ রংপুর তো কাল চাঁদপুর। বেতনও এমন কিছু না। আমি থাকব মফস্বলে, তুমি থাকবে ঢাকায়।আমি ঢাকায় থাকব তোমাকে কে বলেছে? আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। তুমি যেখানে আমিও সেখানে।পাগল হয়েছ। আমি যে সব হোটেলে থাকি তুমি সে সব হোটেলে ঢুকবেই না। সব সময় যে হোটেলে থাকি তাও না। মাঝে মাঝে ইস্টিশনের বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেই।

সেতো আরো একসাইটিং। দুজন স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। তুমি স্টেশনের টি স্টল থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসবে। আমরা দুজন সেই চা ভাগাভাগি করে খাব।চিন্তা করতে তোমার কাছে যত ইন্টারেস্টিং লাগছে, বাস্তব কিন্তু তেমন ইন্টারেস্টিং না।ইন্টারেস্টিং ভাবলেই ইন্টারেস্টিং। আর বোরিং ভাবলে বোরিং।

ও।

এ রকম বিশ্রি ভাবে ও বললে কেন?

বিশ্রী ভাবে বলেছি?

খুবই বিশ্রী ভাবে বলেছ। তোমার ও বলা শুনে মনে হয়েছে তোমার পেটের ব্যথা শেষ পর্যায়ে গিয়েছে এবং তুমি প্যান্টে পুপু দিয়েছ। হি হি হি।ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, অনেক ফাজলামী করেছি আর করব না। চল সুন্দর দেখে কিছু ক্যাসেট কিনি। সর্বশেষ অস্বস্তিকর জিজ্ঞাসা–পেটের ব্যথা কমেছে?

হুঁ।আচ্ছা আজ আমার এত আনন্দ লাগছে কেন বলতো? আমার ঠিক এই মুহূর্তে কি ইচ্ছা করছে জান? না। কি ইচ্ছা করছে? ইচ্ছা করছে মাইকের দোকান থেকে একটা মাইক ভাড়া করতে। সেই মাইকটা পিকনিক পার্টির বাসে যেমন করে বাসের ছাদে ফিট করে, তেমন করে আমাদের মাইক্রোবাসের ছাদে ফিট করব। আমাদের মাইক্রোবাস চলবে। আমাদের পছন্দের গানগুলি আমরা বাজাব। মাঝে মাঝে আমি একটা ঘোষণা দেব। আমি বলব—

ঢাকা নগরবাসি। আমার নাম আসমানী।

আমার পাশে যে যুবকটি বসে আছে তার নাম ফরহাদ।

আমরা আগামী শুক্রবার বিয়ে করছি।

আমাদের বিয়েতে আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ। কোন গিফট আনতে

হবে না। তবে খালি হাতে যেহেতু আসতে আপনাদের লজ্জা লাগবে

আপনারা ইচ্ছা করলে একটা করে বেলী ফুলের মালা আনতে পারেন।

বেলী আমার খুব পছন্দের ফুল।

ফরহাদ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। আসমানীর এই রূপের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সে হাসি খুশি ধরনের মেয়ে। মজা করে কথা বলতে পছন্দ করে। আবেগ উচ্ছাস সবই পরিমিতির মধ্যে এতদিন পর্যন্ত এ রকম ধারণা ছিল। আজ ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। একটা মানুষের ভিতর তিন চারটা মানুষ বাস করে। বিচিত্র পরিবেশে বিভিন্ন জন বের হয়ে আসে। আসমানীর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। আসমানীর ভেতর থেকে অন্য এক আসমানী বের হয়ে আসছে।

যাকে ফরহাদ চেনে না।আসমানী বলল, তুমি দয়া করে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে আমার জ্বর কি-না।কপালে হাত দিয়ে ফরহাদ চমকে উঠল অনেক জ্বর।আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, জ্বরটা অনেকক্ষণ ধরে টের পাচ্ছিলাম। যতক্ষণ পেরেছি অগ্রাহ্য করেছি। এখন আর পারছি না। চল বাসায় চলে যাই।চল।

আসমানী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল—তোমাকে একটা ট্রিকস শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি যখনই দেখবে আমি হড়বড় করে কথা বলছি তখন বুঝবে আমার জ্বর আসছে।তোমার কি প্রায়ই জ্বর আসে? হু। একবারতো ডাক্তাররা সন্দেহ করল ব্লাড ক্যান্সার। নানান টেস্ট ফেস্ট করল। তারপর দেখা গেল-ব্লাড ক্যান্সার না। আমার মনটা খুবই খারাপ হল।কেন?

ব্লাড ক্যান্সার হলে সবাইকে বড় গলায় বলতে পারতাম। তখন সবাই আমার সঙ্গে অন্য রকম করে কথা বলতো। সবাই ভাবতো—আহারে মেয়েটা মাত্র অল্প কিছু দিন বাঁচবে।মরবিড ধরনের কথা বন্ধ করতো।ওকে বন্ধ করলাম। আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দাও তোমার কি অফিসে চাকরি নিয়ে কোন সমস্যা হয়েছে? হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

আসমানী বলল, তুমি পাঁচ মিনিটের কথা বলে অফিসে গেলে। এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পরে ফিরে আসলে। তোমার মুখ ছাই বর্ণ। এর পর থেকে লক্ষ্য করছি তুমি কিছুতেই মন বসাতে পারছ না। তারপর কথা নেই, বার্তা নেই বললে এই চাকরিটা তুমি ছেড়ে দিতে চাচ্ছ। দুই এবং দুই মিলিয়ে আমি চার করেছি। আমার অনেক বুদ্ধি।তাইতো দেখছি।

তোমার যে চাকরি চলে গেছে এই খবরটা ভুলেও আমাদের বাসার কাউকে জানাবে না। তাহলে আমাকে মামা জাহাজীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমার সঙ্গে বিয়েটা আগে হয়ে যাক তারপর যা ইচ্ছা থোক। কপালে হাত দিয়ে দেখতো–আমার জ্বর মনে হয় আরো বেড়েছে।হ্যাঁ বেড়েছে।মাইক্রোবাসে উঠেই আমি কিন্তু তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ব। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া। পারবে না? পারব।একটা গাছ দশটা পাখি। তিনটা উড়ে গেল। কটা থাকল?

সাতটা। কেন?

এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।

এটা কি কোন ধাঁধা?

না কোন ধাঁধা না।

ফরহাদ লক্ষ্য করল আসমানী ঠিকমত হাঁটতেও পারছে না। এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছে। জ্বরের আভায় তার মুখ লালচে হয়ে আছে। ফরহাদের মনে হচ্ছে আসমানীর হাত ধরা মাত্র সে এলিয়ে তার কাঁধে পড়ে যাবে। তাদেরকে বেশ অনেক খানি পথ হাঁটতে হবে। মাইক্রোবাস অনেক দূরে অপেক্ষা করছে।আসমানী শরীরটা কি খুব বেশী খারাপ লাগছে? উঁহু।হাঁটতে পারছ?

পারছি। কিন্তু আমার ফিলিং হচ্ছে আমি ভাসতে ভাসতে যাচ্ছি।এসো আমার হাত ধর।হাত ধরব না। হাত ধরলে ভেসে যাবার ফিলিংসটা থাকবে না। আমার মনে হয় তোমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বিপদে ফেলব।কি বিপদ?

মনে হয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। নিউমার্কেটে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। মিনিটের মধ্যে শত শত লোক জমে গিয়েছিল। একটা সুন্দরী এবং তরুণী মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে বিরাট ব্যাপার না? খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। আমি আর হাঁটতে পারছি না—আমার হাত ধর। যদি অজ্ঞান হয়ে যাই—মেঝেতে শোয়বে না। কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। মেঝেতে শোয়ালেই শত শত লোক জমে যাবে, তুমি আর আমাকে ভীড় ঠেলে বের করতে পারবে না। বুঝতে পারছ? পারছি।

 

Read more

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *