জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৩ হুমায়ূন আহমেদ

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৩

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৩

বাবু জীবনকৃষ্ণ রায় ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার ছিলেন। ঘোৱ বিষয়ী মানুষ। পেশকারী আয় ছাড়াও পাটের ব্যবসা, ধানের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেলেন। ইংরেজি ১৯৪০ সালে কেন্দুয়ায় রায় বাজারে নিজ বসত বাটিতে লাখের প্রদীপ জ্বালেন। লাখ টাকা ঘরে থাকলে লাখের প্রদীপ জ্বালাবার নিয়ম। লম্বা একটা বাঁশের মাথায় হারিকেন। হারিকেনের চিমনী লাল রঙ করা। এই হল লাখের বাতি।জীবনকৃষ্ণ রায় লাখের বাতি জ্বালালেন, অষ্টপ্রহর নামগানের আয়োজন করলেন, কাঙ্গালী ভোজ করালেন। তার হাতির খুব শখ। সেই রাতেই দুহাজার টাকা দিয়ে লোক পাঠালেন সুসং দুর্গাপুরে একটা মাদী হাতি কেনার জন্যে। লাখের বাতি জ্বালাবার মহা আনন্দ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। তখন একটা কিছু হল। কি হল তা পরিস্কার না।

হয়ত কোন স্বপ্ন দেখলেন–কিংবা অন্য কিছু। সকালবেলা জীবনকৃষ্ণ বাবুকে দেখা গেল, তাঁর ঘরের উঠোনে জলচৌকির উপর পা তুলে বসে আছেন। তাঁর চোখ লাল উদভ্রান্ত চেহারা। তাঁর বড় ছেলের স্ত্রী সরজুবালা তার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা আপনার কি হয়েছে? তিনি সহজ গলায় বললেন, কিছু হয় নাই।তাঁকে সকালের নাশতা দেয়া হল। কাসার জামবাটিতে এক বাটি কালি-পেঁপে। আরেকটা ছোট বাটিতে সুন্দরবনের খাটি মধু। সকালের নাশতা হিসেবে তিনি পেঁপে, মধু এবং সবশেষে বিশাল এক গ্লাস কুসুম গরম পানি খান। কবিরাজের এই ব্যবস্থা।জীবনকৃষ্ণ রায় দুটুকরো পেঁপে খেয়ে জামবাটি সরিয়ে দিয়ে বললেন, সরকার মশাইকে খবর দাও।সরজুবালা আবার বললেন, আপনার কি হয়েছে বাবা?

তিনি বললেন, আমার মন কিঞ্চিত বিক্ষিপ্ত। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাৰে। তোমরা চিন্তিত হয়ো না। আমারে দিং (বিরক্ত) করবা না।সবাইকে গভীর চিন্তায় রেখে তিনি জলচৌকিতে বসে সরকার বাবুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।সরকার বাবু মোকদ্দমার কাজে কেন্দুয়া গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। দুপুর পর্যন্ত জীবনকৃষ্ণ বাবু জলচৌকিতেই বসে রইলেন। সরকার বাবু আসার পর তাঁর সঙ্গে তিনি কিছু কথাবার্তা বললেন যা পরিবারের অন্য কেউ শুনল না।তিনি বললেন–নিতাই, অমিার মন অস্থির হয়েছে। অস্থিরতা দূর করতে চাই।

নিতাই কিছুই বলল না, তাকিয়ে রইল। জীবন বাবু বললেন, আমি এ জীবনে যত অর্থ উপার্জন করেছি তার সবটাই সৎ কাজে ব্যয় করতে চাই।নিতাই শুকনো গলায় বলল, এটা তো খুবই উত্তম কথা।উত্তম কথা না অধম কথা আমি জানি না। আমার মনের ইচ্ছা তোমাকে বললাম। সেই মত ব্যবস্থা কর।ব্যবস্থা করছি। আপনি খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম করুন।আমার বিশ্রাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। তোমার যা করতে বলছি কর।সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, বললেই তো ব্যবস্থা হয় না। সৎ কাজে অর্থ কিভাবে খরচ করতে চান তাও জানা দরকার। কালি মন্দির বানাবেন? এই অঞ্চলে মন্দির নাই। আপনারা কালির উপাসক…..

মন্দির না। মানুষের সরাসরি কল্যাণ হয় এই ধরনের কোন ব্যবস্থা। রাস্তা ঘাট করতে পারো–ভূমিহীন চাষিদের জমিজমা দিতে পারো। স্কুল করতে পার।স্কুল দিয়ে তো লাভ হবে না। ছাত্র কোথায়? স্কুল চলবে কিভাবে? স্কুল হোক, তারপর দেখবে ছাত্র হবে।জীবনকৃষ্ণ বাবু সৎ কাজে অর্থ ব্যয় শুরু করলেন। তার বিপুল বিত্ত অতি দ্রুত ফুরিয়ে আসতে লাগল। তার পরিবারের লোকজন শুরুতে ধারণা করেছিলেন–মাথায় গন্ডােগোল হয়েছে। ঝাড়-ফুক, গোপন তন্ত্র মন্ত্র সবই করানো হয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই মর্মে কোর্টে আর্জিও জারি করিয়েছিল যাতে জীবনকৃষ্ণ বাবু সম্পত্তিতে হাত দিতে না পারেন।

কোর্ট সেই আবেদন গ্রাহ্য করেনি। জীবনকৃষ্ণ বাবু দুবছরের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। সেবার শীতের শুরুতে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। ময়মনসিংহ থেকে বড় চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করার সঙ্গতি তাঁর ছিল না। এক সময় রোগ গুরুতর আকার ধারণ করল। শ্বাস কষ্ট শুরু হল। মৃত্যু অশুচি। ঘরে মৃত্যু হলে ঘর অশুচি হবে, কাজেই তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ক্ষীণ স্বরে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী নিতাইকে বললেন–নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবীতে এসেছিলাম। নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।

নিতাই বিষণ্ণ গলায় বলল, তাই তো যাচ্ছেন।তিনি আঙুলের ইশারায় তার বসতবাটি দেখালেন। নিতাই ইঙ্গিত বুঝল। বিরক্ত গলায় বলল, আপনার পুত্র এবং পুত্রবধুদের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব আছে। এরা থাকবে কোথায়? জীবনকৃষ্ণ বাবুর পুত্রবধু সরজুবালা বললেন, সবই তো দানে চলে গেছে। সামান্য বসতবাটি দিয়ে কি হবে। বাবার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাঁকে শান্তি মতো যেতে দিন।বাড়ির উঠোনে খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে জীবনবাবু তার বসতবাটি মৌখিকভাবে দান করে গেলেন। তিনি নিঃস্ব হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, নিঃস্ব হয়েই পৃথিবী থেকে ফেরত গেলেন। এমন অসাধারণ ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসেন।

জীবনকৃষ্ণু বাবুর চেহারা কেমন ছিল তার একটা নমুনা স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে আছে। তিন ফুট বাই চার ফুটের বিশাল এক তৈলচিত্র লাইব্রেরীতে টানানো আছে। যেখানে খালি গায়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে এক লোক জলচৌকিতে বসা। ছোট ছোট চোখ। কপালও ছোট। ছোট কপাল ও ছোট ছোট চোখের জন্যে তৈলচিত্রের মানুষটাকে ক্রুর ধরনের একজন বলে মনে হত। ঠোঁটের নিচে বিশাল গোঁফের কারণে সেই ক্রুরতার সঙ্গে মিশেছিল নিষ্ঠুরতা। ছবি দেখে লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ছাড়া ভাঁকে আর কিছু মনে করার কোন কারণ ছিল না।একাত্তরে পাকিস্তানী মিলিটারী এসে ক্যাম্প করল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে। বর্তমান মন্ত্রী সিরাজ সাহেবের বাবা মফিজ সাহেব তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান।

মিলিটারী ক্যাপ্টেন এজাজ মফিজ সাহেবকে বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার মত মানুষ থাকতে হিন্দুর নামে স্কুল, এ ৰ্মেন কথা? মফিজ সাহেব হাত কচলে বললেন, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে যান। সুন্দর একটা ইসলামী নাম।ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, স্কুল কলেজ এইসবের নাম হবে বিশিষ্ট দেশপ্রেমী মানুষের নামে।মফিজ সাহেব বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।স্কুলের নাম দিন কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান স্কুল।আলহামদুলিল্লাহ, বড় সুন্দর নাম। ময়মনসিংহ থেকে সাইন বোর্ড লিখায়ে এনে আপনার হাতে টানায়ে দিব।নতুন সাইন বোর্ড টানানো হল–ক্যাপ্টেন এজাজ নিজের হাতেই নতুন সাইন বোর্ড টানতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব তখন বললেন–স্যার, এইটা আপনি করতে পারেন না। জীবনকৃষ্ণ বাৰু এই অঞ্চলের অতি বিশিষ্ট একজন মানুষ। অতি শ্রদ্ধায় তার নাম স্মরণ করা হয়……

এজাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কে? আমি এই স্কুলের একজন শিক্ষক।তুমি বলতে চাও একজন হিন্দু এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট মানুষ। সে কি কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের চেয়েও বড়?স্যার, উনার নিজের জমিতে উনার টাকায় স্কুল হয়েছে।প্রশ্নের জবাব দাও। উনি কি কায়দে মিল্লাতের চেয়েও বড়? ফজলুল করিম সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, কায়দে মিল্লাত শব্দের অর্থ জানেন? জ্বি স্যার জানি। সমস্যাটা হল–স্কুল বোর্ডের অনুমতি ছাড়া আপনি নাম পাল্টাতে পারেন না।আচ্ছা, ঠিক আছে, স্কুল বোর্ডের সভা ডাকা হোক।

সেই দিন বিকেলেই স্কুল বোর্ডের সভা হল। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল–স্কুলের নাম পাল্টানো হবে।সভা শেষে ক্যাপ্টেন এজাজ হুকুম দিলেন ফজলুল করিম নামের শিক্ষককে নেংটা করে এই স্কুলের চারিদিকে যেন পঞ্চাশবার চক্কর দেয়া হয়।মফিজ সাহেবের ক্ষীণ আপত্তি সত্ত্বেও মিলিটারী হুকুম যথাযথভাবে পালন করা হয়। ফজলুল করিম সাহেবের স্ত্রী তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। খবর শুনে মাথা ঘুরে উঠোনে পড়ে যান। তাঁর মৃত্যু হয় পরদিন ভোরবেলা।

স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন? শব্দটা ঠিক মত আসছে না। ঝনঝন শব্দ না চাপা শব্দ। ব্যাপার কি? ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। হরিপদকে ডাকা দরকার। এই মুহুর্তে ডাকলে সে ঘণ্টা পেটা বন্ধ করে ছুটে আসবে। কাজেই পাঁচটা ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বয়সের কারণে হরিপদের সমস্যা হচ্ছে। গত সপ্তাহেই ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে সে পাঁচটা ঘণ্টা বাজিয়ে বসে আছে। এইসব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না। তিনি দুটাকা ফাইন করেছেন। বেতন থেকে কাটা যাবে। যার প্রধান কাজই ঘণ্টা পেটানো। সে যদি তাতেই ভুল করে বসে তাহলে হবে কিভাবে?

দুটাকা ফাইন করে তার নিজেরও মন খারাপ হয়েছে। দুটাকার মূল্য হরিপদের কাছে অনেক। তারপরেও স্কুলের শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। ক্লাসে ক্লাসে ছেলেরা কান খাড়া করে আছে ঘণ্টা শোনার জন্য। চারটার জায়গায় পাঁচটা ঘণ্টা শুনলে ওদের কেমন লাগবে?ফজলুল করিম সাহেব টিচারদের রোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মমতাজ সাহেব আজও এবসেন্ট। মাহবুব সাহেব এসেছেন ফার্স্ট পিরিয়ডের পর। শিক্ষকদেরও ফাইন করার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল। নিয়ম সবার জন্যেই এক হওয়া উচিত। কারো জন্যে কঠিন নিয়ম। কারো জন্যে সহজ, অ হয় না।

হরিপদ।আজ্ঞে।ঘণ্টা নিয়ে ভেতরে আস।হরিপদ স্কুল-ঘণ্টা বগলদাবা করে ভয়ে ভয়ে ঢুকল। বিনয়ে নিচু হয়ে পড়ল। এখন অবশ্যি বিনয় ছাড়াই তার শরীর নুয়ে পড়েছে। কোমর বেঁকে গেছে। বয়স মানুষকে বাকা করে ফেলে।স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজ ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না ব্যাপার কি? হরিপদ আরো নিচু হয়ে গেল। মাথা প্রায় মাটির সঙ্গে যাচ্ছে।দেখি ঘণ্টা দেখি। ঘণ্টা ঠিক আছে।হরিপদ ঘণ্টাটা টেবিলের ওপর রাখল। ঘণ্টা ঠিক আছে। ফেটে যায়নি। এই স্কুলের সবচে মূল্যবান সম্পত্তি হল–ঘণ্টাটা। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল শুরু হয় এই ঘণ্টা দিয়ে। ফজলুল করিম সাহেব তখন ছিলেন না–কত আগের কথা। তবে তিনি শুনছেন–স্কুল শুরু হবার প্রথম ঘণ্টা জীবনকৃষ্ণ বাবু নিজে বাজিয়েছিলেন। ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কেঁদেছিলেন। কি জন্যে কেঁদেছিলেন? মনের আনন্দে?

হরিপদ? আজ্ঞে? ঘণ্টাতো ঠিকই আছে। শব্দ এরকম হয় কেন? হাতুড়ি চুরি গেছে স্যার। এই জন্যে শব্দ কম হয়।ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত চোখে তাকালেন। কি ভয়ংকর কথা। হাতুড়ি চুরি গেছে। আজ হাতুড়ি গেলে, কাল যাবে ঘণ্টা।কখন চুরি গেছে? কাইল থাইক্যা পাই না।তুমি তো অসম্ভব কথা বলছ হরিপদ। স্কুলের প্রাণ হল তার ঘণ্টা। ঘণ্টা হাতুড়ি থাকে তোমার দায়িত্বে। সেই হাতুড়ি চলে গেল তুমি খবর পর্যন্ত দিলে না। তুমি ঘোরর অন্যায় করেছ। তোমাকে আরো দুটাকা ফাইন করা হল। ঘণ্টার হাতুড়ি চুরি হবার মত কোন বস্তু না। নিশ্চয়ই কোথাও আছে। খুঁজে বের কর।জ্বে আজ্ঞে।মাহবুব সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে তাকে ডেকে আনায় তিনি বিরক্ত। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডেকেছেন?

মাহবুব সাহেব আজকের ফাস্ট পিরিয়ড মিস করেছেন।কাজ ছিল।কাজ থাকলে আগে ভাগে ছুটি নেবেন যাতে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে পারি।হঠাৎ কাজ পড়ে গেল, আগে জানানো সম্ভব ছিল না। ময়মনসিংহ-এর ডিসি সাহেব হঠাৎ চলে এসেছেন। উঠেছেন ডাকবাংলায়…… সকালে তাঁর সঙ্গে চা খেতে বললেন। তাকে তো আর বলতে পারি না–চা খাব না।সেটা কেন বলবেন? চা খেতে ডেকেছে চা খাবেন। আবার আপনার জন্যে ছাত্ররা যাতে অসুবিধায় না পড়ে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবেন। ডিসি সাহেবের সঙ্গে চায়ের চেয়ে ছাত্রদের ক্লাশ অনেক জরুরী। আপনি শিক্ষক মানুষ। এই ব্যাপারটা আপনি ছাড়া কে বুঝবে?

মাহবুব সাহেব চোখ মুখ কঠিন করে বসে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, এইটা বলার জন্যই ডেকেছিলাম। শুধু যে আজই আপনি ক্লাস মিস করেছেন তাই না। গতকালও স্কুলে এসেছেন টিফিন টাইমের পরে।গতকাল স্কুলের কাজেই বাইরে ছিলাম। বাজার কমিটির সাথে একটা সভা ছিল। বাজার কমিটির চাদা ছাড়া তো স্কুল চলবে না। না-কি চলবে? বাজার কমিটির টাকা আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু এদের মিটিং এমনভাবে ফেলতে হবে যেন স্কুল এফেকটেড না হয়। ছুটির দিনে মিটিং করবেন কিংবা সন্ধ্যাবেলা করবেন।

মাহবুব সাহেবের মুখে খুব কঠিন কিছু কথা এসে গিয়েছিল সেই সব কথা তিনি সামলে নিলেন। কঠিন কথা বলার সময় পাওয়া যাবে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে কঠিন কথা ঠিক না। কঠিন কথা বলতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।মাহবুব সাহেব।জ্বি স্যার।আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার আসবেন পরশু সন্ধ্যায়। বিদেশী মানুষ, তাঁর থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়…।দেখি, একটা ব্যবস্থা করব।কি ব্যবস্থা করবেন আমাকে জানাবেন। ষ্টেশনে কাউকে পাঠাতেও হবে উনাকে আনার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম। আমার শরীরটা খারাপ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। শরীর ভাল লাগলে নিজেই যাব।মাহবুব সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললেন সার আমি তাহলে উঠি?

আচ্ছা। মাহবুব সাহেব! জ্বি স্যার।অনেক কঠিন কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। মেজাজও খুব খারাপ, হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি রকম অব্যবস্থা–স্কুলের হাতুড়ি চুরি গেছে। ডাষ্টার দিয়ে ঘণ্টা পিটাচ্ছে…। আচ্ছা যান। আপনার ক্লাসের সময় হয়ে গেল।ফিফথ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব ঘণ্টার শব্দ শুনছেন। হাতুড়ি পাওয়া যায় নি। ঘণ্টার শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে হাতুড়ি পাওয়া যায়নি। ফজলুল করিম সাহেব স্কুলের প্যান্ডে হরিপদের জরিমানা সংক্রান্ত নোটিশ লিখতে শুরু করলেন। সব কিছুর রেকর্ড থাকা দরকার। ফজলুল করিম সাহেব লিখলেন বিষয়ঃ কর্তব্য কার্যে গুরুতর অবহেলা।

সন্ধ্যাবেলা হরিপদ এসে জানালো হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যায় নি। হেডমাস্টার সাহেব তাকে জরিমানার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। হরিপদ বিনয়ে নিচু হয়ে রইল। কিছু বলল না।ফজলুল করিম সাহেব বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা কথা আছে আই হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল ওনলি টু বি কাইন্ড। অর্থাৎ তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছি, তৈমাকে করুণী প্রদর্শনের জন্যেই। বুঝছি জ্বে আজ্ঞে।আচ্ছা যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব। রাতে এক জায়গায় দাওয়াত আছে। কাজেই রাত আটটা পর্যন্ত স্কুলে থাকব। তোমার থাকার কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও।জ্বে আজ্ঞে।যাবার আগে হারিকেনে তেল ভরে দিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়ে যেও।তেল কিনতে হবে স্যার। তেল নাই।

ফজলুল করিম সাহেব দশটাকার একটা নোট বের করে দিলেন।বোতল নিয়ে যাও ছটাকার কেরোসিন আনবে।জ্বে আজ্ঞে।হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করে রেখেছেন যে চারটাকা ফেরত আসবে সেই টাকাটা তিনি রাখবেন না এতে দুটাকা দুটাকা করে যে চার টাকা ফাইন হয়েছিল সেটা হরিপদ সামলে ফেলতে পারবে। বোকা মানুষ বলে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না।ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হরিপদ বারান্দায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। হেড স্যারকে ফেলে সে যেতে পারে না। এটা সম্ভব না।

 

Read more

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল পর্ব – ৪ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *