দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি প্রায়ই কিছু অদ্ভুত চরিত্র নিয়ে ভাবিএমন কিছু চরিত্র যাদের কখনো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে নাঅবশ্য ধরনের চরিত্র নিয়ে কিছু লিখতে ভরসা হয় নাকারণ আমি জানি লেখা মাত্র আমাকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হবেদুই দুয়ারী

পাঠক পাঠিকা জানতে চাইবেন, লােকটা কে?সে কোত্থেকে এসেছে?ব্যাপারটা কি?কি হচ্ছে ?আমি এসব প্রশ্নের জবাবি জানি না। অবশ্য সব প্রশ্নের জবাব যে জানতেই হবে তারও তাে কোনাে কথা নেইএই ভেবেই শেষ পর্যন্ত লিখে ফেললামলেখার খসড়া একটি ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলপুস্তকাকারে পরিপূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হলোকেউ গুরুত্বের সঙ্গে এই লেখাটি বিবেচনা না করলেই খুশী হবে। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ ১লা বৈশাখ ১৩৯৮ 

মতিন সাহেব গাড়ির একসিলেটর আরাে খানিকটা নামিয়ে দিলেনস্পীডােমিটারের কাঁটা সত্তর থেকে আশিতে চলে এলময়মনসিংহঢাকা হাইওয়েফাঁকা রাস্তা, ঘন্টায় আশি কিলােমিটার কিছুই নামতিন সাহেবের ছােট মেয়ে মিতু পেছনের সীটে বসে আছেতার হাতে সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লারওনা হবার সময় সে পড়তে শুরু করেছে এখন আর অল্প কিছু পাতা বাকিমনে হচ্ছে ঢাকায় পৌছবার আগেই সে বইটা শেষ করতে পারবেগাড়ি শালবনের ভেতর ঢুকলমতিন সাহেব গাড়ির স্পীড আরাে খানিকটা বাড়িয়েদিলেনস্পীড বাড়াতে শুরু করলে নেশার মত হয়ে যায়শুধু বাড়াতেই ইচ্ছা করেমিতু বই বন্ধ করে মিষ্টি গলায় ডাকল, বাবা

মতিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, কি মা? ঢাকায় পৌছতে আর কতক্ষণ লাগবে? পঁয়তাল্লিশ মিনিট, গিভ এণ্ড টেক টেন মিনিটসগিভ এণ্ড টেক টেন মিনিটস মানে কি বাবা?” 

তিনি প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন নাআচমকা আতংকে জমে গেলেনরাস্তার মাঝামাঝি একটা লােক দাঁড়িয়ে আছেসরে দাঁড়ানাের কোন লক্ষণ দেখাচ্ছে নাযে গাড়ি ঘণ্টায় নব্বই কিলােমিটার যাচ্ছে তাকে মুহূর্তের মধ্যেথামানাে সম্ভব নয়লােকটির পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার মত জায়গা কি আছে

দুই দুয়ারী-পর্ব-১-হুমায়ুন আহমেদ

মতিন সাহেব একই সঙ্গে হর্ন এবং ব্রেক চাপলেনচাপা গলায় বললেন, মাই গড়মাই গড। 

ধ্বক করে শব্দ হল| লােকটি গাড়ির মাডগার্ডে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার এক পাশেগাড়ি তাকে ছাড়িয়ে ত্রিশ গজের মত এগিয়ে পুরােপুরি থামলমতিন সাহেব ইগনিশন সুইচ বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। 

 মিতুর মুখ আতংকে শাদা হয়ে আছেকপালে বিন্দু বিন্দু ঘামপাতলা ঠোট কালচে দেখাচ্ছেমিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা লােকটা কি মারা গেছে? মতিন সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতে মুছতে বললেন, আমার তাই ধারণা। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

এখন আমরা কি করব বাবা?কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব। 

তিনি গাড়ির গ্লোব কম্পার্টমেন্টে সিগারেটের জন্যে হাত বাড়ালেনতাঁর মনে পড়ল দুমাস আগে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেনগ্লোব কম্পার্টমেন্টে একটা টর্চলাইট ছাড়া কিছুই নেইতিনি চোখ বন্ধ করে বসে আছেনরকম একটা ঘটনা ঢাকা শহরে ঘটলে কি হত দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছেনএতক্ষণে হাজারখানিক লােক জমে যেতগাড়ির কাচ ভাঙ্গতােতাকে এবং মিতুকে গাড়ি থেকে টেনে নামাতােকিছু লােক একত্র হলে এক ধরনের হিংস্রতা আপনা আপনি জেগে ওঠেমুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটে। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

মতিন সাহেব গাড়ির দরজা খুললেন। মিতু ভীত গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছ বাবা

লােকটাকে দেখে আসিআমার ভয় লাগছেভয়ের কিছু নেই। 

তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর নিজেরই ভয় লাগছেগায়ে কাঁটা দিচ্ছেমুখে থুথু জমা হচ্ছেপ্রচণ্ড ভয় পেলে শরীরের হরমােনাল ব্যালান্স নষ্ট হয়বমি ভাব হয়, মুখে থুথু জমতে থাকে। 

মিতু ক্ষীণ গলায় বলল, তাড়াতাড়ি এসাে বাবাআমার কেমন জানি লাগছেতিনি এগিয়ে গেলেনলােকটি মরে গিয়ে থাকলে কি করবেন বুঝতে পারছেন নাএখানে ফেলে রেখে যাবেন? নাকি তাঁর বাচ্চা মেয়ের পাশে রক্তমাখা একটা 

ডেডবডি নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হবেনমিতুর জন্যে তা হবে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাসেই অভিজ্ঞতার জন্যে তাঁর মেয়ে এখনাে তৈরী নয়শুধু তাঁর মেয়ে নয়, তিনি নিজেও তৈরী ননমতিন সাহেব এক দলা থুথু ফেললেন। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

মতিন সাহেব লােকটির পাশে দাঁড়াতেই সে উঠে বসলমাথা উঁচু করে তাকাললােকটির চোখ পিট পিট করছেসূর্যের আলাে পড়েছে তার চোখেসে ভালমত তাকাতে পারছে নামতিন সাহেব পুরাে হকচকিয়ে গেলেন। 

লােকটি বেঁচে আছেতা এখনাে মতিন সাহেবের কাছে বিশ্বাসযােগ্য তথ্য হিসেবে ধরা পড়ছে নাতবে বেঁচে আছে তাতে দেখাই যাচ্ছেএই তাে লােকটার গায়ের নীল হাফশার্টে রক্তের ছােপকালো রংয়ের প্যান্টের হাঁটুর কাছটা ছেড়ামতিন সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, আপনি বেঁচে আছেন

 সে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল, যেন বেঁচে থাকার অপরাধে সে অপরাধী। মরে গেলেই যেন ব্যাপারটা শোভন এবং সুন্দর হত। 

আপনি কি উঠে দাঁড়াতে পারবেন? জ্বি। 

লােকটি উঠে দাঁড়ালতার হাঁটুর কাছেও অনেকখানি কেটেছে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

থ্যাংক গড় যে, আপনি বেঁচে আছেনএখানে দাঁড়িয়ে থাকুনআমি গাড়ি ব্যাক করে আনছিআপনাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। 

লাগবে নাডাক্তার পরীক্ষা করে দেখুকআপনার তাে বেঁচে থাকারই কথা না। 

সে হাসলমতিন সাহেব লােকটির দিকে ভাল করে তাকালেনঅসম্ভব রােগা লম্বা একজন মানুষঅতিরিক্ত রকমের ফর্সাহাতের নীল শিরা চামড়া ভেদ করে ফুটে রয়েছেসরল ধরনের লম্বাটে মুখচোখে এক ধরনের শান্ত ভাব আছে, যা শুধুমাত্র পশুদের চোখেই দেখা যায়| গাড়িতে উঠেই লােকটি ঘুমিয়ে পড়লএটা ভাল লক্ষণ নাপ্রচণ্ড আঘাতে মস্তিষ্কে রক্তপাত হলে ঘুম পায়সেই ঘুম সচরাচর ভাঙ্গে নাঘুমুতে ঘুমুতে কমায় চলে যায়কমা থেকে মৃত্যু। 

দুই দুয়ারী-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা উনি কি ঘুমুচ্ছেন

হা মাউনার কিন্তু খালি পা। 

তিনি তাকিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি খালি পাপায়ে নিশ্চয়ই স্যাণ্ডেল ছিল ছিটকে পড়েছেলােকটিকে গাড়িতে ওঠানাের সময় খেয়াল হয়নিএখন স্যাণ্ডেলের জন্যে আবার ফিরে যাবার কোন অর্থ হয় না| মিতুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাব এখনাে দূর হয়নিতার বয়স দশবছর ক্লাস ফাইভে উঠেছেতার ক্ষুদ্র জীবনে এমন ভয়ংকর ঘটনা আর ঘটেনিসে সােনার কেল্লা বইটা তার চোখের সামনে ধরে রেখেছে কিন্তু বইমন দিতে পারছে না। 

বাবা!কি মাআমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছেকিসের ভয়?মনে হচ্ছে উনি মরে গেছেন। 

আরে দূরতুমি চুপচাপ বই পড়তে থাকআমি বরং গান দিয়ে দিদেব?দাও। 

ভল্যুম অনেকখানি বাড়িয়ে মতিন সাহেব ক্যাসেট চালু করলেনতিনি ভেবেছিলেন গানের শব্দে লােকটি জেগে উঠবেতা হল নালােকটি সীটে হেলান দিয়ে পাথরের মত পড়ে আছে

 

 

Read More

দুই দুয়ারী-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *