নি পর্ব:০৮ হুমায়ূন আহমেদ

নি পর্ব:০৮

পাড়াগায় যারা থাকে তাদের জীবন মোটামুটি নিস্তরঙ্গ। বড় ধরনের কিছু চারপাশে ঘটে না। দুরবিন নিয়ে কেউ উপস্থিত হলে তাকেই মনে হয় গ্যালিলিও। আসলে তার প্ৰতিভা হয়তো ঐকিক নিয়মে ভালো অঙ্ক করায় সীমাবদ্ধ। কাউকে স্পেসিফিক্যালি মিন করে আমি বলছি না। তুমি রাগ করো না।আমি রাগ করছি না। ব্যাপারটা সত্যিা হলে রাগ হতো। সত্যি না বলেই রাগের বদলে হাসি পাচ্ছে।তোমার স্যার সম্পর্কে আমি এমন একটা কথা জানি যা শুনলে তুমি হয়তো রাগ করবে।বলুন।শুনেছি তিনি গম চুরি করেছেন। স্কুলের বরাদ্দ একশ মণ গম লোপাট করে দিয়েছে। তার নামে কেস হয়েছে।কে বলেছে আপনাকে?

এটা কোনো গোপন ব্যাপার না। আমি তোমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি।তিনি আপনাকে কখন বললেন, আজ? হ্যাঁ।বাবা খুব ভালো করেই জানেন এটা মিথ্যা। তার পরেও তিনি এটা আপনাকে কেন বলেছেন তা কি আপনি বুঝতে পারছেন? না।জানি বুঝতে পারবেন না। কারণ আপনার এত বুদ্ধি নেই। যদি আপনার খানিকটা বুদ্ধি থাকত তাহলে আপনি বুঝে ফেলতেন যে বাবা এটা আপনাকে বলছেন যাতে আপনার সব রাগ গিয়ে ঐ মানুষটার উপর পড়ে। যাতে আপনি ভাবতে শুরু করেন যে, সব দোষ ঐ চোর মানুষটার। রূপা নামের মেয়েটার কোনো দোষ নেই।

তানভিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রূপা মেয়েটি তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। গ্রামে বড় হওয়া বাচ্চা একটা মেয়ে এমন গুছিয়ে কথা বলছে–আশ্চর্য! তানভিব বলল, এই চেয়ারটায় বস রূপা। মেজাজ ঠাণ্ডা কর, তারপর কথা বলি। রূপা বলল, আমার মেজাজ খুব ঠাণ্ডা আছে। কেন আমার মেজাজ এত ঠাণ্ডা তা জানেন? না।একদিন না একদিন এ-রকম একটা ব্যাপার ঘটবে তা আমি জানতাম! একদিন সবাই জানবে। তুমুল হৈচৈ শুরু হবে। মা ক্রমাগত কাঁদতে থাকবেন। বাবা স্তম্ভিত হয়ে বাবান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকবেন। এটা আমি জানতাম। এই ঘটনার জন্যে আমার মানসিক প্ৰস্তৃতি ছিল বলেই আমি এত সহজভাবে সব কিছু নিতে পারছি।

তানভির বলল, আমি তাই দেখছি। এবং খানিকটা বিস্মিতও হচ্ছি। তোমার স্যার অসাধারণ কি-না জানি না, তবে তুমি অসাধারণ।রূপা বাবান্দা থেকে চলে এলো। আসলেই তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মনে হচ্ছে এখনো কেউ খাদ্য নি। আজ রাতে কি এ বাড়িতে খাওয়া হবে না? রূপা রান্নাঘরে ঢুকাল। রূপার মা রান্নাঘরে মোড়ায় একা একা বসে আছেন। রূপা বলল, প্ৰচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে মা। আমাকে ভাত দিয়ে দাও। আজ কী রান্না? রূপার মা দীর্ঘ সময় মেয়েব দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বৌমা যা বলল তা-কি ? হ্যাঁ, সত্যি। এখন তোমাবা কী কববে? বটি দিয়ে কুপিয়ে আমাকে কুচিকুচি কবে নদীতে ফেলে দেবে? রূপার মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই ঠিক কবে বল তো মা ঐ হারামজাদা মাস্টার কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে?

রূপা শান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে ছোট করতে চাও, কর। কিন্তু মা উনাকে ছোট করবে না। উনি এসব কিছুই জানেন না।রূপার মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, হারামজাদা জানে না মানে? হারামজাদা ঠিকই জানে। জেনেশুনে সে তোকে জাদু করেছে। তুই হচ্ছিস গাধার গাধা। মহাগাধা। তুই কিছুই বুঝতে পারিস নি। তোর বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছে। সে ঐ ছোটলোকটাকে এমন শাস্তি দেবে যে সে তার বাপ-মার নাম ভুলে যাবে।কী শান্তি দিবে? খুন করবে?

কথা বলিস না তো। তোর কথা শুনে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। তুই যা আমার সামনে থেকে।তিনি শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। রূপা নিজের ঘরে চলে এলো। তার অসম্ভব ভয় লাগছে। বাবা মাস্টার সাহেবকে শাস্তি দেবেন। এটা নিশ্চিত। তার অপরাধে শান্তি পাবে অন্য একজন। কী শাস্তি কে জানে। মেরে ফেলবেন না নিশ্চয়ই। মানুষ এত নিচে নামতে পারে না। চেষ্টা করেও পারে না। স্কুলের চাকরি চলে যাবে। তাকে নীলগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা হলে শাপে বর হয়। সেও স্যারের সঙ্গে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে কোথাও। যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। কেউ না।

মিনু এসে ডাকল, খেতে আস রূপা।রূপা বলল, ক্ষিধা মরে গেছে ভাবি। তোমরা খাও। আমি কিছু খাব না।তোমার ভাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, খেয়ে আমার ঘরে আস।আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না ভাবি। আমার প্রচণ্ড মাথা ধবেছে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব।তোমার ভাই কিন্তু রাগ করবে।রাগ যা কবার করেছে। এখন দেখা করতে গেলেও সেই রাগের উনিশ-বিশ হবে না। আমি সকালে কথা বলব।আফজাল সাহেব রাত এগারোটায় ভাত না খেয়েই জুতা-জামা পরে ঘর থেকে বেবোলেন। রফিক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন নি। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা এখন তার নেই। রফিক বলল, আমি কী সঙ্গে আসব বাবা?

তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।রফিক সঙ্গে চলল। বাবা প্ৰচণ্ড রেগে আছেন। তার হাই ব্লাড প্রেসার। এ রকম অবস্থায় তাকে একা ছাড়া উচিত না। তাছাড়া আকাশের অবস্তা ভালো না। যে৬াবে মেঘ ডাকছে তাতে মনে হয় ঝড়-টড় হবে।রাস্তায় নেমেই রফিক বলল, যাচ্ছেন কোথায় বাবা? থানায় যাচ্ছি।থানায়? হুঁ। ওসি সাহেবকে বলব, ঐ শুওরের বাচ্চাকে কাল যেন কোমরে দড়ি বেঁধে হজিতে নিয়ে ঢোকায়। নীলগঞ্জের সমস্ত মানুষ যেন তাকে দেখে।ওসি সাহেব কি এটা করবেন?

অবশ্যই করবে। থানার বড় সাহেবরা যে কোনো অন্যায় আগ্রহ নিয়ে কবে। আর এটা কোনো অন্যায় না। ব্যাটার বিরুদ্ধে কেইস আছে। গম চুরির কেইস।রফিক বলল, হাজতে নিয়ে ঢুকানোর আইডিয়াটা মন্দ না বাবা। রূপা যদি শোনে চুরির অপরাধে ব্যাটাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাহলে তার মোহভঙ্গ হতে পাবে।‘ মোহভঙ্গ হোক আর না হোক, হারামজাদার বিষদাঁত আমি ভেঙে দেব। ন্যাংটো করে সারা নীলগঞ্জ আমি তাকে ঘুরাব। কুত্তা লেলিয়ে দেব। আমি খেজুরের কাটা দিয়ে ঐ কুত্তার চোখ গেলে দিব।এত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ট্যাকল করব। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।

রূপা ঘুমুতে গেল বৃষ্টি নামার পর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর ধুয়েমুছে যাবে। রূপেশ্বর এবার বান ডাকবে। নিশ্চয়ই ডাকবে। ভাবতেই রূপার ভালো লাগছে। ডাকুক, ভয়াবহ বান ডাকুক। নীলগঞ্জ ধুয়ে-মুছে যাক রূপেশ্বরের জলে।বাতি নেভাতেই জেবা ডাকল, ফুপু।রূপা বলল, হুঁ।বাড়িতে এখন দুটা দল হয়ে গেছে।হুঁ, হয়েছে।তোমার এক দল আর বাকি সবার দল।রূপা কিছু বলল না। আসলে কোনো কিছুই সে শুনছে না। প্রচণ্ড জ্বরের সময় যেমন হয় এখন তার তাই হচ্ছে। কোনো কথা পরিষ্কার তার মাথায় ঢুকছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।জেবা বলল, ওদের দলে এত মানুষ আর তোমার দলে আছি শুধু আমি। দুজনের দল–তাই না ফুপু?

হুঁ।নদীর দিক থেকে শো-শো শব্দ আসছে। রাত যত বাড়ছে শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছে।রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, এ বছর রূপেশ্বর নদীতে বান ডাকবে।বান ডাকলে কি তুমি খুশি হও ফুপু? হ্যাঁ হই। জলের তোড়ে ভেসে গেলে খুশি হই। জেবা হাসল। খিলখিল হাসি। অন্ধকারে তার হাসি অদ্ভুত শোনাল। মনে হচ্ছে সে হাসি যেন কলকল শব্দে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।ফুপু।ফুপু ফুপু করবি না তো। ঘুমো।একটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ব। কথাটা হচ্ছে–কাল সকালটা তোমার জন্যে খুব কষ্টেব্য হলে। খুব কষ্টেল, তবে আমি তো তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে।তোমার কথার আগা-মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না জেবা। তুমি কি সব সময় এরকম পাগলের মতো কথা বলে?

আমি কোনোদিনই পাগলের মতো কথা বলি না। কিন্তু সবাই মনে করে আমি পাগলের মতো কথা বলি।ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও।ফুপু।আর একটা কথাও না। ঘুমাও তো।আমি কী আমার একটা হাত তোমার গায়ে রাখতে পারি? না।আচ্ছা আমি ঘুমুচ্ছি। তুমি ঘুমাও।আমার ঘুম আসবে না।আসবে। এক্ষুণি আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।রূপা শুয়েছে। বৃষ্টির জন্যেই একটু শীত শীত লাগছে। গায়ে পাতলা চাদর দিতে পারলে ভালো হতো। আলসি লাগছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুমের মধ্যেই রূপা শুনতে পাচ্ছে, জেবা বলছে–দেখলে ফুপু, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ঘুম! ঘুম!! নীলগঞ্জ এমনই এক জায়গা যেখানে কখনো নাটকীয় কিছু ঘটে না। কারো বড়শিতে বড় মাছ ধরা পড়লে অনেক দিন সেই মাছ ধরার গল্প হয়। আসরে গল্প হিসেবে মাছেব প্ৰসঙ্গ আসে–ধরেছিল একটা মাছ, পুব পাড়ার নীলমাধব। একটা জিনিসের মতো জিনিস…

সেই নীলগঞ্জে আজ ভোরবেলা ভয়াবহ এক নাটক হচ্ছে। অচিন্তনীয় একটা ঘটনা ঘটছে। নীলগঞ্জের মানুষ এতই হকচকিয়ে গেছে যে কিছু বলতে পারছে না। পাশের জনকে ফিসফিসিয়েও কিছু বলছে না। দৃশ্যটা হজম করতে সবারই সময় লাগছে। তাবা অবাক হয়ে দেখছে নীলগঞ্জ স্কুলের স্যার মবিনুর রহমানকে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে যাচ্ছেন ওসি সাহেব। তার চোখে সানগ্লাস। সানগ্লাস থাকাব কারণে তাঁর মুখের ভাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোমরের দড়ি ধরে যে পুলিশটি যাচ্ছে তাকে খুব বিমর্ষ মনে হচ্ছে। সে হাঁটছে মাথা নিচু করে। মবিনুব রহমানের পেছনেও দুজন পুলিশ। তারাও মাথা নিচু করে হাঁটছে।

মবিনুর রহমানকে অত্যন্ত বিস্মিত মনে হচ্ছে। এই গরমেও তিনি একটা কোট গায়ে দিয়েছেন। তার হাতে টেলিস্কোপের বাক্সটা আছে। বাক্সটা কিছুক্ষণ পর পর এ হাত থেকে ও হাতে নিচ্ছেন।ওসি সাহেব মবিনুর রহমানকে বললেন, সিগারেট খাবেন? মবিনুর রহমান বললেন, জি না।ওসি সাহেব বললেন, আপনার ঐ টেলিস্কোপটা কনষ্টেবলের হাতে দিয়ে দিন। হাঁটতে আপনার কষ্ট হচ্ছে।কষ্ট হচ্ছে না। এর ওজন বেশি না। থ্রি পয়েন্ট টু কেজি।সাবধানে পা ফেলুন, ভীষণ কাদা।ওসি সাহেবরা আসামিদের সঙ্গে এই ভঙ্গিতে কথা বলেন না, বিশেষত যে আসামিকে কোমরে দড়ি বেধে নিয়ে যেতে হয়। এই আসামির বেলায় তিনি কিছু ব্যতিক্রম করেছেন। শুরুতেই আপনি বলে ফেলেছেন। শুরুতে আপনি না বললে এই যন্ত্রণা হতো না।

এই লোকটা গম চুরির সঙ্গে জড়িত না তা তিনি বুঝতে পাবছেন। এটা বোঝার জন্যে এগারো বছর ধরে ওসিগিরি করতে হয় না। লোকটাকে কায়দা করে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আগে মনে হচ্ছিল পুরো ব্যাপারটার পেছনে আছে হেডমাস্টাব হাফিজুল কবির। এখন মনে হচ্ছে আরো অনেকেই আছে। বিশেষ করে আফজাল সাহেব আছেন।একটা নিরপরাধ লোককে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আফজাল সাহেবের কারণে। তিনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন যেন কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার বাড়ির সামনে নিয়ে নেয়া হয়।

আফজাল সাহেব এই অঞ্চলের অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এদের কথা শুনতে হয়। না শুনলে এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালানো যায় না। বড়দারোগাগিরি সহজ জিনিস নয়। অনেকের মন রেখে চলতে হয়। এমন সব কাজ করতে হয় যার জন্যে মন ছোট হয়ে ওসি সাহেব নিজের অস্বস্তি দূর করবার জন্যেই বললেন–আপনার এই যন্ত্র দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র সব দেখা যায়? মবিনুর রহমান আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, সব দেখা না গেলেও অনেক দেখা যায়। যেমন ধরুন শনি গ্রহের বলয় দেখা যায়।দেখতে কেমন?

অপূর্ব।ওসি সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, জিনিসটা একবার দেখলে হয়।মবিনুর রহমান বললেন, টেলিস্কোপ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে আপনাকে দেখাব।ওসি সাহেব লজ্জিত বোধ করছেন। মানুষটা তো অদ্ভুত। তার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে আর সে কী না বলছে তাকে টেলিস্কোপে শনি গ্রহের বলয় দেখাবে। মানুষটাকে এ্যাবেষ্ট করতে গিয়েও বিপত্তি। কাউকে এ্যাবেষ্ট করে নিয়ে আসা এমন কোনো মজাদার বিষয় নয়। বিশেষ করে যখন জানা থাকে লোকটা নিরপরাধ। হন্বিতম্বি তখনি বেশি করতে হয়। নিরপরাধ লোকের মনেও এই বিশ্বাস ধরিয়ে দিতে হয় যে সে আসলে নিরপরাধ না। কোনো একটা অপরাধ তার আছে যা সে নিজে তেমন ভালো জানে না। ওসি সাহেবও তাই করলেন। ভয়ঙ্কর মূর্তিতে উপস্থিত হলেন। খসখসে গলায় বললেন, ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট।

ভদ্রলোক চায়ে পানি গরম কবছিলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, কেন বলুন তো? গম চুরির মামলা–মিস এপ্রোপ্রিয়েশন অব পাবলিক ফান্ড। নব্বই বস্তা গম আপনি চুরি করেছেন।নব্বই বস্তা গম দিয়ে আমি কী কবব? আমার সঙ্গে কি রসিকতা করার চেষ্টা করছেন? নব্বই বস্তা গম দিয়ে আপনি কী করবেন তা জানেন না? স্ট্রেইট কথা বলুন। বাকা কথা বলবেন না।বাঁকা কথা কী বললাম বুঝতে পারছি না।বুঝতে না পারলে কথা বলবেন না। শুধু প্রশ্ন কবলেই জবাব দেবেন। নট বিফোর 179। জি আচ্ছা।আপনার ঘরও সার্চ হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। পাশের ঘরে কী আছে?

দুটা চন্দ্রবোড়া সাপ আছে আর তাদের একত্ৰিশটা ছানা আছে। সাবধানে যাবেন।ওসি সাহেবের রাগে গা জ্বলে গেল। লোকটিকে সাদাসিধা ভালোমানুষ মনে হয়েছিল, আসলে সে তা না। খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায়। যারা খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায় তাদেরকে চোখে চোখে রাখতে হয়। বুঝিয়ে দিতে হয় যে খাকি পোশাক রসিকতা পছন্দ করে না।কী বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ? জি।ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।ওসি সাহেব নিজেই দরজা খুললেন এবং ছিটকে বের হয়ে এলেন। দুটি চন্দ্রবোড়াব একটি তিনি দেখতে পেয়েছেন। সেই দৃশ্য খুব সুখকর নয়। তখনই তিনি ঠিক করেছেন এই আসামির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। মবিনুর রহমান যখন বললেন, আমি কি আমার দুরবিনটা সঙ্গে নিতে পারি?

ওসি সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, অবশ্যই পারেন। অবশ্যই। সঙ্গে আরো কিছু নিতে চাইলে তাও নিতে পারেন।না, আর কিছু না। হাজতে কি আমাকে দীর্ঘদিন থাকতে হবে? এখন বলা যাচ্ছে না। নির্ভর করে কীসেবা ওপর নির্ভর করে? ওসি সাহেব তার জবাব দিলেন না। তার মন বলছে এই লোকটির সঙ্গে বেশি। কথাবার্তায় যাওয়া ঠিক হবে না।রাস্তায় লোক জমছে। তারা অবাক হয়ে মবিনুর রহমানকে দেখছে। মবিনুর রহমান তাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। তাঁর সেই তাকানোয় লজ্জা-সংকোচ কিছুই নেই। বিব্রত একটা ভঙ্গি আছে, এর বেশি কিছু না।কালিপদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের দল দেখে থমকে দাঁড়াল। উঁচু গলায় বলল, কী হইছে? মবিন্নুর রহমান বললেন, কেমন আছ কালিপদ? আপনেরে কই নিয়া যায়? থানায় নিয়ে যাচ্ছে।কেন?

আমার বিরুদ্ধে গম চুরির কেইস আছে।কালিপদ বালতি নামিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা সে তার জায়গায় বসেই রইল, নড়ল না।পুলিশের দলটা থামল আফজাল সাহেবের বাড়ির সামনে। ওসি সাহেব বাড়ির গেট খুলে বাইরের বাবান্দায় ঢুকলেন এবং গম্ভীর গলায় ডাকলেন, আফজাল সাহেব আছেন? আফজাল সাহেব বের হয়ে এলেন।ওসি সাহেব বললেন, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পাবেন? এদিকে কোথায় এসেছিলেন? আসামি নিয়ে থানায় যাচ্ছি।বসুন চা খেয়ে যান।চা অবশ্যি এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।ওসি সাহেব পুলিশের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ্যাই, তোমরা একটু দাঁড়াও। পুলিশের দল মবিনুর রহমানকে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

 

Read more

নি পর্ব:০৯ হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *