তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর 

ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প

ইস্কুল মাষ্টারের ছেলে। অনেক দুঃখ কষ্ট সয়ে এম-এ পাশ করলেও মুরুব্বির অভাবে ভাল চাকরি জোগাড় করতে পারল না। শেষ অবধি হলাে কেরানী। এখনকার দিনে কেরানীগিরির আবার দুটো ভাগ হয়েছে, নীচু কেরানীর মাইনে হয় সওয়া শশা থেকে শুরু, আর উচু কেরানীর মাইনে শুরু হয় সওয়া দুশাে টাকা থেকে। মুরুব্বিহীন দুর্গাবিনােদ নীচু ধাপের কেরানী হলাে। তাও জুটলাে অনেক কষ্টে। এম-এ পাশেও কুলােয়নি। এই কেরানীগিরির জন্য আবার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। 

যাক চাকরিটা হয়ে দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান তাে হলাে। দুর্গাবিননাদের পড়াশুনার শখ আছে, সন্ধ্যা সাতটা থেকে সে লাইব্রেরীতে হাজিরা দিয়ে চলল, রাত ন’টা অবধি। দর্শনশাস্ত্রে সে এমএ পাশ করেছে, এবার হিন্দু দর্শনটা সে ভালভাবে বুঝে নিতে চায়। 

ধর্ম কী? ঈশ্বর কী? মানুষ কেমন করে নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে? এই বুঝতে বুঝতে শেষে এসে পড়ে যে সব সাধু সন্ত মহাত্মা সাধনা করতে করতে ভগবদ্ শক্তি লাভ করেছিলেন তাদের কথা। ভারতের সাধকদের যত সব অলৌকিক কীর্তির কথা পড়তে পড়তে দুর্গাবিনােদ সাধু দর্শনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলাে। রবিবারে ছুটির দিনে তার আর বাড়ীতে বসে থাকা চললাে না। কলিকাতার আশেপাশে বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোথায় কোন আশ্ৰম আছে, কোথায় কোন্ তান্ত্রিক থাকেন, সেখানে সে যাওয়া আসা শুরু করলাে। 

তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর 

দুর্গাবিনােদ আশ্রমে যায়, আরাে দশ জনের মাঝে বসে, আশ্রমিক মহাত্মাদের বাণী শােনে, তারপর প্রণাম করে বিদায় নেয়। ফেরার পথে মহাত্মার বাণী মনে  মনে আলােচনা করে, মহাত্মা কত বড় সাধক তার একটা পরিমাপ করার চেষ্টা। করে। মহাত্মার কোন অলৌকিক শক্তি আছে কিনা জানার চেষ্টা করে। 

একদিন খবর পেল হাওড়ার এক গ্রামে এক তান্ত্রিক আছেন তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। জলপড়া দিয়ে অনুশূল সারান, কানে কাঠি দিয়ে কালা মানুষের বধিরতা দূর করেন, কঠিন বাতের বেদনা সামান্য হাত বুলিয়ে আরাম করে দেন। যিনি খবরটা দিয়েছিলেন তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। বাস থেকে নেমে মাইল খানেক হেঁটে গেলে একটি ছােট গ্রাম। গাঁয়ের গােড়াতেই এক পুকুর পাড়ে একটি ছােট মন্দির, মন্দিরের পাশেই একখানি চালাঘর। ঘরের দাওয়ায় একজন জটাধারী সাধু বসে আছেন, সামনে ধুনুচীতে আগুন জ্বলছে, পাশে একটা কলসী ও ভাড়। কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা হাত জোড় করে সামনে মাদুরে বসে আছে। দুর্গাবিনােদও বসে পড়লাে। 

সাধুর বয়স বেশী নয়, তার চেহারা বলিষ্ঠ, রং কালাে, মাথার জটাও বিশেষ দীর্ঘ নয়। চোখ দুটি জবা ফুলের মতাে লাল। তার উপর কপালে লাল চন্দন লেপা। ভক্তির চেয়ে ভয় হয় বেশী। | দুর্গাবিননাদের দিকে নজর ফেলতেই সে হাত জোড় করে প্রণাম জানালাে। সাধু নিজে থেকেই বললেন -কী চাই? গুরু? গুরু মেলা অত সহজ নয়, আগে নিজেকে তৈরী কর, তারপর শুরু। পাত্র ফুটো হলে জল রাখবি কেমন করে? আধার ঠিক না হলে মন্ত্রশক্তি ধারণ করবি কেমন করে? সে মন্ত্র যে দেবে তার কোন লাভ নেই, যে নেবে সেও ব্যর্থ হবে। তৈরী হ’। 

দুর্গাবিনােদ ভরসা পেল। বললাে – কিভাবে তৈরী হতে হবে ? বাক্ সংগম কর, বেশী কথা বলবি না। নিরামিষ আহার করবি। অযথা কোন পরিশ্রম করবি না, শক্তি সঞ্চয় করবি। সন্ধ্যার পর কোন মন্দিরে বা গঙ্গার তীরে চুপ করে ঈশ্বরের ধ্যান করবি। ধীরে ধীরে মন আত্মস্থ হবে, চিত্ত দৃঢ় হবে। তখন গুরুমন্ত্র নিয়ে সাধন-ভজনের কথা উঠবে, তার আগে কিছু হবে না। 

তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর 

দুর্গাবিনােদ এতদিনে যেন একটা আলাে দেখতে পেল। গুরু ও মন্ত্রের কথাটা সে ভেবেছে, কিন্তু এমন ভাবে তার হদিশ কেউ তাকে বাতলাতে পারেনি। তান্ত্রিকের উপর তার বিশ্বাস হলাে। প্রথম দর্শনেই এমনভাবে মনের কথাটা টেনে বলা সহজ নয়। 

 বিকাল অবধি দুর্গতিনাদ কালীবাব ইল। অবধূত কালীবাবা আর তার সঙ্গে কোন কথা বললেন ।খে, উড়ে মদ ঢালেন আর খান। আর অসুস্থদের রােগের কথা শােনে ওষুধও দেন। ওষুধ মানে কাউকে খুনির দুই, কাউকে খুগে কাঠি। এই দুইটা তিন ভাগ করে তিন দিন সকালে খালি পেটে এই কাঠিটা একটা তামার মালিতে ভর ধারণ করবি ইত্যাদি। 

বিকেলবেলা দুর্গাবিননাদ প্রণাম জানি উঠে পড়লাে। কালীবাবা একবার তাকিয়ে হাসলেন শুধু। | গাবিনােদ অনেক আশ্রমে ঘরেছে, অনেক মহাৱাজকেন করছে, দিনের || পর দিন অনেকের উপদেশ বাণী শুনেছে। কিন্তু কালীবাবার মতাে অলৌকিক ক্ষমতা কারও দেখেনি। দুই দিয়ে রােগ সারানাে, কানে কাঠি দিয়ে বধির আরাম করা, হাত বুলিয়ে বাতের বেদনা মুক্ত করা এসব বড় কম শক্তির কথা নয়। এই মানুষটি কিছুটা ঐশ্বরিক শক্তি যে আয়ত্তে এনেছে – একথা মানতেই হবে। দুর্গাবিনােদ কালীবাবার কাছে নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু করলাে। যদি ইনি প্রসন্ন হয়ে কৃপা করেন, তাহলে দুর্গবিনােদও একদিন কৃতার্থ হবে। 

কালীবাবা সেই যে প্রথম দিন কথা বলেছিলেন, তারপর থেকে আর কথাই বলেন না। প্রণাম করলে হাসেন আর হাত তুলে বলেন – জয়।দুর্গাবিনােদ এদিকে নিরামিষ খাওয়া শুরু করেছে, কথা কম বলে, অনর্থক কোন মােরাফেরা করে পরিশ্রম করে না। রাত বারােটা অবধি বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। কালীবাবার কথা মতাে নিজেকে সে দীক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত করে তুলেছে। 

তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর 

হঠাৎ একদিন মাস দুয়েক পরে কালীবাবা বললেন – তুই তাে রবিবারে আসিস, আসছেশনিবারে আয় না। সেদিন অমাবস্যা, রাতে মায়ের পুজো দেখবি।এ তাে আমার সৌভাগ্য। 

– সন্ধ্যায় চলে আসবি। রাতে এখানে থাকবি। সারা রাত জাগতে পারবি ত? আমি সারা রাত পূজো করি। 

– একটা রাত তাহলে আসার সময় মায়ের পুজো নিয়ে আসিস।কী আনতে হবে বলুন ? তুই আর কী আনবি? তিন বােতল দেশী মদ আনবি। কারণবারি  তাতেই হবে।কালীবাবা গুণ করে উঠলেন – মদ খাই মা কাণী বলে – তারপর কলসী থেকে এক ভাড় মদ নিয়ে গলায় ঢাললেন। 

 দুর্গাবিনােদ সেদিন খুশি হলাে। কালীবাৰা মদ চেয়েছেন। পূজো দেখার জন্য ডেকেছেন। এবার তিনি প্রসন্ন হবেন। উৎফুল্ল মনে দুর্গাবিনােব সেদিন বাড়ী ফিরলাে।শনিবার সন্ধ্যায় এক রেশন ব্যাগের মধ্যে তিন বােতল দেশী মদ নিয়ে গাবিনােদ কালীবাবার আশ্রমে এলাে, তখন ঘরে ঘরে আলাে জ্বলছে। কালীবাবা দাওয়ায় বসেছিলেন, বললেন – এনেছি? দে—বােতল তিনটি নিয়ে কালীবাবা মন্দিরে চলে গেলেন, বললেন – দু বা এখন বােস, পুজোর সময় আমি তােকে ডাকবাে। | মাদুর পাতা ছিল, দুর্গাবিনােদ সেই মাদুরের ওপর উঠে বসলাে। 

ক’ মিনিট বসে থাকার পরেই দুর্গতিনােদ বুঝলাে রাতের অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকার মতাে স্থান সেটা নয়। কানের পাশে মশার ডাক আর থামতে চায় না। বুদ্ধি করে দুর্গবিনােদ রেশনের থলির মধ্যে একখানা চাদর এনেছিল। এবার সেই চাদরখানা দিয়ে আপাদমস্তক মুড়ে দিল। শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে রইল। তবু মনে হয় যেন মশা কামড়াচ্ছে। | সামনে অন্ধকার, মাঠ ঘাট গাছপালা সবই কালােয় মিশে গেছে।

তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর

অনেকটা তফাতে দু-তিনটে ঘরের জানলায় আলাে দেখা যাচ্ছে। কাছাকাছি মানুষ আছে বলে মনে হয় না। কালীবাবার এই ঘরখানাতেও কেউ থাকে না। তার পরিজনরা থাকে ওই গ্রামে। এখানে কালীবাবা একা থাকেন, সাধন-ভজনের জন্য। ঝিৰি পােকা ডাকছে। চারিপাশে নিঝুম। এই তাে সন্ধ্যা হয়েছে, এরই মধ্যে মনে হয় রাত যেন দুপুর হয়ে গেল।এভাবে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। কালীবাবাও তাে মন্দিরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। 

পাশে একজন কথা বলার মানুষ থাকলে ভাল হতাে। বড় একা একা মনে হয়। দেয়ালে হেলান দিয়ে দুর্গাবিনােদ বিমুতে শুরু করে। | দুর্গাবিনােদ কোন এক সময় বােধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। সহসা ঘুম ভালাে | কালীবাবার ডাকে — আয় উঠে আয় এবার মায়ের আরতি হবে।ধড়মড় করে উঠে দুর্গবিনােদ কালীবাবার অনুসরণ করলাে।মন্দিরের মধ্যে পিদিম জ্বলছে। ধূপধুনায় অন্ধকার। ছােট প্রতিমাটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। সামনে কিছু জবা ফুল, আর মদের তিনটে বােতল। কালীবাবা আসনে গিয়ে বসলেন, বললেন – তুই দরজার বাইরে বােস। 

দুর্গাবিনােদ বাইরে বসে পড়লাে। কালীবাবা ওঁ হ্রীং বলে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। মাঝে মাঝে জবা ফুল তুলে প্রতিমার চরণে অৰ্য্য দিতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক এইভাবে পূজা করার পর হাঁক দিয়ে উঠলেন -~~ মা কালী করালবদনা-লােল-জিহ্বা মা তারপর পঞ্চপ্রদীপের আরতি শুরু করলেন। এবার প্রদীপের আলােয় ধোঁয়ার মাঝেও কিছু কিছু নজরে পড়তে লাগল। | দুর্গাবিননাদ দেখলাে ঘরের মধ্যে দরজার পাশে আরেকজন কে বসে আছে। ও কে? কখন এলাে? 

পঞ্চপ্রদীপ ঘুরতে ঘুরতে আলােটা যখনই সেদিকে পড়ে দূর্গাবিনােদ লােকটির মুখের পানে নজর করে। কি বিশ্রী ফ্যাকাশে মুখ, যেন মড়ার মতাে। | আরতি শেষ হয়। শাঁখ বাজিয়ে কালীবাবা বসলেন। মদের তিনটি বােতল মায়ের চরণে স্পর্শ করিয়ে হাক দিলেন – মা কালী করালবদনা … লােল জিহ্বা মা তারপর বললেন-প্রণাম কর –প্রসাদ নে – দুর্গাবিনােদ প্রণাম করলো। বােতল থেকে এক ভাড় মদ ঢেলে কালীবাবা বসে থাকা সেই লােকটির মুখে ধরলেন, বললেন — খাও। 

তান্ত্রিক–ধীরেন্দ্রলাল ধর

লােকটি মদ খেলাে। কালীবাবা সেই ভাড়ে আবার মদ ঢাললেন। তাকে বললেন – ধরাে, ওকে দাও লােকটি ভাড় ধরলাে, হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল দুর্গাবিননাদের দিকে।মানুষের হাত যে এতটা লম্বা হয়, দুর্গাবিননাদ তা জানতাে না। ভাড় শুদ্ধ হাতখানা সােজা দরজা পার হয়ে চলে এলাে তার মুখের কাছে।দুর্গাবিনােদ থ’। 

 ভয় পাসনি, খা, মায়ের প্রসাদ –কালীবাবা বললেন। দুর্গাৰিনােদ তাকিয়ে দেখলাে। হাতখানায় কোথাও এতটুকু মাংস নেই, সবটাই কঙ্কাল। হাতের মালিকের পানে তাকালাে — মুখ কই, কঙ্কালের করােটি।দুর্গাবিননাদের সারা দেহ কেঁপে উঠলাে। – না না বলেই এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠেই সে ছুটলাে। সােজা পথ দিয়ে সে ছুটলাে। কানে এল পিছনে কে যেন অট্টহাসি হাসছে। 

সেই অন্ধকার পথে পুরাে দু’মাইল ছুটে এসে দুর্গাবিনােদ থামলাে একেবারে বাজারের মধ্যে। তখনও সকাল হতে অনেক দেরী। ভয়ে ভয়ে সে পিছন পানে তাকালাে, পিছনে কেউ আসছে কিনা। বাজারে অনেক ঘরের দাওয়ায় মানুষ শুয়েছিল। তাদের দেখে দুর্গাবিনােদ ভরা পেল। একটা দোকানের দাওয়ায় সে বসে পড়লাে।পরক্ষণেই মনে হলাে সেই হাতখানা তার মুখের সামনে মদের ভাড়টা যেন এগিয়ে ধরেছে। দুর্গাবিনােদ চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল। সকালে বাজারের লােকেরাই দুর্গবিনােদকে বাসে তুলে দিয়েছিল। ওয়ের ভাবটা কাটিয়ে উঠতে কদিন তার সময় লেগেছিল। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *